১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্টে পাকিস্তান তৈরির জন্য মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দিলে শহর কলকাতা জুড়ে শুরু হয়ে যায় হিন্দু গণহত্যা। নেহেরু তখন দিল্লিতে অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী। আর অখণ্ড বাংলার শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিল মুসলিম লীগ এবং মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সুরাবর্দি।
সুরাবর্দির নির্দেশেই কলকাতায় শুরু হয় এই হিন্দু গণহত্যা। কলকাতায় ছিল মহড়া, আর পুরো উদ্দেশ্যটি কার্যকর করা হয় নোয়াখালীতে। ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্টের বিকেলে কলকাতার ময়দানে মনুমেন্টের তলায় মুসলিম লীগ ও ভারতের কম্যুনিষ্ট পার্টির যৌথ সভা হয়। ওই সভার মঞ্চে হাজির ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু, হোসেন সুরাবর্দি ও খাজা নাজিম উদ্দিন। সেই মঞ্চে একসঙ্গে বাঁধা ছিল মুসলিম লীগের চাঁদ তারা মার্কা ও কম্যুনিষ্টদের লাল পতাকা।
ওই মঞ্চ থেকে কম্যুনিষ্ট নেতারা শ্লোগান দিলেন,
“আগে পাকিস্তান দিতে হবে, তবেই ভারত স্বাধীন হবে”।
সুরাবর্দী মন্চ থেকে তার অনুগামীদের আদেশ দিলেন কাজ শুরু করতে তিনি তিনদিন পুলিশকে আটকে রাখবেন।
ওইদিনই বিকেলে মিটিং থেকে ফেরার পথে মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লো ধর্মতলায় হিন্দু জনসাধারণ ও হিন্দুদের দোকানের ওপর।
১৯৪৬-এর ১৬, ১৭, ১৮ আগস্ট তিন দিন ধরে সারা কলকাতা জুড়ে চললো মুসলিম লীগের পরিকল্পিত গণহত্যা। সুরাবর্দি লালবাজার কণ্ট্রোল রুমে বসে নিষ্ক্রিয় করে রাখলেন পুলিশকে। এই সুযোগে কলকাতায় তাণ্ডব চালালো নিউ মার্কেট এলাকার বোম্বাইয়া, কর্ণওয়ালিশ বস্তির মিনা পাঞ্জাবী ও হ্যারিসন রোডের মুন্না চৌধুরীর মতো মুসলিম লীগের গুণ্ডারা। এই দাঙ্গার বিষয়ে ইংরেজি দৈনিক “দ্য স্টেটসম্যান” লিখলো, “দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং”, অন্যান্যরা লিখলো, “উইক অব্ লং নাইভস্।”
ওই সময় কলকাতায় ছিলেন এক বিদেশি সাংবাদিক, নাম— ফিলিপ ট্যালবট্। তিনি “ইনস্টিটিউট অব্ কারেন্ট ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স” -এর প্রধান ওয়াল্টার রজার্সকে লিখলেন,
“ভারতের বৃহত্তম এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহরটা (কলকাতা) যেন লিপ্ত রয়েছে নিজেকে নরখাদকে পরিণত করতে। শহরের সমস্ত রাস্তার দোকানগুলির একটিরও দেওয়াল বা দরজা আস্ত নেই। লুঠ হয়েছে সব দোকান। আর গুণ্ডারা যেগুলোকে লুঠ করতে পারে নি, সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে রাস্তায়। আর চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে মানুষের লাশ। টাটকা লাশ, গরমে পচা লাশ, অঙ্গহীন লাশ, থেঁতলে যাওয়া লাশ, ঠেলা গাড়িতে জড়ো করা লাশ, নর্দমায় লাশ, খালি জায়গায় গাদা হয়ে থাকা লাশ, শুধু লাশ আর লাশ।
শুধু ৩৫০০ লাশ সংগ্রহ করে গোনা হয়েছে, আর কত লাশ যে হুগলি নদীতে ভেসে গেছে, কত হাইড্রেনে আটকে আছে, কত লাশ যে ১২০০ জায়গায় দাঙ্গার আগুনে পুড়ে গেছে, কত লাশ যে তাদের আত্মীয়রা তুলে নিয়ে গিয়ে সৎকার করেছে, এর সংখ্যা বলতে পারবে না কেউই।”
তিন দিন পর শহরে সেনা নামানো হয়। ৭, ০০০ থেকে ১০, ০০০ লোক এই দাঙ্গায় খুন হয়েছে বলে সেনাবাহিনীর অনুমান।
দুদিন ধরে এরকম দাঙ্গার পর মুসলিম লীগের গুণ্ডাবাহিনীর হাতে হিন্দুদের বাঁচাতে এগিয়ে এলেন কলকাতা বৌবাজারের এক ডাকসাইটে হিন্দু যুবক কুস্তিগীর গোপাল মুখোপাধ্যায়। পরিচয়ে বিপ্লবী অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ভাগ্নে। কলকাতা বৌবাজারের মলঙ্গা লেনে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ ই সেপ্টেম্বর গোপালের জন্ম।
কলকাতায় তাঁদের একটি বুচার শপ অর্থাৎ পাঁঠা কাটার পারিবারিক দোকান ছিল। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উল্টোদিকে কলেজ স্ট্রিটে সে দোকান এখনো রয়েছে, নাম—
“অনুকূল মুখার্জীর পাঁঠা কাটার দোকান।”
পাঁঠা কাটার এই পারিবারিক ব্যবসার সূত্রে লোকমুখে গোপাল মুখোপাধ্যায়ের নাম হয়ে যায় “গোপাল পাঁঠা।”
হিন্দুদের বাঁচাতে গোপাল জোগাড় করলেন ২৪ পয়েন্ট বোরের রাইফেল এবং সেগুলি জোগাড় হলো ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতায় ঘাঁটি গেড়ে থাকা মার্কিন সৈন্যদের কাছ থেকে। এক বোতল হুইস্কি কিংবা সামান্য কিছু টাকা দিলেই তখন সেগুলো পাওয়া যেতো।
ছোট থেকেই গোপালের আদর্শ ছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। “ভারতীয় জাতীয় বাহিনী” নামে একটি ছোট্ট সংগঠন পরিচালনা করতেন গোপাল। গোপালের সঙ্গে যোগ দিলেন যুগলকিশোর ঘোষ, কলকাতায় বসবাসকারী শিখ ও গোয়ালা সম্প্রদায়ের মানুষজন ।গোপাল পাঁঠার নেতৃত্বে মারমুখী হিন্দুরা এবার পাল্টা মার দিতে শুরু করলো। মার খেতে লাগলো মুসলিম লীগের দলবল। তখন সুরাবর্দি ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ করে সেনা নামালেন।
অমনি হাজির হলেন গান্ধী। গোপালকে বললেন, তাঁর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে।
গোপাল জানিয়ে দিলেন, যতক্ষণ পযর্ন্ত হিন্দুদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি একটি সূঁচ বা পেরেকও দেবেন না। দরকার হলে তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্রের পায়ে তাঁর অস্ত্র সমর্পণ করবেন, কিন্তু গান্ধীর কাছে নয়।
অবস্থা বেগতিক দেখে এরপর মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠনের প্রধান জিজি আজমিরি এবং মুসলিম ন্যাশনাল গার্ডের সদস্য শেখ মুজিবর রহমান (পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) হাত জোড় করে এই আক্রমণ বন্ধ করতে কাতর অনুরোধ জানালে গোপাল পাঁঠা থামেন। গোপাল একদিনেই আটশো হিন্দু ও শিখ যুবককে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা মার দিয়েছিলেন।শেষ জীবনে গোপাল একজন সমাজকর্মী হিসেবে “ন্যাশনাল রিলিফ সেণ্টার ফর্ ডেসটিটিউটস্” নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান চালাতেন।
এলাকায় বিশাল আকারে শুরু করেছিলেন কালীপুজো। বহু বিশিষ্টজনেরা এই কালীপুজোয় এসেছেন।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ১০ ই ফেব্রুয়ারি কলকাতার এই বীর গোপাল পাঁঠার মৃত্যু হয়।
কলকাতা শহরের বুকে হিন্দুদের নিরাপদ একটি ঠিকানা তৈরির কারিগরটির নাম “গোপাল পাঁঠা।” পরবর্তী কলকাতা কে সুরক্ষার দ্বায়িত্ব আমাদের-আপনাদের।
https://www.facebook.com/bangladiscoverindia/posts/pfbid034fQi7xqbkCY99uTfaw5T6LU1wwofnhEWfbNKALQmaiS6bpfm6fJEyAhzhJn1A7X6l
0 মন্তব্যসমূহ