ইতিহাস: বাঙালী ও পঞ্জিকা । রানা চক্রবর্তী

ইতিহাস: বাঙালী ও পঞ্জিকা । রানা চক্রবর্তী

বাঙালী ঠিক কবে থেকে তিথি-বিচার প্রবল হয়ে উঠেছিল? ইতিহাস বলে যে, গুপ্তযুগ থেকেই বাঙলা তথা সৌরাষ্ট্র থেকে শুরু করে সমগ্র উত্তরাখণ্ডে ‘গুপ্তাব্দের’ প্রচলন ঘটেছিল। গুপ্তাব্দ শুরু হয়েছিল ৩১৯ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, অর্থাৎ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের আমলে। এরপরে ষষ্ঠ শতকের প্রায় প্রথম পাদ পর্যন্ত বাঙলায় গুপ্তাব্দ চালু ছিল। তারপরে পালাব্দ শুরু হয়েছিল ৭৫০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে, কিন্তু একই সঙ্গে তখন হয়ত গুপ্তাব্দও কিছু চলত। নবম শতক থেকে সারা উত্তরাখণ্ডে বিক্রমাব্দের প্রচলন ঘটেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে বিক্রমাব্দের পিছনে কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই, তাই সারা উত্তরাখণ্ডে সেটি চললেও বাঙলায় কিন্তু চলেনি। তখন ওই সব অব্দ সাধারণতঃ রাজকার্যে, আর বিভিন্ন সামাজিক ব্যাপারে, দিনক্ষণ দেখতে এবং তিথি-বিচার করতে ব্যবহার করা হত। ক্রমে মানুষের জীবনে দৈবশক্তির তথা গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাববৃদ্ধির ফলে সেই বিচার সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়ে উঠেছিল। বৌদ্ধযুগেও বঙ্গদেশে দিনক্ষণ দেখা চলত, ‘ঠাকুরদাদার ঝুলি’তে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায়। ওই সময়ে দিনক্ষণ দেখেই সওদাগরেরা বাণিজ্যে যাত্রা করতেন। ‘মধুমালা’য় রানী ও রাজকন্যা “ক্ষণ-সময় দেখিয়া মদনকুমারকে সোনার ময়ূরে চড়াইয়া মধুমালার দেশে পাঠাইয়া দিলেন।” কিন্তু তখন সারা দেশ যে গণক-জ্যোতিষে ভর্তি ছিল না, ডাকের বচনে সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় –


“যে দেশে নাই গণক জ্যোতিষা

গোধূলি লগন, যাত্রা ঊষা।”


সেই কারণেই দ্বাদশ শতকে বাঙালীর তিথি-বিচার প্রবল হয়ে উঠেছিল। বাঙলার সেন রাজারা গুপ্তাব্দ ও পালাব্দ বন্ধ করে শকাব্দের প্রচলন করেছিলেন। প্রায় ১৪০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মধ্য-এশিয়ায় শকদের অভ্যুদয় ঘটেছিল। তারপরে ৭০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আফগানিস্থান হয়ে মালোয়া, গুজরাট ও তক্ষশিলা জয় করে তাঁরা মথুরায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে সাতবাহন রাজা তখন তাঁদের দক্ষিণাপথের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, সেই শকদ্বীপের ব্রাহ্মণেরাই (বা সাইথিয়ান ব্রাহ্মণ) ১০০-২০০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ভারতে ‘সিদ্ধান্ত জ্যোতিষের’ প্রচলন করেছিলেন; এর আগে ‘বেদাঙ্গ-জ্যোতিষ’ চালু ছিল। সিদ্ধান্তজ্যোতিষ বা সূর্যসিদ্ধান্ত বিজ্ঞানভিত্তিক; শকদ্বীপী ব্রাহ্মণেরা কোষ্ঠী তৈরী ও বিচারের সময়েও শুধুমাত্র শকাব্দের ব্যবহার করতেন। কালক্রমে পঞ্চম শতক থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত ভারতবর্ষের প্রায় সর্বত্রই শকাব্দের প্রচলন ঘটেছিল; তবে সেটা তিথি নিরূপণের জন্য নয়, মাস-বর্ষ-দিন নির্ণয়ের জন্য। ঐতিহাসিকদের মতে ১২৯, মতান্তরে ১২৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শকাব্দের শুরু হয়েছিল। এর কারণ হল যে, শকেরা ১২৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ব্যাট্রিয়ার যুদ্ধে অবতীর্ন হলেও, সেই যুদ্ধ প্রায় সাত বছর পরে, অর্থাৎ ১২৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে শেষ হয়েছিল। কাজেই, ১২৩ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকেই শকাব্দ চালু হওয়ার অধিকতর সম্ভাবনা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হল যে, নতুন শকাব্দে ১১৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দকে হিসেবে না ধরে, শুধুমাত্র ২৯ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে সাল গণনা করা হয় কেন? কারণ, ওই প্রথম দুশো বছরের গণনায় রীতি মেনে সাধারণতঃ অব্দকে বাদ দেওয়া হয়। ইতিহাসে ‘কণিষ্কাব্দ’ বলতে যেটা বোঝায়, সেটা আর কিছুই নয় – পুরনো শকাব্দ থেকে ঠিক দুশো বছর বাদ দেওয়া সাল। বলা বাহুল্য যে, সিদ্ধান্তজ্যোতিষ হল সূর্যভিত্তিক দিন গণনা। কিন্তু ‘তিথি’ হল চন্দ্রভিত্তিক; এক-একটি তিথি এক-একটি চান্দ্র দিন। এটি হিন্দু ফলিত জ্যোতিষের একটি অভিনব বিভাবন। ত্রিশটি তিথিতে একটি পূর্ণ মাস হয়। সৌর দিন চব্বিশটি ঘণ্টায় বিভক্ত, কিন্তু চন্দ্রের গতি অনিয়ত বা অনির্দিষ্ট; গড়পড়তা চান্দ্রদিন হল ২৩.৬২ ঘণ্টা। এই অনির্দিষ্টতার জন্য কোনো কোনো তিথি যেমন বিশ ঘণ্টায় শেষ হয়, তেমনি কোনটি আবার ২৬.৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চলে। হিন্দুদের সামাজিক সর্বব্যাপারই তিথির সাম্রাজ্যে অবস্থান করছে, গৃহ্যসূত্রোক্ত দশকর্ম থেকে শুরু করে পূজা-পার্বণ পর্যন্ত সবই তিথি দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়। সেন রাজাদের আমলে দ্বাদশ শতকে বাঙলায় শকাব্দের প্রচলন ঘটেছিল। 


তুর্কীরা ক্ষমতা দখল করবার পরে বাঙলায় তাঁদের অধিকৃত এলাকায় ‘হিজরা’ সাল চালু করার চেষ্টা করলেও, সেটা শুধুমাত্র অফিস আদালতের ব্যাপারে ও মুসলমানী পার্বণেই চালু করা গিয়েছিল। তখন বাঙলার অন্যত্র কিন্তু শকাব্দই চালু ছিল; আর হিন্দুর ‘তিথি’র রাজত্বেও কোনো ভাঙ্গন ধরেনি। হিজরা নিরেট চান্দ্র অব্দ, হজরত মহম্মদের মদিনা যাত্রার দিন থেকে সেটির গণনা শুরু হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে সম্ভবতঃ ‘খলিফা ওমর’ সেই অব্দের প্রবর্তক ছিলেন, এবং ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা থেকে হিজরা অব্দের গণনা শুরু হয়েছিল। উক্ত সময় থেকে – ‘মানুষ ভাগ্যের ক্রীড়নক মাত্র’ – এই ধারণা বাঙালী সমাজে যত প্রতিষ্ঠা লাভ করতে শুরু করেছিল, ততই তিথি-মাহাত্ম্য, কোষ্ঠী-বিচার ও শাকুন-শাস্ত্রের বিধি-নিষেধের প্রভাবও ক্রমশঃ বাড়তে শুরু করেছিল। তখন সেক সাহেবের মতন মানুষেরাও নিজেদের স্বার্থেই ওই ধারণাকে প্রবলতর করতেই সচেষ্ট হয়েছিলেন। সে স্বার্থটা কি ছিল? স্বার্থ ধর্মান্তরকরণ। সেই কারণেই সেক শুভোদয়া গ্রন্থের পীর সাহেব হলায়ুধের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, “যদ্যপি যাবনিকং কর্তুং সমায়াতঃ তদা রক্ষিতুং কোহপি শক্তঃ। … দৈবেন ক্রিয়তে যত্তু নান্যথেতি কদাচন।” অর্থাৎ, পীর (সেক) সাহেব সত্যিই যদি আমাদের ইসলামে দীক্ষা দিতে এসে থাকেন, তাহলে আমাদের রক্ষা করবার, অর্থাৎ হিন্দুধর্মে ধরে রাখবার সাধ্য কার মধ্যে রয়েছে? ভাগ্যে যা রয়েছে তা তো ঘটবেই। সূর্যের গতির তুলনায় চন্দ্রের গতি অনিয়ন্ত্রিত ও অনির্দিষ্ট; কাজেই সৌর দিন ও চান্দ্র দিনে, অর্থাৎ তিথিতে প্রভেদ দেখতে পাওয়া যায়। তাই তিথি সম্পর্কে নানা তর্কবিতর্ক যে থাকবেই, তাতে কোন সন্দেহ থাকে না। তখন এই সূত্র ধরে অনেক ‘পঞ্চাঙ্গ’ বা পঞ্চিকা বা পঞ্জিকা তৈরী করা হয়েছিল; তিথি নিয়ে সেগুলোতে মতভেদ ছিল। এই ‘পঞ্চাঙ্গ’ কি কি? অর্থাৎ, পঞ্জিকার মধ্যে ফলিত জ্যোতিষের কাজে লাগতে পারে এমন কি কি জিনিস পাওয়া যায়? সেগুলি হল তিথি, বার, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। তিথি, বার ও নক্ষত্র সবারই পরিচিত জিনিস; ‘যোগ’ হল গণিত জ্যোতিষের মতে কালের একটা বিশিষ্ট অংশ, আর ‘করণ’ হল দিনের একটি অংশ। দিন এগারোটি ভাগে বিভক্ত। আগেই বলা হয়েছে যে, বাঙলায় মুসলমানদের অনুপ্রবেশের পরে, ত্রয়োদশ শতক থেকেই হিজরা অব্দের প্রচলনের চেষ্টা করা হয়েছিল। হিজরা অব্দ মূলতঃ চন্দ্র-ভিত্তিক, ৬২২ খৃষ্টাব্দের ১৫ই জুলাই, বৃহস্পতিবারে এই অব্দের জন্ম হয়েছিল; খুব সম্ভবতঃ ‘খলিফা ওমর’ (৬৩৮-৬৩৯ খৃষ্টাব্দ) এর জন্মদাতা ছিলেন। সুলতানি আমলের বঙ্গদেশে এই অব্দ অনুসারেই সমস্ত রাজকার্য চললেও, বাঙলার শিক্ষিত শ্রেণী কিন্তু শকাব্দকেই মেনে চলতেন। তখনকার সাধারণ মানুষও হিজরা অব্দকে গ্রহণ করেন নি; তাঁরাও তাঁদের দৈনন্দিন কাজে সেনরাজাদের আমলেও যেমন ‘পরগণাতি অব্দ’ মেনে চলতেন, সুলতানি রাজত্বেও তেমনি চালু ছিল। ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে সম্রাট আকবর সেই হিজরা অব্দকে বন্ধ করে দিয়ে তাঁর ‘তারিখ-ই-এলাহী’ প্রচলনের চেষ্টা করেছিলেন। ‘তারিখ-ই-এলাহী’ মূলতঃ সূর্য-ভিত্তিক অব্দ, সেটি প্রাচীন ইরানীয় পদ্ধতির একটু পরিবর্তিত সংস্করণ ছিল। কিন্তু ১৬৩০ খৃষ্টাব্দের পরেই সেটির বিলোপ ঘটেছিল। এরপরেই বর্তমান সময়ে বহুল প্রচলিত বঙ্গাব্দর আবির্ভাব ঘটেছিল। এটি মূলতঃ মিশ্র জাতীয় – সংকর শ্রেণী একটি অব্দ; এতে হিজরার সঙ্গে সূর্যসিদ্ধান্তের অব্দের সমন্বয় ঘটানো হয়েছে। বঙ্গাব্দ, বর্তমান পৃথিবীর সর্বত্র গৃহীত ও প্রচলিত গ্রেগরিয়ান পদ্ধতির সঙ্গে একটা নির্দিষ্ট ব্যবধান রেখে সমান্তরাল ভাবে চলেছে। গ্রেগরিয়ান পদ্ধতিও সূর্য-ভিত্তিক। ইতিহাস বলে যে, অতীতের বাঙলার শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণেরা সূর্যসিদ্ধান্ত রীতিতে অব্দ গণনা করতেন। ৪০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ১২০০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত সারা ভারতবর্ষই তাঁদের সেই হিসাব মেনে চলেছিল। ১৬৩০ খৃষ্টাব্দের পরে, শিক্ষিত বাঙালী সমাজে আবার শকাব্দের, অর্থাৎ সূর্যসিদ্ধান্ত-রীতির প্রচলন ঘটেছিল। ‘ডঃ ফন লিউর’ (Dr. Von L. de Leeuw) মতে, খৃষ্টপূর্ব ১২৯ সনে ভারতবর্ষে শকদের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। যথারীতি সেটার থেকে শতবর্ষ বাদ দিলে ২৯ বাকি থাকে। কাজেই একটা যোগ-বিয়োগ কষে গ্রেগরিয়ান অব্দ থেকে বঙ্গাব্দ বের করতে হবে। গ্রেগরিয়ান অব্দকে শকাব্দে পরিণত করে সেটা থেকে প্রথমে হিজরা অব্দকে বাদ দিতে হবে। যেমন, এখন গ্রেগরিয়ান অব্দ হল ২০২৩; সুতরাং শকাব্দ হল ২০২৩ + ২৯ = ২০৫২; আর বঙ্গাব্দ হল ২০৫২ – ৬২২ = ১৪৩০। শকরা খৃষ্টপূর্ব ১২৯ সনে ভারতে প্রবেশ করেছিলেন, নাকি ১২৩ সনে ভারতে এসেছিলেন, তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতদ্বৈধ বর্তমান রয়েছে। বিখ্যাত বাঙালী বিজ্ঞানী ‘মেঘনাদ সাহা’ দ্বিতীয় অব্দটির প্রধান সমর্থক ছিলেন। তাঁর মত ডঃ ফন লিউ মেনে নিলেও, কার্যত কিন্তু সেটার প্রচলন এখনো পর্যন্ত ঘটেনি। এছাড়া সূর্যসিদ্ধান্তবাদীদের আরো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েও পণ্ডিতমহলে দ্বন্দ্ব রয়েছে। যদি তাঁরা ভারতবর্ষের চিরাগত রীতি মেনে চলেন, তাহলে চৈত্র মাসকেই বর্ষশীর্ষে ধরতে হয়, আবার গ্রীক-চলডিয়ান রীতিকে মেনে নিলে বৈশাখ থেকে বর্ষ শুরু করতে হয়। তাই সেই দ্বন্দ্বকে মেটানোর জন্য তাঁরা একটা মধ্যপন্থাকে বেছে নিয়েছেন। সৌর বর্ষ গণনার ক্ষেত্রে তাঁরা বৈশাখকেই প্রথম মাস বলে ধরেছেন, আবার চান্দ্র বর্ষ গুণতে গিয়ে চৈত্র মাসকে প্রথম বলে ধরেছেন। বর্তমান বাঙালী সমাজে এই রীতিই চালু রয়েছে, কিন্তু তামিলনাড়ুতে সৌর ও চান্দ্র বর্ষ দুটোই চৈত্র থেকে শুরু হয়। ‘পঞ্জি’, ‘পঞ্জী’ বা ‘পঞ্জিকা’ কথাটা সংস্কৃত শব্দ ‘পঞ্চাঙ্গ’ থেকে এসেছে। 


পঞ্জিকার সেই পঞ্চাঙ্গ কি কি? সেগুলো হল – তিথি, বার, নক্ষত্র, যোগ ও করণ। প্রথম তিনটি সহজবোধ্য, আর জন্মপত্রিকার গণনার সময়ে শেষ দুটির প্রয়োজন হয়। ‘যোগ’ হল ফলিত জ্যোতিষের মতে একটা বিশিষ্ট কাল-বিভাগ, আর ‘করণ’ হল দিন-বিভাগ। করণের সংখ্যা এগারো। বলা বাহুল্য যে, হিজরা অব্দ ফলিত জ্যোতিষের ভিত্তিতে রচিত হয়নি; হিজরার ক্ষেত্রে সেদিন সন্ধ্যা থেকেই মাস শুরু হয়, যেদিন অমা-পক্ষের (অমাবস্যার) শেষে আকাশে নতুন চাঁদ দেখা দেয়। বঙ্গাব্দের দ্বাদশ মাসের সঙ্গে হিজরা অব্দের মাসের তালিকাটা নিম্নরূপ –


বৈশাখ = মহরম, জৈষ্ঠ্য = সফর, আষাঢ় = রবি-উল-আওয়ল, শ্রাবণ = রবি-উস-সনি, ভাদ্র = জুমাদা-উল-আওয়ল, অশ্বিন = জুমাদা-উস-সনি, কার্তিক = রজব, অগ্রহায়ণ = শবান, পৌষ = রমজান, মাঘ = শওঅল, ফাল্গুন = জুলকুদা, চৈত্র = জুলহিজা।

মনে রাখতে হবে যে, ডঃ ফন লিউর সূত্র ধরে বঙ্গাব্দের ক্ষেত্রে এক বছরের প্রভেদ দেখতে পাওয়া যায়, কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, খৃষ্টাব্দ জানুয়ারিতে শুরু হয় আর বঙ্গাব্দ বৈশাখে, অর্থাৎ এপ্রিল মাসে; দু’য়ের মধ্যে সাড়ে তিন মাসের মত ব্যবধান রয়েছে। বঙ্গদেশে রাজকার্যের জন্য আকবর যে ‘তারিখ-ই-এলাহি’র প্রচলন করেছিলেন, সেটা ১৬৩০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। তারপরে বাঙলার মুসলমান সমাজে হিজরাব্দ, উচ্চকোটি হিন্দু সমাজে শকাব্দ, আর সাধারণের মধ্যে ‘পরগণাতি-অব্দ’ চালু ছিল। পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তীকালেই ইংরেজরা ব্যবসা-বাণিজ্য ও দেওয়ানী কাজে ‘গ্রেগারিয়ান’ সালের প্রচলন করেছিলেন। সেটাই ক্রমে সর্ব রাজকার্যে ও বাণিজ্যিক ব্যাপারে সারা বাঙলায় গৃহীত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। তবে তখনকার মুসলমান সমাজ সামাজিক ব্যাপারে হিজরাব্দ মেনেই থেকে গিয়েছিল; আর বাঙলার সর্ব সমাজে বছর ও দিন গণনায়, দিন ও মাস গণনায়, ‘গ্রেগরিয়ান’ চালু হয়েছিল। একই সঙ্গে তখনকার হিন্দু সমাজের নানা অঞ্চলে সাল প্রচলিত হয়েছিল, বাঙলায় সঙ্কর বঙ্গাব্দ চালু হয়েছিল, কিন্তু হিন্দু সমাজ ‘তিথি’র ব্যাপারে পুরনো চন্দ্র-ভিত্তিক গণনাকেই আঁকড়ে থেকেছিল। ‘গ্রেগরিয়ান’ পদ্ধতিও সূর্য-ভিত্তিক, তবে এখন সারা পৃথিবীতে যা চালু রয়েছে সেটা ত্রয়োদশ পোপ ‘গ্রেগরী’র নির্দেশে ১৫৭২ খৃষ্টাব্দে কিছুটা অদল-বদল করা হয়েছিল। এরপরেও তাতে আরো কিছু অদল-বদল করবার প্রয়োজন স্বীকৃত হলেও, সেটা আর সম্ভবপর হয়নি।


বর্তমানে হালখাতার অনুষ্ঠান আর নতুন জামাকাপড়ের সঙ্গে বাংলা নববর্ষের আর একটা বড় প্রাপ্তি হলো বাংলা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকা অথবা তার ক্ষুদ্র সংস্করণ বাংলা ক্যালেন্ডার। সাধারণভাবে দেখলে, বাংলায় এই ক্যালেন্ডার একটু গোলমেলে। ইংরেজি ক্যালেন্ডারের বছর বা অব্দকে যেমন খৃষ্টাব্দ বলা হয়, ঠিক তেমনই এই বাংলা ক্যালেন্ডারের অব্দকে বলা হয় বঙ্গাব্দ। অন্যান্য প্রচলিত অব্দগুলোর মতো, বঙ্গাব্দেও বারোটি মাস আছে, কিন্তু সেগুলোর দিন সংখ্যা ইংরেজি ক্যালেন্ডারের মতো নির্দিষ্ট নয়। বাংলায় বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা তিথি নক্ষত্রের সময়কাল অনুসারে পরিবর্তিত হয়। তাই এই পঞ্জিকার বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা ২৯, ৩০, ৩১ কিংবা ৩২ পর্যন্ত হতে পারে। প্রাচীন এই ক্যালেন্ডারের বার, তারিখ, তিথি নক্ষত্র নির্ণীত হয় পঞ্জিকা বা পাঁজি থেকে। যত দূর জানা যায়, আজ পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ব্যবহৃত হওয়া বর্ষপঞ্জি ‘ইংলিশ ক্যালেন্ডার ইয়ার’ নামে পরিচিত হলেও আদতে এই বর্ষপঞ্জি রোমানদের তৈরী, তাঁরা আবার গ্রীকদের কাছ থেকে এটি ধার করেছিলেন। প্রাচীন গ্রীসের মানুষদের নিজস্ব বছরের সময়কাল তিনশো চার দিনের, এবং দশটি মাসে বিভক্ত ছিল। তাঁদের বছরের সূচনা ধরা হত মার্চ মাস থেকে। খৃষ্টপূর্ব ৬৭৩ অব্দে রোম-সম্রাট ‘নুমা পম্পিসিয়াস’ গ্রীক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বছরের ১১ ও ১২ নম্বর মাস হিসাবে যথাক্রমে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিকে যুক্ত করেছিলেন। তাতে ওই বারো মাসের ক্যালেন্ডারটি আগের থেকে ভাল হলেও তাতে কিছু সমস্যা থেকে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও দীর্ঘদিন ধরে সেই ব্যবস্থাই বজায় ছিল। অনেক দিন পরে খৃষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে রোম-সম্রাট ‘জুলিয়াস সিজারের’ নির্দেশে ক্যালেন্ডারকে তারিখ অনুযায়ী সাজানো হয়েছিল, এবং তখন থেকেই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি বছরের প্রথম ও দ্বিতীয় মাসের মর্যাদা পেয়েছিল। সিজারের সময়কালে নির্মিত সেই ক্যালেন্ডার পরবর্তী সময়ে জুলিয়াস সিজারের নাম অনুসারেই ‘জুলিয়েন ক্যালেন্ডার’ নামে অভিহিত হতে থাকে।


বর্তমানে ব্যবহৃত ইংরেজি মতের ক্যালেন্ডারকে বলা হয় ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। এটি আদতে প্রাচীন ‘জুলিয়েন ক্যালেন্ডার’-এরই সংশোধিত রূপ। ১৫৮২ খৃষ্টাব্দে লক্ষ্য করা হয়েছিল যে, পুরনো ক্যালেন্ডারের মত অনুসারে প্রায় ১০ দিনের মতো ভুল গণনা করা হচ্ছে। তৎকালীন রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি বর্ষপঞ্জি সংস্কার করবার জন্য ৫ই অক্টোবর তারিখটিকে ১৫ই অক্টোবর, শুক্রবার হিসেবে গণ্য করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সরকারিভাবে বৃটেন ১৭৫২ খৃষ্টাব্দে সেই সংস্কার গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তত দিনে ভুলের মাত্রা ১০ ছাড়িয়ে ১১ দিনের মতো হয়ে গিয়েছিল, তাই ১৭৫২ খৃষ্টাব্দের ৩রা সেপ্টেম্বর তারিখটিকে ১৪ই সেপ্টেম্বর হিসেবে গণ্য করে বৃটেন সেই সংশোধন গ্রহণ করেছিল। গ্রিক-রোমানদের সেই ক্যালেন্ডার বা বর্ষপঞ্জি প্রধানতঃ বৃটিশদের কল্যাণেই পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল, এবং সেই কারণেই এটি ‘ইংলিশ ক্যালেন্ডার ইয়ার’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সর্বত্র ‘ইংলিশ ক্যালেন্ডার ইয়ার’ ব্যবহৃত হলেও প্রত্যেক উন্নত জাতি গোষ্ঠীরই নিজের নিজের বর্ষপঞ্জি বা ক্যালেন্ডার রয়েছে।

প্রাচীনকালে ভারতেও জ্যোতিষীরা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্রের অবস্থান, দিন রাতের হিসাব ইত্যাদি বিশেষ কিছু তথ্যের ওপর নির্ভর করে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত লিখে রাখতেন। প্রধানতঃ সেখান থেকেই পঞ্জিকার ধারণা তৈরি হয়েছে। পরবর্তীকালে জ্যোতিবিদ্যার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জিকার গণনা পদ্ধতির পরিবর্তন হতে থাকে, এবং পঞ্জিকা ক্রমে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়ে। প্রাচীন ভারতে একাধিক জাতিগোষ্ঠী ছিল। বিভিন্ন সময়ে সেই সব জাতিগোষ্ঠী বিভিন্ন রকম পঞ্জিকা বা বর্ষপঞ্জি তৈরী করেছিল। কালের নিয়মে সেগুলোর অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবুও এখনও সারা ভারতজুড়ে বঙ্গাব্দ ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়। সেগুলো হলো ‘বিক্রম সম্বত’, ‘শকাব্দ’, বুদ্ধ নির্বাণ – ‘বুদ্ধাব্ধ’, মহাবীর নির্বাণ – ‘মহাবীরাব্দ’, ‘বার্হস্পত্যবর্ষ’, ‘চৈতনাব্দ’, ‘কল্যব্দ’, ‘ভাস্করাব্দ’, ‘শঙ্কররাব্দ’, ‘হিজরী’ সন, ‘মুসলমানী মাস’, ‘ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জী’, ‘অর্থবর্ষ’ ইত্যাদি।


বাংলা সন (বা অব্দ) বঙ্গাব্দ ঠিক কে প্রবর্তন করেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। সাধারণভাবে বলা হয়ে থাকে যে, কোন শক্তিশালী রাজা-সম্রাটদের রাজ্যাভিষেকের তারিখ থেকে বা সেই রাজার কোন উল্লেখযোগ্য রাজ্য জয়ের সময় বা কোন ধর্মীয় নেতার জন্ম বা তাঁর কোন উল্লেখযোগ্য কাজকে স্মরণীয় করে রাখতে অব্দের প্রচলন হয়। কিন্তু বাংলায় প্রচলিত বঙ্গাব্দর সূচনা ঠিক কীভাবে হয়েছিল সেটা এখনও পর্যন্ত খুব একটা স্পষ্ট নয়। কারো কারো মতে মুঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে তাঁর অর্থমন্ত্রী রাজা টোডরমল এই অব্দের প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু আকবর ঠিক কীসের ভিত্তিতে বঙ্গাব্দ গণনা আরম্ভ করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেটা আজও স্পষ্ট নয়। কারণ, সম্রাট আকবর তখতে বসেছিলেন ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দে। আবার কারো কারো মতে বাংলার রাজা শশাঙ্ক বঙ্গাব্দের প্রবর্তক। সঠিক সময়কাল জানা না গেলেও ইতিহাসবিদদের অনুমান যে, রাজা শশাঙ্ক সম্ভবতঃ সপ্তম শতকের গোড়ার দিকে বা তার কিছু আগে বাংলার শাসক হয়েছিলেন। এখন শশাঙ্ক যদি ষষ্ঠ শতকের শেষের দিকে ৫৯৩-৯৪ খৃষ্টাব্দে বাংলার সিংহাসনে বসে থাকেন, তাহলে সেই সময় থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়েছিল বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। তবে এই মতের স্বপক্ষেও কোন জোরালো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। আবার অনেকে এটা মনে করেন যে, খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্যই মোঘল সম্রাট আকবরের নির্দেশে রাজা টোডারমল, শশাঙ্ক প্রবর্তিত বঙ্গাব্দকে সংশোধিত ও পরিমার্জিত করে নতুন করে চালু করেছিলেন।


বাংলা বছর আরম্ভ হওয়ার বেশ কিছু দিন আগে থাকতেই নানা ধরনের পাঁজি বাজারে এসে যায়। সাধারণভাবে জন্ম এবং মৃত্যু ছাড়া লোকজীবনের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান করতে গেলেই ধর্মপ্রাণ মানুষ পঞ্জিকার সাহায্য গ্রহণ করেন। অন্নপ্রাশন, পইতে, বিয়ে, সাধ শ্রাদ্ধ, ভিটেপুজো, গৃহপ্রবেশ, পুকুর খনন ইত্যাদির মতো যাবতীয় কাজের ‘সু-সময়’ খুঁজতে শরণ ‘পঞ্জিকা’র শরণ নিতে হয়। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির মতোই বাংলার পঞ্জিকাতেও বারোটি মাস রয়েছে। এই মাসের নামগুলো বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে হয়েছে। যেমন, বৈশাখ হয়েছে ‘বিশাখা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; জ্যৈষ্ঠ ‘জ্যেষ্ঠা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; আষাঢ় উত্তর ও পূর্ব ‘আষাঢ়া’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; শ্রাবণ ‘শ্রবণা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; ভাদ্র উত্তর ও পূর্ব ‘ভাদ্রপদ’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; আশ্বিন ‘অশ্বিনী’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; কার্তিক ‘কৃত্তিকা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; অগ্রহায়ণ (মার্গশীর্ষ) ‘মৃগশিরা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; পৌষ ‘পুষ্যা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; মাঘ ‘মঘা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে; ফাল্গুন উত্তর ও পূর্ব ‘ফাল্গুনী’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে, এবং চৈত্র ‘চিত্রা’ নক্ষত্রের নাম অনুসারে।


সংস্কৃত ‘পঞ্চাঙ্গ’ শব্দটি থেকে পঞ্জিকা কথাটির উদ্ভব হয়েছে। বার-তিথি-নক্ষত্র-যোগ-করণ এই পাঁচ ‘অঙ্গ’ হলো ‘পঞ্চাঙ্গ’। বাংলায় সপ্তাহের সূচনা হয় রবিবার থেকে। রবি থেকে শনি পর্যন্ত মোট সাতটি বার আছে। বারগুলোর নামকরণ করা হয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রহের নাম অনুসারে। যেমন রবিবার নামটি এসেছে রবি বা সূর্যের নাম অনুসারে, সোমবার নামটি এসেছে সোম বা চন্দ্রের নাম অনুসারে, মঙ্গলবার নামটি এসেছে মঙ্গল গ্রহের নাম অনুসারে, বুধবার নামটি এসেছে বুধ গ্রহের নাম অনুসারে, বৃহস্পতিবার নামটি এসেছে বৃহস্পতি গ্রহের নাম অনুসারে, শুক্রবার নামটি এসেছে শুক্র গ্রহের নাম অনুসারে এবং শনিবার নামটি এসেছে শনি গ্রহের নাম অনুসারে। প্রসঙ্গতঃ বলা যেতে পারে যে, আধুনিক জ্যোতিবিজ্ঞান অনুসারে চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর গ্রহ না হলেও জ্যোতিষবিদ্যায় এগুলোকেও গ্রহ বলা হয়। আর তিথি হল চন্দ্রদিন। উল্লেখ্য, এখন যে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করা হয়, সেটা সৌর দিন ধরে গণনা করা হয়। অর্থাৎ, পৃথিবী যে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টায় সূর্যকে একবার পাক খায়, সেই হিসাব ধরে এই দিনের হিসাব কষা হয়। কিন্তু পঞ্জিকায় তিথি গোনা হয় চন্দ্রমাস ধরে। ২৯ দিন ১২ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ৫/৬ সেকেন্ডের এক চন্দ্রমাসে রয়েছে ৩০টি তিথি। তাই দিন আর তিথির হিসাব অঙ্কের নিয়মে কখনই মেলে না। কোন এক পূর্ণিমা থেকে পরের পূর্ণিমা পর্যন্ত এক চন্দ্রমাস। মাঝের দুই অমাবস্যাকে ধরে এই চন্দ্রমাস ১৫ করে মোট ৩০টি তিথিতে বিভক্ত। এখানেও আবার ভাগ আছে। বাংলা পঞ্জিকাবিদরা প্রাচীন গণনা পদ্ধতি অনুসারে তৈরি ‘অদৃকসিদ্ধ’ এবং আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পদ্ধতিতে গণনা করা ‘দৃকসিদ্ধ’ – এই দুই মতে বিভক্ত। যে গণনা পদ্ধতিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে নির্ণয় করা কোন জ্যোতিষ্কের দূরত্বের মান আধুনিক টেলিস্কোপে মাপা দূরত্বের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, সেটাকে ‘দৃকসিদ্ধ’ বা ‘সায়ন’ পদ্ধতি বলা হয়। আর যে গণনা পদ্ধতিতে মানের পার্থক্য থেকে যায়, সেটাকে ‘অদৃকসিদ্ধ’ বা ‘নিরায়ণ’ পদ্ধতি বলা হয়। বঙ্গদেশে, পঞ্জিকার তিথি গণনায় এই দু’রকম পদ্ধতিরই প্রচলন রয়েছে। গুপ্তপ্রেস, পিএম বাকচি (বাগচী), বেণীমাধব শীল ইত্যাদি হল অদৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা; আর বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই হল বাংলার একমাত্র দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা।


বাংলায় কবে থেকে পঞ্জিকা গণনা আরম্ভ হয়েছিল সেটা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কেউ কেউ বলেন যে, বঙ্গদেশে হাতে লেখা পঞ্জিকার চল বহুকাল আগে থেকেই ছিল। সব থেকে প্রাচীন বেদাঙ্গ জ্যোতিষ পঞ্জিকা নাকি ১৮৫০ খৃষ্টপূর্বাব্দে সংকলিত করা হয়েছিল। সেইসব হাতে লেখা পঞ্জিকা শুধুমাত্র রাজা-জমিদার ও অভিজাত শ্রেণীই ব্যবহার করতেন। অন্যদিকে তখনকার আমজনতা প্রধানতঃ সূর্যের উদয়-অস্তের সময়কালের উপরে নির্ভর করতেন। অনুমান করা হয় যে, খৃষ্টীয় ষোড়শ শতকের স্মার্ত পন্ডিত ‘রঘুনন্দন’ ও ‘রাঘবানন্দ’ প্রথম বাংলা পঞ্জিকা প্রণয়ন করেছিলেন। সেটি পরে ‘নবদ্বীপ পঞ্জিকা’ নামে পরিচিত হয়েছিল। তখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশে মুদ্রণ ব্যবস্থার সূচনা হয়নি, তাই স্বাভাবিকভাবেই রঘুনন্দনের ওই পঞ্জিকা পুঁথি আকারে ছিল। পঞ্জিকা যুগের সূচনা থেকেই বিত্তশালী রাজা-জমিদার শ্রেণী বছরের শুরুতেই নিজেদের বাড়িতে পণ্ডিত ডাকিয়ে সেই বছরের বর্ষফল ও পুজো-পার্বণের দিনক্ষণ আগে থেকে জেনে নিতেন। এই প্রথা দীর্ঘকাল ধরে বাংলায় চালু ছিল। এখনও অনেক পুরনো বনেদি বাড়িতে নববর্ষের দিন পঞ্জিকা পাঠের রেওয়াজ চালু রয়েছে। বলা হয় যে, রঘুনন্দনের করা পঞ্জিকার সেই ধাঁচই নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান পঞ্জিকার রূপ ধারণ করেছে।


নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাসদ ‘রামরুদ্র বিদ্যানিধি’ আদি পঞ্জিকার যে সংস্করণ করেছিলেন, সেটারই একটি প্রতিলিপি থেকেই নাকি ‘দুর্গাচরণ গুপ্ত’ ১২৭৬ বঙ্গাব্দে (১৮৬৯ খৃষ্টাব্দে) ‘গুপ্তপ্রেস’ পঞ্জিকার সূচনা করেছিলেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বঙ্গদেশে মুদ্রণযন্ত্র এসেছিল। ইতিহাস যত দূর জানা যায়, প্রথম মুদ্রিত বাংলা পঞ্জিকার নাম ছিল – ‘রামহরি পঞ্জিকা’, সেটা ১৮১৮ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। আবার অনেকে বলেন যে, শ্রীরামপুরের গণক ‘কালীদাস ভট্টাচার্যের’ গণনা করা সূর্য-পঞ্জিকাই বাংলার প্রথম মুদ্রিত পঞ্জিকা ছিল, সেটা কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকারের চন্দ্রোদয় প্রেসে ছাপা হয়েছিল। দু’বছর পরে, ১৮২০ সালে ‘বিশ্বম্ভর দেবের পঞ্জিকা’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৮২১ খৃষ্টাব্দে শোভাবাজার থেকে একটি পঞ্জিকা প্রকাশিত হয়েছিল, যেটার সংকলক ছিলেন ‘গৌরচন্দ্র বিদ্যালঙ্কার’। সাপ্তাহিক ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ প্রেস থেকে ১৮২৭ খৃষ্টাব্দ থেকে সেকালের অন্যতম জনপ্রিয় ‘নবপঞ্জিকা’ প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল। শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে সেই সময়েই দামি ‘শ্রীরামপুর পঞ্জিকা’ প্রকাশিত হত। এগুলোর কোনটাই এখন আর নেই।


বর্তমানে বাংলার প্রাচীন জীবিত পঞ্জিকাগুলোর মধ্যে ‘গুপ্তপ্রেস’ পঞ্জিকাই প্রাচীনতম। দ্বিতীয় প্রাচীন পঞ্জিকা হল ‘পিএম বাকচি ডাইরেক্টরি ও পঞ্জিকা’। সম্ভবতঃ ১৮৮৮ সালে বা তার কিছু পরে সেটি প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছিল। আর বাংলার একমাত্র দৃকসিদ্ধ ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’ ১৮৯০ খৃষ্টাব্দ থেকে প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছিল। প্রাচীন পদ্ধতি অনুসারে করা গণনায় তিথি-নক্ষত্রের হিসেবে গরমিল হওয়ায় ‘মাধবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থের গণনার বীজ সংস্কার করে ওই পঞ্জিকাটি প্রকাশ করেছিলেন।

স্বাধীনতার পরে, ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে এক কমিটি গড়ে পঞ্জিকা সংস্কার করেছিল, এবং সেই কমিটির অনুসারে ১৯৫৭ সাল থেকে আধুনিক গণনা পদ্ধতি সম্বলিত সরকারি ‘পঞ্চাঙ্গ’ মেনে দৃকসিদ্ধ মতের পঞ্জিকার দিনক্ষণ নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এখনও অনেক পঞ্জিকা প্রাচীন গণনা পদ্ধতি অনুসারে প্রকাশিত হয়। তাই সেগুলোর সঙ্গে দৃকসিদ্ধ মতের পঞ্জিকার তিথি-নক্ষত্রের বেশকিছু পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় যায়। যেমন – ১৪১৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাস দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকানুসারে ছিল ৩১ দিনের; কিন্তু প্রাচীন মতের পঞ্জিকায় মাস্তি ছিল ৩২ দিনের। আবার আষাঢ় মাস দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকায় ৩২ দিনের হলেও প্রাচীন পঞ্জিকায় সেটা ৩১ দিনের। কিন্তু কেন এই বিভ্রান্তি? প্রাচীন মতে, প্রকাশিত পঞ্জিকার (গুপ্তপ্রেস, পিএম বাকচি, বেণীমাধব শীল ইত্যাদি) সমর্থকরা বলেন যে, ওই সমস্ত পঞ্জিকা রঘুনন্দনের প্রাচীন সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থের নির্দেশ অনুসারে গণনা করে তিথি-নক্ষত্রের যে অবস্থান পাওয়া যায়, সেই অনুসারে তৈরী করা হয়। অন্যদিকে, দৃকসিদ্ধ মত অনুসারে প্রকাশিত (বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত) পঞ্জিকার গণনা ভারতীয় সরকারি পঞ্চাঙ্গ অনুসারে করা হয় বলে সেটা তুলনামূলকভাবে বিজ্ঞানসম্মত।


পুজো-পার্বণ কিংবা বার-তিথি-নক্ষত্র দেখা ছাড়াও বাংলা সাহিত্যেও কিন্তু পঞ্জিকার আলাদা একটা গুরুত্ব রয়েছে। অনেকেই নিশ্চই অবাক হয়ে ভাবছেন যে, পাঁজি আবার সাহিত্য হল কবে? যাঁরা এমনটা ভাবছেন, তাঁদের ভুল ভাঙানোর জন্য উপদেশ হল যে, অনুগ্রহ করে হাতে অনেকটা সময় নিয়ে একদিন ভাল করে পুরো একটা পাঁজি পড়ে ফেলুন। সব পড়বেন, সূচনাপত্র থেকে শেষ পাতার বিজ্ঞাপন পর্যন্ত। যদি একটু ধৈর্য ধরে পুরো পাঁজিখানা পড়তে পারেন, তাহলে দেখবেন, বাংলায় অমন রসসাহিত্য আর দ্বিতীয়টি নেই। পঞ্জিকাতে কী নেই? একেবারে গোড়ার দিকে পঞ্জিকার গণক ও অনুমোদক পণ্ডিতদের তালিকায় একবার চোখ বোলান। দেখবেন কাব্যতীর্থ, ব্যাকরণতীর্থ; জ্যোতিষতীর্থ, ন্যায়তীর্থের ছড়াছড়ি। সারাজীবন ঘুরে বেড়ালেও যত তীর্থ দর্শন করতে পারবেন না, অথচ একবার পাঁজির পাতায় চোখ বোলালেই আপনার সেই আশা পূর্ণ হবে। কলকাতাসহ সারা বাংলা তো বটেই, সারা ভারতজুড়েই ছড়িয়ে আছেন সেই সব ‘তীর্থ’রা। এবার আসা যাক গণনায়। পঞ্জিকা অনেক বিষয়েই গণনা করে আগাম বলে দিতে পারে, অন্ততঃ পঞ্জিকাওয়ালাদের দাবি সেই রকমই। বৃষ্টি গণনা, বার্ষিক রাষ্ট্রফল, ব্যক্তির বার্ষিক লগ্নফল; রাশিফল – ফলের ছড়াছড়ি। আবহাওয়ার হাল-হদিশ দিতে যেখানে বড় বড় আবহাওয়াবিদেরা হিমশিম খেয়ে যান, সেখানে শুধু যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে (এখনও পর্যন্ত সব পঞ্জিকায় এর থেকে উচ্চতর কোন গাণিতিক পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয় না) সারা দেশের বৃষ্টি ও আবহাওয়ার খবর দেওয়া কম কৃতিত্বের নয় কিন্তু। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। কোনও এক বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসের বৃষ্টি গণনা করতে গিয়ে একটি পঞ্জিকা লিখেছিল, “এই মাসে যেখানেই মেঘের সঞ্চার ঘটবে সেখানেই বৃষ্টিপাত হবে।” এরপরে কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন! বার্ষিক রাষ্ট্রফল। কোনও এক বঙ্গাব্দের একটি পঞ্জিকার এই বিভাগে বিস্তৃতভাবে ভারতবর্ষ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, চীন, রাশিয়া, জাপান, ইসরাইল, আমেরিকা মহাদেশ ও ব্রিটেনের এবং অল্প কথায় পৃথিবীর আরও অনেক রাষ্ট্রের বার্ষিক রাষ্ট্রফল বলা আছে। হাতে সময় কম থাকলে যে কোন একটা বা দুটো রাষ্ট্রের বর্ষফল পড়লেই চলবে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রায় একই কথা লেখা আছে বাকি সবগুলোর ক্ষেত্রে। তবে বাংলা পঞ্জিকার সব থেকে আকর্ষণীয় অংশটি হল জ্যোতিষ বচনার্থ! কী নেই সেখানে? প্রথমেই রয়েছে ‘বারবেলা’ ও ‘কালবেলা’। রবিবার থেকে শনিবার সপ্তাহের প্রতিটা দিনেরই কোন না কোন সময় বারবেলা বা কালবেলা পড়বে। আর আছে ‘কালরাত্রি’। এই ‘বারবেলা’, ‘কালবেলা’ ও কালরাত্রি সময়কালে কোন কাজ করা যাবে না। করলে নানা বাধা-বিঘ্ন, এমনকী প্রাণ সংশয় পর্যন্ত! সন্তানের অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ যে কোন শুভ কাজেই হোক, পঞ্জিকার জ্যোতিষ বচনের নির্দেশ না মানলে কিন্তু সমূহ সর্বনাশ! শুধু শুভ কাজই বা বলি কেন, যে কোন কাজেই জ্যোতিষরা আপনার সহায়। ধরা যাক, কোথাও বেড়াতে গিয়েছেন। সেখানে একটা উদ্যানে বোটিং অর্থাৎ নৌকাচালনার ব্যবস্থা আছে। খবরদার। পাঁজি না দেখে কিন্তু নৌকায় চড়তে যাবেন না ভুলেও। জ্যোতিষ বচনার্থ-এর নৌকাযাত্রায় বলা হয়েছে, “অশ্বিনী হস্তাপুষ্যা মৃগশিরা পূর্বফাল্গুনী পূর্বাষাড়া পূর্বভাদ্র অনুরাধা ধনিষ্ঠা ও শ্রবণা নক্ষত্রে, শুভ তারাচন্দ্রে, যাত্রোক্ত দিবসে, শুরু বাড়তি যোগাযোগকরণে নৌকাযাত্রা প্রশস্ত।” বোঝা গেল কিছু? থাক, না বোঝাই ভাল। বুঝতে গেলে ইহকালে আর কোনদিন নৌকায় চড়াই হবে না। 


এককালে উত্তর কলকাতার হাতিবাগান পাড়ার খ্যাতি দুটি কারণে ছিল। এক, হাতিবাগান অঞ্চলেই অগণিত সংস্কৃত টোল তথা শাস্ত্রীয় বিধান দেয়ার আখড়া ছিল। দুই, অতীতের বাংলা পেশাদারি নাট্যশালাগুলোর অধিকাংশই সেখানে ছিল। কিন্তু এখন সেখানে টোলও আর বেশি নেই, নেই পেশাদার রঙ্গমঞ্চগুলোও। মনে হয়, বাংলা রঙ্গমঞ্চের কর্তারা ওইসব টোল থেকে জ্যোতিষ বচনার্থর ‘নাট্যরম্ভ’ তিথি সক্ষ জেনে-বুঝে তবে নাটক আরম্ভ করতেন। কিন্তু টোলগুলো উঠে যাওয়ার কারণে গ্রহ-নক্ষত্রের কোপে পড়ে বাংলা পেশাদারি নাট্যজগৎ হাতিবাগান থেকে একেবারে উঠেই গিয়েছে। এর পরে আসা যাক, পঞ্জিকার মূল অংশে, যেখানে মাস অনুযায়ী, প্রত্যেক দিনের বর্ণনা রয়েছে। এই অংশটিও কম রসক্তি নয়। বার, তারিখ, তিথি, নক্ষত্র, বারবেলা কালবেলা ছাড়াও এখানে প্রতিদিন কী কী খাওয়া যাবে আর কী কী যাবে না তার তালিকাও দেওয়া থাকে। যেমন এক পঞ্জিকা-র মতে, অমুক বঙ্গাব্দের অমুক বৈশাখের দিন, “ঘ ৮।৩৮।৩৭ মধ্যে নারিকেল ভক্ষণ তৈল মৎস্য মাংসাদি সম্ভোগ ও প্রায়শ্চিত্ত নিষেধ ও পরে অলাবু ভক্ষণ নিষেধ।” অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় যাঁরা ভুগছেন, তাঁরা আর কোন কারণে না হোক, এই ‘ডায়েট চার্ট’-এর জন্যেই একটা করে পঞ্জিকা কিনতে পারেন। বলাই বাহুল্য, পঞ্জিকার পাতায় যা ছাপা থাকে, সেগুলো সবই ‘গ্যারান্টেড’, মানে “কিনিলে ঠকিবেন না”। আর কিছু লাভ না হোক, পড়ে যে আনন্দ পাবেন, এটা অন্ততঃ ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে বলা যেতে পারে। পঞ্জিকার মতো নির্মল হাস্যরসের ভান্ডার বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টা নেই।


তথ্যসূত্র:

  • ১- Light on Life: An Introduction to the Astrology of India by Hart Defouw & Robert Svoboda.
  • ২- বঙ্গাব্দ: ইতিহাস ও উৎস সন্ধানে, প্রফেসর মতিয়র রহমান।



সূত্র: ইরাবতী পত্রিকা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ