আহমদ ছফার “লজ্জা” - সুষুপ্ত পাঠক

সুষুপ্ত পাঠকের লেখা আহমদ ছফার “লজ্জা”

সত্যকে চাপা দেয়া একটা ক্রাইম। সে অর্থে বাংলাদেশের লেখক বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশ ক্রিমিনাল! বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক ইতিহাসকে গোপন করতে, ছোট করে দেখাতে তেমনই একটি ক্রাইমে ৯০-এর দশকে আহমদ ছফা জড়িত ছিলেন। আমার ধারণা ছফার লেখা যদি দেশ পত্রিকা চেয়ে নিয়ে ছাপত তাহলে উনি এতখানি ভারত ও হিন্দু বিরোধী হতেন না। তিনি মনে মনে হয়ত কোলকাতার সাহিত্যবোদ্ধাদের স্বীকৃতি চেয়েছিলেন। নিজের সম্পর্কে তার উচ্চ ধারণা ছিলো যে তিনি বাংলা ভাষার সর্বশেষ্ঠ চিন্তক! বস্তুত তার লেখালেখি সামগ্রিক বিবেচনা করলে তিনি মধ্যম মানের একজন লেখক ছাড়া আর কিছু নন। যদিও এই লেখাটি পুরোপুরি ছফাকে নিয়ে নয়। এমনকি তসলিমা নাসরিনকে নিয়েও পুরোটা নয়, বলা উচিত “লজ্জা” নামের একটি উপন্যাস নিয়ে। যে রকম উপন্যাস বাংলাদেশে একশ বছরেও কেউ লিখেনি।


‘লজ্জার’ সাহিত্য মান, লজ্জার শিল্পমান নিয়ে আমি বলিনি যে এরকম লেখা একশো বছরেও কেউ লিখেনি। সেটি মহাকাল ঠিক করে দিবে। আমি বলেছি লজ্জা এইদেশের একমাত্র সাহিত্য যা এদেশের ভেতর রাজত্ব করে থাকা সাম্প্রদায়িকতাকে তুলে ধরেছে। তসলিমার জন্ম ১৯২০ সালে হলে নিশ্চিত করে ৪৬-এর নোয়াখালী ম্যাসাকারকে তার উপন্যাসে তুলে রাখতে পারতেন যা আজ দলিল হয়ে থাকত। তসলিমার উপর ছফা ও তার চ্যালাদের সমস্ত ক্ষোভ একারণেই। তসলিমার নারীবাদ, তার ইসলামের বিরোধীতার কারণে দেশছাড়তে হয়নি। তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছে আসলে এই একটি উপন্যাসের কারণেই। ছফা পুরো মুসলমানদের নেতা হয়ে কাগজে লিখতে লাগলেন বিজেপির টাকা খেয়ে তসলিমা এই উপন্যাস লিখে বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে সাম্প্রদায়িক প্রমাণ করতে চেয়েছে। আহমদ ছফা তাঁর "আনুপূর্বিক তসলিমা এবং অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ" বইয়ের ১৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, "বাবরী মসজিদ ধ্বংস এবং সংগঠিত গণহত্যার পর পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশসমূহে যেখানে ভারতের ব্যবসা বাণিজ্যের স্বার্থ অনেক বেশী, সেক্যুলার ভারত রাষ্ট্রের ইমেজটি ভয়ঙ্কর ভাবে মার খেয়ে যায়। সকলে একবাক্যে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে”। তখনই নাকি তসলিমা “লজ্জা” উপন্যাসটি লিখেন।


কোলকাতার একটি কাগজে ছফা ইন্টারভিউতে বলেন, 


“তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিশেবে। কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদ উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে এবার জামায়াত পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। এই আনন্দবাজারের দৌরাত্ম্য আমরা বাংলাদেশে চলতে দেব না”


তসলিমা নাসরিনকে প্রাণ হাতে নিয়ে দেশ ছাড়তে হয় ভারতের স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটা সাক্ষাতকারে তার একটি মন্তব্য ছাপা হয় যা তিনি বলেননি বলে দাবী করেন। কিন্তু সেই বক্তব্য দ্রত বাংলাদেশে দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে। মাদ্রাসার হুজুররা কি স্টেটসম্যান পত্রিকা পড়ে? পড়ে তো ছফাদের মত লোকজন। কাজেই লজ্জা উপন্যাস, তারপর আনন্দ পুরস্কার পাওয়া এইদেশের ‘বাঙালি মুসলমান লেখক কবি বুদ্ধিজীবীদের’ মাথায় আগুন ধরে যায়। তারাই পরোক্ষ তসলিমার ফাঁসি চাইত না হয় দেশ থেকে বিতারণ চাইত। তাদের থেকেই হুজুররা তসলিমাকে ইস্যু বানায়। সলমান রুশদী কি লিখেছে এটা হুজুরদের জানার কথা নয়। সলমান রুশদি কি লিখেছে সেটি লেখাপড়া করা সাহিত্য টাহিত্য করা লোকজনই ইস্যু বানিয়েছিলো। এই ইন্টেলেকচুয়াল লোকজনদের মধ্যে মৌলবাদী বা জাতীয়তাবাদী লোকজনই লেখকদের স্বাধীনতাকে হরণ করতে ধার্মিক মৌলবাদীদের লেলিয়ে দেয় পরোক্ষভাবে। কিন্তু “লজ্জ্বা” কি সত্যিই বিজেপির টাকায় লেখা হয়েছিলো। সাধারণ পাঠকদের কৌতুহল থাকতে পারে! তাহলে লজ্জার এই লাইনগুলি একটু পড়ে দেখুন- 


“করসেবকরা সাড়ে চারশ’ বছরের পুরোনো একটি মসজিদ ভেঙে ফেলেছে।বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ঘোষিত করসেবা শুরুর পঁচিশ মিনিট আগে ঘটনাটি ঘটে। করসেবকরা প্রায় পাঁচ ঘন্টার চেষ্টায় তিনটি গম্বুজ সহ সম্পূর্ণ সৌধটিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়। পুরো ঘটনাই ঘটে বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস, বজরং দলের সর্বচ্চ নেতৃত্বের উপস্থিতিতে। কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, পিএসি ও উত্তর প্রদেশ পুলিশ নিষ্ক্রিয় দাঁড়িয়ে করসেবকদের অবিশ্বাস্য অপকান্ড দেখে।দুপুর দুইটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে প্রথম গম্বুজ ভাঙা হয়, সাড়ে চারটায় দ্বিতীয় গম্বুজ, চারটা পঁয়তাল্লিশে তৃতীয় গম্বুজটিও ভেঙে ফেলে উন্মত্ত করসেবকরা।” (লজ্জা, তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠা-৭)


এবার আপনারাই বলুন, বিজেপি নিজের টাকায় নিজেদেরকে ভিলেন বানাবে? বাবরী মসজিদ ভাঙ্গা যে সভ্যতার উপর আঘাত, ভারতের ঐতিহ্যের উপর আঘাত এটা কি বিজেপি মনে করে? তসলিমা লজ্জায় লিখেছেন-


“বাবরি মসজিদ দেখেনি সুরঞ্জন। দেখবে কি সুরঞ্জন অযোধ্যায় যায়নি কোনদিন, দেশের বাইরে কোথাও যাওয়া হয়নি তার।সুরঞ্জন এটা মানে, ষোড়শ শতাব্দীর এই স্থাপত্য কাজে আঘাত করা মানে এ কেবল ভারতীয় মুসলমানকে আঘাত করা নয়, সমগ্র হিন্দুর ওপরও আঘাত, আসলে এ পুরো ভারতের উপরেই আঘাত, সমগ্র কল্যাণবোধ উপর, সমবেত বিবেকের ওপর আঘাত।” (লজ্জা, তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠা ৭-৮)


লজ্জার ১৮ পৃষ্ঠার পুরো বিববণ আসলে ইতিহাসের দলিল হয়ে আছে। ছফাদের রাগ ক্ষোভের কারণও তাই। তখনকার সংবাদপত্রের পাতা থেকেই সেসব তথ্য নেওয়া বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে আগুন দেয়ার পর শিবমন্দির, নাটমন্দির রামসীতা মন্দির থেকে শুরু করে পুরান ঢাকার হিন্দু দোকানপাট সব তছনছ হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এসবের জন্য তসিলমা ইসলাম বা মুসলমানদের কোন দোষ দেননি। তিনি লিখেছেন প্রকৃত ধার্মীকের কাজ এগুলো নয়, এগুলো গুন্ডাদের কাজ।


“জল খাবার ভেঙেছে। মরণচাঁদও নাকি ভেঙে চুরমার করেছে। সব মিষ্টির দোকান ভাঙা হচ্ছে। কারণ কি ধর্মীয় দ্বন্দ্ব? নাকি মিষ্টি খাওয়া, লুটপাট? সুরঞ্জনের মনে হয় ধর্মের চেয়ে হাতের থাবাটিই এখানে বড়। ধার্মিকেরা কখনও পারে বিধর্মীর সম্পদ লুট করে নিজের ধর্ম রক্ষা করতে? এত আসলে ধার্মিকের কাজ নয়, এ হচ্ছে গুন্ডা বদমাশের কাজ। গুন্ডাবদমাশেরা সুযোগ পেলেই থাবা দেয়।” (লজ্জা, তসলিমা নাসরিন, পৃষ্ঠা ১৮)


উপন্যাসের চরিত্র সুরঞ্জন যে বিজেপি বিরোধী সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একজন মানুষ যে বিজেপিকে সব দোষ দিচ্ছে তা কি বিজেপি তাদের টাকায় লেখাবে? উপন্যাসে সুরঞ্জন ভাবছে, বিজেপির উশকানিতে করসেবকরা বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে এইদেশের (বাংলাদেশের) মৌলবাদীদের উশকে দিয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বিজেপি কি জানে না তাদের উন্মাদনা শুধু ভারতের ভৌগলিক সীমায় আটকে থাকবে না। বাংলাদেশে যে হিন্দু আছে সেকথা তারা জানে না?


লজ্জা উপন্যাসে সুরঞ্জনের বাবা সুধাময়ের মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা- যেকখা আমি ব্লগে ‘হিন্দু হলোকস্টের’ প্রমাণ দিয়েছিলাম তারই আখ্যান যা এ যাবত কালে বাংলাদেশের কোন ‘বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক’ লিখেনি। সুধাময়ের স্ত্রীর নাম ফাতেমা রাখা হয় পরিচয় লুকিয়ে। সুধাময় তখন বুঝতে পারেন এই বিপদের দিনে এই দেশে তাদের আর ফয়জুল আলম সলিমুল্লাহ বিপদ এক রকম নয়। সুধাময় বুঝেছিলেন মুসলমান হলে রক্ষা আছে কিন্তু হিন্দু হলে দ্বিতীয় সুযোগ পাকিস্তানীরা দিবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হিন্দুদের এই বাস্তবতার কোন স্বীকৃতি নেই। কাজেই লজ্জ্বা উপন্যাস নিয়ে ‘বাঙালি মুসলমান সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের’ ক্ষোভের যথেষ্ঠ কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার কোন দলিল রাখা যাবে না। এই বিষয়ে ডানপন্থী প্রগতিশীল সব পক্ষই একমত। সে অলিখিত চুক্তিপত্রের উপর ‘লজ্জা’ ছিলো ছড়ছড় করে মুতে দিয়ে সত্য বলার মত। ফলে বাংলাদেশের কবি সাহিত্যকদের মধ্যে তসলিমার পক্ষে লোকজন খুবই কম। “লজ্জা” উপন্যাসের সাহিত্য মান কেমন সেটি ভিন্ন বিষয়। কিন্তু লজ্জা উপন্যাস ভবিষ্যতের গবেষকদের বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে কাজ করতে গেলে অবশ্যই পাঠ করতে হবে নিশ্চিত। সেটা জেনেই ছফা শিষ্যরা আজো শংকিত।


#লজ্জা #তসলিমানাসরিন


লিখেছেন: সুষুপ্ত পাঠক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ