বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যবস্তুই ছিল এদেশীয় পরম্পরাগত ভাবাবেগ এবং বিশ্বাস, বিশেষ করে ধর্মীয় বিশ্বাস। সে আক্রমণের প্রথমেই শিকার হয় মানুষের বিশ্বাস এবং শ্রদ্ধার প্রতীক বিভিন্ন দেবমন্দিরগুলো। এ মন্দিরগুলোকে তারা বিভিন্ন সময় আক্রমণ করে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এ কারণে ভারতবর্ষের ইতিহাসে দেখা যায়, অনেক মন্দিরই বিভিন্ন সময়ে সাময়িক বা দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থানান্তরিত করতে হয়েছে। যদি আমরা চট্টগ্রামের পুরাতন ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেই, তবে আমরা দেখি চট্টগ্রামের স্থানীয়দের কতটা নির্দয়ভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে! সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত কবি মুহাম্মদ খান কর্তৃক আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ কাব্যের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই চট্টগ্রামের স্থানীয় মানুষদের কিভাবে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। কদলখান গাজী তার এগারো জন বন্ধু-দরবেশের সাহায্যে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেন। গোলাম সাকলায়েনের লেখা 'বাংলাদেশের সূফী-সাধক' গ্রন্থে বারো আউলিয়ার মধ্যে দশ আউলিয়ার সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায়। সে সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল:
- ১. সুলতান বায়েযীদ বোস্তামী—চট্টগ্রাম শহরের পাঁচ মাইল উত্তরে নাসিরাবাদে পর্বত চূড়ায় ।
- ২. শেখ ফরীদ—চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির এক মাইল উত্তরে ষোল শহরে পর্বতের পাদদেশে।
- ৩. বদর শাহ্ বা বদর আউলিয়া বা পীর বদর—চট্টগ্রাম শহরের বকশীর হাটের পাশে।
- ৪. কতল পীর (পীর কতল ) — চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্গত কাতালগঞ্জে।
- ৫. শাহ্ মহসিন আওলিয়া— আনোয়ারা থানার অন্তর্গত বটতলী গ্রামে।
- ৬. শাহ্ পীর—দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায়।
- ৭.শাহ্ উমর— কক্সবাজার জেলার চকরিয়ায় উপজেলায়।
- ৮. শাহ্ বাদল—ধুম রেল স্টেশনের নিকটবর্তী জামালপুরে।
- ৯.শাহ্ চাঁদ আউলিয়া— পটিয়া থানার নিকটবর্তী।
- ১০. শাহ্ জায়েজ—কন্দেরহাট স্টেশনের নিকটবর্তী।
তবে এ কথা অবিসংবাদিতরূপে বলা যায় যে, এ সকল আউলিয়া সকলেই একসঙ্গে চট্টগ্রামে আসেন নি। সম্ভবত তারা দুই-তিন জন এক এক দলে অথবা জনে জনে চট্টগ্রামে এসেছিলেন। লোকশ্রুতি যে, পীর বদর শাহ্, কতল পীর এবং মহসিন আউলিয়া সম্ভবত সর্বপ্রথম একসঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আগমন করেন।চট্টল বিজেতা কদল খান গাজী সর্ম্পকে বিস্তারিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত কবি মুহাম্মদ খাঁ রচিত ‘মক্তুল হোসেন’ গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সমন্বয়ে গবেষকরা এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সুফি কদল খান গাজী এগারোজন বন্ধু দরবেশের সহযোগিতায় স্থানীয়দের পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করে তা সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দখলদারিত্বের অন্তর্ভুক্ত করেন।অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে কদলখান গাজী ছিলেন ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের সেনাপতি। মতান্তরে সুফি ভাবাদর্শী কদল খান গাজী ধর্ম প্রচারের আশায় নিজের উদ্যোগেই তার শিষ্যদের নিয়ে স্থানীয় চট্টলবাসীদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ তাকে সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করেন। এ দু'টি তথ্যের মধ্যে যে তথটিই সত্য হোক না কেন; একথা ঐতিহাসিক সত্য যে কদল খান গাজীর মাধ্যমেই সর্বপ্রথম চট্টল বিজিত হয় তুর্কী সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা । মক্তুল হোসেন গ্রন্থে উল্লেখ আছে:
"এক মনে প্রণাম করম বারে বার।
কদলখান গজী পীর ত্রিভূবনের সার ।।
যাঁর রণে পড়িল অক্ষয় রিপুদল।
ভএ কেহ মজ্জি সমুদ্রের তল ।।
একসর মহিম হইল প্রাণহীন।
রিপুজিনি চাটি গ্রাম কৈলা নিজাধীন ।।
বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ।
সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন ।।
তান একাদশ মিত্র করম প্রণাম।
পুস্তক বাড়এ হেতু না লেখিলু নাম।।
তান একাদশ মিত্র জিনিয়া চাটিগ্রাম।
মুসলমান কৈলা চাটিগ্রাম অনুপাম ।।"
(ডক্টর আব্দুর করিম, ২০১৮: ১৯-২০)
কতটা নির্মমতার আশ্রয় নিয়ে চট্টগ্রামকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে, তা সেই সময়ের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই। আরববীয়, তুর্কি পাঠান শাসকদের ইতিহাসের সংরক্ষণে একটি অত্যন্ত পজেটিভ বিষয় ছিল, তা হল নিজদের কর্মকাণ্ড লিখে রাখা। সেকালে তারা যা নৃসংসতা করেছে, তা সকলই তারা অকপটে স্বীকার করে গিয়েছেন। তৎকালীন সময়ে বিষয়টি ছিল তাদের কাছে অত্যন্ত গর্বের। প্রায় সকলেরই আরবি, ফার্সি বা স্থানীয় ভাষায় জীবনী লেখা আছে। এ গ্রন্থগুলোতে সকল তথ্য লিপিবদ্ধ করা আছে যে, কিভাবে তারা বিভিন্ন এদেশীয় মন্দিরগুলোকে ধ্বংস করেছে। কত মানুষকে হত্যা করেছে ইত্যাদি। সে সময়ে বিষয়টি তাদের কাছে গর্বের থাকলেও, তারা হয়ত কখনও কল্পনা করেনি আজকের পৃথিবীর কথা- যে পৃথিবীতে বৈশ্বিক সকল জাতিই একে অন্যের খুব কাছাকাছি আসবে। বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় জগতের সকল জাতিগোষ্ঠীকে নিয়ে 'জাতিসংঘ' নামে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হবে। মানবতার প্রশ্নে, গণহত্যার প্রশ্নে জগতের সকল জাতিগোষ্ঠীকেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। মানুষ ইচ্ছামত কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস কাজ করতে পারবে না। বিষয়টি তারা হয়তো কল্পনাও করতে পারিনে। কল্পনা করতে পারলে তারা হয়ত তাদের বিভিন্ন নৃশংস বর্বরোচিত ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের কথা গৌরবের ভাষায় লিখে রাখতেন না।
ভারতবর্ষের অধিকাংশ নগর সেই নগরের উপাস্য কোন কুলদেবতা বা কুলদেবীর নামে নামাঙ্কিত। তাই প্রত্যেকটি স্থানের সাথেই একজন দেবতা বিশেষ করে দেবীর নাম পাওয়া যায়। যেমন ঢাকার নামের সাথে যুক্ত দেবী ঢাকেশ্বরী; তেমনি চট্টগ্রামের সাথে চট্টেশ্বরী, কোলকাতার সাথে কালীঘাট, যশোরের সাথে যশোরেশ্বরী ইত্যাদি। সে অনুসারে চট্টগ্রামে স্থাপিত হয় চট্টেশ্বরী মন্দির। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী তুর্কি শাসকরা কোন নগরকে জয় করে সর্বপ্রথমে তারা সেই শহরের আরাধ্য কুলদেবতা বা দেববিগ্রহাদি ধ্বংস করে মানুষের মধ্যে প্রচণ্ড ভীতি স্থাপন করতেন। চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাসেও ঠিক এমন ঘটনাই ঘটেছিলো। মধ্যযুগের কবি মােহাম্মদ খান রচিত 'মক্তুল হােসেন' কাব্যে স্থানীয়দের নির্মমভাবে ধর্মান্তরিত করার সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ পাওয়া যায়। সেই কাব্যের শুরুতেই বলা আছে জঙ্গী পীর কদল খান গাজীর সহযােগীরা চট্টগ্রাম নগর করায়ত্ব করে সর্বপ্রথম দেবী চট্টেশ্বরীর বিগ্রহাদি ধ্বংস করে চট্টগ্রামের অধিবাসীদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করে।
তান এক মিত্রে বধিলেক চাটেশ্বরী।
মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী ॥
(ডক্টর আব্দুর করিম, ২০১৮: ২৯)
চট্টেশ্বরী দেবী তৎকালে সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ তীর্থে অবস্থিত ছিল। দেবী পুরাণে চৈত্র মাহাত্ম্যে স্বয়ম্ভুরহস্য কথনে চণ্ডিক খণ্ডে বলা আছে, চন্দ্রশেখর পর্বত স্থিত চট্টেশ্বরী অন্নপূর্ণারূপে সর্বদা সাধুদের রক্ষা এবং দুষ্টের বিনাশে করেন। কদল খান গাজী এবং তার এগারোজন সহযোগী মিলে যখন চট্টেশ্বরী দেবীর বিগ্রহ ধ্বংসের পরে পরবর্তীতে কোন সময়ে চট্টেশ্বরী দেবীর বিগ্রহ চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান স্থানে স্থাপিত হয়। বর্তমান চট্টেশ্বরী অঞ্চলটি সে সময়ে ছিল নির্জন ঘন জঙ্গলে পূর্ণ। এ কারণেই বিভিন্ন পুরাণ এবং তন্ত্রে চট্টেশ্বরী দেবীর বর্ণনা চন্দ্রনাথ তীর্থে বর্ণিত হলেও, বর্তমানে দেবীতীর্থটি পাওয়া যায় চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রস্থলে।
যত্র চট্টেশ্বরী দেবী চান্নপূর্ণা বভূবহ।
দুষ্টানাং প্রাণমাশায় সাধূনাং রক্ষণায় চ।
লিঙ্গরূপং সমাস্থায় শ্রীচণ্ডশেখরে বসন্ ॥
বিরূপাক্ষে কদাদেবাে ভবান্যাচ ভূতেশ্বরঃ।
কদাচ চম্পকারণ্যে কদাচ বাড়বানলে ॥
কদা মন্দাকিনীগতঃ সচ দেবস্মরান্তকঃ।
বভ্রাম কাননে রম্যে লবণাম্বুসমীপতঃ ॥
"সেই চন্দ্রশেখর পর্বত স্থিত চট্টেশ্বরী অন্নপূর্ণারূপে সাধুদের রক্ষা এবং দুষ্টের বিনাশে; কখনও বিরুপাক্ষে , কখনও চম্পকারণ্যে, কখনো বাড়বানলে, কখনো মন্দাকিনীতে, কোন কোন সময়ে লবনাম্বু সমীপবর্তী রম্যকাননে ভগবান ভূতেশ্বর স্মরান্তকারী শিব লিঙ্গমূর্তিতে দেবী পার্বতীর সাথে বিরাজ করেন।"
চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরী যে অন্নপূর্ণারূপে পূজিতা এ বিষয়টি দেবী পুরাণের চৈত্র মাহাত্ম্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তবে বর্তমান চট্টগ্রাম শহরস্থ চট্টেশ্বরী মন্দিরে দেবীকে অন্নপূর্ণারূপেই পূজা করা হয়। চট্টেশ্বরীর প্রণাম মন্ত্রে বলা হয়েছে:
চট্টেশ্বরী মহামায়া শঙ্করপ্রাণবল্লভাঃ।
অত্রৈব সততং তিষ্ঠেত অন্নপূর্ণা স্বরূপিনি।।
চট্টলে দক্ষ বাহু মে ভৈরব চন্দ্রশেখরঃ।
ব্যপ্তরূপা ভগবতি ভবানী অত্র দেবতা।।
চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানার সরোয়াতলি গ্রামের অধিবাসী সাধক রামসুন্দর দেবশর্মণ ছিলেন চট্টেশ্বরী দেবীর একজন নিষ্ঠাবান সাধক। ব্রিটিশ আমলে চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট কবি নবীন চন্দ্র সেন দেবীর সেবাপূজার জন্য রামসুন্দর দেবশর্মণকে একটি বড় অঙ্কের অর্থসাহায্য প্রদান করেছিলেন।১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকারদের দ্বারা পবিত্র এ মন্দিরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে কালের পরিক্রমায় আজও স্বমহিমায় বর্তমান। বাংলায় সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দখলদারিত্বের ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে সুফি কদল খান গাজী এগারোজন বন্ধু দরবেশের সহযোগিতায় স্থানীয়দের পরাজিত করে চট্টগ্রাম অধিকার করে তা অন্তর্ভুক্ত করে তারা প্রথমে চট্টেশ্বরী দেবীর বিগ্রহটি ধ্বংস করেন- "বধিলেক চাটেশ্বরী"। এরপরে স্থানীয় মানুষদের জোরকরে ধর্মান্তরিত করেন- "মুসলমান কৈল সব চাটিগ্রাম পুরী"। সাধারণ মানুষ এদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে যখন গাছেল ডালে উঠেও বাঁচতে পারেননি। যারা গাছের ডালে গিয়ে বসেছে, তাদেরও বৃক্ষছেদন করে নৃশংসভাবে নিধন করা হয়।
"বৃক্ষডালে বসিলেক কাফিরের গণ।
সেই বৃক্ষ ছেদি সবে করিলা নিধন ।"
(ডক্টর আব্দুর করিম, ২০১৮: ১৯)
কদল খান গাজী পীর মগ জনগোষ্ঠীসহ চট্টগ্রামের স্থানীয় ভূমিসন্তানদের দের সাথে কী প্রকার আচরণ করেছেন করেছেন, তার আভাস বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় সংক্ষিপ্তভাবে হলেও কিছুটা টের পাওয়া যায়। সেখানে কদল খান গাজীর স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের প্রতি ভয়ংকর যুদ্ধংদেহী মনোভাবের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়।
"কদল খান গাজী (১৪শ শতক) সুলতান ফখরউদ্দীন মুবারক শাহের (১৩৩৮-১৩৪৯) সেনাপতি বলে কথিত। চট্টলা (চট্টগ্রাম) বিজয়কালে হাজী খলিল ও বদর আলম তাঁর সঙ্গী ছিলেন। তাঁরা চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকে কদল খান গাজীর মাযার আছে। স্থানীয় জনগণের মধ্যে তিনি ‘কাতাল’ বা ‘কাত্তাল পীর’ নামে পরিচিত। এ থেকে ওই স্থানের নাম হয় কাতালগঞ্জ। সম্ভবত কদল খান মগদের সঙ্গে যুদ্ধে বহু শত্রুর শিরশ্ছেদ করে ‘কতল’ (অর্থ শিরশ্ছেদ) আখ্যা পান এবং ‘কতল’ আঞ্চলিক উচ্চারণে হয়েছে ‘কাতাল’।"
কদল পীর বা কতল পীরের নাম প্রসঙ্গে গোলাম সাকলায়েন বলেন:
"কতল পীর নামক আর একজন পীরের সন্ধান জানা যায়। তাঁর প্রকৃত নাম কি ছিল তা জানা যায় না। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির উত্তর দিকে এঁর মাযার বর্তমান রয়েছে। জনশ্রুতি এই যে, ইনি বদর পীরের সঙ্গে ‘কাতল’ বা কাতলা মাছের পিঠে আরোহণ করে চট্টগ্রামে এসেছিলেন, কাজেই তাঁকে এই নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনও ঐতিহাসিক প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত একে গ্রহণ করা যায় না। আমাদের ধারণা, তিনি বদর শাহর সহচর হলেও হতে পারেন এবং সম্ভবত মগদের সাথে যুদ্ধ করে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেন। হয়ত তিনি একজন বড় যোদ্ধা ছিলেন এবং যুদ্ধে বহু শত্রুর শিরশ্ছেদ করেছেন এই জন্য তিনি 'কতল' আখ্যা প্রাপ্ত হন। ‘কতল' শব্দের অর্থ শিরশ্ছেদ।"
(গোলাম সাকলায়েন, ১৯৯৩: ১১৯)
কদল খান গাজী পীর স্থানীয় এত মানুষকে শিরোচ্ছেদ করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিলেন যে, আজও তার নামের সাথে 'কতল’ বা শিরশ্ছেদ শব্দটি যুক্ত হয়ে তিনি 'কাতাল পীর' নামে খ্যাত। যে স্থানটিতে তার মাযার অবস্থিত, সেই স্থানের নাম 'কাতালগঞ্জ'।
কদল খান গাজী পীর স্থানীয়দের 'কতল’, শিরশ্ছেদ বা চট্টেশ্বরী মন্দিরের বিগ্রহাদি ধ্বংসের কারণেই ত্রিপুরার মহারাজ ধন্যমাণিক্য তাঁর সেনাপতি রসাঙ্গ মর্দন নারায়ণকে চট্টেশ্বরী দেবীর পবিত্র বিগ্রহকে পরম শ্রদ্ধায় ত্রিপুরায় নিয়ে আসার জন্য প্রেরণ করেন। অতঃপর মহারাজ ধন্যমাণিক্যর নির্দেশে তাঁর সেনাপতি রসাঙ্গ মর্দন নারায়ণ সাড়ম্বরে দেবীমূর্তিকে ত্রিপুরায় নিয়ে আসে। সে বিগ্রহই উদয়পুরে পরমশ্রদ্ধায় পূজিতা।
"চট্টগ্রামে বা চাটিগ্রামে শাক্ত ধর্মের কেন্দ্রস্থল হলো চট্টেশ্বরী মন্দির। প্রাচীনকাল থেকে এই মন্দির স্থিত দেবী ভক্তদের দ্বারা পূজিতা হয়ে আসছেন। দেবী ত্রিপুরার মহারাজা ধন্যমাণিক্যকে (১৪৯০-১৫১৭ খ্রি.) তাঁকে ত্রিপুরায় নিয়ে আসার জন্য স্বপ্নে নির্দেশ দিচ্ছেন-
চাটিগ্রামে চাটেশ্বরী তাহার নিকট।
প্রস্তরেতে আমি আছি আমার প্রকট ॥
মহারাজ ধন্যমাণিক্য সেনাপতি রসাঙ্গ মর্দন নারায়ণকে দেবীমূর্তিকে ত্রিপুরায় নিয়ে আসবার জন্য প্রেরণ করেন। অতঃপর সাড়ম্বরে দেবীমূর্তিকে ত্রিপুরায় নিয়ে আসা হয়।
রসাঙ্গ মর্দন নারায়ণ পাঠায় চট্টলে।
স্বপ্নে সেই স্থানে দেখে মিলিলেক ভালে ॥
উৎসব মঙ্গল বাদ্যে রাজ্যেতে আনিল।
অবশ্য চট্টেশ্বরী মন্দিরে অপর একটি দেবীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।"
(সুনীতিভূষণ কানুনগো, ২০১৮: ৪৯-৫০)
শ্রীকৈলাশচন্দ্র সিংহের রাজমালা গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৪২৩ শকাব্দে, অর্থাৎ ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে মহারাজ ধন্যমাণিক্য দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির নির্মাণ করেন। মহারাজ ধন্যমাণিক্য দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর কর্তৃক স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে চট্টগ্রাম থেকে দেবীর বিগ্রহ আনয়ন করে পূজা শুরু করেন।
"এই সময় মহারাজ ধন্যমাণিক্য দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দির নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন । উক্ত মন্দিরের খোদিত লিপিতে লিখিত আছে যে, ১৪২৩ শকাব্দে উহা নির্মিত হইয়াছিল। রাজমালায় লিখিত আছে, দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী চট্টলাচল মধ্যে লুক্কায়িত ছিলেন । তিনি স্বপ্নে মহারাজ ধন্যমাণিক্যের প্রতি আদেশ করেন। তদনুসারে ধন্যমাণিক্য দেবীকে রাঙ্গামাটীয়া নগরে আনয়ন পূর্বক তাঁহার পূজা প্রচার করেন। এই দেবী ত্রিপুরাসুন্দরী দ্বারা তান্ত্রিক জগতে ত্রিপুরা একটি তীর্থ (পীঠ) স্থান বলিয়া পরিচিত হইয়াছে। মহারাজ ধন্যমাণিক্য স্বর্ণময়ী ভুবনেশ্বরী দেবী নির্মাণ করাইয়াছিলেন। তিনি অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করিয়া শিব ও শক্তি মুর্ত্তি সংস্থাপন করেন। তিনি স্বয়ং শৈব ছিলেন ।"
(শ্রীকৈলাশচন্দ্র সিংহ, ২০০৯: ৭৫)
- ১. বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ 'বাংলাপিডিয়া'
- ২.শ্রীকৈলাশ সিংহ, রাজমালা বা ত্রিপুরার ইতিহাস, গতিধারা, ঢাকা: জানুয়ারি ২০০৯
- ৩. ডক্টর আব্দুল করিম, চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য, জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা : ফেব্রুয়ারি ২০১৮
- ৪.সুনীতিভূষণ কানুনগো, চট্টগ্রামের প্রাচীন ইতিহাস, বাতিঘর, চট্টগ্রাম: নভেম্বর ২০১৮
- ৫. গোলাম সাকলায়েন, বাংলাদেশের সূফী-সাধক, ইসলামি ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা: জুন ১৯৯৩
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ