নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কার দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল সে বিষয়ে 'সত্যান্বেষী' কর্তৃক বিশ্লেষণ

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় কার দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল সে বিষয়ে 'সত্যান্বেষী' কর্তৃক বিশ্লেষণ

 নালন্দা কে ধ্বংস করেছিলো ?

Author - সত্যান্বেষী, November 30, 2024


আধুনিক যুগের ভারতের ইতিহাস চর্চার প্রায় পুরোটাই শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনে। প্রাচীন পুরাণগুলিতে ইতিহাসের উপাদানের উপস্থিতির সম্ভাবনা সেই সময়ে বাতিল হয়ে যায়। নালন্দা মধ্যযুগের ইতিহাসের মধ্যে পড়ে। এর সমৃদ্ধি গুপ্ত ও পালযুগে হয়েছিল। তুর্কি আক্রমণে এর সমাপ্তি হয়, এমনটাই ইতিহাসে বলা হয়েছে। নালন্দায় আর্কিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার যে ফলক রয়েছে সেখানে ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ারকে নালন্দার ধ্বংসের জন্য দায়ী করা হয়েছে। ঐতিহাসিকেরা তাঁদের লেখাতেও তেমনটাই জানিয়েছেন। যেমন সতীশ চন্দ্র লিখেছেন ২০০৭ সালে,


'A Khalji officer, Bakhtiyar Khalji, whose uncle had fought the battle of Tarain, had been appointed in charge of some area beyond Benaras. He had taken advantage of this to make frequent raids into Bihar, which was at that time in the nature of no-man's land. During these raids, he had attacked and destroyed some of the famous Buddhist monasteries of Bihar, Nalanda and Vikramshila, which had no protector left'

History of Medieval India, S. Chandra, 2007


২০০৬ সালের ইতিহাস কংগ্রেস-এ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডি এন ঝা 'Society and Culture in northern India in the twelfth Century' নামে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেখানে তিনি বখতিয়ার খলজি দ্বারা নালন্দা ধ্বংস হয় নি বলে মন্তব্য করেন। এরপরে কিছু ইতিহাসবিদদের মধ্যে এই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। অরুণ শৌরী ২০১৪ সালে একটি প্রবন্ধ লিখলেন 'How History was made up at Nalanda' নামে, যেখানে মুসলমান আক্রমণকে অস্বীকার করে নালন্দার ইতিহাস নতুন করে লেখার এক ষড়যন্ত্রের কথা বললেন। ডি এন ঝা এই প্রবন্ধের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে আবার লিখলেন কিছু কথা। এই নিয়ে ইতিহাস মহলে নতুন এক বিতর্কের জন্ম হল।


দুপক্ষের বক্তব্যের সারবত্ত্বা নিয়ে কথা বলার আগে একটি কথা জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। যে তুর্কি/আফগানি ব্যক্তি নালন্দা সহ নওদীয়া (লক্ষ্মণসেনের দুর্গ) আক্রমণের সাথে জড়িত, তাঁর প্রকৃত নাম 'বখতিয়ার' নয়। তাঁর নাম ইখতিয়ার। বখতিয়ার হল তাঁর পিতার নাম। 'বিন বখতিয়ার' হল 'son of Bakhtiyar'। তাঁর পুরো নাম হল 'Ikhtiyar Uddin Muhammad Bin (s/o) Bakhtiyar'। মেজর এইচ জি রেভার্টি ১৮৭৩ সালের অনুবাদে 'বিন' অংশটি উল্লেখ না করায় (পৃঃ ৫৪৯) বখতিয়ার নামেই তিনি পরিচিত হয়ে যান। এই অংশের শিরোনামে বখতিয়ারের পুত্র মোহম্মদ বলে অভিহিত করলেও আলোচনায় কয়েকবার 'মোহম্মদ-ই-বখতিয়ার' বলেছিলেন রেভার্টি।


ইখতিয়ার উদ্দীন বিন বখতিয়ারের মগধ ও গৌড় (লক্ষ্মণাবতী) আক্রমনের বর্ণনা পাওয়া যায় মিনহাজ-ই-সিরাজ রচিত 'তবকাত-ই- নাসিরী' নামক গ্রন্থ থেকে। মিনহাজ ১১৯৩ সালে জন্মেছিলেন। ৩৪ বছর বয়সে ভারতে আসেন। দিল্লির সুলতান ইলতুতমিসের শাসনকালে দিল্লি আসেন এবং কাজী ও সদর-ই-জাহান হয়েছিলেন। নাসিরুদ্দীন মাহমুদের আমলে গ্রন্থটি লিখেছিলেন। মিনহাজ স্বয়ং বাংলায় এসেছিলেন এবং দুই বছর এখানে থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন।


মিনহাজের লিখিত বই, যেটি তিনি সুলতান নাসিরের নামে উৎসর্গ করেছিলেন, অনুবাদ করেন মেজর রেভার্টি ১৮৭৩ সালে। যেহেতু ইনি 'বখতিয়ার' নামেই বিখ্যাত হয়ে রয়েছেন তাই আলোচনার সুবিধার্থে সেই নামেই চিহ্নিত করা হল তাঁকে।


বখতিয়ার খলজির সৈন্যদলে ফরগনার দুই ভাই ছিলেন। একজনের নাম নিজাম উদ্দীন এবং অপরজন সমসাম উদ্দীন। এই সমসাম উদ্দীনের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল মিনহাজের, বখতিয়ারের মগধ আক্রমণের ৪০ বছর বাদে ৬৪১ হিজরীতে। তার মুখ থেকেই কাহিনি শুনেছিলেন মিনহাজ।


রেভার্টির অনুবাদটি প্রকাশিত হল ১৮৭৩ সালে। তিনি লিখলেন,


 '... that he advanced to the gateway of the fortress of Bihar with hundred horsemen in defensive armour, and suddenly attacked the place.... they captured the fortress and acquired great booty. The greater number of the inhabitants of that place were Brahmans, and the whole of those Brahmans had their heads shaven; and they were slain. There were a great number of books there; and when all those book came under the observation of the musalmans, they summoned a number of Hindus that they might give them information respecting the import of those books; but the whole of the Hindus had been killed. On becoming acquired it was found that the whole of that fortress and city was a college and in the Hindui tongue, they call a college Bihar'.

- 'The Tabaqat I Nasiri' of Minhaj I Siraj; Major H. G. Raverty


বাংলাদেশের ঐতিহাসিক হলেন আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া। তিনি ইংরেজি থেকে নয়, বরং ফারসি থেকেই অনুবাদ করেছেন 'তবকাত-ই-নাসিরী' ১৯৮৩ সালে। তিনি লিখেছেন,


"দুইশত সশস্ত্র অশ্বারোহী সৈন্যসহ তিনি (বখতিয়ার) বিহার দুর্গাভিমুখে যাত্রা করেন ও অতর্কিতে আক্রমণ করেন।... দুর্গদ্বারে উপস্থিত হবার পর প্রবল আক্রমণ শুরু হল। স্বীয় শক্তি ও সাহসের বলে এই দুর্গদ্বার ভেদ করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তার সৈন্যদল দুর্গ অধিকার করে ও অনেক দ্রব্য লুণ্ঠন করে হস্তগত করে। এ স্থানের অধিকাংশ অধিবাসী ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁদের মস্তক মুণ্ডিত ছিল। তাঁদের সকলকেই হত্যা করা হয়েছিল"।


মিনহাজের এই বর্ণনাটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। আরো পরিষ্কারভাবে বললে বখতিয়ার 'বিহার' দুর্গ বলে কোনটি দখল করে সকলকে হত্যা করেছিলেন, সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক একে নালন্দা বলে চিহ্নিত করলেও ডি এন ঝা একে 'ওদন্তপুরী' বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। ওদন্তপুরী হল বর্তমানের বিহার শরীফ। ঝা-এর সমর্থকেরা বলতে চেয়েছেন যে বখতিয়ার ওদন্তপুরী এবং বিক্রমশীল নষ্ট করলেও নালন্দার ক্ষতি করেন নি।


যুক্তি হিসেবে তাঁরা ধর্মস্বামিন বা ধর্মস্বামী কথিত 'নাম থর'-এর কথা বলেন। তিব্বতীয় শ্রমণ ছোইজে পাল (Chos-rje-dpal)-এর নাম হল ধর্মস্বামিন (১১৯৭-১২৬৪) যিনি নালন্দায় এসেছিলেন ১২৩৫ সালের এপ্রিলে। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন শিষ্য ছোই পাল দারপ্যাং-কে। শিষ্য লেখেন 'নাম থর (rnam-thar)', যার অর্থ জীবনকথা। রাহুল সাংকৃত্যায়ন তিব্বত ভ্রমণকালে ১৯৩৬ সালে দারপ্যাং-এর পাণ্ডুলিপিটি পেয়েছিলেন। গ্রন্থটির পুরো নাম হল, 'চাগ বংশীয় অনুবাদক গুরু ধর্মস্বামীর জীবনী'।


ধর্মস্বামী ১২৩৪ সালের এপ্রিলে মিথিলা থেকে গঙ্গা পার হয়ে মগধে পৌঁছান। বোধগয়াতে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত থাকেন। ১২৩৫ সালের জানুয়ারীতে রাজগৃহে আসেন। এপ্রিলে যান নালন্দায়। মে বা জুন মাসে ফেরেন মিথিলায়। এই সময়ে মিথিলা বা তিরহুতের রাজা ছিলেন কর্ণাট বংশীয় রামসিংহ (১২২৭-৮৫) এবং মগধের রাজা বুদ্ধসেন। ... তবে এই রাজাদের ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ। আফগানেরা যথেচ্ছ লুঠতরাজ চালাত সেখানে।


ধর্মস্বামী জানিয়েছেন যে সেই সময়ে নালন্দার অধ্যক্ষ রাহুলশ্রীভদ্রের সাথে কিছুকাল তিনি অতিবাহিত করেছিলেন। খসর্পণ লোকেশ্বর, মঞ্জুশ্রী, জ্ঞাননাথ ও তারা, এই চারটি দেবতার পূজা সেই সময়ে নালন্দায় হত। যেহেতু বখতিয়ার খলজি তিব্বত আক্রমণ করে ফেরার পরেই মারা যান ১২০৬ সালে এবং তার প্রায় ৩০ বছর বাদে ধর্মস্বামী নালন্দায় বাস করেছিলেন, তাই বখতিয়ারের দ্বারা নালন্দা ধ্বংস হতে পারে না, এটি যুক্তি স্বরূপ প্রদান করা হয়।


দ্বিতীয় প্রমাণস্বরূপ বলা হয় যে তারানাথের বর্ণনায় রাহুলশ্রীর পরে নালন্দায় আচার্য হয়েছিলেন ভূমিশ্রীভদ্র এবং তারপরে উপায়শ্রীভদ্র। আবার তারানাথ (অধ্যায় ৩৭) জানিয়েছেন, ভাঙ্গল (বঙ্গাল?) অঞ্চলের রাজা চঙ্গলরাজ/চিঙ্গলরাজ শক্তিশালী হন। হিন্দুদের একত্রিত করেন। প্রথম জীবনে হিন্দু হলেও রানির প্রভাবে বৌদ্ধধর্মে আস্থা আসে। তুরুস্কদের হাতে নষ্ট হওয়া নয়তলা 'গণ্ডোলা'-র চারতলা তিনি নির্মাণ করে দেন। তিনি নালন্দার মন্দিরে অনেক দান করেছিলেন, যদিও নতুন কিছু স্থাপন করেন নি।


মঙ্গোলিয় সুমপা খনপো ইয়েশো পালজোর ১৭৪৮ সালে লেখেন 'পাগ সাম জোন জাং'। এতে বলা হয়েছে যে কাশ্মীরের বৌদ্ধ সন্ন্যাসী শাক্যশ্রীভদ্র (১১২৭-১২২৫) মগধে এসে ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীল ধ্বংসপ্রাপ্ত দেখে বরেন্দ্র অঞ্চলের জগদ্দলে চলে যান। সেখানে শুভকরগুপ্তের কাছে তিনবছর শিক্ষাগ্রহণ করেন।


'পাগ সাম...'-এর অপর একটি তথ্যের উপরে জোর দেওয়া হয়। সেখানে বলা হয়েছে নালন্দার গ্রন্থাগার এলাকাটির নাম ছিল ধর্মগঞ্জ। তাতে তিনটি বহুতল ছিল। রত্নসাগর, রত্নোদধি ও রত্নরঞ্জক। তুরুস্কদের আক্রমণে নালন্দার চৈত্য ও বিহারগুলির যে ক্ষতি হয়েছিল, তা মুদিতভদ্র নামক ভিক্ষু মেরামত করে নেন। এর কিছুদিন বাদে মগধের রাজার মন্ত্রী কুকুটসিদ্ধ নালন্দায় মন্দির নির্মাণ করান। ঐ মন্দিরের উদঘাটন চলার সময়ে দুজন তীর্থিকের (হিন্দু সাধু বলে অনুবাদ করলেও তা এপেন্ডিক্স অনুযায়ী ভুল , কেননা তীর্থক বা তীর্থংকর মূলত জৈনদের সাধুদের বলে, হিন্দুদের না । মূল ও এপেন্ডিক্সের এই বিরোধ খেয়াল না করে ডিএন ঝা ও তার অনুগামী অধুনা অমর্ত্যসেন পর্যন্ত এই ভুলই কপিপেস্ট করে গিয়েছেন) গায়ে নোংরা নর্দমার জলছিটিয়ে দেয় কয়েকজন অল্পবয়স্ক বৌদ্ধ ভিক্ষু। এতে রুষ্ট হয়ে একজন ১২ বছর সূর্যদেবের তপস্যা করে একটি যজ্ঞের আয়োজন করে সমিধ ও ভস্ম ছিটিয়ে দিলে বিহারে আগুন লেগে যায়। ধর্মগঞ্জের তিনটি ভবনে আগুন লাগে। অলৌকিক জলধারা পুঁথিগুলিকে রক্ষা করে। রাজার ভয়ে পালাতে গিয়ে দুই তীর্থিক আগুনে পুড়ে মারা যায়।


এই ঘটনাটি উল্লেখ করে নালন্দায় আগুন লাগানোর দায় ব্রাহ্মণ সাধুর উপর ন্যস্ত করা হয়েছে।


 আমাদের বক্তব্য


আমাদের সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার আগে আমরা কয়েকটি তথ্য দেখে নেবোঃ


১। পাগ সাম জোন জাং -এ পরিষ্কারভাবেই বলা হয়েছে যে নালন্দার গ্রন্থাগারের পুঁথিগুলি রক্ষা পেয়েছিল। তীর্থিকেরা আগুন ছুঁড়েছিল বটে, তবে অলৌকিকভাবে গ্রন্থগুলি রক্ষা পায়। অলৌকিক জলের বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে আমরা পুঁথিগুলির রক্ষা পাওয়ার উপরে জোর দিতে চাই। যে দুই তীর্থিক আগুন লাগিয়েছিল তারা সেই আগুনেই মারা যান। দুজন সাধুর পক্ষে নালন্দা ধ্বংস করা যে সম্ভব নয়, সেটি একজন শিশুও বুঝতে পারবে, যদি সে নালন্দার খনন করা ধ্বংসাবশেষ দেখে থাকে। উপরন্তু কয়েকটি পুঁথিতে কেবল আগুন লাগাতে সক্ষম হয়েছিল তাঁরা। নালন্দার বিহারগুলি আক্রান্ত হয় নি।


২। পাগ সাম...-এ প্রথমেই তুরুস্কদের দ্বারা নালন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে মুদিতভদ্র নামক একজন শ্রমণ তা মেরামত করেছিলেন। নালন্দার বিরাট বিরাট চৈত্য ও বিহারগুলি মেরামত করা কি একজন ভিক্ষুর পক্ষে করা সত্যিই সম্ভব? তুরুস্করা যে নালন্দা আক্রমণ করেছিল সে কথা তারানাথের লেখাতেও বলা হয়েছে।


৩। তৃতীয় বিষয়টি হল ধর্মস্বামীর 'নাম-থের'-এর বর্ণনা। সেখানে বলা হয়েছিল যে মগধের রাজা সেই সময়ে বুদ্ধসেন হলেও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ তাঁর তেমন ছিল না। আফগান সেনারা লুঠতরাজ চালাত। এছাড়াও ধর্মস্বামী নালন্দায় আসার পরে কি হয়েছিল তার বিস্তারিত বর্ণনাও রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে,


নালন্দার ৭টি চৈত্য এবং ১৪টি বিহারের অধিকাংশই তখন ব্যবহারযোগ্য ছিল না। (আমরা মনে রাখব যে এই ৭+১৪ = ২১টি স্থাপত্যের মধ্যে ১৪টি আবিস্কৃত হয়েছে প্রত্নবিভাগের দ্বারা। অর্থাৎ বাকি ৭টি একেবারে ধূলায় মিশে গিয়েছে)। কয়েকটি আফগান সেনাদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত। (এই পয়েন্টটি আমরা বিবেচনায় রাখব। বখতিয়ার ছিলেন আফগানিস্তানের গরমশির অঞ্চলের মানুষ। তাঁর বাহিনীকে তুর্কি এবং/বা আফগান, উভয়ভাবেই বর্ণনা করা হয়েছে)। কেবল ২টি ছিল ব্যবহারযোগ্য (অর্থাৎ ২১টি স্থাপত্য বা ১৪টি বিহারের মধ্যে মাত্র দুটি ছিল ব্যবহারযোগ্য। অর্থাৎ ১২ টি বিহার নষ্ট করা হয়েছিল) ছিল ধর্মস্বামীর সময়ে (১২৩৫ সালে)। আচার্য রাহুলশ্রীভদ্রের কাছে ৭০ জন ভিক্ষু শিক্ষালাভ করতেন (যে নালন্দায় একসময় কয়েক হাজার ছাত্র ছিল, সেখানে ধর্মস্বামীর সময়ে ছাত্র সংখ্যা মাত্র ৭০ জন)। মগধের রাজা বুদ্ধসেন গুরু রাহুলশ্রীভদ্রকে মশারি সমেত রত্নখোচিত বিছানা, হাতপাখা ও মশা তাড়ানোর ধুপদানী দান করেছিলেন। ভিক্ষুদের খরচ চালাতেন ওদন্তপুরীর জয়দেব। ধর্মস্বামী থাকাকালীন জয়দেব ও তাঁর আত্মীয়কে আফগানরা বন্দি করেছিল ওদন্তপুরীতে। জয়দেব দূত পাঠিয়ে রাহুলশ্রীভদ্রকে নালন্দা আক্রমণের বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। এই সংবাদ পেয়ে ভিক্ষুরা ভয়ে পালিয়ে যান। রাহুলশ্রীভদ্রের বয়স সেই সময়ে ৯০ বছর। তিনি অন্যত্র যেতে রাজি হন নি। ধর্মস্বামী তখন গুরু রাহুলশ্রীকে নিয়ে জ্ঞাননাথ মন্দিরে লুকিয়ে ছিলেন। আফগান সেনারা নালন্দায় এসে লুঠ করার মতো কিছু না পেয়ে ফিরে যায়।


অর্থাৎ ১২৩৫ সাল পর্যন্ত মাঝেমধ্যেই যে আফগান সেনাদের (তাদের ঘাঁটি ছিল ওদন্তপুরী বা বিহার শরীফ) আক্রমণ চলত নালন্দায়। আগেই ১২ টি বিহার নষ্ট হয়েছিল। ধর্মস্বামীর সময়ে নালন্দায় লুঠ করার মতো কিছুই আর অবশিষ্ট ছিল না। রাজা বুদ্ধসেন এতো বড় রাজা ছিলেন না যে নালন্দার পুনর্নির্মাণ করাবেন। সামান্য মশারি, বিছানা, হাতপাখা ইত্যাদি দান করতেন। তাঁর সেনাবাহিনীও এমন ছিল না যে আফগানদের প্রতিহত করবেন। চিঙ্গলরাজার আমলেও নানা দান করা হলেও কোনো বিহার নির্মাণ করা হয় নি। লাগাতার আক্রমণ চলছিল, এদিকে নতুন করে কিছু নির্মাণ করা হচ্ছিল না। ফলে অচিরেই নালন্দা পরিত্যক্ত হয়েছিল।


৪। একথা সত্য যে নালন্দায় আক্রমণ তুর্কি বা আফগানরা শুরু করে নি। এর আগেও পূর্ণবর্মন একবার পুনর্নির্মাণ করেছিলেন। সম্রাট মহীপালও কিছু পুনর্নির্মাণ করান। বিরোধী শক্তির দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যান্য রাজারা নালন্দায় পুনর্নির্মাণ করে দিতেন। কিন্তু তুর্কিদের আক্রমণের পরে নির্মাণের কাজ আর হয় নি।


৫। কাশ্মীরের বৌদ্ধ শ্রমণ শাক্যশ্রীভদ্রের কথা বলা হয়েছে। তিনি মগধে এসে ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীলকে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেখে বরেন্দ্রীতে জগদ্দল বিহারে চলে যান শিক্ষাগ্রহণ করতে। এই তথ্য দিয়ে বলা হয় যে নালন্দা ধ্বংসের কথা সেখানে উল্লেখ করা হয় নি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে নালন্দার মতন এমন জগতবিখ্যাত স্থান থাকতে তিনি জগদ্দলে কেন যাবেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে জগদ্দল নালন্দার থেকে অনেক কম মর্যাদার। আমরা ধরে নিতে পারি যে যেভাবে ওদন্তপুরী আফগানদের ঘাটি হয়েছিল বা বিক্রমশীল ধুলোয় মিশে গিয়েছিল, শাক্যশ্রীর সময়ে ততটা খারাপ অবস্থা নালন্দার হয় নি। কিন্তু নালন্দায় বসবাস করে শিক্ষালাভের নিশ্চয়তা (মাঝেমধ্যেই আক্রমণ) ছিল না বলেই শাক্যশ্রী বরেন্দ্রীতে (সেখানে তখনও সেন রাজাদের শাসন) চলে গিয়েছিলেন।


মিনহাজ বর্ণিত 'বিহার' কি নালন্দা?


যোগীন্দ্রনাথ সমাদ্দার 'The Glorious Magadha'-এ বলেছিলেন ১১৯৯ সালেই নালন্দা ধ্বংস হয়েছিল। ধীরজলাল সাঙ্কালিয়া (The University of Nalanda) মিনহাজের বর্ণনাতে নালন্দার কথা নেই বললেও শেষ পর্যন্ত পরোক্ষ প্রমাণ দিয়ে সেটিকে নালন্দাই বলেছিলেন। আধুনিক কিছু ঐতিহাসিক বখতিয়ার আক্রান্ত বিহারটিকে নালন্দা নয় বলতে চেয়েছেন। তাঁদের মতে সেটি ওদন্তপুরী। যেহেতু তারানাথ ওদন্তপুরী ও বিক্রমশীল ধ্বংসের কথা বলেছেন তাই সেটি নালন্দা নয় বলে মনে করা হয়েছে।


মিনহাজের বর্ণনার কয়েকটি বিষয় নিয়ে যে ব্যাখ্যা করা হয় তা নিয়ে আমাদের মনে প্রশ্ন রয়েছে,


১। বখতিয়ার যে আক্রমণ করে বিহারটিকে ধ্বংস করেছিলেন, এমন কথা একেবারেই বলা হয় নি। বলা হয়েছে 'দুর্গ' ভেদ করে তাঁর সৈন্য প্রবেশ করেন, অবাধে লুণ্ঠন করেন এবং ভেতরের সকল মুণ্ডিত মস্তক ব্রাহ্মণদের হত্যা করেন। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে নালন্দাও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় নি সেই সময়ে (১১৯৯-১২০৬)।


২। বখতিয়ার ওদন্তপুরী দখল করে সেখানেই ঘাঁটি করেছিলেন। তুর্কি-আফগানদের ঘাঁটি সেখানেই ছিল তাঁর মৃত্যুর পরেও। কিন্তু মিনহাজ যে দুর্গটির (বিহার) কথা বলেছেন, সেখানে দখল করে আফগানদের ঘাঁটি হওয়ার কথা বলা হয় নি।


৩। মিনহাজ বলেছিলেন সেই দুর্গে (বিহার) অনেক গ্রন্থ ছিল। সেসব গ্রন্থের অর্থ বলার জন্য হিন্দুদের ডাকা হয়। কিন্তু সকল হিন্দুদের (ব্রাহ্মণ) হত্যা করা হয়েছিল বলে অর্থ উদ্ধের জন্য কেউ ছিল না। যদিও ওদন্তপুরী বিহারে পড়াশোনা করা হত, তবু অজস্র গ্রন্থের সম্ভার নালন্দাতেই ছিল। নালন্দার গ্রন্থাগারের খ্যাতি ছিল বিশ্ববিখ্যাত। প্রচুর গ্রন্থের কথা বলায় বখতিয়ারের আক্রান্ত বিহারটি নালন্দা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।


৪। বলা হয়েছে বখতিয়ার নাকি বিহারটিকে দুর্গ ভেবেছিলেন, এর প্রাচীর, দুর্গদ্বার ও সুরক্ষার মাত্রা দেখে। সেই সময়ে নালন্দা ছিল বিশাল এলাকা নিয়ে প্রাচীর ঘেরা এক অঞ্চল। বাইরে থেকে তাকে দুর্গ বলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।


৫। শ্রমণদের 'ব্রাহ্মণ' বলে বর্ণনা। বলা হয়ে থাকে যে বখতিয়ার যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে দুর্গ ভেবেছিলেন ভুল করে, মিনহাজও তেমনি বৌদ্ধ শ্রমণদের ভুল করে 'ব্রাহ্মণ' বলেছিলেন। দুটি বিষয়েই আমাদের বক্তব্য রয়েছে। বখতিয়ার কিছুমাত্র ভুল করেন নি। এমন একেবারেই নয় যে তিনি আচমকাই মগধ আক্রমণ করেছিলেন। মিনহাজের লেখাতেই আছে যে তিনি মানের (পাটনার কাছে) অঞ্চলে দুই বছর ধরে ছিলেন এবং বিহার অঞ্চলে দু'বছর ধরে লুঠতরাজ চালাচ্ছিলেন। তিনি অতুল ঐশ্বর্য্যের খোঁজখবর নিয়েই দু'বছর বাদে বিহার/দুর্গটিকে আক্রমণ করেছিলেন। দু'বছর ধরে বিহার বা মগধে লুঠপাট চালানো বখতিয়ার যে নালন্দাকে ছেড়ে দেওয়ার মানুষ নন (কারণ নালন্দার নানা ঐশ্বর্য্যের যেমন, সোনা, রত্নখচিত মূর্তি ইত্যাদির খ্যাতি ছিল), সেকথা বলাই বাহুল্য।


মিনহাজ ১২২৭ সালে ভারতে এসেছিলেন এবং 'তবকাত ই নাসিরী' রচনা করেন ১২৬০ সালে, অর্থাৎ ৩৩ বছর বাদে। ৩৩ বছর ভারতে বাস করে এবং দুই বছর বাংলায় থেকে মিনহাজ বৌদ্ধ শ্রমণ এবং ব্রাহ্মণের পার্থক্য জানতেন না, এমন হতেই পারে না। আসলে তিনি ভুলবশত নয়, জেনেশুনেই 'ব্রাহ্মণ' শব্দটি লিখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে নালন্দায় কেবলমাত্র বৌদ্ধরাই শিক্ষাগ্রহণে আসতেন না। সবধর্মের মানুষই আসতেন। হিন্দু ব্রাহ্মণেরাও আসতেন। হিন্দুরাও শিক্ষাগ্রহণকালে মুণ্ডিতমস্তক হতেন কয়েকশো বছর আগেও। মাথার পিছনে থাকত শিখা। অর্থাৎ বৌদ্ধশ্রমণ এবং হিন্দু-ব্রাহ্মণ ছাত্র, সকলেই ছিলেন মুণ্ডিত মস্তক নালন্দায় বখতিয়ারের আক্রমণের কালে।


বিক্রমশীল এবং ওদন্তপুরী (এই দুটিই পালসম্রাটদের আমলে স্থাপিত) ছিল বৌদ্ধ বজ্রযান চর্চার কেন্দ্র। ফলে এই দুই কেন্দ্রে মূলত বৌদ্ধরাই শিক্ষা নিতে আসত। অপরদিকে নালন্দা যে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল, সেই বিষয়ে অনেকেই জানিয়েছেন। হিউয়েন সাঙ যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে দেখা যায় যে সেখানে বেদ পড়ানো হত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রও পড়ানো হত।


এমন একটা সম্ভাবনা থেকেই যায় যে মিনহাজ যার থেকে বিহার আক্রমণের কথা শুনেছিলেন (সমসাম উদ্দীন) বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণের পার্থক্য জানত না আক্রমণের সময়ে। হয়তো সে কিছুদিন আগে ভারতে এসেছিল। ভারতের মানুষদের শ্রেণীবিভাগ সম্পর্কে সে ওয়াকিবহাল ছিল না। মিনহাজ তাঁর বর্ণনায় জানিয়েছিলেন যে বিহারটি যে দুর্গ নয়, তা পরে বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু ৪০ বছর বাদে যখন সমসাম উদ্দীন মিনহাজকে বর্ণনা করছেন, তখনও সে বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণে তফাৎ বোঝে না, একথা বিশ্বেয়াসযোগ্য নয়।


অর্থাৎ সমসাম উদ্দীন জেনেশুনেই 'ব্রাহ্মণ' বলেছিলেন এবং মিনহাজ জেনেশুনেই সেকথা লিখেছিলেন। সংখ্যাধিক্য ব্রাহ্মণদের উপস্থিতি কেবলমাত্র নালন্দাতেই হওয়া সম্ভব ছিল সেই সময়ে মগধে। এক্ষেত্রে আক্রমণ যে নালন্দাতেই হয়েছিল সে বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হওয়া যায়।


তুর্কি/আফগান না হলে নালন্দা ধ্বংস করল কারা?


কুকুটসিদ্ধের মন্দির উদঘাটনের সময়ে দুই তীর্থিককে অপমান করার ফলে তারা যে যজ্ঞের আগুন লাগিয়েছিল নালন্দার গ্রন্থাগারে, সেটি যে নালন্দা ধ্বংসের কারণ নয়, সেটি আমরা জেনেছি। যে বিহারে কয়েক হাজার মানুষ (ছাত্র, শিক্ষক মিলিয়ে) থাকত সেখানে দুজন নিরস্ত্র হিন্দু সাধু ধ্বংসলীলা চালালো, এমনটা হতে পারে না। পুষ্যমিত্র বা মিহিরকুলের মতন বৌদ্ধবিদ্বেষী রাজাবা ছিলেন বটে, তবে তারা বখতিয়ারের আগমনের অনেক আগেকার রাজা। বখতিয়ারের আমলে যে নালন্দা চালু ছিল সে বিষয়ে সকলেই নিশ্চিত। মগধ অঞ্চল মুসলিম অধিকারে আসার পরে তেমন কোনো শক্তিশালী হিন্দু রাজার নাম পাওয়া যায় নি, যারা আক্রমণ করেছিলেন। ফলত হিন্দু রাজাদের হাতে নালন্দা ধ্বংসের সম্ভাবনা সেই সময়ে নেই। হিন্দু রাজাদের আক্রমণের যা কিছু ইতিহাস সবই মুসলিম অধিকারের আগের যুগের।


যে সকল ঐতিহাসিকেরা বখতিয়ারের হাতে নালন্দার বিনষ্ট হওয়ার কথা বাতিল করেন, তাঁদের একথা বলার আবশ্যকতা রয়েছে, বিকল্প কার বা কাদের হাতে নালন্দা নষ্ট হয়েছিল। তুরস্কদের বারংবার নালন্দা আক্রমণের কথা বরং পাওয়া যাচ্ছে। ধর্মস্বামীর সময়ে (বখতিয়ারের ৩০-৩৫ বছর বাদে) নালন্দার অধিকাংশ অংশই নষ্ট অবস্থায় ছিল। বাকি দুটি বিহার পরবর্তী আক্রমণে (জয়দেব যেমন একটি আক্রমণের কথা রাহুলশ্রীভদ্রকে জানিয়েছিলেন) বাকিগুলিও নষ্ট হয়ে যায়।


 

নালন্দা থেকে মানের দূরত্ব ম্যাপ

মানের থেকে বিহার শরীফের দূরত্ব = ৯৫ কি.মি.

মানের থেকে নালন্দার দূরত্ব = ১০৬ কি.মি.

নালন্দা থেকে বিহার শরীফের দূরত্ব = ১২ কি.মি.


 

"তিনি (বখতিয়ার) মানের ও বিহার অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করেন এবং অনেক লুণ্ঠিত দ্রব্য তিনি হস্তগত করেন এবং তাতে অশ্ব, যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্যসহ সম্পূর্ণ উপকরণ তাঁর অধিকারে আসে। তাঁর বীরত্ব এবং লুণ্ঠিত দ্রব্যের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।... তাঁর সংবাদ সুলতান কুতব-উদ-দীনের দরবারে পৌঁছলে তিনি তাঁকে একটি সম্মালূচক পরিচ্ছদ প্রেরণ ও প্রচুর সম্মান প্রদান করেন। এই সম্মান ও সমর্থন লাভ করে তিনি বিহার অভিমুখে সৈন্য পরিচালনা করেন এবং সে রাজ্য লুণ্ঠন করেন। দুই এক বৎসর তিনি ঐ অঞ্চল ও রাজ্যের মধ্যে আক্রমণ চালালেন ও বিহার অবরোধের প্রস্তুতি চালালেন'।

- বকাত-ই-নাসিরী, অনুবাদক যাকারিয়া


মানের অঞ্চলে ঘাঁটি করে বখতিয়ার প্রায় দুই বছর ছিলেন এবং আশেপাশের সমগ্র অঞ্চলে লুঠপাঠ চালিয়েছিলেন। মানের থেকে ওদন্তপুরী (বিহার শরীফ) যতদূর, নালন্দাও প্রায় তাই। উপরন্তু নালন্দা ও ওদন্তপুরী নিকটবর্তী অঞ্চল। বখতিয়ার মানের থেকে ওদন্তপুরী এলেন (৯৫ কিমি), অথচ খুব কাছেই নালন্দায় এলেন না, এমন হতে পারে না। প্রায় ২/৩ বর্গকিমি এলাকা জুড়ে নালন্দা বখতিয়ারের নজর এড়িয়ে যেতে পারেই না। নালন্দায় প্রায় ১৬০০ বছর ধরে নানা দেশের ও রাজ্যের রাজা, ধনী ব্যক্তিদের মূল্যবান দানের সামগ্রী জমায়েত হয়েছিল। আজকের ভারতের তিরুপতি জাতীয় মন্দিরের সম্পদের পরিমাণ আমরা অনুমান করি। ধর্মস্থানে সাধারণ মানুষেরাও দান করে সাধারণত। দুই বছর ধরে নানান খোঁজখবর নিয়েই বখতিয়ার এই অঞ্চলে লুঠপাট করেছিলেন। বিহার অবরোধের যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বখতিয়ার তা মিনহাজই জানিয়েছেন। হিউয়েন সাঙ এবং ইৎ সিঙ, দুজনের বর্ণনাতেই পাওয়া যায় যে নালন্দা প্রাচীর দ্বারা ঘেরা ছিল। বিশাল নালন্দার এলাকা একটি শহরের মতই বিস্তৃত ছিল। ফলে নালন্দাকে দুর্গ বলে ভুল করার যথেষ্ট সম্ভাবনাও ছিল। ফলত নালন্দা যে বখতিয়ারের আক্রমণের শিকার হয়েছিল সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। পরবর্তী ধারাবাহিক আক্রমণ এবং রাজন্যবর্গের অনুকূলতা না পাওয়া নালন্দাকে একসময়ে নিশ্চিন্ন করে দেয়। মাত্র ৩০ বছরের মধ্যে ধর্মস্বামীর আমলে ১২ টি বিহারের ১০ টি নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা আমরা জেনেছি। টিমটিম করে টিকে থাকা বাকি অংশও ক্রমে হারিয়ে যায়।


মিনহাজ বর্ণিত 'বিহার' যে নালন্দা সেই বিষয়ে আমাদের যুক্তি হল নিম্নরূপ-


  • ১। বখতিয়ার নালন্দাকে দুর্গ মনে করেছিলেন। হিউয়েন সাঙ ও ইৎ সিঙের লেখাতে নালন্দার বিহার যে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল, তা জানা যায়।
  • ২। বখতিয়ার অজস্র বই বা গ্রন্থ দেখেছিলেন বিহারে। নালন্দার বিখ্যাত গ্রন্থাগারের কথা অনেকেই বলেছেন।
  • ৩। 'পাগ সাম...' এবং তারানাথ, উভয় বর্ণনাতেই তুরুস্কদের আক্রমণে নালন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
  • ৪। ধর্মস্বামীর আমলেও বিহার শরীফ বা ওদন্তপুরী থেকে আক্রমণ হত। তার আগেই নালন্দায় ১২টি বিহার অকেজো হয়ে গিয়েছিল।



সূত্র: অগ্নিবীর বাংলা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ