১৪৮৬ খৃষ্টাব্দে শ্রীচৈতন্যের জন্ম ও ১৫৩৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর মর্তলীলার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃত প্রভৃতি গ্রন্থগুলি অনুধাবন করলে গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের যে রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়, সেটা শ্রীচৈতন্যের আদর্শে প্রবর্তিত বলে দেখা যায়। শ্রীচৈতন্যের জীবদ্দশাতেই এই নব-বৈষ্ণবধর্মের সঙ্গে বাংলার প্রথম পরিচয় ঘটলেও তাঁর তিরোভাবের পরে সমগ্র বাংলায় এর সম্প্রসারণ এবং বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দার্শনিক ব্যাখ্যায় এর প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। তবে ইতিহাস বলে যে, মূলতঃ শ্রীচৈতন্যের সময় থেকেই এই নব-বৈষ্ণবধর্ম গড়ে উঠলেও বাংলার সঙ্গে বৈষ্ণবধর্মের পরিচয় কিন্তু বহুকালের, এরও অনেক আগেকার ব্যাপার।
বস্তুতঃ গুপ্তযুগ থেকে বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস পাওয়া যায়। সেই সময়ে বাংলায় যে বিষ্ণুপ্রধান বৈষ্ণবধর্মের প্রসার ঘটেছিল, ইতিহাসে সেটার পরিচয় পাওয়া যায়। তবে গুপ্তরাও তাঁদের সঙ্গে করে বৈষ্ণবধর্মকে বাংলায় নিয়ে আসেননি। বাংলায় তাঁদের আগমনের আগেই, আনুমানিক খৃষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর শুশুনিয়া পর্বতলিপিতে চন্দ্রবর্মণকে— চক্রস্বামী বা বিষ্ণুর উপাসক —বলা হয়েছিল বলে দেখা যায়।
বর্তমানের বাংলায় শ্রীকৃষ্ণসম্বন্ধে যেসব পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত রয়েছে, সেইসব কাহিনী যে খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতাব্দী থেকেই বাংলায় প্রচলিত ছিল— পাহাড়পুরের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যই সেকথার ঐতিহাসিক প্রমাণ দেয়। আনুমানিক খৃষ্টীয় একাদশ শতকের বেলাব শিলালেখে শ্রীকৃষ্ণকে— ‘গোপীশতকেলিকার’ —বলে উল্লেখ করা হয়েছিল বলে দেখা যায়; যদিও উক্ত শিলালেখে কৃষ্ণকে একজন অংশাবতারমাত্র বলা হয়েছিল।
সেন বংশের আমলে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের বিশেষ প্রসার ঘটেছিল। রাজা লক্ষ্মণসেন পরমবৈষ্ণব ছিলেন। তাঁর সময় থেকেই রাজকীয় শাসনের শুরুতে শিবের পরিবর্তে বিষ্ণুর স্তবের প্রচলন ঘটেছিল। লক্ষ্মণসেনের সভাকবিরা— জয়দেব, ধোয়ী, উমাপতিধর, শ্রীধর —প্রমুখ তাঁকে স্তুতি করতে গিয়ে শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বলে দেখা যায়। তবে সেই শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন না, তিনি ছিলেন— ‘গোপবধূবীট’। জয়দেবের গীতগোবিন্দ তৎকালীন বৈষ্ণবসমাজে বিশেষভাবে সম্মানিত ও আদৃত হয়েছিল। সেই গীতগোবিন্দে বিষ্ণুর দশ অবতারের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, কালক্রমে সেটাই সমগ্র ভারতে গৃহীত হয়েছিল বলে দেখা যায়।
এভাবেই ধীরে ধীরে বৈষ্ণবধর্ম তখন বাংলায় প্রসারলাভ করেছিল। তবে তখনও পর্যন্ত এই ধর্মকে কেউ দার্শনিক ভিত্তিতে গড়ে তোলবার চেষ্টা করেননি। আচার্য রামানুজ-প্রচারিত— ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’ —থেকেই সর্বপ্রথম বৈষ্ণবধর্মের দার্শনিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। রামানুজ তাঁর পূর্ববর্তীকালের প্রসিদ্ধ প্রায় সব বৈষ্ণব মতকেই গ্রহণ করে নিজের দার্শনিক প্রতিভায় সেটিকে একটি সুস্পষ্ট মতবাদে রূপায়িত করেছিলেন। এর আগে আচার্য শঙ্করের অদ্বৈতবাদ সমগ্র ভারতে যে প্রবল আন্দোলনের সৃষ্টি করেছিল, সেটার ফলে তৎকালীন ভারতের ভক্তিবাদের ভিত্তি টলে গিয়েছিল। তখন শঙ্করের ক্ষুরধার তর্ক-বুদ্ধির সামনে দাঁড়ানোর জন্য অনুরূপ কোন বলিষ্ঠ প্রতিভার প্রযোজন ছিল। সেই প্রয়োজনেই পরবর্তী সময়ে রামানুজাচার্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। রামানুজের পর থেকে দার্শনিক বৈষ্ণব মত নানাভাবে ক্রমশঃ গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। বলাই বাহুল্য যে, আচার্য শঙ্করই সেইসব মতবাদের মুখ্য-প্রতিপক্ষ ছিলেন। বেদান্তের অদ্বৈতবাদের খণ্ডনের উপরেই পরবর্তীকালে মধ্বাচার্য, বল্লভাচার্য প্রমুখ প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবাচার্যদের দার্শনিক মতের প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল।
মধ্বাচার্য রামানুজের কিছু পরবর্তীকালের মানুষ ছিলেন। দার্শনিক ভিত্তির উপরে নিজের মতবাদকে স্থাপন করে তিনি তাঁর দ্বৈতবাদটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্রাক-চৈতন্যযুগে রামানুজ ও মধ্বাচার্য সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলায় যাতায়াত করতেন বলে শোনা যায়। অবশ্য তৎকালীন বাংলায় রামানুজ-সম্প্রদায়ের বৈষ্ণবধর্ম প্রচারের সুস্পষ্ট কোন তথ্য ইতিহাস থেকে পাওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, অতীতে রসিকমোহন বিদ্যাভূষণ তাঁর ‘শ্রীবৈষ্ণব’ নামক গ্রন্থের ৬ নং পৃষ্ঠায় লিখেছিলেন যে, তাঁর ঊর্ধ্বতন দশমপুরুষ হরিচরণ চট্টরাজ রামানুজীয় বৈষ্ণব গুরুর কাছে দীক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এসম্বন্ধে অন্যত্র কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে প্রাক-চৈতন্যযুগে মধ্বাচার্য সম্প্রদায়ভুক্ত বলে কথিত মাধবেন্দ্রপুরীর বাংলায় প্রেম-ভক্তি-প্রচারের কথাও শুনতে পাওয়া যায়—
“ভক্তিরসে আদি মাধবেন্দ্র সুত্রধার।”(চৈতন্যভাগবত, আদিখণ্ড, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত, ১৩৬৯ বঙ্গাব্দ, পৃ- ৬০)
‘বৈষ্ণব-বন্দনা’ গ্রন্থে দেবকীনন্দনও তাঁকেই বাংলায় ভক্তি-পথের ‘প্রথম অবতার’ উপাধিতে আখ্যায়িত করেছিলেন বলে দেখা যায়। আর তাঁর সম্পর্কে কবিরাজ গোস্বামী বলেছিলেন—
“ভক্তি-কল্পতকর তেঁহো প্রথম অঙ্কুর।”(চৈতন্যচরিতামৃত, আদি লীলা, ১ম পরিচ্ছেদ, ডঃ সুকুমার সেন সম্পাদিত, সাহিত্য আকাদেমী সংস্করণ, ১৯৬৩ সাল, পৃ- ৪১)
অদ্বৈত আচার্য, ঈশ্বরপুরী প্রমুখ মাধবেন্দ্রপুরীর কাছে দীক্ষাগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
পরবর্তী সময়ে ভারতে আরেকজন বৈষ্ণবাচার্যের আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁর নাম ছিল— বামানন্দ স্বামী। বামানন্দ মূলতঃ রামানুজ-সম্প্রদায়ের শিষ্য হলেও পরে তিনি একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় সংগঠন করেছিলেন। সেই সম্প্রদায়ের নাম ছিল— ‘রামাইৎ’। রামানন্দের নামানুসারে এটিকে রামানন্দী-সম্প্রদায়ও বলা হত। শ্রীরামচন্দ্র এই সম্প্রদায়ের ইষ্টদেবতা ছিলেন। উত্তরকালে কবির এই রামানন্দেরই শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন।
বৈষ্ণবধর্মের ইতিহাসের সঙ্গে বৈষ্ণব সাহিত্যও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত বলে দেখা যায়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে লক্ষ্মণসেনের মন্ত্রী ও ধর্মাধ্যক্ষ হলায়ুধ— ‘বৈষ্ণবসর্বস্ব’ —নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। (বাংলাদেশের ইতিহাস, পৃ: ৮৯ ও ১৩১) কিন্তু অন্য কেউ এই গ্রন্থের অস্তিত্বের সন্ধান পাননি। তবে লক্ষ্মণসেনের বিশিষ্ট সভাকবি জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দের নাম আগেই বলা হয়েছে; এবং এই গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যের একটি অপরিচ্ছেদ্য সম্পদ। জয়দেবের পরবর্তী সময়ে মৈথিল কবি বিদ্যাপতি বৈষ্ণব পদাবলী এবং বড়ু চণ্ডীদাস— ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ —কাব্য রচনা করেছিলেন। কৃত্তিবাস ওঝা বাংলা ভাষায় যে রামায়ণটি রচনা করেছিলেন, তাতে তিনি তাঁর গ্রন্থের শুরুতেই নারায়ণকেই মূল পুরুষ ধরে তাঁর চার অংশ প্রকাশের কথা বলেছিলেন—
“শ্রীরাম ভরত আর শত্রুঘ্ন লক্ষ্মণ।এক অংশে চারি অংশ হৈলা নারায়ণ॥”(কৃত্তিবাসী রামায়ণ, আদিকাণ্ড, পূর্ণচন্দ্র দে সম্পাদিত, ১৯২৮ সাল, পৃ- ৩)
খৃষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের শেষেরদিকে (১৪১৫ শকাব্দ বা ১৪৯৩ খৃষ্টাব্দ) রামকেলী গ্রামের অধিবাসী কবি চতুর্ভুজ ভট্টাচার্যের— ‘হরিচরিতম’ —নামক মহাকাব্যের নামও এপ্রসঙ্গে করা যেতে পারে। কবি কৃষ্ণচরিত অবলম্বনে ত্রয়োদশ সর্গে সংস্কৃত ভাষায় এই মহাকাব্যটি রচনা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রদত্ত প্রাচীন সংস্কৃত পাণ্ডুলিপির বিবরণীতে (Report on the Search of Sanskrit Mass: 1895-1900, p- 17) প্রথম এই গ্রন্থটির নাম দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। পরে ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নেপাল থেকে এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির একটি প্রতিলিপি সংগ্রহ করেছিলেন, মূল পাণ্ডুলিপিটি নেপালরাজের পুস্তকাগারে সংরক্ষিত ছিল। পরে শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য নেপালে গিয়ে মূল পাণ্ডুলিপির সঙ্গে এই নকল পাণ্ডুলিপিটি মিলিয়ে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরবর্তী সময়ে তাঁরই সম্পাদনায় এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ১৯৬৭ সালে এই মহাকাব্যটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।
শ্রীচৈতন্যের জন্মের অত্যল্পকাল আগে মালাধর বসু— ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ —নামক কাব্যটি রচনা করেছিলেন। প্রাক-চৈতন্যযুগের বৈষ্ণবধর্মের স্বরূপ এই গ্রন্থটি থেকে জানতে পারা যায়। কাজেই বাংলার সংস্কৃতির ইতিহাসে এই গ্রন্থটির একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে।
শেখরের ‘পদ’ থেকে জানা যায় যে, নরহরি সরকার— শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের আগেই ব্রজরস গেয়েছিলেন—
“গৌরাঙ্গ জন্মের আগে বিবিধ রাগিণী রাগেব্রজরস করিলেন গান।হের নরহরিসঙ্গ পাঞাপহুঁ শ্রীগৌরাঙ্গবড় সুখে জুড়াইলা প্রাণ॥”(হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত বৈষ্ণব পদাবলী, সাহিত্য সংসদ সংস্করণ, ১৯৬১ সাল, পৃ- ৩০৩)
এভাবেই প্রাক-চৈতন্যযুগে বাঙালি-মানস সমাজ ও সাহিত্যে বিকশিত হয়ে উঠেছিল বলে ইতিহাসে দেখা যায়।
সূত্র: ফেসবুক
0 মন্তব্যসমূহ