ফেসবুকে বিভিন্ন স্ট্যাটাস, শেয়ার করা আর্টিকেল এবং কমেন্ট সেকশনের বিতর্কে একটি দাবী প্রায়ই দেখি। তা হলো, ‘মোঘল আমলে ভারতবর্ষে দুর্ভিক্ষ হয়নি, ইংরেজরা ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর একটি সমৃদ্ধশালী উপমহাদেশকে প্রায় মরুভূমিতে পরিণত করে’ ইত্যাদি। এক সেলিব্রিটি ‘ইতিহাস এর ছাত্র’ আবার এমন ও দাবী করেছেন যে তিনি ঢাকা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরীর পুরানো রেফারেন্স ঘাটেন টাটেন বলে জানেন যে মোঘল আমলে বাংলা অঞ্চলে একটিও দুর্ভিক্ষ হয়নি! পাঠক যদি এই বিশাল লেখাটি পুরোটা নাও পড়েন, তাহলে শুধুমাত্র টেবিলটি এক নজর দেখলেই বুঝবেন উভয় দাবীই সম্পূর্ণ মিথ্যা! না, আমি এই লেখায় কোনভাবেই দেখাতে চাইছি না যে দুর্ভিক্ষের জন্য এক ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের উত্তর বা পূর্বসূরি আরেক ঔপনিবেশিক শক্তির থেকে কম বা বেশি দায়ী। সেই চেষ্টা করা বৃথা, কারণ দুর্ভিক্ষের পেছনে নানাবিধ ফ্যাকটর জড়িত যা কয়েক শতাব্দী ধরে বিস্তৃত। এই সময়ে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনীতি, সেচ ব্যবস্থা, শস্যের ফলন, কৃষি বিজ্ঞান, ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবস্থা, যাতায়াতের মাধ্যম, রেকর্ড কিপিং ইত্যাদির নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছে। জনসংখ্যা বাড়লে মৃত্যু ও বেশি হবে যে কারনে পরবর্তী দুর্ভিক্ষগুলোতে ক্যাজুয়াল্টির সংখ্যা বেশি। কিন্তু যারা মূলত এই ভুল তথ্য গুলো ছড়ান, সেই বাম শিবিরের লেখকেরা, যাদের আমি নাম দিয়েছি ‘বামাতিহাসিক’, কোন ইন্টেলেকচুয়াল সততার ধার ধারেন না। তাদের এই একপেশে প্রোপাগান্ডা অনেকটাই পরিকল্পিত যা স্বদেশ প্রেম, আর্য-অনার্য, সাদা-কালো গাত্রবর্ণের বাইনারীর ছদ্ম আবেগে ভর করে চলে, ফ্যাক্ট নয়। এর সাথে আবার যুক্ত হয়েছে ব্রাহ্মণবাদী পক্ষ যারা মোঘল আমলের আগে হিন্দু ও বৌদ্ধ রাজাদের আমলকে দুর্ভিক্ষ মুক্ত দেখাতে সমান তৎপর!
যাহোক, ইংরেজ এবং প্রাক মোঘল আমলের দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি আজকের আলোচনার স্কোপ এর বাইরে। মোঘল আমলের কোন রেকর্ড আদৌ ইন্টারনেটে সহজলভ্য হবে এই আশা প্রথমে করিনি। গুগলে Famines in India লিখে সার্চ দিলে প্রথমেই হরহর করে ব্রিটিশ আমলের দুর্ভিক্ষের উপর পেইজের তালিকা চলে আসে। একটি উইকি পেইজে ইংরেজ আমলের আগের দুর্ভিক্ষের তালিকা পেলেও বিস্তারিত তথ্য ছিল না। প্রতিটা রেফারেন্স এ গিয়ে তথ্য খোঁজা সময় সাপেক্ষ কাজ। তারপর ফার্সী থেকে অনুবাদ করে অজস্র তথ্যের মধ্যে থেকে দুর্ভিক্ষের তথ্য কে আলাদা করতে যাবে? ইংরেজরা রেকর্ড কিপিং এর ব্যাপারে অত্যন্ত পার্টিকুলার বলে নিজেদের দোষক্রুটিও অম্লানবদনে ডকুমেন্ট করে গেছে। এই কারণে বামাতিহাসিকদের আরো পোয়া বারো হয়েছে। তারা ফাক মাঠে গোল দিয়ে এসেছে এতদিন। মোঘল আমলের এত পেইন্টিং থাকতেও আমার আর্টিকেল এর জন্য একটা দুর্ভিক্ষের পেইন্টিং পর্যন্ত নেটে পাইনি, সব দুর্ভিক্ষের পেইন্টিং ইংরেজ আমলের! এর কারণ কি কেউ বলতে পারেন? যাহোক, আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করে সামান্য গুগল সার্চেই একটি ‘রেডিমেড’ পেপার পেয়ে গেলাম, এবং ইংরেজীতেই! (সেই সেলিব্রিটি ইতিহাসের ছাত্র কেন এর নাগাল পেলেন না, তা বোধগম্য নয়! আমাকে তো এর জন্য লাইব্রেরীতেও যেতে হয়নি, সেখানে নিশ্চয়ই প্রচুর বই পত্র আছে যা আমার থেকে ইতিহাসের ছাত্র ভাল জানবেন!) মুহাম্মদ পারভেজ এবং এনায়েতুল্লাহ খান এর Famines in Mughal India রিসার্চ পেপার (Vidyasagar University Journal of History, Volume V, 2016-2017, Pages: 21-45 ISSN 2321-0834) এ ১৫২৬ থেকে শুরু করে ১৭১৭ সাল পর্যন্ত পুরো মোগল আমলের দুর্ভিক্ষের যাবতীয় তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যে অজানা চিত্র উঠে এসেছে ইতিহাসের পাতা থেকে তা পড়ে হতবাক হয়ে গেছি! ভারতীয় উপমহাদেশে এই চেহারা আগে কোন স্কুল কলেজ লেভেলের বই এ পাইনি!
এই একাউন্টগুলোর কিছু এসেছে মোগল কর্মকর্তাদের রেকর্ড, সমসাময়িক ভারতীয় ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে। বাকিটা ইংরেজ বা ডাচ ব্যবসায়ী ফ্যাকটরদের (ফ্যাকটরি কর্মকর্তা) রেকর্ড ও দিনলিপি থেকে। তাই মুঘল সম্রাট বাবর ও হুমায়ূন এর আমলে কোন দুর্ভিক্ষ ঘটেছে কি না, বা ঘটে থাকলেও বিস্তারিত জানার উপায় নেই, কারন তখনো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ভারতে পা দেয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৬০৮ সালে গুজরাট এর সুরাটে। প্রথম ফ্যাকটরি স্থাপিত হয় ১৬১৩ সালে। ১৬১৫ সাল স্যার থমাস রো এর সাথে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর ব্যবসায়িক চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানী স্থায়ী ভাবে ব্যবসা শুরু করে। ১৬৪৭ সালের মধ্যে প্রায় ২৩ টি ট্রেডিং পোস্ট বা ফ্যাকটরি স্থাপিত হয় বিভিন্ন শহরে। এই ফ্যাকটরি গুলোর রেকর্ড থেকে দুর্ভিক্ষ সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য জানা যায়। তবে প্রশাসনিক কাজে এদের কোন ভূমিকা ছিল না ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে কোম্পানীর শাসন শুরু হবার আগে। গভর্মেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্ট এর মাধ্যমে কোম্পানী শাসনের অবসান ঘটিয়ে ব্রিটিশ ক্রাউন ১৮৫৮ সালে শাসনভার গ্রহণ করে। সুতরাং মনে রাখতে হবে ১৭৫৭ (অনেকের হিসাবে ১৭৬৫) এর আগে ভারতবর্ষে সকল দুর্ভিক্ষের দায়দায়িত্ব মোঘল শাসকদের উপরই বর্তায়।
প্রথমেই বলে নেয়া ভাল, আমি এখানে কোন পক্ষের সাফাই বা গীবত গাইতে আসিনি, শুধু ভুল দাবী খন্ডন করতে এসেছি, এবং এই পেপারটি সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য যথেষ্ঠ। রেফারেন্স চেক করার জন্য কমেন্ট বক্সে পেপারের পিডিএফ লিংকটি যুক্ত করে দিলাম। সাল দিয়ে শুরু করে প্রতিটি দুর্ভিক্ষের বর্ণনার সংক্ষিপ্ত অনুবাদ নীচে দেওয়া হয়েছে ধারাবাহিক ভাবে। এটি পুরো রিসার্চ পেপারের লাইন বাই লাইন অনুবাদ নয়। শুধু ভয়াবহতার চিত্র তুলে ধরার জন্য যতটুকু দরকার ততটুকুই অনুবাদ করেছি। কারণ বাংলা অনুবাদ না দিলে মোগল সিমপ্যাথাইজাররা সুযোগ পেয়ে যায় এইসব তথ্য ধামাচাপা দেবার। তারা জানে ফেসবুকে কেউ ইংরেজী পিডিএফ ঘেটে দেখতে চাইবে না। মাথা খাটিয়ে দুই দুই চার করা, বা বিশ্লেষণ পড়া তো দূরের কথা! এখন কেউ মোঘল আমলে দুর্ভিক্ষ হয় নাই, বাংলা ও ভারতের মানুষ মহা সুখে ছিল – এই ভুল দাবী করতে আসলে সহজেই বাংলা অনুবাদ বা টেবিলটি কাট এন্ড পেস্ট করে মিথ্যাচার ধরিয়ে দেওয়া সম্ভব হবে। আলোচনার সুবিধার জন্য *** চিহ্নিত সালগুলো যুদ্ধের কারণে দুর্ভিক্ষ, ৳৳৳ চিহ্নিত সালগুলো বাংলা/ঢাকার দুর্ভিক্ষ, ও ### চিহ্নিত সালগুলো আগ্রার দুর্ভিক্ষ হিসাবে আলাদা করে সনাক্ত করা হয়েছে। এই তথ্যগুলোর উপর ভিত্তি করে সবার শেষে কিছু কঠিন প্রশ্ন রেখেছি। চাইলে সরাসরি সেখান থেকেও পড়া শুরু করতে পারেন, তারপর সালের রেফারেন্স ধরে বিস্তারিত একাউন্টে যেতে পারেন।
১৫২৬ সালের মিরাট-ই-আহমাদীর লেখায় পাওয়া যায় যখন সুলতান বাহাদুর গুজরাট এর মসনদে বসেন, তখন সেই অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সুলতান লঙ্গরখানা খোলেন এবং যখনই তার ঘোড়ায় চড়তেন, তার এলাকার সকল গরীব প্রজাদের এক আশরাফি করে দিতেন।
৳৳৳ ১৫৪০-৪৫ সালে শের শাহ এর আমলে প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় বাংলা ও বিহারের দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে। গরীব প্রজাদের কাছে রাষ্ট্রীয় শস্যাগার থেকে ডিস্ককাউন্টেড রেটে চাল বিক্রি করা হতো। তিনি আইন ২১ এর অধীনে দাশারি নামে নতুন শুল্ক পত্তন করেন যা আকবর এর সময় পর্যন্ত চালু ছিল। বিঘা প্রতি ১০ সের করে চাল রয়ালিটি হিসাবে নেয়া হতো রাষ্ট্রীয় শস্যাগার এর জন্য যা সরকারী গবাদি ও যুদ্ধে ব্যবহৃত পশু খাদ্যের কাজে লাগতো।
১৫৫৪-৫৫ সালে মুন্তাখাব-উদ-তাওয়ারিখ এর লেখক জানান যে খরা এবং দুই বছর ধরে যুদ্ধের কারনে পুরো পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে আগ্রা ও বায়ানানদ দিল্লী জুড়ে নিদারুন দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শস্যক্ষেত্র মরুভূমিতে পরিনত হয় এবং কোন জমি কর্ষণে জন্য কোন ক্ষেতকর্মী অবশিষ্ঠ ছিল না। এক সের জাওয়ার শস্যের দাম আড়াই টাকা পর্যন্ত ওঠে, যদিও ওই দামেও তা পাওয়া যাচ্ছিল না। শয়ে শয়ে মানুষ মারা যায়। কবর বা চিতা কোন কিছুই জোটেনি মৃতদের ভাগ্যে। গ্রামবাসীরা কাটাগাছ, বীজ ও পাতা খেয়ে বেচে থাকার চেষ্টা করতো, কিন্তু হাতে পায়ে বাঘমা উঠে ফুলে মারা যায়।
১৫৫৬ সালে বাদাউনি ও আবুল ফজল এর লেখায় পাওয়া যায় সম্রাট আকবর এর ক্ষমতায় আরোহন এর সময় বড় দুর্ভিক্ষ হয় যার বিশাল মৃত্যুহারে রাজধানী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। খাদ্যের অভাব এত ভয়াবহ ছিল যে দিল্লী ও আগ্রায় মানুষজন দল বেধে একা মানুষ পেল মেরে তার মাংস খেয়ে ফেলতো! তার নিজের ৭০ সদস্যের পরিবার এক কাপ চাল ফুটন্ত পানিতে দিয়ে রান্না করে পুরো একদিন চলতো।
১৫৭৩ এবং ১৫৯৫ এর মধ্যে মোগল ভারতে ৫ টি দুর্ভিক্ষ সংগঠিত হয়
***১৫৭৩ এ বৃহত্তর গুজরাত, পাটান ও বারোদা অঞ্চল এর দুর্ভিক্ষ ছয় মাস স্থায়ী হয় যা খরা বা অতিবৃষ্টির জন্য নয় বরং বিভিন্ন রাজ্যে বিদ্রোহ দমনকালে যুদ্ধবাজ আফগান, আবিসিয়ান ও মির্জাদের অপশাসন, অত্যাচার এর কারনে ঘটে সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের মতে। মৃত্যুহার এত বেশি ছিল যে এক হাজার গরু গাড়ি ভর্তি লাশ প্রতিদিন শুধুমাত্র আহমেদাবাদ শহর থেকেই সৎকারের জন্য বাইরে নিয়ে যাওয়া হতো, যদিও কাফনের কাপড় বা পোড়ানোর জন্য জমি বা কাঠ জুটতো না। ঘোড়া ও অন্যান্য গবাদিপশুর খাবার সহজলভ্য ছিল না, এবং তাদের গাছের বাকল খেয়ে থাকতে হতো। যব এর মন ১২০ ব্রাস টাকায় গিয়ে পৌছায়।
১৫৭৪ এ গুজরাতে আবার দুর্ভিক্ষ হয় মহামারীর হাত ধরে এবং হাজার হাজার মানুষ মারা যায়।
১৫৭৬ সালে আলি শাহ এর শাসনামলে কাশ্মীরে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ হয় ক্ষেতে শস্য থাকা অবস্থায় অতিরিক্ত তুষারপাত এর ফলে। হাজার হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করে। যারা বেচে ছিল তারা মৃতদের মাংস খেতে বাধ্য হয়। অনেকেই নিজেদের সন্তানের বিনিময়ে খাদ্য সংগ্রহ করে। অনেক মানুষ দেশান্তরি হয়।
১৫৮৪ সালে সম্রাট শহরের বাইরে দুইটি স্থানে লঙ্গরখানা খোলেন দুর্ভিক্ষপীড়িত প্রজাদের জন্য।
১৫৮৩-৮৫ এবং ১৫৯৫-৯৮ সালে দুই দফায় সম্রাট আকবর এর তৃতীয় কাশ্মীর সফরের সময় কাশ্মীরে আবারো দুর্ভিক্ষ হয় খরার কারণে। উত্তর ভারতের বিশাল অঞ্চল জুড়ে কাশ্মীর ও লাহোরে প্লেগ ও দেখা দেয়। গমের অভাবে মানুষ নরমাংস ভক্ষণ শুরু করে। জেরোম হাভিয়ের এর লেখায় পাওয়া যায় একজন মা তার শিশুকে রাস্তায় ফেলে যায় মরার অপেক্ষায় এবং জেসুইট মিশনারীরা তাকে উদ্ধার করে ব্যাপটাইজ করে। আকবর সাথে সাথে সরকারী অর্থ সাহায্য পাঠান ও রান্না করা খাবার বিলানোর জন্য লঙ্গরখানা খোলেন। তিনি কাগজে-এ-ইখাম এর ভিত্তিতে খাজনা পুনঃনির্ধারণ করে উৎপাদিত শস্যের অর্ধেক করে দেন। শেখ ফরিদ বুখারিকে প্রেরণ করেন রিলিফের কাজ তদারকির জন্য।
১৬১৪-১৫ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর এর সময়ে খরার কারনে পাঞ্জাব প্রদেশে তীব্র দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যা দিল্লী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৬১৮-১৯ এ তা দক্ষিণাঞ্চলে সমুদ্রতীরবর্তী করমন্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষের ভাগান্তি চরমে পৌছে। মেথহোল্ড ১৬২২ সালে ইস্ট কোস্ট ত্যাগকালে লিপিবদ্ধ করেন যে দুর্ভিক্ষ বিজয়নগরেও হানা দেয়।
১৬২৩ এ খরার কারনে পুরো হিন্দুস্থান জুড়ে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যা তিন চার বছর স্থায়ী হয়। সম্রাট শেখ ফরিদ বুখারীকে নির্দেশ দেন শহরগুলোতে ঠিক মত সাহায্য বিতরণ হচ্ছে কি না তা তদারকির জন্য। মানুষ তারপরেও খাদ্যের অভাবে তাদের আত্মীয়দের ভক্ষণ করে। শহরের রাস্তায় শবের পাহাড় জমে যায়।
***১৬৩০-৩১ সালে মুঘল সম্রাট শাহাজাহানের আমলে পরপর তিন সিজনে ফলন ভাল না হওয়ার কারনে দক্ষিণাঞ্চলের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে যে দুর্ভিক্ষ হয় তা স্থানীয়ভাবে সত্যসিয়াহ নামে পরিচিত। এটি গলকোন্ডা, আহমেদনগর, গুজরাত ও মারওয়ার কিছু অংশ জুড়ে বিস্তারলাভ করে। মালওয়াতে স্থানীয় মোঘল সুবেদার এর বিদ্রোহ করে দক্ষিণের নিজাম শাহ ও আদিল শাহ এর দলে যোগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে শাহাজাহানের যুদ্ধ ঘোষনার কারনে দুর্ভিক্ষ আরো প্রবল হয়। ফার্সী এবং ইউরোপিয়ান দুই সোর্সেই এই দুর্ভিক্ষের বর্ণনা আছে। পিটার মানডির বর্ণনায় পাওয়া যায় গুজরাত এর দুর্ভিক্ষ শুরু হয় ১৬৩০ সালে খরার মধ্যে দিয়ে। পরের বছর ইদুর ও পঙ্গপালের আক্রমণে শস্য নষ্ট হয়। তার পরের বছর অতি বৃষ্টিতে। না খেয়ে এবং পানিবাহিত রোগে ১৬৩১ এর শেষে মারা যায় প্রায় ৭.৪ মিলিয়ন মানুষ। অনেকে কম আক্রান্ত অঞ্চলে মাইগ্রেট করতে গিয়ে পথিমধ্যে মারা যায় যেহেতু গঙ্গা অববাহিকা, আগ্রা ও মালওয়ার অধিকাংশ অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ অত প্রকট ছিল না। লাশ জমে রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। মানুষ গরু ছাগলের চামড়া খেয়ে বেচে ছিল। শেষের দিকে ক্যানিবালিজম শুরু হয়।
মিরাট-ই-আহমাদী গ্রন্থে এই দুর্ভিক্ষের বর্ননায় বলা হয় মানুষ নিজের জীবনের বিনিময়েও একটুকরো রুটি কিনতে ব্যররথ হয়। ছাগলের বদলে কুকুরের মাংস রান্না করে এবং হাড্ডি গুড়ো করে ময়দার সাথে মিশিয়ে বিক্রি করা শুরু করে মানুষ; যদিও ধরা পড়লে বিক্রেতা শাস্তি পেত। শেষের দিকে মানুষ মানুষের মাংস খাওয়া শুরু করে খিদের জ্বালায়। কেউ একা পথ চলার সাহস পেত না নরমাংসের জন্য শিকার হবার ভয়ে! যারা হাটতে সক্ষম ছিল, তারা অন্যান্য প্রদেশে মাইগ্রেট করে। জন ভিয়ান এর অক্টোবর ৭, ১৬৩০ সালের ফ্যাকটরি রেকর্ডে পাওয়া যায় যে তিনি দুই নৌকা বোঝাই অভুক্ত গ্রামবাসীদের কোম্বা থেকে দক্ষিণাঞ্চলে যেতে দেখেছেন পুরো মুঘল রাজ্য জুড়ে দুর্ভিক্ষের কারণে।
সম্রাটের আদেশে মুৎসাদ্দিয়ান-ই-মাহমাত কর্মকর্তারা বোরহানপুর, আহমেদাবাদ এবং সুরাটে আসপাইখানা (ফ্রি কিচেন) খোলে। সুবে দেওয়ান কে কোষাগার থেকে পঞ্চাশ হাজার রুপি খাদ্য কিনতে দেবার জন্য হুকুম দেয়া হয়। খরার কারনে দুর্ভিক্ষ এবং রায়ট এর কারণে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের পরেও সেই বছর সরকারী খাস জমি এবং জায়গীর থেকে ৭০ লাখ টাকা শুল্ক অর্জিত হয় যা তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে প্রেরণ করেন। এই অংক দম এর হিসাবে আট কোটি এবং মুঘল অধিকৃত অঞ্চলের মোট শুল্কের এগারো ভাগের একভাগ।
হেনরি হিল, ক্রিস্টোফার রিড ও নিকোলাস বিক্স আরামগাও থেকে ব্যান্টাম ফ্যাকটরিতে প্রেরিত ১৬৩০ সালের ২৭ শে ডিসেম্বরের চিঠিতে সুরাটে ভয়াবহ প্লেগ, দুর্ভিক্ষে ও ফ্যাকটরি অফিসিয়ালদের দেশত্যাগ এর উল্লেখ পাওয়া যায়। জ্যাকবসন্স ডে নামে এক অফিসার রুটির সন্ধানে তার ফ্যামিলি সহ বাড়ি বাড়ি ধর্না দেন। তিনি রাস্তায় বিশাল সংখ্যক মরণাপন্ন গরীব অভুক্ত মানুষ পড়ে থাকতে দেখেন। এক মাহমুদিতে আড়াই সের ময়দা এবং চাল, পৌনে দুই মাহমুদিতে মাখন ও ৪ মাহমুদিতে একটা মুরগী বিক্রি হতো। ব্যবসা বানিজ্য ও স্থবির হয়ে পড়েছিল বিশাল সংখ্যক ধোপা ও তাতীর মৃত্যুতে। বাইরে থেকে ৭০ রুপি দিয়ে ষাড় আনতে হয়েছিল প্রজনন এর জন্যে কারন গবাদি পশুর অধিকাংশই মারা পড়েছিল অনাহারে। একজন ডাচ ফ্যাকটরি কর্মকর্তা যিনি বাটাভিয়া থেকে সুরাটে আগমণ করেন ১৬৩১ সালের ২৩ শে অক্টোবর, উল্লেখ করেন যে ২৬০ টি পরিবারের মধ্যে মাত্র ১০ বা ১১ টি জীবিত ছিল। টাউনে মোট ৩০০০০ মানুষ মারা যায়। ফ্যাকটরি কর্মীদের মধ্যে ১০-১১ জন ও ৩ জন ডাচ কর্মকর্তা ও মারা যান। গুজরাতের জনসংখ্যা প্রায় এক-দশমাংসে নেমে এসেছিল।
দুর্ভিক্ষের আগে মাথা পিছু গমের মুল্য ছিল ১ মাহমুদী, যা ১৬৩১ এ গিয়ে দাড়ায় ১৬ মাহমুদীতে। প্রতি সোমবার সম্রাটের আদেশে ৫০০০ রুপি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সাহায্যে প্রেরণ করা হলেও সরকারী লঙ্গরখানা এবং খাজনা মওকুফ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে ব্যার্থ হয়। গুজরাতের কালিকো কাপড়ের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাতী সম্প্রদায়ের মৃত্যু ও দেশত্যাগ এর কারনে। মারওয়ার কম ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল থেকে রওনা দেয়া শস্যবাহী গাড়ির বহর পথে আটকে দেয়া হয় এবং সাপ্লাই পাঠিয়ে দেওয়া হয় বোরহানপুরে যুদ্ধরত শাহাজাহানের সৈন্যদের জন্যে! এর ফলে গুজরাতে মাত্র প্রথম দশ মাসে অক্টোবর এর মধ্যে মারা যায় ৩ মিলিয়ন মানুষ এবং আহমেদনগরে আরো ১ মিলিয়ন।
১৬৩৪ সালে রাজস্থানের পারগনাজালর এ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। পাঞ্জাব এর নাজিম, ওয়াজির খান ১৬৩৬ সালে ঘোষণা দেন যে পাঞ্জাবে দুর্ভিক্ষ চলছে। শস্যের দামের উর্দ্ধগতি ১৬৩৮ সালের গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত আগ্রাতেও বলবৎ ছিল, যদিও সেখানে দুর্ভিক্ষ পরিলক্ষিত হয়নি।
১৬৪০-৪১ সালে অতিবৃষ্টির কারনে দক্ষিণাঞ্চল থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।
১৬৪১-৪২ এ কাশ্মীরে আবার একই কারণে দুর্ভিক্ষ হয়। মোঘল সম্রাট শাহাজাহান তখন লাহোরে অবস্থান করছিলেন এবং ৩০,০০০ মানুষের লাহোরে মাইগ্রেশনের সাক্ষী হন। তিনি তারবিয়াত খান কে ৩০,০০০ রুপি সহ রিলিফ ওয়ার্ক তদারকি করতে পাঠান এবং কাশ্মীরে ৫ টি লঙ্গরখানা খোলেন। পরে তারবিয়াত খান পরিস্থতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হলে সুবেদার জাফর খান ১,৫০,০০০ রুপি নিয়ে তার স্থলাভিষিক্ত হন।
১৬৬৭ সালে থমাস আইভি, জর্জ ট্রাভেল ও উইলিয়াম গার্নির চিঠি থেকে জানা যায় সুরাটের দুর্ভিক্ষে পুলিকেট এ ৩০০০, সেন্ট থমাসে ১৫০০০ ও মাদ্রাজপটমে ৪০০০ মানুষ মারা যায়। ২১ শে জানুয়ারির এক চিঠিতে জানা যায় ব্রিটিশ ফ্যাক্টরি ১০০-২০০ টন চাল ও ২০ ব্যাগ ময়দা সাহায্যের আবেদন জানায় তাদের ভারতীয় কর্মীদের প্রাণ বাচানোর জন্য।
১৬৪৮ এ আগ্রায় আবার খরা হয়।
৳৳৳ ১৬৪৪-৪৮ এ বাংলা অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে আখের ফলন ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
১৬৫০ সালে সমগ্র ভারত জুড়ে খরা হয়। আওয়াধ থেকে শস্যের ঘাটতি রয়েছে বলে রিপোর্ট করা হয়। আগ্রা থেকে আহমেদাবাদ পর্যন্ত এই ঘাটতি অনুভুত হয়। এই দুর্ভিক্ষের কারণে সীমিত আকারে খাজনা আদায় হয় যা ‘পাতালভোগ’ নামে পরিচিত।
১৬৫১ তে পাঞ্জাবে এবং মুলতানে রবিশস্য প্রথমে খরা, পঙ্গপাল ও পরের বছর অতিবৃষ্টিতে নষ্ট হয়। চাষীরা পুরো খাজনা দিতে ব্যররথ হয়।
১৬৫৪ সালে মুহম্মদ দারা শিকোর সৈন্যরা আহমেদাবাদ এর উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে খরার কবলে পড়ে প্রাণ হারায় কারন পথিমধ্যে সকল মিঠা পানির পুকুর ও নালা শুকিয়ে গিয়েছিল। মিরাট-ই-আহমাদি থেকে জানা যায় সমুদ্রতীর থেকে চল্লিশ ক্রোশ পর্যন্ত মিঠাপানির অভাব দেখা দিয়েছিল।
১৬৫৫ দক্ষিনের বালাঘাট অঞ্চলে খারি শস্য অতিবৃষ্টির কারনে নষ্ট হয়। ১৬৫৭-৫৮ এর খাজনা রেকর্ড থেকে ধারনা করা হয় যে মারওয়ার অঞ্চলে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।
***১৬৫৮-৬০ সালে এক জৈন পরিব্রাজকের বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে অতিবৃষ্টির কারনে ফসল নষ্ট হওয়ায় রাজস্থানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সাধারন প্রজারা তো বটেই, শাহ (ব্যাংকার) রা পর্যন্ত তাদের সন্তানদের সাধুদের আশ্রমে দান করে দেয়। ১৬৫৮ এর মসনদে আরোহন এর যুদ্ধে আগ্রা, দিল্লী ও লাহোরে শস্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সরকার দিল্লীতে ১০ টি ও আশেপাশের পরগনায় ১২ টি লঙ্গরখানা খোলে। সম্রাট শাহজাহান আদেশ দেন যে এক হাজার সৈন্য যাদের অধীনে আছে এমন প্রত্যেক সেনাপতিকে নিজের বেতন থেকে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সাহায্য করতে হবে অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত।
১৬৫৯-৬০ সালে মুসলিপাটাম ও সিন্ধু প্রদেশে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে অধিকাংশ অধিবাসী মারা যায়। মৃতদের সৎকার করা অসম্ভব হয়ে দাড়ায়।
১৬৬১ সালে ইংরেজ ফ্যাকটরি রেকর্ড থেকে জানা যায় যে খরার কারনে সুরাটে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং কোম্পানীর কর্মকর্তাদের সাংসারিক খরচ সর্বনিম্ন রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
৳৳৳ ***১৬৬২-৬৩ সালে বাংলা প্রদেশ এর ঢাকা শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় শস্য পরিবহনের পথে মোঘল সরকারের কর্মকর্তাদের উৎকোচ আদায় ও প্রতিবন্ধকতার কারনে।
১৬৬৩ সালে রাজস্থানে খরার কারনে শস্য নষ্ট হলে মারওয়ার এলাকায় খাদ্যের দাম বেড়ে যায় ফলে অনেক মানুষ ও গবাদিপশুর মৃত্যু হয় খাদ্যাভাবে। একই বছর মালাবার তীরে ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যের অপ্রতুলতায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
১৬৬৪ সোঝাট প্রদেশে দুর্ভিক্ষের ফলে রাজস্থানের অন্যান্য এলাকায় মাইগ্রেশন ঘটে।
১৬৭০ সালে বিহারে খারিফ শস্যের ফলন কম হওয়ায় পশ্চিমে বেনারস থেকে রাজমহল পর্যন্ত দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। শুধু পাটনা শহরেই ৯০,০০০ মারা যায় এবং অনেক পরিবার তাদের শিশুদের বিক্রি করতে বাধ্য হয়। একই বছরে রায়বাঘ প্রদেশের বিজাপুরে ও রাজস্থানে দুর্ভিক্ষের কারনে মাইগ্রেশন ও শিশু বিক্রির ঘটনা ঘটে।
১৬৭৪ সালে মারওয়ারে রবি শস্যের ফলন ভাল হলেও ইদুরের আক্রমণে নষ্ট হয়, তবে কোঠি বা শস্যাগার এ যথেষ্ট স্টক থাকায় মানুষকে অনাহারে থাকতে হয়নি।
১৬৭৫ সালেও ফলন ভাল হয় কিন্তু পঙ্গপালের আক্রমণে যোধপুরে খাদ্যাভাব দেখা দেয়।
***১৬৭৮ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব এর সাথে রাঠোর সর্দারদের যুদ্ধের কারণে মারওয়ার পরগনার মানুষ বনে এবং পাহাড়ে পালাতে শুরু করায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়।
১৬৮১-৮২ সালে মারওয়ার প্রদেশে খরার কারণে আবার দুর্ভিক্ষ হয় এবং মহামারিতে প্রচুর মানুষ ও গবাদিপশু মারা যায়। এতে এলাকার প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
১৬৮২ সালে গুজরাতে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। চালের দাম বৃদ্ধির ফলে জনমনে অসন্তোষ বেড়ে যায়। মোহাম্মদ আমিন খান যখন ঈদের নামাজ পড়ে ফিরছিলেন, ছেলে বুড়ো, নারী পুরুষের একটি দল তাকে ঘিরে ধরে অভিযোগ জানায়। আবু বকর নামের একজন সেখানে জনতাকে দাঙ্গার জন্য উসকানী দেয়।
***১৬৮৫ সালে আজম এর সৈন্যরা বিজাপুরে অতিবৃষ্টির জন্য আটকে পড়ে এবং মারাঠাদের সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে ফসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়। চালের দাম ১৫ রুপিতে এক সের পর্যন্ত বেড়ে যায়। পুরো দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে এই দুর্ভিক্ষ অবস্থান করে ১৬৮৬ পর্যন্ত। সিন্ধু অঞ্চলে ১৬৮৮ পর্যন্ত।
১৬৯১ সালে গুজরাতে আবার দুর্ভিক্ষ ও পঙ্গপালের আক্রমণ হয়। খাদ্যাভাব অনুভূত হয় ১৬৯৪-৯৫ পর্যন্ত।
১৬৯৪ এ মারওয়ার অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে খারিফ শস্য ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এমনকি ব্রাহ্মণ ঠাকুর ও বেনিয়ারাও জীবন বাচাতে আশেপাশের অঞ্চলে মাইগ্রেট করে। পরিবাররা রুটির বিনিময়ে তাদের সন্তানদের বিক্রি করে দেয়। এক কবি ১৬৩০-৩১ সালের গুজরাতের মহাদুর্ভিক্ষের সাথে এই দুর্ভিক্ষের তুলনা করেন।
১৬৯৪-৯৫ সালে দিল্লীতেও খাদ্যাভাব অনুভূত হয়। থর মরভূমির উত্তর-পূর্ব প্রান্তে বাগার অঞ্চল সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়। অধিবাসীরা মরা পশুর মাংস খেতে বাধ্য হয়, শিশুদের বিক্রি করে দেয় এবং হাজারে হাজারে মারা যায়। পূর্ব রাজস্থানের নিওয়ারি পরগনার আমিন গিরিধর দাস এবং আমিল মনরুপ মহারাজা বিষান সিং কে চিঠিতে দুর্ভিক্ষের কথা লিখে জানান। একই বছর ওড়িশ্যা অঞ্চলেও দুর্ভিক্ষ বিরাজ করছিল।
১৬৯৬-৯৭ এ খারিফ শস্য খরার কারণে বিনষ্ট হলে সানচোর পরগনায় খাদ্যাভাবে বিশাল সংখ্যক মানুষ মারা যায়। পরের বছর পঙ্গপাল শস্য নষ্ট করে এবং মারওয়ার প্রদেশে পাটান থেকে যোধপুর পর্যন্ত সকল সবুজ প্রকৃতি ও মিঠা পানির উৎস অদৃশ্য হয়ে যায়। খরার কারণে সৃষ্ট প্লেগে সিন্ধু অঞ্চলে ৮০,০০০ মানুষ মারা যায়।
১৭০২ সালে দক্ষিণে বড় ধরনের দুর্ভিক্ষ হয়। আওরঙ্গবাদ প্রদেশের সাংমার কোর্ট থেকে রিপোর্ট করা হয় যে খরার কারনে বেশির ভাগ গ্রাম জনশূণ্য হয়ে পড়ে। খাদ্যাভাব নর্মদার দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত অনুভূত হয় এবং অধিবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে ছাড়তে বাধ্য হয়। এই অবস্থা ১৭০৪ সাল পর্যন্ত বিরাজ করে যা প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়। পিতা তার সন্তান কে সাড়ে চার আনায় বিক্রি করেও ক্রেতা যোগার করতে পারতো না।
১৭০৫ সালের মারওয়ার দুর্ভিক্ষকে দুর্ভাগ্যের বছর হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এই অঞ্চলের মানুষ ঢাকা ও পাটনাতে মাইগ্রেট করে।
১৭১৭-১৮ তে আবার দুর্ভিক্ষ আঘাত করে যা জানবাত্রা নামে পরিচিত। তবে সুবে’র নায়েব এর কঠোর শাসনের কারনে কেউ দুর্বলকে শোষনের সুযোগ পায়নি। বাইরে থেকে আমদানীকৃত খাদ্য হায়দার কুলী খান এর দেওয়ান রায় রঘুনাথ দাস এর বাড়িতে বিক্রি করা হতো। গরীবেরা গাছের পাতা সিদ্ধ করে জীবন রক্ষার চেষ্টা করতো। কিন্তু এর পরিণতি ছিল রোগে ভুগে মৃত্যু। ১-২ রুপিতে সন্তান বিক্রি করতো মানুষেরা। মহামারীতেও প্রচুর মানুষ এর মৃত্যু হয়।
এই তথ্য উপাত্ত গুলো থেকে আমরা কী সিদ্ধান্তে আসতে পারি? নীচে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ ও প্রশ্ন পয়েন্ট আকারে তুলে ধরলাম…
[১] পেপারটিতে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে মুহাম্মদ পারভেজ এবং এনায়েতুল্লাহ খান সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ উদ্দেশ্য নিয়ে এটি লেখেননি। তাদের রিসার্চ এ কোন খাদ নেই, তথ্য গোপনের ব্যাপার নেই, কিন্তু এখানে মোগল আমলে দুর্ভিক্ষের বর্ণনার থেকে মোঘল সম্রাটরা কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন তা আলাদা চ্যাপ্টারে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ দুর্ভিক্ষের অবতারনা করা হয়েছে এই সাম্রাজ্যকে ভিলেন নয়, হিরো বানাতে! না হলে স্কোপের বাইরে হওয়া সত্ত্বেও তারা শুরুতেই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ইংরেজদের ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট এর সমালোচনা করবেন কেন? ১৭১৭ সালের শেষ একাউন্ট এর পর ও নিশ্চয়ই প্রচুর দুর্ভিক্ষ হয়েছে, কিন্তু সেগুলো তারা উল্লেখ করেননি কোম্পানি শাসন এর আমলে বলে, তাহলে দায় এর প্রশ্ন কেন আসছে? মোগলদের তো আমরা তেমন ভাবে কেউই দায়ী করছি না তাদের আমলের দুর্ভিক্ষের জন্য! খেয়াল করে দেখবেন, মোগল আমলে অধিকাংশ দুর্ভিক্ষই হয়েছে ক্লাইমেট এর কারনে যা শুধু রংপুরের মঙ্গার মত কোন একটা অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না, পুরো ভারত জুড়ে একসাথে খাদ্যাভাব হয়েছে এমন ও হয়েছে, ১৬৫০ সালে। একটা অঞ্চলের ক্লাইমেট সাধারনত হঠাৎ পরিবর্তন হয় না। তাহলে মোঘল আমল শেষ হলেই ইংরেজ আমলের দুর্ভিক্ষ গুলোতে ক্লাইমেট চোখের পলকে এত ফেবারেবল হয়ে গেল যে ইংরেজদের অব্যবস্থাপনা আর লুটপাটই দুর্ভিক্ষের মূল কারণ হয়ে গেল ঐতিহাসিকদের কাছে! এটা কী বিশ্বাসযোগ্য? বিজ্ঞানের উন্নতি মানেই ফলন, ডিস্ট্রিবিউশন বেটার হবে এটা ভুল সিদ্ধান্ত। অস্ত্রের উন্নতি, বানিজ্য রুটের উন্নতির সাথে সাথে আন্তর্জাতিক কনফ্লিক্ট ও বাড়ে, যার কারনে বৃহত্তর পরিসরে যুদ্ধ হলে আধুনিক যুগেও দুর্ভিক্ষ হতে পারে।
[২] আমরা ইতিহাসের বইতে সবসময়ই বাংলা এবং বৃহত্তর ভারতের কৃষিভিত্তিক সমাজের একটা কমন চিত্র পাই যে তখন আমাদের গোলা ভরা ধান ছিল, পুকুর ভরা মাছ ছিল। হ্যা, হিসেব নিলেই দেখবেন যে বাংলা অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ পুরো ভারতের তুলনায় অনেক কম হয়েছে, মনশুন প্রধান অঞ্চল হলেও অতি বৃষ্টির কোপ তেমন পড়েনি। হয়তো নদীনালার সংখ্যা বেশি থাকায় এবং বিশাল ডেল্টা বেসিন হবার কারণে। কিন্তু দেখুন ১৫৪০-৪৫ সালে শের শাহের আমলে এবং ১৬৬২-৬৩ সালে সেই ‘টাকায় আট মন চাল’ এর গল্প শোনা বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খান এর শাসনামলে ও (১৬৫৮-১৬৮৮) ও দুর্ভিক্ষ হয়েছে! কৃষকের গোলা ভরা ধান তখন কই গেল? আর পরপর দুই বছর শস্য নষ্ট হলে যদি কৃষকের গোলার ধান ও শেষ হয়ে যায়, তাহলে বাদশাহর শস্যাধারে লঙ্গরখানা খোলার মত এত শস্য এল কোথা থেকে! সেই শস্যেও তো টান পড়ার কথা। খাজনা হিসাবে পরিশোধ করা শস্যের হিস্যা কি এতই বেশি ছিল? তখন বিদেশ বা অন্য অঞ্চল থেকে চাল আমদানী তো এক দুই দিনের মামলা ছিল না। এটা কী ধরনের গ্রামবাংলার সচ্ছলতার চিত্র যে এক বছর ফলন ঠিকমতো না হলেই কৃষকদের একেবারে মানুষের মাংস খাবার, সন্তান বিক্রি করে দেবার উপক্রম হয়? উপরে গুণে দেখুন কয়টি দুর্ভিক্ষে ক্যানিবালিজম আর সন্তান বিক্রির কথা এসেছে! এই একই ভয়াবহ পরিস্থিতি প্রায় ৩ শতাব্দী ধরে চলেছে! মহাপরাক্রমশালী মোগল সাম্রাজ্য কী প্রকৃতির কাছে এতটাই অসহায় ছিল যে এর কোন প্রতিকার করতে পারে নাই? হ্যা, তারা প্রচুর ড্যাম, ওয়াটার রিজার্ভার, লেক, উন্নত সেচ পদ্ধতি ইত্যাদি নির্মাণ করেছে, ফ্রি কিচেন বা লঙ্গরখানা খুলেছে, কিন্তু সেটি কী আসলেও যথেষ্ঠ ছিল? আমরা সেই আমলের যে সব পেইন্টিং দেখি, সেখানে কৃষকের শরীরে সেই একই একরত্তি নেংটি আর কিষানীর গায়ে এক প্যাচের মোটা কাপড়ের শাড়ি! এই ‘সমৃদ্ধ’ বাংলার চিত্রই দেখে এসেছি অনন্তকাল ধরে। বুঝলাম গরমের দেশ, কাপড়ের সল্পতা দিয়ে ধনী গরীব মাপা ঠিক নয়। কিন্ত একই ক্লাইমেট এ বসবাস করা ‘এদেশ কে আপন করে নেওয়া’ মোগল সম্রাট ও তাদের সভাসদ, পাইক-বরকন্দাজদের পরনে এত জমকালো হীরা, মণি-মানিক্য খচিত মোটা জোব্বা কেন? তাদের প্রাসাদে কি এয়ারকন্ডিশন ছিল? প্রজারা যেখানে একে অন্যের মাংস খাচ্ছে, ইংরেজ, ডাচ ফ্যাকটরি কর্মকর্তারা পর্যন্ত মারা যাচ্ছে, সেখানে কোন মোগল কর্মকর্তার মৃত্যুর খবর আমরা পাই না কেন? উল্টা তাদের পরনের জামায় এত মণিমানিক্যের যোগান আসে কোথা থেকে? বামাতিদের মোঘল সাম্রাজ্যবাদ এর সাফাই হিসাবে বলা ‘দেশের সম্পদ দেশে রয়ে গেলে’ই কি তা সাধারণ প্রজাদের কোন কাজে লাগল এক্ষেত্রে?
[৩] ১৫৮৪ সালের এবং পরবর্তী আরো দুর্ভিক্ষে বড় বড় শহরে যে লঙ্গরখানা গুলো খোলা হয় তা তিন ভাগে বিভক্ত ছিল। মুসলমানদেরটা খায়েরপুর, হিন্দুদেরটা ধর্মপুর আর যোগীদেরটা যোগীপুর নামে পরিচিত ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় ও যারা জাতপাত ভোলে না, আলাদা লঙ্গরখানা লাগে, তাদের আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক কেমন ছিল তা বলাই বাহুল্য! অথচ আমরা বামাতিহাসিকদের কাছে প্রায়ই শুনি ইংরেজদের আগমণ এর আগে ভারতে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক অত্যন্ত ভাল ছিল, তারাই নিজেদের শাসনের সুবিদার্থে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাধায়!
[৪] পাঠক, লক্ষ্য করুন *** চিহ্নিত অন্তত ৬ টি দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে (১৫৭৩, ১৬৩০, ১৬৫৮, ১৬৬২, ১৬৭৮, ১৬৮৫ সাল) প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর বাইরে মোঘলদের মসনদের যুদ্ধ, বিদ্রোহ, দুর্নীতি ও মানব সৃষ্ট কারণকে দায়ী করা হয়েছে। এতে শুধু ১৬৩১ এর মহা দুর্ভিক্ষেই মৃত্যু হয়েছে ৭-১০ মিলিয়ন মানুষের! এর মধ্যে ১৬৬২ সালের দুর্ভিক্ষটি বাংলা অঞ্চলে ঢাকাতেই সংঘটিত হয়। দেশের মানুষের আহারের ব্যবস্থা না করে যুদ্ধরত সৈন্যদের জন্য বেশিরভাগ সাপ্লাই পাঠিয়ে দেবার ঘটনা আমরা আর কোথায় যেন পড়েছি? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৩ সনের বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে কি? যেখানে পায় ৬ মিলিয়ন বাঙ্গালির অনাহারে মৃত্যু হয়? অথচ আমাদের ভারতীয় বামাতিহাসবিদদের অতুলনীয় স্কলারশীপ এর কল্যানে তৎকালীন ইংরেজ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল হচ্ছেন সাক্ষাৎ নরপিশাচ আর তাজমহলের রুপকার মোঘল সম্রাট শাহজাহান একই অপকর্ম করেও চিরন্তন প্রেমের প্রতীক!
[৫] তাজমহলের প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, পুরো পেপারে একবারও তাজমহল নির্মাণের উল্লেখ নেই! তাতে কী? আসুন গুগল করে দেখি ঠিক কোন সময়ে তাজমহল তৈরির কাজ শুরু হয় — সালটা ১৬৩১ এবং শেষ হয় মোটামুটিভাবে ১৬৪৮ সালে, সম্রাট শাহজাহানের আমলে, ঠিক বলেছি? এবার একটু কষ্ট করে আবার উপরে গিয়ে দেখুন তো এতগুলো দুর্ভিক্ষে মধ্যে কোন সালের দুর্ভিক্ষের বর্ণনা সবচাইতে বড়? কোন সালের দুর্ভিক্ষে সবচাইতে বেশি লোক মারা গেছিল? সেই দুর্ভিক্ষ আগ্রা হতে কত দূরে হয়েছিল? হ্যা, সালটা হুবহু ১৬৩১ এবং মারওয়ার থেকে আগ্রা মাত্র ৫২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, ৪ দিনের হাটা পথ! তাছাড়া খোদ আগ্রাতেই দুর্ভিক্ষ হয় ১৬৪৪ এবং ১৬৪৮ সালে যখন তাজমহল নির্মাণ চলছিল! শাহাজাহান তখন তার ৬ নম্বর স্ত্রী এর আপন বোন, ১৪ নম্বর সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করা ৭ নম্বর স্ত্রী এর শোকে ‘প্রেমের প্রতীক’ তাজমহল বানাতে ব্যস্ত! দুর্ভিক্ষের জন্য ৭০ লাখ রুপী সাহায্য করেও যিনি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারেন নি, মানুষ মানুষের লাশ খাচ্ছে, কবর জুটছে না; তখন তিনি ২২,০০০ মিস্ত্রি, ১০০০ হাতি নিয়োগ করে ১৭ বছর ধরে সেই আমলে ৩ কোটি ২০ লাখ রুপি খরচ করেছেন (বর্তমানের হিসাবে প্রায় ১ বিলিয়ন ইউ এস ডলার) শুধু একটি কবরকে অলংকৃত করতে! দেশের এক অঞ্চলে যখন খরা, তখন যমুনা নদীতে থেকে ধাপে ধাপে পশু বাহিত পুলি সিস্টেমে বালতিতে করে পানি এনে নির্মান কাজের জন্য ভরিয়েছেন ৩ টি বিশালকায় পানির রিজার্ভ! বিদেশ থেকে খাদ্য সাহায্য না এলেও তাজমহলের জন্য সূদুর মারকানা, রাজস্থান থেকে ট্রান্সলুসেন্ট সাদা মার্বেল, পাঞ্জাব থেকে জ্যাসপার, চায়না থেকে জেড এবং ক্রিস্টাল, তিব্বত থেকে টারকোয়েজ, আফগানিস্তান থেকে ল্যাপিস ল্যাজুলাই, শ্রীলংকা থেকে স্যাফায়ার এবং আরব থেকে কার্নেলিয়া ঠিকই এসেছে! বোরহানপুরে শাহজাহানের সৈন্যদের জন্য খাদ্য সাহায্য ঠিকই গেছে! উপরে দেখুন এই সম্রাট শাহজাহানই (মৃত্যু ১৬৬৬) ১৬৫৮ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তার সেনাপতিদের হুকুম দিচ্ছেন অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত নিজেদের স্যালারি থেকে দুর্ভিক্ষ পীড়িতদের সাহায্য করতে! কেন, উনি তাজমহল থেকে মনিমুক্তা খুলে বিক্রি করে দিতে পারতেন না?
বামাতিহাসিকরা তাজমহলের আর্টিসানদের কাজ শেষে হাত কেটে নেওয়ার মিথকে ও স্রেফ জনশ্রুতি বলে উড়িয়ে দেন কোন প্রমাণ ছাড়াই (এ সংক্রান্ত কোন সূত্র না পাওয়া গেলেও আর্টিসানদের সাথে নন ডিসক্লোজার চুক্তির উল্লেখ আছে, যদিও খোদ সম্রাটের সাথে চুক্তি একটি হাস্যকর ফরমালিটি, চুক্তি ভঙ্গের শাস্তি কী হতে পারে, সকলেই জানে!), কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ঢাকার মসলিন তাতীদের আঙ্গুল কেটে নেওয়ার মিথ যে উইলিয়াম বোল্ট এর বই (Considerations on India Affairs: Particularly Respecting the Present State of Bengal and Its Dependencies, Volume 1 by William Bolts. J Almon, 1772) এর ভুল ট্রান্সলেশন থেকে উদ্ভূত, সেটা চেপে জান (এই বিষয়ে আরেকদিন লেখার ইচ্ছে আছে)। বামাতিহাসিকরা আমাদের ইংরেজদের শোষণ করা পয়সায় গড়া বাকিংহ্যাম প্যালেস এর জৌলুস দেখান ঘৃণা ভরে, কিন্তু তাজমহল তাদের কাছে অতি গর্বের বস্তু! কারণ এদেশে ‘ভালবেসে থেকে যাওয়া’ (কিন্তু তলোয়ার উচিয়ে লুট, অগ্নিসংযোগ, গণহত্যার মাধ্যমে প্রবেশ করা) কাছাকাছি গাত্রবর্ণের এবং ধর্মের মোঘল শাসকদের তৈরি এটি, হোক না সে অনাহারে মৃত্যুবরণ করা ১০ মিলিয়ন সাধারন প্রজার লাশের উপর বসে বানানো!
এতসব তথ্য প্রমাণের পরেও কি নিজেদের লক্ষ্য পূরণের অক্ষমতা ঢাকতে বেছে বেছে শুধু ইংরেজদের গালি দিয়ে খন্ডিত ইতিহাস চর্চা করা ভন্ড, রেসিস্ট বামাতিহাসিকদের বিন্দুমাত্র লজ্জা হবে? আমাকে বাঙ্গালীর এক অলৌকিক ঐতিহাসিক কীর্তির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা চাওয়ায় আনফ্রেন্ড করে চলে যাওয়া এক ‘যুক্তিবাদী’ ফেসবুক বন্ধু একটি ইস্যুতে ইংরেজদের ডিফেন্ড করায় একবার প্রশ্ন করেছিলেন, বাঙ্গালী হিসাবে আপনার গায়ে লাগে না? আমার উত্তর হল, না। কারণ, আমি বাঙ্গালী হিসাবে ইতিহাস এর বিচার করি না। ইতিহাস বিজয়ী বা পরাজিত, দুই পক্ষের দৃষ্টিতেই বিচার করা ইন্টেলেকচুয়াল ডিজঅনেস্টি। আমি কোনদিন ইতিহাসে কোন পক্ষের সাফাই গাইতে কোন লেখা নিজে থেকে কখনো লিখিনি, শুধুমাত্র একপেশে ও মিথ্যা দাবীর বিপক্ষে সঠিক তথ্য ও দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরতে কলম ধরেছি, যা অনেকের কাছে হোয়াটাবাউটারি মনে হতে পারে।
একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিস্কার হবে। আমার সন্তান স্কুলের বাৎসরিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নিলে আমি আমি তাকে চিয়ার করে উৎসাহ দিতে পারি, ক্লাসের সেরা ক্রীড়াবিদকেই ভাল খেলে বলে দিতে হবে, এমনটি নয়। কিন্তু সেটা দৌড়ের সময় পর্যন্তই। (আমিই ধারাভাষ্যকার হলে সেটাও পারি না!)। দৌড় শেষ হলে হেরে গেলে আমি ব্যক্তিগতভাবে ছেলেকে সান্ত্বনা দিতে পারি, কিন্তু রিভিউ লেখার সময় আমাকে নিরপেক্ষভাবেই সবার পারফরমেন্স এর বিচার করতে হবে। অন্যের ছেলে বলে ইগনোর করলে হবে না। ‘ছেলের বাবার আবেগ’ সেখানে অনাকাঙ্ঘিত। আজকে আমার বাঙ্গালি, অনার্য, কালো চামড়া, নাস্তিক হিসাবে ‘গায়ে লাগলে’ কালকে অন্য কারো ইংরেজ/মোঘল, আর্য, সাদা চামড়া, হিন্দু/মুসলমান হিসাবে ও ‘গায়ে লাগতে’ পারে। একমাত্র আবেগমুক্ত সলিড যুক্তির মেরিটই আপনাকে দিতে পারে এই বাইনারীর কারাগার থেকে মুক্তি। আমি এই লেখায় সেই চেষ্টাই করেছি, বাকীটা পাঠকদের বিবেচনা।
১৬-১৭ শতকে মুঘল আমলের দুর্ভিক্ষ |
প্রচ্ছদের ছবি:
Emperor Jahangir Triumphing Over Poverty (“Dalidra”), circa 1620-1625. Attributed to Abu’l Hasan. Credit: Los Angeles County Museum of Art (LACMA)
0 মন্তব্যসমূহ