বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া পাঁচটি মুচি পরিবার এখন কোথায় যাবে

নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা এলাকায় মুচি সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা এলাকায় মুচি সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। আজ বুধবার দুপুরে তোলা, ছবি: প্রথম আলো


প্রতিনিধি, নেত্রকোনা, প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১৭: ২০


‘আগে কয়েকটা ঘর ভাঙছিল। চামড়া কিননের টেহা-পয়সা লুট কইরা লইয়া গেছিল। আইজ দুপুরে দল বাইন্দা আইয়া বাকি সবার ঘরবাড়ি ভাইঙা গুঁড়াইয়া দিছে। গাছপালও কাইট্টা ফালাইয়া দিয়া গেছে। আর কোনো কিছুই নাই। তারা যা করছে, তা মাইনষের সাথে মাইনষে করে না। আমরা মুচারজাত দেইখ্খা কোনো বিচার পাই না। আমরার কী দোষ, বাবু, আপনিই কইন, আমরার জন্মই কি দোষের? এই ২২ জন মানুষ লইয়া অহন আমরা কই থাকবাম?’


গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে কথাগুলো বলছিলেন নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার জালশুকা এলাকার ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ অনীল রবিদাস। তাঁর অভিযোগ, পাশের ধারা গ্রামের সিরাজ মিয়া লোকজন নিয়ে দফায় দফায় তাঁর বাড়িতে হামলা করে এসব ঘটনা ঘটিয়েছেন। এখন তিনি কোথায় থাকবেন, কী খাবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন।


উপজেলা প্রশাসন, থানা-পুলিশ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার বিশকাকুনি ইউনিয়নের জালশুকা বাজারসংলগ্ন রেললাইনের পাশের একটি খাসজমিতে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছে মুচি সম্প্রদায়ের পাঁচটি পরিবার। নারী-শিশু মিলে পরিবারগুলোর সদস্যসংখ্যা বর্তমানে ২২। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী খলিশাউর ইউনিয়নের ধারা গ্রামের মৃত জানু মিয়ার ছেলে সিরাজ মিয়া ও বকুল মিয়া ওই জমি তাঁদের ব্যক্তিমালিকানাধীন বলে দাবি করেন এবং পরিবারগুলোকে উঠে যেতে বলেন। এ অবস্থায় পরিবারের পক্ষ থেকে সুনীল রবিদাস জেলা প্রশাসকের কাছে একটি অভিযোগ করেন। এর জেরে সিরাজ মিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমে গত বৃহস্পতিবার সুনীল রবিদাসের বাড়িতে হামলা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মারধর করেন। সুনীলের অভিযোগ, হামলাকারীরা কোরবানির চামড়া কেনার জন্য ধার করে আনা ও গচ্ছিত কিছু টাকা লুট করে নিয়ে গেছে। এরপর ঈদের পরদিন পুনরায় হামলা চালিয়ে তিনটি ঘর ভাঙচুর করা হয়। আবার গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে হামলা চালিয়ে অবশিষ্ট দুটি ঘরও গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ পরিবারের সদস্যদের মারধর করে উচ্ছেদ করা হয়। ফলে পরিবারের নারী, শিশুসহ ২২ জন সদস্য এখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন।


গতকাল বিকেলে সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, জালশুকা বাজারসংলগ্ন রেললাইনের পাশে একটুকরা বিধ্বস্ত জমি। গুঁড়িয়ে দেওয়া ঘরের মোচড়ানো টিন পড়ে আছে। হাঁড়িতে রান্না করা ভাত-তরকারি ছিটানো। ভাঙা চৌকি, খাটের পাশে বিছানার তোশক, কাপড়চোপড় মাটিতে মিশে আছে। পাশে খেতে জমে থাকা পানিতে আসবাব পড়ে আছে। এর পাশে মাথায় হাত দিয়ে কান্না করছিলেন বৃদ্ধা চম্পা রবিদাস। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনীল রবিদাস বিবর্ণ মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। পরিচয় দিয়ে কারা এ রকম করল, জিজ্ঞেস করলে তিনি কেঁদে ওঠেন। জানান, এই জায়গায় তাঁরা বহু বছর ধরে বসবাস করছেন। সম্প্রতি সিরাজ মিয়া জায়গাটি দখল করে নিতেই এই তাণ্ডব চালিয়েছেন। তিনি বলেন, 


‘বাবু, এখন আমরা কই যাইয়াম, কই থাকবাম, কই বিচার দিয়াম? আমরার কোনোখানে জায়গা নাই। দুপুরে সেনাবাহিনী আইয়া দেইখ্খা গেছে। ভূমি অফিস থাইক্কা নায়েব সাহেবও আইছিলেন। বলছে, ব্যবস্থা একটা হইব। কিন্তু যারা আমরারে এই অবস্থা করল, তাদের কী বিচার হইব?’


হামলা চালিয়ে পাঁচটি ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ পরিবারের সদস্যদের মারধর করে উচ্ছেদ করায় নারী, শিশুসহ ২২ জন সদস্য এখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন, ছবি: প্রথম আলো
হামলা চালিয়ে পাঁচটি ঘর গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ পরিবারের সদস্যদের মারধর করে উচ্ছেদ করায় নারী, শিশুসহ ২২ জন সদস্য এখন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন, ছবি: প্রথম আলো


জানতে চাইলে সিরাজ মিয়া বলেন, 


‘জায়গাটি আমাদের। আমার বাবা এই পরিবারগুলোকে থাকতে দিয়েছিলেন। এখন এই জায়গা আমাদের দরকার। আর তাঁদের মারধর করা হয়নি। তাঁরা জায়গা না ছাড়ায় কিছু লোক রাগান্বিত হয়ে বাড়িঘর ভেঙেছে।’


পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রেজওয়ানা কবির বলেন, 


‘খবর পেয়ে আমরা বিশকাকুনি ইউনিয়নের তহসিলদারকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম। জমিটি ব্যক্তিমালিকানাধীন নয়, খাস খতিয়ানভুক্ত। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করে এই পরিবারগুলোর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে।’



আজ বুধবার সকালে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুখময় সরকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি অসহায় পরিবারের মধ্যে খাদ্যসহায়তা প্রদান করেন, ছবি: প্রথম আলো
আজ বুধবার সকালে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুখময় সরকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি অসহায় পরিবারের মধ্যে খাদ্যসহায়তা প্রদান করেন, ছবি: প্রথম আলো



জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, 


‘বিষয়টি আগে আমার জানা ছিল না। মঙ্গলবার রাতে জানার পর বুধবার সকালে কার্যালয় থেকে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে কর্মকর্তাদের ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। পরিবারগুলোকে কিছু আর্থিক সহযোগিতাসহ প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করা হবে। দুর্বৃত্তদের আইনের আওতায় আনা হবে।’


সূত্র: প্রথমআলো

Post a Comment

0 Comments