18 December at 00:08 ·
ফেসবুক থেকে শুনছি, বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ!
ফেসবুক থেকে জেনেছি, ভারতের রাষ্ট্রপতি আজ ভারতের অনুদানে নির্মিত ঢাকার রমনা কালীমন্দিরের সম্প্রসারিত ভবনের দ্বার উদবোধন করেছেন।
সম্প্রসারিত ভবন! সম্প্রসারিত ভবন মানে, মূল ভবনের বিস্তৃতি! আরও প্রসার, আরও উন্নতি!
কিন্তু এখানে সম্প্রসারণ বলতে রমনা কালী মন্দিরের মূল ভবনের উন্নতি বোঝানো হয়নি।
রমনা কালী বাড়ির মূল ভবন থাকলে তো এর উন্নতি, শ্রীবৃদ্ধি হবে!
মন্দিরের মূল ভবন তো ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো।
রমনা কালী মন্দিরের দেবী কালী অত্যন্ত জাগ্রত দেবী হিসেবে হিন্দুদের কাছে পূজিত হতেন।
হিন্দু নামেই পাকিস্তানীদের বিদ্বেষ ছিল, ঘৃণা ছিলো, আক্রোশ ছিলো। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী তাই হিন্দু খুঁজে খুঁজে হত্যা করতো, হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম জ্বালিয়ে দিতো।
যুদ্ধের শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু ছাত্রদের আবাসিক জগন্নাথ হল, শহীদ মিনার (যেহেতু একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতে খালি পায়ে হেঁটে এসে সকল বাঙালি শহীদ বেদীতে ফুল দেয় তাই এটাও হিন্দু) ভেঙ্গেছিল।
রমনা কালীবাড়ির জাগ্রত দেবীকে ভেঙ্গে ঘুম পাড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।
মন্দির জ্বালিয়ে দেয়ার সময় পুরোহিতসহ মন্দিরে অবস্থানরত শত শত ভক্তদেরও হত্যা করা হয়।
এরপর তো নয় মাস যুদ্ধ শেষে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম হয়।
নতুন বাংলাদেশ হাঁটি হাঁটি পা পা করে শৈশব পার করে, দেশের অনেক উন্নতি হয় কিন্তু রমনা কালীবাড়ির ভাঙ্গা মন্দির জোড়া লাগে না!
রমনা কালীবাড়ি জোড়া লাগবে কি, মন্দিরের মালিকানাই তো হিন্দুদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয় না!
বাংলাদেশ কৈশোর পার করে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার আর মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের সরকার পালা করে দেশ শাসনের ভার নেয়, দুই তরফের সরকারের আমলেই সারাদেশে হাজার হাজার মসজিদ নির্মাণ হয়, পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ মাদ্রাসা নির্মিত হয়, কিন্তু ঢাকার বুকে অবস্থিত ইতিহাসের সাক্ষী, ঐতিহ্যবাহী রমনা কালীবাড়ি আর ঠিক হয় না!
তবে এতদিনে একটা উন্নতি হয়েছে, রমনার ভাঙ্গা কালী মন্দিরের মালিকানা হিন্দুদের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
এভাবেই বাংলাদেশ আজ পঞ্চাশ বছর পার করে ফেলেছে!
পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশ মুসলিম দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধর্মীয় পরিচয় হয়েছে, বাংলাদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগুরু, অমুসলমানরা সংখ্যালঘু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
পঞ্চাশ বছরে বাংলাদেশে হিন্দুদের সংখ্যা কমতে কমতে ২৭% থেকে ৭%-এ এসে দাঁড়িয়েছে।
এতদিনে রমনা কালীবাড়ির সম্প্রসারণ হয়েছে! তাও ভারত সরকারের অনুদানে!
এই তথ্যগুলো আমি ফেসবুক থেকে পেয়েছি। ফেসবুকের তথ্য, ভুলও হতে পারে, শুদ্ধও হতে পারে!
আমি তথ্যের সত্য মিথ্যা যাচাই করতে যাইনি, কারণ বাংলাদেশে হিন্দুদের বর্তমান দেখে ভবিষ্যত কল্পনা করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।
তাই দেশ স্বাধীনের পঞ্চাশ বছর পর বাঙালির প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী কালী মন্দিরের ভাঙা দেয়াল জোড়া লাগলেই কি, আর না লাগলেই কি, মন্দির সংস্কারের খরচ দেশের সরকার দিলো নাকি পাশের দেশের দাদারা দিলো, আমার কিছুই আসে যায় না আর।
আমার মন্দির তো আমার বুকের ভেতর, মন্দিরে অধিষ্ঠিত দেবতাও আমার বুকের ভেতরেই সুরক্ষিত থাকেন।
তাই পাথরের মন্দির তৈরির জন্য আমি কারো কাছ থেকে অনুদান ভিক্ষা নেই না।
এই তো দেড় মাস আগের কথা! ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবের আগ মুহূর্তে বাঙালির অন্যতম প্রধান উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালীন কুমিল্লা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ফেনি চৌমুহনি রংপুরের পীরগঞ্জে হিন্দুদের উপর, হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির বিগ্রহ প্রতিমা পূজামন্ডপের উপর দেশের প্রধান ধর্মাবলম্বীগণ যে নৃশংস অত্যাচার করেছিলো,
তাতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের শারীরিক মানসিক অর্থনৈতিক যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিলো, সে সমস্ত ক্ষতির কথা বাদ দিয়েও, প্রধান ধর্মাবলম্বীদের পিটুনিতে দুর্গাপূজার উৎসবে আনন্দরত যতন সাহা মাণিক সাহা শান্ত দাস দীলিপ দাসের অসহায় মৃত্যুর কথা তো ভুলতে পারবো না। ভুলতে পারবে না তাদের পরিবারের জীবিত মানুষগুলো। দেশব্যাপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হিন্দু সম্প্রদায়ের কেউই ভুলতে পারবে না!
দুর্গাপূজার পর থেকে আমি এখন আর বাংলাদেশের টিভি চ্যানেল খুলি না। বাংলাদেশের কোথায় কী হচ্ছে, সেই সংবাদ নেই না। ফেসবুকেও আগের মত আগ্রহ নেই।
পূজার সময় যখন বাংলাদেশে হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছিলো, চারদিকে আগুনের লেলিহান শিখা, ঘর পোড়া নারীদের আহাজারি চারদিকে, তখনও ফেসবুকে আমি সাজুগুজু করা মেয়েদের ছবি পোস্ট দেখেছি, রান্না বান্নার গল্প দেখেছি, ছেলেদের দেখেছি খেলাধুলা নিয়ে মাতামাতি করতে, ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি করতে, মন্ত্রীদের ফিতে কাটার ছবি দেখেছি---- তখন থেকেই আমার বুকের রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে!
তারপরেও ফেসবুকে এখনো আসি। আসি শুধুই তাদের জন্য, যারা ধর্মীয় পরিচয়ের বাইরে বের হয়ে অক্টোবরের কালো দিন গুলোতে, আগুনের লেলিহান শিখা জ্বলা সময়টাতে ফেসবুকে একের পর এক প্রতিবাদী পোস্ট দিয়ে গেছে।
তাঁরা সংখ্যায় কম, তবে তাঁদের বুকের ভেতর জায়গাটা অনেক চওড়া। অক্টোবারে নির্যাতিতদের আহাজারি, হাহাকার সংখ্যায় কম মানুষগুলোর চওড়া বুকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিয়েছিলো। তাই তারা সকল অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফেসবুকে এসে প্রতিবাদ করেছিলো। তাঁদেরকে দূর থেকে প্রণাম করি,
সেই তাঁদের টানেই আমি ফেসবুকে ঢুঁ মারি।
যা বলছিলাম, রমনা কালীমন্দিরের সম্প্রসারিত দালানের দ্বার উদ্বোধন করলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ।
রমনা কালীবাড়ি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মন্দির, এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।
পশ্চিম পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দির ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, পঞ্চাশ বছর পর ভারত সরকার অনুদান দিয়ে সেই মন্দির আবার গড়ে দিয়েছে।
এই ক্ষণে আমার একটা প্রবাদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। " কার বাড়ির গোয়াল, কে দেয় ধোঁয়া! "
অ- সহী মুসলমানদের ধারণা, হিন্দুরা যে দেব দেবীর পূজা করে, সেই সকল দেব দেবী আসলে মাটির মূর্তি ছাড়া আর কিছুই না। মাটির মূর্তির আবার প্রাণ থাকে নাকি!
তাই হয়তো হিন্দুদের দুর্বল করে দিতেই মনে আঘাত দেয়ার জন্য অ-সহী মুসলমানেরা যখন তখন হিন্দুদের মন্দির ভাঙ্গে, দেব দেবীর প্রতিমা ভাঙ্গে!
আবার উপহাসও করে, " তোদের দেব দেবীর যদি এতই ক্ষমতা, কই এই যে আমরা তোদের ঠাকুরের মূর্তি ভাঙ্গি, তোদের ঠাকুর তো আমাদের একটা চুলও ছিঁড়তে পারে না!"
না, মাটির তৈরি প্রতিমা কারো চুলই স্পর্শ করে না।
তবে প্রচলিত ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মুখে মুখে বলে আর কানে কানে শুনে অনেক রীতির কথাই প্রবাদের মতো সত্য হয়ে যায়। রমনা কালীবাড়ির কালী দেবী যে জাগ্রত ছিলেন, এটাও প্রবাদের মত সত্য ছিলো।
তাই রমনা কালীবাড়ি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো। মন্দির যখন ওরা গুঁড়া করেছিল, জাগ্রত দেবী কালী প্রতিমা ভেঙ্গে গুঁড়ো করে দিয়েছিলো,
মাটির প্রতিমা কিন্তু সেদিনও পাকিস্তানী সেনাদের চুল স্পর্শ করেননি।
শুধু, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১, বিকেল সাড়ে তিনটায় রেসকোর্স ময়দানে মহা পরাক্রমশালী পাকিস্তানীবাহীনি কিছু ভারতীয় সেনা সদস্য এবং কিছু রোগা প্যাকাটি বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের পায়ের উপর উবু হয়ে শুয়ে নাক খত দিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে।
আর বর্তমান পাকিস্তানের পরিণতি তো সারা বিশ্ব দেখছে।
এটাই ছিলো পাকিস্তানিদের চরম শিক্ষা দিতে জাগ্রত রমনা কালীদেবীর মহিমা।
মাটির প্রতিমাকে মাটির মূর্তি ভেবে বাংলাদেশে প্রায় প্রতিদিন যারা প্রতিমা ভেঙ্গে দেব দেবীকে অপমান করছে, হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাসকে পায়ে দলে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে, তাদের জন্য রমনা কালীবাড়ির জাগ্রত কালী দেবী সম্পর্কে আমার নিজস্ব বার্তাটি রেখে গেলাম। পাকিস্তানের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিন।
সূত্র: ফেসবুক
0 মন্তব্যসমূহ