হেডিং পড়ে যারা আমায় ‘মনুবাদী’ তকমা দিয়ে ফেলেছেন বা ‘তকমায়িব তোরে’ ভেবে যাদের ঠোঁট অলরেডি সুরসুর করছে, তাঁদের বলি ‘দাঁড়াও পথিকবর … তিষ্ঠ ক্ষণকাল’ – এনার্জি নষ্ট করবেন না কাইন্ডলি, আমিই আপনাদের হয়ে ব্যাখ্যা করে দিচ্ছি আমি কেন ‘মনুবাদী’ এবং ‘মনুবাদ’ কি ধরণের জুজু যাতে একটা গ্রন্থ না পড়েই তা কারো কারো পড়ানোর দরকার হয়ে পড়ে!
তার আগে একটা ছোট্ট প্রশ্ন উত্তর হয়ে যাক । এক্কেরে নিজের মর্জিতে নিজের বোধবুদ্ধি খাটিয়ে কমন সেন্স ঘাঁটিয়ে উত্তর গুলো দিয়ে ফেলুন তো …
প্রশ্ন ১: কে জাতবাদী?
- ক। যে - কোন ব্যক্তির সামাজিক বর্ণ পরিচয় এক জন্মেই প্রয়োজনে পাল্টে দেবার পক্ষে সওয়াল করে, বা নির্দিষ্ট কয়েক প্রজন্মের পর পাল্টানোর পক্ষে সওয়াল করে? না কি –
- খ। যে – বাপের বর্ণ পরিচয় সন্তান চূড়ান্তভাবে পাবে এবং এটা প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলতে থাকবে, অর্থাৎ স্ট্যাটিক?
মনু বলছে খ উত্তর জাতবাদী, আর আপনারা কেউ খ-কে আঁকড়ে ধরে ক-কে বলছেন জাতবাদী মনুবাদ? খেয়াল রাখুন, খ-এর ওপর ভিত্তি করেই আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রে সংরক্ষণবাদ কায়েম আছে ।
শ্লোক নং ১০.৬৪-৬৫ দেখুন । মনু বলছেন ব্রাহ্মণ শূদ্র হয়ে যেতে পারে, আর শূদ্র ব্রাহ্মণ হয়ে যেতে পারে ৭ প্রজন্মে ।
তাহলে কে জাতবাদী আর কে মডার্ন? মনু, না আধুনিক রাষ্ট্র?
অনেক শ্লোক আছে । আপাতত শ্লোক নং ২.১০৩ দেখুন । মনু বলছে, ব্রাহ্মণ প্রপার আচার পালন না করলে সে শূদ্র । দ্বিজ যদি সকালে পূর্বমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে পূজা না করে আর সন্ধ্যায় পশ্চিমমুখী হয়ে বসে পূজা না করে, তাহলে সে শূদ্র গণ্য হবে ।
আরে! আমি তো এসব করিনা । তাহলে আমি তো শূদ্র!
আচ্ছা, নিজেকে উদাহরণ খাড়া করি । রাষ্ট্র বলছে আমার জাত ব্রাহ্মণ । কিন্তু মাই ডিয়ার রাষ্ট্র-বাপ, আমার হাম্বল প্রেয়ার, আমার তো সাত প্রজন্ম বামুন পরিচয় হয়ে গেছে, তাইলে আমায় শূদ্র ঘোষণা করা হচ্ছে না কেন?
মনু বলছেন, এই ব্যাটা, তোর সাত প্রজন্ম পার, তায় আবার তুই আদর্শ গুণ-ব্রাহ্মণ নস, অতএব তুই এখন শূদ্র ।
আর রাষ্ট্র বলছে, আরে ছোড় ইয়ার! বামুনের ঘরে জন্মেছিস, তুই ফিক্সড বামুন, তোর বাপ বামুন, তোর বেটি বামুন … এটা চলতে থাকবে, আর মনুর দোষে, তোর কোন কাল্পনিক পূর্ব পুরুষের দোষে, কোন এভিডেন্স ছাড়াই তোর মেয়েও বামুন হবার জন্য অপরাধী হবে, তার ভর্তি চাকরি সব স্কোপ কম!
শ্লোক নং ২.১৬৮ দেখুন । মনু বলছে, যে দ্বিজ বেদ পড়েনি, সে শূদ্র, তার বংশধর শূদ্র ।
না, আমি গুরুগৃহে বেদ পড়িনি ।
রাষ্ট্র বলবেনা, কিন্তু একমাত্র মনুবাদী হলে আমি বলতে পারি, আমি বেদপাঠ করিনি তাই আমি শূদ্র ।
শ্লোক নং ৮.১০২ দেখুন । মনু বলছে যে দ্বিজ ব্যবসা করে, পশুপালন করে, মিস্ত্রির কাজ করে বা অভিনেতা – সে শূদ্র ।
কি কেলেঙ্কারি রে বাবা! আমি তো ব্যাঙ্ক পোস্ট অফিসে টাকা রেখে সুদের ব্যবসা করি, তাহলে তো আমি শূদ্র?
আরও ভাবলাম, টিভি সিরিয়ালে অন্তত একবার মুখ দেখিয়ে বা যাত্রা নাটকে অন্তত একবার মঞ্চে উঠে শর্ট-কাটে বুদ্ধিজীবী হব, কিন্তু মনু তো হুমকি দিচ্ছে, অমন বুদ্ধিজীবী = শূদ্র?
ভাই সকল, এই কারণে আমি মনুবাদী, কারণ আমি জানি আমি শূদ্র । কেন? আরে, আমি অধ্যাপনা করি, সেই হিসাবে ব্রাহ্মণ বৃত্তি ঠিকই, সে যারাই শিক্ষকতা করে সেই হিসাবে তারা সকলেই ব্রাহ্মণ, কিন্তু আইন বলছে আমি ‘পাব্লিক সার্ভেন্ট’ – মানে ‘চাকর’, অতএব আমি শূদ্র ।
তাইলে? মনু বলছে তুই শূদ্র, আমি বলছি আমি শূদ্র, আর রাষ্ট্র বলছে না তুই বামুন!
আচ্ছা, যারা আজ শূদ্র পরিচয়ে পরিচিত, সাত প্রজন্ম তো ওভার, তারা অনেকেই ব্রাহ্মণ-গুণী ব্রাহ্মণ-বৃত্তিধারী, তাহলে রাষ্ট্র কেন তাদের ব্রাহ্মণ ঘোষণা করছে না? তারাই বা সে দাবী তুলছে না কেন?
মনু তো বলছে তাই করতে!
তার মানে তো দেখা যাচ্ছে, জাতবাদ বাহানা, আসলে জাতবাদ কায়েম রেখে আর্থিক ও বস্তুবাদী সুবিধা আদায় করাই মনুর বিরোধিতা করার উদ্দেশ্য!
তাইলে? মনু বলছে শূদ্র বলে চূড়ান্ত কিছু নেই, শূদ্র ব্রাহ্মণ হতে পারে, আর রাষ্ট্র বলছে না তা হবে না, শূদ্র বংশ পরম্পরায় শূদ্র থাকবে? যে রাজনৈতিক দল এটা বলছে সে তো বিপুল ভোট পাচ্ছে?
এই কারণেই কি মনু স্মৃতি পুড়িয়ে মনুবাদ মুছে দেবার চেষ্টা যাতে মনু হাটে হাঁড়ি না ভাঙতে পারে?
প্রশ্ন ২: কে বেশী স্বাধীন?
- ক। যা ইচ্ছামত বৃত্তির প্রয়োজনে ভারতের যে কোন জায়গায় যেতে পারে? না কি –
- খ। যে নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যেতে পারবে না?
রাষ্ট্র বলছে ক, কিন্তু প্রচুর সাব-ক্লজ আর ‘কনডিশান্স অ্যাপ্ল্যাই’ করে আসলে করেছে খ ।
মনু বলছে, শূদ্র বৃত্তির প্রয়োজনে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে কিন্তু ব্রাহ্মণ পারবে না । শ্লোক নং ২.২৪ দেখুন ।
তাহলে প্রকৃত – আজকের সংবিধান সম্মত Right to Freedom of Movement তো মনু দিয়েছে শূদ্রকে?
প্রশ্ন উত্তরে আবার ফিরব, তার আগে বলি, মনু স্মৃতিতে প্রচুর জল মেশানো হয়েছে ১০ম শতাব্দীর পর আমরা জানি, সেটা মনু স্মৃতি পড়লে আর স্ববিরোধী কথা দেখলেই মালুম হবে ।
সব জল আর দুধ একসঙ্গে নিয়ে, মনু স্মৃতিতে এমন শ্লোক আছে যা আধুনিক যুগে অচল । দেশের আইন সংবিধান তা সংস্কার করেছে ।
কিন্তু এই যে সংস্কার, এ নিয়ে মনু কি বলছে?
জল আর দুধ বাছাই করবেন কি করে?
সংস্কার আর বাছাইয়ের দাওয়াই তো মনুই দিয়ে গেছে ।
শ্লোক নং ২.৬ দেখুন, মনু বলছে, ধর্মের মূল বেদ, আর অথরিটি যারা স্মৃতি বা শাস্ত্র জানে, আর অথরিটি সাধু ব্যক্তির আচরণ ।
কিন্তু ধর্ম অধর্ম – কি ঠিক কি ঠিক নয় – এ বিচারের দায়িত্ব মনু সব মানুষকেই দিয়েছে ।
মনু বলছে, ধর্মের মূল হল ‘আত্মনস তুষ্টি’।
এইভাবে মনু (বোধহয় জানতেন ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁর বচনে জল মেশাবে) তাঁর নিজের স্মৃতিকেই সংস্কারমুখী রেখেছে । মনু স্মৃতির কোন অংশ পড়ে যদি ‘আত্ম তুষ্টি’ না হয়, তাহলে তা বাতিল করার অধিকার মনু দিয়ে গেছে ।
পৃথিবীর আর কোন রেলিজিওনের কোন গ্রন্থে মানুষের ‘আত্ম তুষ্টি’কে ধর্ম সংজ্ঞায়িত করার ক্রাইটেরিয়ন করা হয়েছে?
খুঁজে দেখান তো দেখি!
সুতরাং মনু স্মৃতির অমুক অংশ তমুক অংশ নিয়ে আক্ষেপ করার তো যুক্তি নেই । দুধে জলে মিশে আছে থাক । বাছাই করতে গেলে সম্প্রদায়ের আর গুরুবাদের সৃষ্টি হবে । দরকার নেই বাছাইয়ের । জাস্ট অ্যাপ্লাই কমন সেন্স । আত্ম তুষ্টি । কি ভালো কি মন্দ কি যুগোপযোগী কি বাতিলযোগ্য – সে বোধ যে কোন মানুষের আছে, যদি না তার ‘মনু স্মৃতি পোড়ান’ মগজধোলাই হয়ে গিয়ে কমন সেন্সটাই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে থাকে, আর সুবিধাবাদের ধান্দাবাজীতে বিবেক পুড়ে ছাই হয়ে গিয়ে থাকে ।
মনু স্মৃতির প্রমানেই ‘আত্ম তুষ্টি’ অ্যাপ্ল্যাই করুন অন্য তিনটির পাশাপাশি – বেদ, শাস্ত্রজ্ঞান আর সাধু মানুষের আচরণ । তাতেই চেনা যাবে আসল মনু ।
হ্যাঁ, সেই অর্থে আমি মনুবাদী, কারণ ধর্ম অধর্ম ভালো মন্দ বাছাইয়ের এই স্বাধীনতা মনু দিয়েছে । যে আমার স্বাধীনতা সম্মান করে, আমার বিবেকের ওপর ভরসা রাখে, তাকে আমি শ্রদ্ধা করি ।
আলোচনা চলবে …
তথ্যসূত্র:
- Patrick Olivelle. Dharmasūtras: The Law Codes of Āpastamba,, Gautama, Bauddhāyana, and Vaśiṣṭha. Motilal Banarsidass, Delhi, 2000
- Kane, P. V. 1962-75. History of Dharmasastra. 5 vols. Poona: Bhandarkar Oriental Research Institute
........ ক্রমশ
0 মন্তব্যসমূহ