গগন হরকরার 'আমি কোথায় পাব তারে' গানের সুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সঙ্গীতের সুর চুরি করেছিলেন কী?

রবীন্দ্রনাথের ঢাবি বিরোধীতা

বাংলাদেশের মানুষজন পড়াশোনা থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন আর গুজবসম্রাট তার প্রমাণ পাওয়া যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তারই একটা সাম্প্রতিকতম প্রমাণ "গগন হরকরার আমি কোথায় পাব তারে গানের সুর থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয় সঙ্গীতের সুর চুরি করেছিলেন" এই জাতীয় প্রোপাগাণ্ডা। স্বাভাবিকভাবেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী সাহিত্যিক যিনি কিনা পৃথিবীর ইতিহাসের ই অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তাঁর নাম "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর", এই অলঙ্ঘনীয় সত্যের ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে রাতের পর রাত ক্রন্দনরত নির্ঘুম রজনী পারি দেয়া সহজ বিষয় নয়।

কিন্তু কে এই গগন হরকরা? কবিগুরু তাঁর সুর চুরি করেন নি, বরং নিতান্তই গ্রামীণ এক ডাকঘরের হরকরাকে নিজ উদ্যোগে সাহিত্য জগতে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, তার মেধা ও গুণকে মূল্যায়ন করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ না চাইলে আপনি আমি কখনও শুনতাম ই না তার নাম।

গগন হরকরার আসল নাম গগনচন্দ্র ড্যাম, তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদহের এক পোস্ট অফিসের ডাক হরকরা বা ডাকপিয়ন ছিলেন যিনি চিঠি বিলি করতেন। ছিলেন লালন ফকিরের একনিষ্ঠ ভক্ত ও বাউল গায়ক। গগন হরকরার জীবনের ছায়া অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন ডাকঘর নাটকটি, নাটকের গগেন্দ্রনাথ ঠাকুর চরিত্রটি মূলত গগন হরকরা। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে নিয়মিত জমিদারী দেখাশোনা করতে যেতেন। তখন শিলাইদহে তাঁর সঙ্গে গগনের পরিচয় হয়েছিল। গগণ তাকে গান গেয়ে শোনাতেন। শিলাইদহে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিঠি পৌঁছে দিতেন এবং সংগ্রহ করতেন। ইন্দিরা দেবীর কাছে ছিন্নপত্রে জমা হওয়া চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাকে নিয়ে বহুবার লিখেছেন।

শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল, সর্বক্ষেপী বোষ্টমী, গোঁসাই রামলাল এবং লালনের অজস্র শিষ্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। লালন ও বাউল সঙ্গীতের ভক্ত কবিগুরু শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া অঞ্চল হতে অনেক বাউল গান সংগ্রহ ও করতেন এবং তারপরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেগুলো প্রচার করার ব্যবস্থা করতেন। উদ্দেশ্য ছিল যাতে সুধী সমাজের মধ্যে বাংলাদেশের বাউল গান সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে।

অধ্যাপক মনসুরউদ্দিনের বাংলা লোকগীতি নিয়ে ১৩ খণ্ডের অমর রচনা হারামণি। সেই গ্রন্থের ১ম খণ্ডের ভূমিকা আবার লিখেছেন বাউল-লালন-লোকগানের সর্বশ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সেই ভূমিকাতেই কবিগুরু গগন হরকরার আমি কোথায় পাব তারে গানের কথা উল্লেখ করেন-

"আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিল–

কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে....

কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে : তং বেদ্যং পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ। যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো, নইলে যে মরণবেদনা। অপণ্ডিতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম তার গেঁয়ো সুরে সহজ ভাষায়–যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না-জানবার বেদনা–অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর–তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। ‘অন্তরতর যদয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড়ো বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেক কাল পরে ক্ষিতিমোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি, ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না–তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্বতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি নে।"

রবীন্দ্রনাথ এভাবেই বেদ-উপনিষদের অমর শিক্ষাকে বাউল সঙ্গীতের মাধ্যমে সহজ ভাষায় প্রকাশিত হতে দেখে আপ্লুত হতেন। এত অসামান্য শিল্পকে তিনি সর্বত্র প্রচার, প্রসার করার জন্য সর্বদা ছিলেন তাই উন্মুখ। "আমি কোথায় পাব তারে" গানটি যে গানটির সুর থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিয়েছিলেন আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুর, না চুরি করে নয়, সর্বত্র ঢাকঢোল পিটিয়ে গগন হরকরার ভূয়সী প্রশংসা ও শ্রদ্ধার্পণের মধ্যে দিয়ে, সেই গানটি ছিল উপনিষদের অমর বাণীর ই সহজ সরল প্রকাশ। আমাদের মাটি আবহমান কাল ধরে এই অমর গ্রন্থগুলোর সাথে কত আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে তা আসলে গভীর অধ্যয়ন ছাড়া অনুধাবন করা অসম্ভব। আর এই বিষয়টিই সকলের কাছে ছড়িয়ে দিতে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রবাসী’ পত্রিকার ১৩২২ বাংলার বৈশাখ সংখ্যায় ‘হারমণি’ বিভাগ চালু হলে ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে’-ভাবতত্ত্বের এ গান দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বিভাগের সূচনা করেন।

পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী বলেছেন: 

"লালন-এর শীর্ষ ধারার একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ডাক হরকরা–যাঁর নাম গগন। রবীন্দ্রনাথ গগনকে সবার মাঝে বিভিন্ন ভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত করে যথাসাধ্য মূল্যায়ন করেছেন।"

প্রথমবার গগন হরকরার সাথে দেখা হলে রবীন্দ্রনাথকে তিনি গেয়ে শোনান "আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যারে", শুনে অভিভূত রবীন্দ্রনাথ গগণের নাম ও তার গানটির বিষয়ে তার প্রবন্ধ “An Indian Folk Religion” এ উল্লেখ  করে বলেন, “The first Baul song, which I chanced to hear with any attention, profoundly stirred my mind.”

কবিগুরুর মন্ত্রশিষ্য ও ছায়া সঙ্গী শান্তিদেব ঘোষ আরও লিখেছেন যে-

 "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায়
ভালবাসি" গানটি তিনি (গুরুদেব) রচনা করেছেন "গগন হরকরার রচনা---
'আমি কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে ||
হারায় সেই মানুষে তার উদ্দিশে
                     দেশ বিদেশে
আমি দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে' গানটির সঙ্গে মিলিয়ে |"
(শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্র সংগীত, পৃষ্ঠা-১৩০)

সত্যেন রায় লিখেছেন- 

"বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ৭ আগস্ট (১৯০৫ খৃ:) কলিকাতার টাউন হলে যে সভা হয়েছিল, সেই উপলক্ষ্যে… রবীন্দ্রনাথ নূতন সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা’ বাউল সুরে গীত হয়েছিল।"

জেনে রাখা ভালো এই সুরগুলো সংগ্রহ করে রাখতেন রবীন্দ্রনাথেরই বোন স্বর্ণকুমারী দেবীর মেয়ে সরলাদেবী।

সরলাদেবী তাঁর জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে এ বিষয়ে লিখেছেন— 

"কর্তাদাদামহাশয় চূঁচড়ায় থাকতে তাঁর ওখানে মাঝে মাঝে থাকবার অবসরে তাঁর বোটের মাঝির কাছ থেকে অনেক বাউলের গান আদায় করেছিলুম। যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্যে প্রাণ ব্যস্ত থাকত— তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিল না। যেমন যেমন আমি শোনাতুম—অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে, কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে একখানি নিজের গান রচনা করতেন। কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, আমার সোনার বাংলা প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝিদের কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান।"

সরলা দেবী চৌধুরানী ইতিপূর্বে ১৩০৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে কবিগুরুর সহায়তায় তার শতগান সংকলনে গগন হরকরা রচিত গানটির স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের বঙ্গভঙ্গ-সমসাময়িক অনেক স্বদেশী গানের সুরই এই স্বরলিপি গ্রন্থ থেকে গৃহীত হয়েছিল। সরলা দেবী চৌধুরানী ঠাকুর পরিবারের মুখপত্র ভারতী পত্রিকায়

"লালন ফকির ও গগন" শিরোনামের একটি প্রবন্ধও প্রকাশ করেছিলেন । এই রচনাটিতে গগনের দুটি গান অন্তর্ভুক্ত ছিল - "আমি কোথায় পাবো তার" এবং "(ও সোম) আসর মায়াই ভুলে রবে"। ১৩২২ বাংলা সনে রবীন্দ্রনাথ প্রথম হরকরার গান তাঁর প্রবাসী পত্রে প্রকাশ করেন।

অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রত্যক্ষ সাহচর্যেই বাউলদের গ্রামীণ সঙ্গীতসমূহ বিদ্বৎসমাজে প্রকাশিত হয়, তিনিই গগন হরকরা ও তাঁর গানটিকে পরিচয় করিয়ে দেন বিশ্বমাঝে এবং সকলকে জানিয়েই তিনি তাঁর লিখিত গীতিকাব্যে এই সুর সমূহ আরোপ করে এদেরকে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেন। আর আজ পাড়ার সালেক মালেকও এই অমর অবদানকে চুরি বলে ফেসবুকে পোস্ট করছে, চারদিকে এতই অশিক্ষা! 

স্বরবিতান ষট্‌চত্বারিংশ (৪৬) খণ্ডে মুদ্রিত স্বরলিপিতে গানটির রাগ ও তালের উল্লেখ নেই। বাউল গানের সুরে এর সুর নিবদ্ধ। তাই গানটিকে বাউলাঙ্গও বলা হয়। 

শেষ করব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি গল্পের মাধ্যমে।

শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে এক জমজমাট দুপুর। বাড়িতে অতিথি হয়ে এসেছেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের সকলের প্রিয় সঙ্গীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। তিনি জমিদারের বন্ধু, জমিদার রবীন্দ্রনাথ। দুই সঙ্গীতজ্ঞ যেখাবে সেখানে এসব গানবাজনা তো হবেই। হারমোনিয়াম বাজিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বেশ রসিয়ে রসিয়ে পরিবেশন করলেন "বাহবা, বাহবা নন্দলাল"। সকলেই বাহবা, বাহবা করতে লাগল।

জমিদার মশাইয়ের গলায় আজ অল্প ব্যথা। তিনি বন্ধুবরকে বললেন, আমার গান তো শুনেছেন অনেক, আজ এর গান শুনুন। সামনে সংকুচিত হয়ে বসে থাকা এক রোগা-হ্যাংলা মানুষের দিকে নির্দেশ করতে সে আরো কাঁচুমাচু হয়ে গেল। ভাবটা যেন, সত্যি আমাকে ডাকছেন? একে এলাকার সবাই চেনে। দ্বিজুবাবুকে এর পরিচয় দেওয়া হলো, এখানকার ডাকঘরের ডাক হরকরা, এর নাম গগন। আপনারা লালন ফকিরের গান তো শুনেছেন নিশ্চয়, এবার এর গান শুনুন। গগনের দিকে একবার তাকিয়ে কার উদ্দেশ্যে যেন নমস্কার ঠুকে গগন গান ধরলেন-

কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে!
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হত খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।

...উদাত্ত কণ্ঠে এই মাটির প্রাণের গান, গাওয়া শেষ হলেও অনেকক্ষণ কারো মুখ দিয়েই কথা বেরোলো না।

এভাবেই বাংলার মাটির কাছের বাউল সঙ্গীতকে তুলে নিয়ে এসে অমরত্ব এনে দিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবং বারেবারে এই সঙ্গীতসমূহের সূর স্রষ্টাদের স্মরণ করেছেন জগৎসংসারের সম্মুখে। তিনি আজীবন লালনের গানে, বাউলের সুরে খুঁজে বেড়িয়েছেন সেই জ্যোতির্ময়কে যা তাঁর রচিত আরও একটি বাউল সুরারোপিত অমর গীতিকাব্যে আজও বাজে-

পথিক কয়, "ভেবো না রে ডুবে যাও রূপসাগরে
বিরলে বসে করো যোগ-সাধনা
তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলেম, আর পেলেম না
দেখেছি রূপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা...


তথ্যসূত্র- 
  • ১.শান্তিদেব ঘোষ, রবীন্দ্র সংগীত
  • ২. রবিজীবনী- প্রশান্ত কুমার পাল
  • ৩. প্রথম আলো (১ম খন্ড) - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
  • ৪. হারামণি, মুহাম্মদ মনসুরউদ্দিন
  • ৫. অন্তর্জাল

© বাংলাদেশ অগ্নিবীর

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ