অপারেশন খরচাখাতা: একটি ব্যক্তিগত ডকুফিকশন - মোজাফ্‌ফর হোসেন

অপারেশন খরচাখাতা: একটি ব্যক্তিগত ডকুফিকশন - মোজাফ্‌ফর হোসেন
 


১৩ই জুন : এই রকম বিশ্বাসঘাতকার ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে?

---------------------------------------------

১৩ই জুন। দেশজুড়ে তখন যুদ্ধের উত্তেজনা, যুদ্ধের আতঙ্ক। চারিদিকে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। হিন্দুদের কোথাও ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে ভয়ে শঙ্কায় খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে সৈয়দপুরে আটকা পড়া হিন্দু ও মাড়োয়ারি পরিবারগুলোর। কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না বাড়ির শিশুরা। আতঙ্কে কেউ কারো মুখের দিকে যেন তাকাতে পারছে না। চারিদিকে পাকিস্তানি সৈন্য, বিহারি এবং বাঙালি দোসর। বিহারি বাড়িগুলোর উপরে পতপত করে উড়ছে পাকিস্তানি পতাকা। হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের সামনে মিথ্যা আশ্বাসটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। মেয়েগুলো ঘরের কোণে জড়সড়, শিশুরা গৃহবন্দী, বাবা ও মায়েরা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে হার্টবিট সচল রাখার জোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিভাবে শেষ চেষ্টা করবে সেই চিন্তায় ব্যাকুল পরিবারের যুবকরা। 


এই নিশ্চিত দুর্যোগের মধ্যে ‘ত্রাতা’ হয়ে এলো বিহারি লোকজন ও তাদের বাঙালি দোসররা। সঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যও আছে। তাদের মানবিক আচরণে, চমৎকার কথায় শুকনো প্রাণে স্বপ্ন জেগে ওঠে আটকেপড়া মানুষগুলোর। ঘরে ফিরে একজন তার মা আর বোনকে বলে, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নাও। আজ আমাদের মুক্তি। একজন বলে তার বউ-মেয়েকে, আর আমাদের ভয় নেই, এখন ঝটপট গুছিয়ে নাও বহন করার মতো কিছু জামাকাপড় আর দু তিন বেলার মতো খাবার। ঘুড়ি হাতে গৃহবন্দি শিশুকে বুকে তুলে নিয়ে বাবা বলে, কালই আমরা ঘুড়ি উড়াব। শিশুটি আনন্দে লাফিয়ে ওঠে। মায়ের ব্যাগের সঙ্গে জেদ ধরে ঘুড়িটিও সে সঙ্গে নেয়। এক তরুণ যুবা এতদিন পর ভালো করে তার বোনের দিকে তাকায়। আজ তাদের মুক্তি। এখন আর নিজেদের চোখে চোখ রাখতে ভয় করে না ওদের। পাকিস্তানি সৈন্যরা হিন্দু ও মাড়োয়ারিদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দিতে একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। অবিশ্বাস্য শোনালেও বিশ্বাস না করে উপায় নেই। বিহারি ও পাকিস্তানি সৈন্যরা রীতিমতো মাইকিং করে খবরটি জানাচ্ছে। টানা ৫দিন ধরে মাইকিং চলে। নিরাপদে গৃহবন্দিদের ভারতে পৌঁছে দেওয়া হবে। স্বয়ং মানুষরূপে অবতার নেমে এসেছে পৃথিবীতে, হিন্দুপাড়ার মানুষগুলো ভাবে। আনন্দ হয় আবার ভয়ও করে। বাতাসে যে মিশে আছে ভয়ের অক্সিজেন! কিন্তু অবতাররূপী মানুষগুলো বারবার আশ্বস্ত করেছে। মানুষে বিশ্বাস হারানো পাপ। বিপদে মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। ওরা অভয় দিয়েছে। কারো কোনো ক্ষতি হবে। নিরাপদে পৌঁছে দেওয়া হবে সীমান্তে। 


ওদিকে মকছেদ আলীর বউ পারুল জেনে গেছে কিছু একটা। তাঁকে ঘরের মধ্যে আটকে রেখে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে দিয়েছে মকছেদ। মকছেদ বাঙালি হলেও পাকিস্তানি ও বিহারিদের দোসর হিসেবে কাজ করছে। মাড়োয়ারি জয়প্রকাশের ঘনিষ্ট বন্ধু সে। মকছেদ আলীই জয়প্রকাশকে রাজি করিয়েছে পরিবারশুদ্ধ এই ট্রেনে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। কিন্তু মকছেন আলীর বউটা আরেকটু হলেই জয়প্রকাশের পরিবারকে সব জানিয়ে দিত। শেষ মুহূর্তে এসে সবকিছু ভেস্তে যেত। ঠিক সময়মতো পারুলকে তালাবন্দি করেছে মকছেদ। 


সকাল দশটার সময় ট্রেন। এই ট্রেন কোনোভাবেই ফেল করা যাবে না। এই ট্রেনই ওদের নিশ্চিত করবে বেঁচে থাকার লাইসেন্স। সংখ্যায় ওরা ৪৫০ জনের সামান্য বেশি। বেঁচে থাকার পাল্লা যেন পরস্পরের মধ্যে, কে আগে ট্রেনে ওঠে! যদি সকলের জায়গা না হয়, আগেই উঠতে হবে। এক পরিবার আরেক পরিবারকে সহযোগিতা করে বটে কিন্তু কোনোভাবেই কেউ কারো পেছনে পড়তে চায় না। মানুষগুলো আগের রাত থেকেই স্টেশনের দিকে ছুটতে থাকে। শিশুদের সঙ্গে সঙ্গে দুয়েকটি মুরগিও হয়তো কেউ কেউ হাতে নিয়েছে। মনে করে কবুতরের খাঁচাটা ছেড়ে দিয়েছে, কাল থেকে ওরাও মুক্ত। ছেড়ে দিয়েছে গরুর গলার দড়িও, যাতে খাবারের কষ্ট না পায়। মানুষগুলো ছুটে যাচ্ছে আবার মনে করছে, মুরগির খাঁচাটাও খুলে এসেছে তো! ভিটে ছেড়ে যাবে না বলে যে বৃদ্ধ মা বেঁকে বসেছিল, তাকেও জোর করে তুলে নিয়েছে ছেলেরা। বেঁচে থাকলে ভিটে হবে মা। বেঁচে থাকার এতো বড়ো সুযোগ আর আসবে না। মাকে বুঝিয়েছে। যারা খুনি তারাই আজ পালানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই মহত কাজটির পিছনে যারা আছে তাদের মঙ্গল কামনা করে প্রার্থনা করেছে সকলে। 


রাত গড়িয়ে সকাল হয়। মকছেদের বউ পারুল ভেতর থেকে কোনোভাবেই তালাটা ভাঙতে পারে না। বাড়িতে আর কেউ নেয় যে তাকে সহযোগিতা করবে। আছে এক ছেলে, নয়ন, তাও মাত্র ন বছর বয়স। ভেতর থেকে নয়নকে ডাকে পারুল। দরজার ওপাশ থেকে নয়ন সব শোনে, কিছু বোঝে, কিছু সে বোঝে না। তাকে এখন দৌড়ে স্টেশনে যেতে হবে। জয়প্রকাশ কাকাকে বলতে হবে কিছুতেই ট্রেনে যেন না ওঠে ওরা—মা বলে দিয়েছে—একজনও যেন ট্রেনে না ওঠে। জয়প্রকাশ বুদ্ধিমান মানুষ, পারুলের এই বার্তা কোনোভাবে তার কানে পৌঁছালেই হবে। নয়ন এবার এবার বুঝে ফেলে সবটা। পরিস্থিতি যেন মুহূর্তেই ওর বোধ বাড়িয়ে দিগুণ করে দেয়। নয়ন দৌড় দেয়। স্টেশন বাড়ি থেকে অনেকটা পথ দূরে। পায়ে হাঁটার পথ না। নয়ন বুঝতে পারে এখন আর কারো সহযোগিতাও সে নিতে পারবে না। তাকে পৌঁছাতেই হবে, একা। নয়ন দৌড়াতে থাকে মূল পথটা এড়িয়ে। কিছুটা দৌড়ানোর পর স্যান্ডেলটা খুলে ফেলে। আরো জোরে দৌড়াতে হবে তাকে। জয়প্রকাশ কাকার মেয়ে জানভি আর নয়ন এক ক্লাসেই পড়ে। জানভির কথা ওর মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। 


ট্রেনে উঠে বসেছে মানুষগুলো, ঘুমন্ত শিশুরা মায়ের কোলে। ট্রেন কেনো ছাড়ে না? পরস্পরকে এ ছাড়া কোনো প্রশ্ন করে না? অচেনা দেশে কোথায় যাবে, কোথায় উঠবে সেই প্রশ্নটা এখন কারো মনে জাগে না। ট্রেন ছাড়ে না কেন? 


নয়ন ট্রেনের লাইন ধরে দৌড়াতে থাকে। দেখতে পায় দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন। নয়নের পা রক্তাক্ত, উপর থেকে অবশ হয়ে গেছে। তবু দৌড়াতে হবে। আরেকটু দৌড়ালেই পৌঁছে যাবে ট্রেনের কাছে। 


ট্রেনটি চলা শুরু করেছে। নয়নও পৌঁছে গেছে। একপাশে বাবা এবং চেনা আরো দুয়েকজনকে দেখে নয়ন অন্য পাশে সরে যায়। পায়ে হাঁটা গতিতে চলতে থাকা ট্রেনের কাকে কি বলবে কিভাবে বলবে বুঝতে না পেরে ভিড়ের মধ্যে কৌশলে ট্রেনের শেষ বগিতে উঠে পড়ে সে। গতি ততক্ষণে সামান্য বাড়ে। নয়ন ভিড়ের মধ্যে বসে পড়ে হাঁপাতে থাকে। একটু জিরিয়ে নেয় এই ছোট্ট ছেলেটা। 


শরীরের রক্ত চলাচলের মতো ট্রেনটি মানুষগুলোর শিরায় উপশিরা ধরে চলতে থাকে। হার্টবিটের মতো শব্দ করে করে ট্রেনটি চলে। ট্রেন আর মানুষগুলোর হৃদপিণ্ড মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ধীরে চলে ট্রেন। আরো জোরে কেন চলে না? সকলে মনে মনে জোর ধাক্কা লাগায় ট্রেনের চাকায়। 


ট্রেন চলতে থাকে। শিশুরা ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত জেগে বসে থেকে ক্লান্ত মায়েরাও। এই একটা দিন শুধু—প্রার্থনা করছে ভগমানের কাছে। একটা দিন যেন এই ট্রেন আর কোথাও না থামে। কিছুতেই না থামে। এরপর পৃথিবীর সমস্ত ট্রেন থেমে যাক। থেমে যাক চিরতরে। কিন্তু এই একটা ট্রেন এই একটা দিন যেন চলতে থাকে অবিরাম। কিন্তু ট্রেন যে থামাতে হবে, এখনই, নয়ন এবার খুঁজতে থাকে জয়প্রকাশ কাকাকে। ওর চোখ জানভিকে খোঁজে। ট্রেনের গতি বাড়ে। মানুষগুলো একটু একটু করে নিশ্চিন্ত হতে থাকে। যারা যত্ন করে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়েছে, তাদেরকে এরা ঈশ্বর মনে করে। 


কিন্তু ট্রেনটি থেমে যায়, মাইল দুয়েক পরেই। স্টেশনের আগেই গোলাহাটের কাছে এসে ট্রেনটি থেমে পড়ে। একসঙ্গে সবগুলো মানুষ নড়েচড়ে বসে। মুহূর্তেই তাদের মনের মধ্যে টর্নেডো বয়ে যায়! মায়েদের চোখেমুখে অচেনা অজানা আতঙ্ক দেখে শিশুরা ভয়ে গুটিয়ে যায় কোলের মধ্যে। 


কাউকে কি তোলা হবে? তাদেরই মতো হিন্দু বা মাড়োয়ারি কোনো পরিবারকে? বাবারা ভাবে। 


নষ্ট হয়ে গেল ট্রেন? মায়েরা ভাবে।


তারা কি পৌঁছে গেল এতো তাড়াতাড়ি? শিশুরা ভাবে। 


যাক, ট্রেন থেমে গেছে। নয়ন নিশ্চিন্ত হয়। জয়প্রকাশ কাকাতে এতক্ষণে দেখে। পাশেই জানভি। নয়ন জানভির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ট্রেন ছাড়ার সময় বাইরে থেকে ট্রেনের জানালা-দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। জয়প্রকাশ ট্রেনের ছিদ্র দিয়ে বাইরেটা দেখার চেষ্টা করে। 


মা পাঠিয়েছে, নয়ন বলে। জয়প্রকাশ শোনেন কিনা বোঝা যায় না। 


বাইরে তখন অপক্ষো করছে বিহারী ও রাজাকার ইজাহার আহমেদ, বিহারী নেতা কাইয়ুম খান ও বিপুলসংখ্যক বিহারী ও পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈন্য। তাদের হাতে ট্রেনভর্তি মানুষগুলোর স্বপ্ন, বেঁচে থাকা। বাইরের মানুষগুলো বগির দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে। হাতে সবার রামদা। ভারী আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ট্রেনের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতক্ষণে ভেতরের মানুষগুলো টের পায়, হিটলারের গ্যাস চেম্বারের মতো তাদের ট্রেনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে; যেন একজন মাড়োয়ারিও পালাতে না পারে। শুরু হয় রামদা দিয়ে নির্বিচারে কোপানো। কোনো কোনো লাশকে কয়েক টুকরো করে রেললাইনের চারপাশে ছুঁড়ে ফেলা হয়। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ভয়ার্ত শিশুদের, হতবাক মায়েদের। মুহূর্তে মেরে ফেলা হয় প্রায় সাড়ে চারশ মানুষ। বিভৎসতা সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ পাকিস্তানি ও বিহারি ঘাতকদের পা ধরে অনুরোধ করেছিল গুলি করার জন্য। কিন্তু গুলির তো অনেক দাম! মানুষগুলোর জন্য একটা গুলিও খরচ করতে চায়নি ঘাতকরা। প্রায় সাড়ে চারশজনকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে। কোলের শিশু থেকে বৃদ্ধ মা-বাবা কেউই বাদ যায়নি। 


মকছেদ আলী ট্রেনের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরায়। পরিকল্পনাটা এত সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, এটা তার কখনোই মনে হয়নি। সিগারেটটা খুব জোরে একটা টান দিয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ দেয় সে। 


--------------------------------------------------------

[পাকিস্তানিরা এর নাম দিয়েছিল "অপারেশন খরচাখাতা"। আমার কল্পিত চরিত্র ‘নয়ন’ ছাড়া এই ঘটনার একচুলও আমি বানিয়ে বলিনি। নয়নের কিছু করার ছিল না। যা ঘটে গেছে একাত্তরে (ইতিহাসে), তাকে আর ফেরানো যাবে না। কিন্তু বার বার আমি নয়নকে পাঠাবো। নয়নের মধ্য দিয়ে বারবার আমি রক্তাক্ত করব নিজেকে। আমি সেদিনের সেই নির্মম বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হিন্দু বা মাড়োয়ারি পরিবারের কেউ না হতে পারি, কিন্তু একজন নয়ন তো হতে পারি।]


অপারেশন খরচাখাতা: একটি ব্যক্তিগত ডকুফিকশন


লেখা: মোজাফ্‌ফর হোসেন

Repost to remember the DAY


সূত্র: ফেসবুক

----------


গল্পটি যে ঘটনার আলোকে রচিত সেই ঘটনার বিবরণ পড়ুন



আরও পড়ুন...


Post a Comment

0 Comments