রমনা থেকে কাবুল। বাংলাদেশ থেকে আফগানিস্থান। অনেকটা পথ। তবুও হাঁটতে হবে। আমাদের।আমাদের উত্তরপুরুষদের। হাঁটতেই হবে।
ধ্বংসের যুগ পেরিয়ে শুরু হয়েছে পুনর্জাগরণ আর সৃষ্টির যুগ।
বাবরের ধ্বংস করা রামের মন্দির মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
ঔরংগজেবের গুঁড়িয়ে দেওয়া শিবের মন্দির সেজেছে নতুন রূপে।
পাকিস্তানের গোলায় চূর্ণ হওয়া রমনা কালী মন্দির আবার স্বমহিমায়।
কিন্তু এখনও অনেক সৃষ্টি বাকি।
অনেক গড়া বাকি। অনেক ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে অনেক উদ্ধার বাকি।
এই যে ডানদিকের ছবি এটা দিল্লীর মেরুস্তম্ভ (যা বর্তমানে কুতুব মিনার নামে পরিচিত) নয়।
এটি আফগানিস্তানের ওজাম প্রদেশের মেরুস্তম্ভ। যার বর্তমান নাম 'মিনার-ই-জাম'। দুটোই একই সময়ে একই জনের তৈরি। বরাহমিহিরের। সেই যে মহারাজা বিক্রমাদিত্য, তাঁর সভার জ্যোর্তিবিজ্ঞানী।দুটোরই নাম পালটে গেছে।
কিন্তু আমরা তো সৃষ্টির পক্ষে। তাই রমনা যেতে পারলে একদিন আফগানিস্তানের ওজাম এও পৌঁছে যাবো ঠিক।
আমাদের পোঁছতেই হবে। হত্যা আর ধ্বংসের বার্তা নিয়ে নয়, প্রেম, আর সৃস্টির বার্তা নিয়ে।
সেদিন আফগানিস্তানের কিশোরী মেয়েটিও ঐ মেরুস্তম্ভের থেকেও মাথা উঁচু করে বলবে — " মানিনা সেই ঈশ্বর যে ঈশ্বর প্রেমের বিরুদ্ধে, যে ঈশ্বর মনে করে নারী শুধু শষ্যক্ষেত্র। মানিনা সেই বিধান যে বিধান নারীর বিরুদ্ধে। "
আমরা অযোধ্যায় পেরেছি, কাশীতে পেরেছি, বাংলাদেশে পেরেছি।
আফগানিস্তানেও পারবো।
নিশ্চিত পারবো।
এটাই পরম্পরা। এটাই সংস্কৃতি।
✍মানস ভট্টাচার্য্য
এই লেখাটি ক্যানভাস পেজে প্রকাশিত...
ইতিহাস !
🚩 রমনা কালী মন্দির- বহু অবিচারের স্বাক্ষী।। 🚩
ভারত সরকারের আর্থিক অনুদানে ৫০ বছর আগে ধ্বংস করে দেওয়া রমনা কালী মন্দিরের সে-ই ১২০ ফুট চূড়া ২০২১ সালে এসে আবার দৃশ্যমান হচ্ছে।
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতসহ শতাধিক হিন্দু সাধু, সন্ন্যাসী ও ভক্তদের তাজা রক্তে রঞ্জিত হয় রমনা মন্দিরের মাটি। এমনকি ডিনামাইট দিয়ে ২.২২ একরের উপর বিশাল মন্দির কমপ্লেক্সটি গুড়িয়ে দেওয়া হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে ঘন্টাব্যাপী নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে প্রায় ১৫ জন কমবয়সী হিন্দু কিশোরীকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি যাদেরকে আর কখনোই খোঁজে পাওয়া যায় নি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার উক্ত স্থানকে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে হস্তান্তর করে। তারপর সরকারি বাহিনী দিয়ে মন্দিরের অবশিষ্ট অংশও গুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং তৎকালীন সময় থেকে পরবর্তী বিভিন্ন সরকারের সময় সেখানকার বেঁচে যাওয়া সাধু-সন্ন্যাসীদের মন্দিরে জায়গা বুঝিয়ে না দিয়ে বরং তাদেরকে একরকম বিতাড়িত করা হয়।
🔸 মন্দিরের ইতিহাসঃ
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক মুনতাশির মামুনের মতে,
রমনা কালী বাড়ির আদি মন্দিরটি আদিগুরু শঙ্করাচার্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত দশনামী সম্প্রদায়ের অনুসারীদের দানের অর্থে স্থাপিত হয়েছিলো। বদ্রি নারায়ণ জোশী মঠের স্বামী গোপাল গিরি প্রায় ৫০০ বছর আগে ঢাকায় এসে প্রথমে রমনায় একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সময় মঠটি“কাঠঘর”নামে পরিচিত ছিল।
পরবর্তীকালে এখানে প্রধান মন্দিরটি হরিচরণ গিরি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। প্রায় ৩০০ বছর আগে নির্মিত এই মন্দিরটি ১৯৭১ সালের ২৭শে মার্চ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিলো। মন্দিরটি যখন ধ্বংস করে দেওয়া হয় তখন মন্দিরে প্রধান পুরোহিত ছিলেন শ্রীমঠ স্বামী পরমানন্দ গিরি।
মন্দিরে কাঠের সিংহাসনে দেবী ভদ্রকালীর বিস্ময়কর চিত্র বসানো হয়েছিল এবং মন্দিরটি রেসকোর্স গ্রাউন্ডের প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। মন্দির ভবনের সামনের হ্রদটি ভাওয়ালের রাণী বিলাশমণি খনন করেছিলেন যা এখন একটি ছোট্ট পুকুরের আকার ধারণ করে কেবল স্মৃতি হয়ে আছে।
★ সেদিন কি ঘটেছিল রমনা কালী মন্দির চত্ত্বরে
১৯৭১ সালের ২৭ শে মার্চ রাত দুইটায় পাকিস্তানি জল্লাদরা প্রবেশ করে রমনা কালী বাড়িতে। এসেই তারা অতর্কিত গুলাগুলি শুরু করে দিলো৷ আতঙ্কিত হয়ে অনেকেই “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”স্লোগান দিতে শুরু করলো এবং অনেক মহিলা নিজেদের সন্তানদের বাঁচাতে হাতের শাঁখা ভেঙে ফেলেছিলো এবং সিঁদুরের মুছে ফেলেছিলো।
কেউ কেউ মন্দির এবং আশ্রমের বিভিন্ন কোণে আত্মগোপন করেছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের খোঁজে বের করে মন্দিরের সামনে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেয়। পুরুষদের এক লাইনে দাঁড় করানো হয়েছিল এবং বাচ্চারা সহ মহিলারা অন্য লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর নির্বিচারে গুলি করা হয় তাদেরকে। অতপর পাকিস্তানি জল্লাদরা সকল লাশ একসাথে জড়ো করে এবং পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় ফলে যারা আহত হয়েছিল তারাও আগুনে পুড়ে মারা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা উল্লেখ করেছিল যে আগুনে বহু নারী ও শিশুকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল এমনকি আশ্রমের ৫০ টিরও বেশি গরুকে পুড়িয়ে হত্যা করেছিলো।
সমস্ত লোকের সামনে, পাকিস্তানি সৈন্যরা মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে ‘কালেমা’ আবৃত্তি করতে বাধ্য করে এবং তৎক্ষণাৎ তার পেটে বেয়নেট ঢুকিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে।
সরকারি আইন কমিশনে দেওয়া স্বাক্ষীতে কমলা রায় নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন,
"পাকিস্তানিরা অর্ধেক মৃত লোকের সাথে সমস্ত মৃত দেহ এক স্থানে সংগ্রহ করে ঘরের বাঁশের বেড়া সমেত আগুন ধরিয়ে দেয়। শিশুরা যখন ভয়ে চিৎকার করে দৌড়াচ্ছিল তখন তাদেরকে ধরে ধরে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলো।"
পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমের তপস্বী জাটালি মা, যারা এই গণহত্যায় বেঁচে গিয়েছিলেন তাদের সাথে নিয়ে রমনা ত্যাগ করেছিলেন।
🔹 স্বাধীনতা পরবর্তী অবিচারঃ
স্বাধীনতার পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের গণপূর্ত অধিদফতর সম্পূর্ণ জায়গাটি নিজেদের দখলে নিয়ে মন্দিরের অবশিষ্ট ধ্বংসাবশেষও নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
মন্দিরের বেঁচে যাওয়া বাসিন্দারা, যারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছিল, তারা ফিরে এসেছিল। যথারীতি, তারা উপাসনা শুরু করার জন্য একটি অস্থায়ী মন্দির তৈরি করেছিলো এবং সেখানে থাকার জন্য নিজেদের (সরকারি সহযোগিতা পায় নি) অর্থায়নে কিছু বসতঘরও নির্মাণ করেছিলো।
রমনা কালী মন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরির ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবদুল আলী ফকির মন্দিরের ভক্তদের সাথে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে একটি স্মারকলিপি দিয়ে ঐতিহাসিক এই মন্দিরটি পুনর্নির্মাণের জন্য তাঁকে অনুরোধও করেন। পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের তপস্যাবিদ জটালি মাও তাঁদের সাথে গিয়েছিলেন।
কিন্তু গণমানুষের নেতা খ্যাত বঙ্গবন্ধু ভুক্তভোগীদের রিক্ত হস্তে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এমনকি তাদেরকে ঢাকার নিকটস্থ পোস্তগোলার শ্মশান সংলগ্ন একটি চারণভূমিতে থাকতে দিয়েছিলেন সামান্য তাবু গেড়ে। তাঁদেরকে কোনরকম সরকারি তদারকি করা হয় নি এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করে কোন সরকারি সহায়তাও দেওয়া হয় নি।
ক্ষমতায় পরিবর্তন হয় কিন্তু ভুক্তভোগীদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় না। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বন্দুকের নলের মুখে পোস্তগোলার চারণভূমি থেকেও তাঁদেরকে উচ্ছেদ করে। দীর্ঘ লড়াই করে স্বাধীন বাংলাদেশের সকল সরকার কর্তৃক অবিচারের শিকার হয়ে হতাশাগ্রস্ত সুচেতা গিরি ১৯৯২ সালে ভারতে চলে যান। কয়েকবছরের মধ্যে জটালি মাও মারা যান। ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার ও অধিকার বঞ্চিত অবস্থায়ই বিদায় নেন।
১৯৭১ সালে মন্দিরটি ধ্বংস করার সময় ২.২২ একর এলাকা জুড়ে স্থাপিত রমনা মন্দিরের চূড়াটি প্রায় ১২০ ফুট লম্বা ছিলো যা বহুদূর হতেও দৃশ্যমান ছিলো। পরবর্তীতে বাংলাদেশের কোন সরকারই মন্দিরটির পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ না করে উলটো রমনা মন্দিরের জায়গা দখলের নানারকম প্রয়াস চালায়৷
🔸 মন্দিরের নবনির্মাণঃ
পরবর্তীতে ২০১৬ সালে তৎকালীন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা সরাজের ঐকান্তিক ইচ্ছে ও তত্ত্বাবধানে এবং ভারত সরকারের ৭ কোটি টাকা অনুদানের উপর ভিত্তি করে মন্দিরটি পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় যা ২০২১ সালে এসে পূর্ণতা পায় এবং রমনা কালী মন্দিরের সে-ই চূড়াটি আবারও দৃশ্যমান হয়।
রমনা কালী মন্দির ৭১ এর ভয়ংকর সময়সহ স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বিভিন্ন অবিচারের স্বাক্ষী হয়ে থাকবে আরও দীর্ঘ সময়। এই কলংকিত ইতিহাস মুছে ফেলা যাবে না।
স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর পর ২০২১ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নবনির্মিত মন্দির কমপ্লেক্সটি উদ্বোধন করে একটি কালিমালিপ্ত অধ্যায়ের সমাপ্তি করতে যাচ্ছেন।
©স্টিমন অনিক।
১৬ ডিসেম্বর, ২০২১।। রোজঃ বৃহস্পতিবার।।
সুত্রঃ
*রমনা কালী মন্দির – উইকিপিডিয়া
*রমনা কালী মন্দির – বাংলাপিডিয়া
*ইন্টারনেটের বিভিন্ন নিবন্ধ
লেখাসূত্র: ফেসবুকের 'ইতিহাসের সত্যতা' গ্রুপ
সৌজন্য: Debjit Sarkar
0 মন্তব্যসমূহ