দীপাবলির উৎস ও বিবর্তন - শ্রী অর্ণব ঘোষ

দীপাবলির উৎস ও বিবর্তন  - শ্রী অর্ণব ঘোষ
 

♦ ।। দীপাবলির উৎস ও বিবর্তন।।  - শ্রী অর্ণব ঘোষ


কৃষিভিত্তিক নবশস্যেষ্টি থেকে আলোর উৎসব… 


দীপাবলি শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে "দীপ" ও "আবলি" এই দুইটি শব্দ পাওয়া যায়। "দীপ" শব্দের অর্থ "প্রদীপ" আর "আবলি" শব্দের অর্থ "পংক্তি"। দীপাবলির শব্দবিশ্লেষণগত দিক থেকে এর দ্বারা সারিবদ্ধ প্রদীপ্ত দীপের আলোক উৎসব নির্দেশ করে ,‌যা সনাতনীদের অন্যতম প্রধান উৎসব হিসেবে এখনো পালিত হয়। 


অঞ্চলভেদে দীপাবলির সাথে যুক্ত হয়েছে নানা অনুষঙ্গ। যেমন, পূর্ব ভারত ও বাংলার শাক্তরা এদিন কালী পূজা করে থাকে। পশ্চিম ভারত ও রাজস্থান‌ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এদিন ধনতেরাস পালন করে ও ধনের দেবীর আরাধনা‌ করে। উত্তর ভারতীয়রা শ্রীরামচন্দ্রের অযোধ্যায় গমন উপলক্ষে এদিনটি পালন করে। 


 তবে নানা অঞ্চলে এই তিথিতে নানা দেবতার নামে পূজা প্রচলিত থাকায় খুব সম্ভব এই যে, প্রকৃতপক্ষে বৈদিক সামাজিক বা প্রাকৃতিক আচার থেকেই এ দিনটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল, পরবর্তীতে অঞ্চলভেদে হয়তো কোন কোন উৎসব প্রাধান্য পেয়েছে, তবে এ দিনটির বিশেষ তাৎপর্য রয়ে গেছে।


 প্রাচীন বৈদিক গ্রন্থসমূহে দীপাবলির এই নাম এবং বর্তমান উৎযাপন পদ্ধতি পাওয়া যায় না। প্রাচীন কালে এই দিনটি পালিত হলো "শারদীয় নবশস্যেষ্টি" বা নবান্ন‌ হিসেবে৷ 


এই নামটি অনেকের কাছেই নতুন। তাই এই নামের অর্থ অনেকেই বুঝতে পারছেন না। "নবশস্যেষ্টি" শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যায়— নব + শস্য + ইষ্টি। "নব" অর্থ "নতুন", "শস্য" অর্থ "ফসল" আর "ইষ্টি" অর্থ "যজ্ঞ"। মনুসংহিতায় (৪।২৬) নতুন ফসল ওঠার পর তা দিয়ে "নবশস্যেষ্টি" যজ্ঞ করার বিধান দেওয়া হয়েছ— "শস্যান্তে নবশস্যেষ্টয়া তথর্ত্বন্তে দ্বিজোঅধ্বরৈঃ"।  এছাড়াও গোভিল, পারস্কর, আপস্তম্ব প্রভৃতি গৃহ্যসূত্রেও যব, মুগসহ নতুন শস্য দিয়ে এসময় যজ্ঞের বিধান পাওয়া যায়৷ প্রাচীন ভারতে শ্রাবণ মাসের দিকে রোপণকৃত শস্য জাতীয় ফসল এসময় ঘরে তোলা হত৷ ফলে এই তিথিতে "নবশস্যেষ্টি" যজ্ঞ হতো৷ এখনো আমরা দেখি‌ প্রথাগতভাবে প্রচলিত বছর অনুযায়ী অগ্রহায়ণ মাসের শুরুতে নবান্ন হয়। কিন্তু বৈদিক চান্দ্র বছরগণনা পদ্ধতি (Luni Solar Calendar system) অনুযায়ী মাসের সূচনা হত সাধারণত অমাবস্যা থেকে। কাজেই বলা যায় কার্তিক‌ মাসের অমাবস্যাই আসলে অগ্রহায়ণের সূচনা এবং বৈদিক মতে নবান্ন।


আবার সনাতন ধর্মের শ্রৌত গ্রন্থসমূহে প্রতি অমাবস্যায় "দর্শেষ্টি" নামক যজ্ঞের বিধান আছে। এই শারদীয় অমাবস্যায় "দর্শেষ্টি" যজ্ঞের পাশাপাশি নতুন ফসল (শস্য) দিয়ে "নবশস্যেষ্টি" যজ্ঞ করারও বিধান থাকায় এই অমাবস্যা অন্যান্য অমাবস্যার তুলনায় এই আলাদা একটি গুরুত্ব লাভ করেছিল। 


উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে দীপাবলীর এই তিথি আলোক উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার পেছনে কয়েকটি কারণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে—


  • ১. একই তিথিতে "নবশস্যেষ্টি" ও "দর্শেষ্টি" যজ্ঞ থাকায় প্রাচীন ভারতের প্রতি গৃহ যজ্ঞের শিখায় আলোকিত হয়ে উঠত। 
  • ২. নতুন ফসল ঘরে ওঠায় সকলের মাঝে একটি উৎসবের আমেজ কাজ করত৷ 
  • ৩. বছরের অন্যান্য অমাবস্যার তুলনায় এই অমাবস্যা অপেক্ষাকৃত বেশি গাঢ় অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় সেই অন্ধকারকেও দূর করার জন্য আলোর ব্যবহার।
  • ৪. শরৎ শেষে হেমন্তকে বরণ। 


ফলে সব কিছু মিলিয়ে প্রাচীন কাল থেকেই এই রাত্রিতে আলোক শিখা প্রত্যেক বাড়িতে প্রদীপ্ত হয়ে উঠত৷ তখনকার যজ্ঞকেন্দ্রিক ধর্মীয় আচার এখন আর বিদ্যমান নেই। ফলে এখন প্রতি গৃহ যজ্ঞের শিখায় উজ্জ্বল হয় না, হয় প্রদীপ শিখায়৷ আবার তখনকার নবশস্যেষ্টি আর বর্তমান দীপাবলীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও আলাদা। কিন্তু এর ভেতরে সাধারণ একটি বিষয় রয়েছে। তা হচ্ছে সকলের মাঝে আলো ছড়িয়ে দেওয়া। তবে আমাদের শুধু প্রতীকিভাবে প্রদীপ জ্বালিয়ে আমাদের দায়িত্ব শেষ করলে হবে না। আমাদের সমাজ থেকে কুসংস্কারের অন্ধকারকে সংস্কারের আলোক দ্বারা বিদীর্ণ করতে হবে। অশিক্ষার অন্ধকারকে শিক্ষার আলো দ্বারা দূর করতে হবে।


অজ্ঞানতার অন্ধকারকে জ্ঞানের আলো দ্বারা দূর করতে হবে৷ তখনই আমাদের সমাজে প্রকৃত দীপাবলীর আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে। শেষ করছি সেই আলোর দিকে গমনের আকাঙ্ক্ষার একটি বিখ্যাত উপনিষদ বাক্য দিয়ে-


"অসতো মা সদ্গময়।

 তমসো মা জ্যোতির্গময়। 

মৃত্যোর্মামৃতং গময়।" 


  - শ্রী অর্ণব ঘোষ, বাংলাদেশ অগ্নিবীর 

   সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক


আরো পড়ুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ