২০২২ সালের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু নির্যাতনের রিপোর্ট প্রকাশ – জাতীয় হিন্দু মহাজোট

বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট গত ০৬/০১/২০২৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে ঢাকা রিপোটার্স ইউনিটির নসরুল হামিদ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদ সম্মেলনে ২০২২ সালে ঘটে যাওয়া হিন্দু নির্যাতনের রিপোর্ট প্রকাশ করে। এই রিপোর্টটির কিয়দংশ আজ প্রকাশ করা হল।


রিপোর্টের লিখিত অংশ তুলে ধরা হলো,

প্রথমে আমাদের সকলকে পরিচয় করিয়ে দেই। লিখিত বক্তব্য পাঠ করছি আমি অ্যাডঃ গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, মহাসচিব বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোট, সাথে আছেন হিন্দু মহাজোটের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডঃ দীনবন্ধু রায়, সিনিয়র সহ সভাপতি ডঃ অচিন্ত কুমার মন্ডল, প্রেসিডিয়াম মেম্বার অভয় কুমার রায়, যুগ্ম মহাসচিব সুজন দে, ডাঃ হেমন্ত দাস, সাংগঠনিক সম্পাদক সুশান্ত কুমার চক্রবর্তী, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক প্রদীপ চন্দ্র চন্দ, দপ্তর সম্পাদক কল্যাণ মন্ডল, হিন্দু মহিলা মহাজোটের সভাপতি অ্যাডভোকেট লাকী বাছাড়, হিন্দু স্বেচ্ছাসেবক মহাজোটের সভাপতি অ্যাডঃ গৌরাঙ্গ মন্ডল, সাধারণ সম্পাদক তোলন চন্দ্র পাল, হিন্দু যুব মহাজোটের সভাপতি প্রদীপ শঙ্কর, নির্বাহী সভাপতি গৌতম সরকার অপু, সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ান মৃণাল মধু, প্রধান সমন্বয়কারী প্রশান্ত হালদার, দপ্তর সম্পাদক রঞ্জন সরকার ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক গোপাল সরকার রোমেল, ছাত্র মহাজোটের সভাপতি সাজেন কৃষ্ণ বল সাধারন সম্পাদক সজিব কুন্ডু, সাংগঠনিক সম্পাদক মলয় কুমার রাহুল, সঞ্জিব বিশ্বাস, পিন্টু লাল দাস, শ্রী কিশোর চন্দ্র দাস, অচিন্ত্য মণ্ডল।


প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,

জানুয়ারী ২০২২ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ ইং তারিখ পর্যন্ত গত এক বছরে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৫৪ জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, হত্যার হুমকী ৮৪৯ জন, হত্যা চেষ্টা ৪২৪ জন, জখম ও আহত করা হয়েছে ৩৬০ জনকে, নিখোঁজ হয়েছে ৬২ জন, চাঁদাবাজী হয়েছে ২৭ কোটি ৪৬ লক্ষ ৩৩ হাজার টাকা, মোট ক্ষতি হয়েছে ২২০ কোটি ৮৯ লক্ষ ৬৫ হাজার ৭০০ টাকা। পরিবার ও মন্দির লুঠ হয়েছে ৩১৯ টি। বসতবাড়ীতে হামলার ঘটনা ঘটেছে ৮৯১টি অগ্নিসংযোগ হয়েছে ৫১৯টি এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ভাংচুর, ১৭৩টি। ভূমি দখল হয়েছে ৮,৯৯৯০ একর ৬৩ শতাংশ, যার মধ্যে, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা সাঁওতাল ও ত্রিপুরা পাহাড়ী আদিবাসীদের ৬৫৫০ একর এবং সমতলের হিন্দুদের ২৪৪০.৬৩ একর শতাংশ। ঘর বাড়ী দখল হয়েছে ৫৭টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ৫০ টি মন্দিরের ভূমি দখল হয়েছে ৫১টির। দখলের তৎপরতা ৯৮৪ একর ১২ শতাংশ। বসত বাড়ী থেকে উচ্ছেদ ৫৭২ টি পরিবার, উচ্ছেদের চেষ্টা ৩৬৯৪ টি পরিবার, উচ্ছেদের হুমকী ৩৫,৮১৮টি পরিবার। দেশত্যাগের বাধ্যকরণ ৪৪৫টি পরিবার। দেশত্যাগে হুমকীর শিকার ১৫১১৫টি পরিবার, নিরাপত্তাহীনতায় ১,৯৫, ৯৯১ টি পরিবার। সংঘবদ্ধ হামলা ৯৫৩টি। মন্দিরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ ১২৮টি, প্রতিমা ভাংচুর ৪৮১টি, প্রতিমা চুরি ৭২টি, অপহরণ করা হয়েছে ১২৭ জনকে অপহরনের চেষ্টা ২৭ জনকে। ৩৯ জনকে ধর্ষন করা হয়েছে, গণধর্ষনের শিকার ২৭ জন। ধর্ষনের পর হত্যা ১৪ জন। ৫৫ জনকে ধর্ষনের চেষ্টা হয়েছে, ১৫২ জনকে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। ধর্মান্তরের চেষ্টা ৪০ জনকে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এর ঘটনা ঘটেছে ১২৭ টি। মিথ্যা মামলায় আসামী, গ্রেফতার, বরখাস্ত, চাকুরীচ্যুত, জেল জরিমানার শিকার ৭৯১ জন, ১৬৫৭ টি পরিবারকে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান অপবিত্রকরণ ১৭৯টি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা ১২৯টি। ধর্মীয় নিষিদ্ধ গরুর মাংস খাইয়ে অপবিত্রকরন ৩৩৩ জন সহ ১টি পরিবারের উপর গোমাংস নিক্ষেপ করে অপবিত্র করা হয়েছে। ২০২২ সালে ১৩১৯টি আলাদা ঘটনা ঘটেছে। উক্ত ঘটনা সমূহে একাধিক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠান, মন্দির ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে; যার সংখ্যা কমপক্ষে ১,৯৫,৯৯১টি এবং ৮৯৯০ একর ৬৩ শতাংশ ভূমি হতে বেদখল করা হয়েছে। এছাড়াও ২০২২ সালের দুর্গাপুজায় ৩৫টি হামলায় ৯১টি প্রতিমা ভাংচুর করা হয়।


প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,

পরিসংখ্যান বলছে দেশে ২০১৩ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন নিপীড়ন বাড়লেও ২০২২ সালে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু নির্যাতন কমেছে। প্রতিমা ভাংচুর, জমি দখল সহ কিছু ক্ষত্রে নির্যাতন কমেছে। আমরা মনে করি মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পুলিশ, প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদেও তৎপরতা ও ত্বরিতগতিতে ব্যবস্থা নেওয়ার কারনেই সংখ্যালঘু নির্যাতন কিছু ক্ষেত্রে কমেছে। সেজন্য আমরা মাননীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সকল স্তরের কর্মকর্তারেকে সাধুবাদ ও ধন্যবাদ জানাই। আমরা মনে করি প্রশাসন বর্তমান অবস্থার মত আন্তরিক ভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করলে সংখ্যালঘু নির্যাতন উল্লেখযোগ্য হারে কমবে।


প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,

বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় কখনোই স্বাধীনতার স্বাদ লাভ করে নাই। স্বাধীনতার পরপরই ঐতিহ্যবাহী রমনা কালি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে; যদিও তা এখন ভারতীয় অর্থে পূনঃ নির্মান হয়েছে। ১৯৭৪ সালে শত্রু সম্পত্তি অর্ডিন্যান্সকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি আইন নামে পাশ করে এদেশের ২৬ লক্ষ একর সম্পত্তি দখল করা হয়েছে। এর পর সংবিধান কেটে ছেঁটে সাম্প্রদায়িকীকরন করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করলেও হিন্দু ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে কাউকে শাস্তি বিধান করা হয় নাই। উপরন্তু ফেসবুক হ্যাক করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শতাধিক হিন্দু যুবককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শত শত ঘরবাড়ী পুড়িয়ে, মঠ মন্দির ধ্বংস করে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে প্রতিনিয়ত হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ২০০১ সালে নির্বাচন পরবর্তী ন্যক্কারজনক সহিংসতা নিয়ে সারা বিশ্বের বিবেকবান মানুষ ধিক্কার জানালেও সেই সমস্ত নির্যাতনকারী অপরাধীদের একজনকেও শাস্তি দেয় নাই বিএনপি সরকার বা বর্তমান সরকার। যে কারণে প্রতিনিয়তই দেশে হিন্দুর সংখ্যা আশঙ্কাজনকহাওে কমছে। সরকারী পরিসংখ্যানে ২০১৫ সালে হিন্দুর সংখ্যা ছিল ১০.৭% কিন্তু ২০২২ সালের পরিসংখ্যানে তা দাঁড়ায় ৭.৯%। যদিও হিন্দু সম্প্রদায় পরিসংখ্যান শুদ্ধ মনে করে না। হিন্দু সম্প্রদায় মনে কওে বাংলাদেশে এখনো হিন্দু সংখ্যা ১৫% এর অধিক। সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নিপিড়ন বন্ধে এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘদিন যাবৎ জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূনঃ প্রতিষ্ঠা এবং একটি সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার দাবী করেছে। উক্ত দাবী দাওয়া বাস্তবায়নের দাবীতে হিন্দু সম্প্রদায় সারা দেশে ব্যাপকভাবে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বেদনার বিষয় সরকার দাবী দুটির প্রতি কর্ণপাত করে নাই। যে কারনে দিন দিন হিন্দু সংখ্যা কমে যাচ্ছে।


প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,

এমতাবস্থায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় আপনাদের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে-

১। হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর সহিংসতা ও নির্যাতন নিরোধ কল্পে এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত করতে জাতীয় সংসদে ৬০টি সংরক্ষিত আসন ও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা পূণঃ প্রতিষ্ঠা।

2। সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা।

৩। একটি উপ-রাষ্ট্রপতি ও উপ- প্রধানমন্ত্রীর পদ সৃষ্টি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত রাখার দাবী জানাচ্ছে।


হিন্দু সম্প্রদায় আশা করে উপরোক্ত ৩ টি দাবীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে সরকার আগামী অধিবেশনে বিল পাশ করে এদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের দীর্ঘদিনের আশা আকাঙ্খা পুরন করবে।


বক্তব্যটি উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক।


এ্ই রিপোর্টের সংশোধনী পড়ুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ