কোলকাতা আসাম ত্রিপুরা ও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ - সুষুপ্ত পাঠক

কোলকাতা আসাম ত্রিপুরা ও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ - সুষুপ্ত পাঠক

 

বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘অসামপ্ত আত্মজীবনী’ এখন এদেশের কওমি হুজুরদের ইতিহাসের রেফারেন্স দেয়ার একমাত্র আকর গ্রন্থ হয়ে উঠেছে। চরমোনাই পীরের পুত্র ফয়জুল করীম এই বই তুলে ধরে ভারত ও হিন্দুদের বিরোধীতার যৌক্তিকতা দেখায়। ওয়াজের হুজুরদের ভারত ও হিন্দু বিরোধীতার রেফারেন্সও এই বই! কেন?


আলোচনার শুরুতে এই প্রশ্নটা মনে হয় জরুরী যে বাঙালি আসলে কে? হিন্দু নাকি মুসলমান? ইংরেজরা যখন ভারতের সবচেয়ে বেয়াড়া ও তাদের জন্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করছিলো বাঙালিদের তখন তারা আসলে কাদের বুঝিয়েছিলেন সেটি বুঝা আগে দরকার।


তাই ১৯০৫ সালের প্রথম বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস বলা উচিত। ভারত সচিব হ্যামিলটনকে লর্ড কার্জন এক চিঠিতে বঙ্গভেঙ্গের গুরুত্ব বুঝাতে লিখেন, বাঙালিরা নিজেদের এক মহানজাতি মনে করে এবং স্বপ্ন দেখে তাদের মধ্য থেকে একজন লাটসাহেবের গদিতে বসতে পারবে। বঙ্গভঙ্গ তাদের সেই স্বপ্নকে কোনদিন বাস্তবায়ন করতে দিবে না। এ জন্য আপনারা পূর্বাঞ্চলে (পূর্ববঙ্গ) এমন এক শক্তিকে জোরদার করবেন যা বর্তমানে যেমন প্রবল হয়ে থাকবে পরবর্তীতেও প্রতিবন্ধক হয়ে থাকে।…


কার্জনের পরামর্শে কাজ হয়েছিলো। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ হচ্ছেন সেই ‘শক্তি’। নবাব আহসানউল্লাহ’র মৃত্যর পর সলিমুল্লাহ তখন নবাবী স্টেটে বসেছেন। অন্য ভাইদের সঙ্গে তখন তার প্রচন্ড বিবাদ চলছে সম্পত্তি নিয়ে। কয়েক বছরের মধ্যে নিজের অযোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে জমিদারী দেউলিয়া করে দেয়ার মত অবস্থায় চলে যায়। এই সময় ইংরেজ সরকার সলিমুল্লাহকে সহায়তা করতে ১৯০৫ সালে কর্নেল জেনারেল হোডিংকে জামিদারীর ম্যানেজার নিয়োগ করেন এবং মাত্র তিন পার্সেন্ট সুদে এক লক্ষ পাউন্ড ঋণ দেন। এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ‘ঋণ’ হিসেবে দিলেও বাস্তবে এটি ছিলো ঘুষ! এই ঘুষের ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের নেতা হয়ে উঠেন সলিমুল্লাহ খান। সেদিনই বস্তুত মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছিলো। এ্ররপর ১৯০৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। “মুসলিম লীগ” কোন দলের নাম নয়। এটি একটি আইডলোজির নাম। আপনি একই সঙ্গে বাঙালি ও ‘মুসলিম লীগ’ হতে পারেন না। কারণ কোলকাতার শিক্ষিত ধনী বাঙালিদের পূর্ববঙ্গের সঙ্গে ছিলো অর্থনৈতিক সম্পর্ক জড়িত। ফলে বঙ্গভঙ্গ করে তাদের সেই সোর্স দুর্বল করে দিতে পারলে ভারতের এই ঘাড় ত্যাড়া জাতি ইংরেজদের উপর আর কোন চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না সেটাই ছিলো কার্জনের উদ্দেশ্য। এই লক্ষ্যে তিনি ১৯০৫ সালেই ঢাকা সফর করে এখানকার মুসলমানদের বুঝাতে শুরু করেন যদি বাংলা ভাগ হয় তাহলে পূর্বে মুসলিম শাসনে তারা যেরকম নিজেদের বোধ করতেন সেরকমই একটা মুসলিম শাসনের বোধ অনুভব করবেন। ইতিহাসের এই অংশটুকুকে আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা কিভাবে বিশ্লেষণ করে থাকে? পূর্ববঙ্গে মুসলমানদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তির বিরুদ্ধে কোলকাতার ব্রাহ্মণ হিন্দুদের ষড়যন্ত্র হিসেবে। তারা তাদের জমিদারী হারানোর ভয়ে মুসলমানদের নিজস্ব ভূমি অধিকারকে রদ করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। উর্দুভাষী সলিমুল্লাহ খান হলেন পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের নেতা। এইসব ইতিহাসের কোথাও তাদের সঙ্গে ‘বাঙালি’ শব্দ ব্যবহারের কোন সুযোগই নেই। কেননা ‘মুসলমানদের’ উন্নতির জন্য ইংরেজদের বঙ্গভঙ্গ কার্যকর করার ভার তখন তাদের হাতে!


১৯০৭ সাল থেকেই কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, জামালপুরে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধায় মুসলিম লীগ। ময়মনসিংহের ইব্রাহিম খাঁ নামের একজন ‘লাল ইশতেহার’ লিখেছিলেন। সেখানে বলা হয়, ‘হে মুসলমানরা, তোমরা জেগে উঠো, তোমরা হিন্দুদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়বে না, হিন্দুদের দোকান থেকে কিছু কিনবে না, হিন্দুদের দ্বারা তৈরি কোন পণ্য স্পর্শ করবে না… যদি জ্ঞান অর্জন করে থাকো তাহলে হিন্দুদের তোমরা জাহান্নামে পাঠাতে পারবে…’। এই ইশতেহার যে মুসলিম লীগারদের হোমড়াচোমড়াদেরই বানানো ছিলো সেটি পরে বুঝা যায়। শুরুতে মুসলিম লীগের কিছু নেতা এই ইশতেহারের প্রচারণা ঠেকাতে চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নবাব খাজা সলিমুল্লাহ ডানহাত নবাব নওয়াব আলী চৌধুরীর পত্রিকা মিহির ও সুধাকরের এই ইশতেহার প্রকাশ করে প্রচারণা তুঙ্গে উঠাতে সাহায্য করেন। এ থেকে বুঝা যায় এই ইশতেহার কোন অতি উত্সাহী মফস্বলের নেতার ছিলো না।


শরত বসু, আবুল হাশিম ও সোহরাওয়ার্দীর ‘অখন্ড বাংলা’ দাবী নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। কী অসাধারণ হতো যদি পুরো বাংলা একটি দেশ হিসেবে বাঙালি হিন্দু মুসলমানের দেশ হতো! কিন্তু এই লাইনের সে সম্ভবনার কোন সম্ভাব্যতা নেই উল্লেখিত ‘হিন্দ মুসলমান’ শব্দ দুটির কারণেই। যখনই ধর্মীয় পরিচয়ে কোন জাতি বিভক্ত হয় তখন সেখানে ঐক্য সম্ভব নয়। বিশেষত ইসলাম যে শিক্ষা দেয় তাতে মুসলমান কোন নৃতাত্ত্বিক জাতির মধ্যে থাকতে পারে না। বাঙালিও মুসলমান হওয়ার পর নিজ জাতির সঙ্গে পদে পদে সংঘর্ষে জড়িয়েছে। আবুল হাশিম (কমরেড বদরুদ্দিন উমারের পিতা) যে অখন্ড বাংলার দাবী করেছিলেন, যে বক্তব্য তিনি রেখেছিলেন বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার সে বক্তব্যের তীব্র বিরোধীতা আসতে থাকে বাঙালি মুসলমানদের কাছ থেকে। ফলে তিনি একটি বিবৃতি দিয়ে তার বক্তব্য খন্ডন করে বলেন, আমি ইসলামিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের যে নিরাপত্তা ও অধিকার দেয়ার কথা বলা আছে সেকখাই বুঝিয়েছি। অর্থ্যাত অখন্ড বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতায় হিন্দুদের ইসলামিক রাষ্ট্রে যে রকম নিরাপত্তা ও অধিকার থাকবে সেকথাই তিনি বলেছিলেন!…


আবুল হাশিমের এটাই যদি মনে কথা হয় তাহলে হিন্দুরা কি করে অখন্ড বাংলায় আস্থা রাখবে? অখন্ড বাংলায় সোহরাওয়ার্দী দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনা দেখছিলেন কিন্তু শরত বসু কি দেখতে পেয়েছিলেন? আবুল হাশিমকে নিয়ে তিনি গান্ধির কাছে অখন্ড বাংলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আবুল হাশিম যে ‘প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও অধিকার থাকবে’ বলেছেন তেমন রাষ্ট্র কি শরত বসু চেয়েছিলেন? সেসময়ের পূর্ববঙ্গের তরুণ মুসলিম লীগাররা কি ভাবছিলো, তারা কেমন দেশ চায়, হিন্দুদের কি চোখে দেখে সেটা শেখ মুজিব তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইতে নিজেই বলেছেন।


বঙ্গবন্ধুর নিজের লেখা এই বইয়ের পান্ডুলিপি আবিস্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে কে কি লিখেছে তাতে আর কিছু যায় আসে না। এই আত্মচরিত পাঠ করলে এই দেশে এন্টি মুজিব সাপোর্টাররা যারা শেখ মুজিবকে ভারতপন্থি, হিন্দুপ্রেমী, সেক্যুলার ইত্যাদি অভিযোগে অভিযুক্ত করে তার বিরোধীতা করত তাদের সে ভুল ভেঙ্গে যেতে বাধ্য। বিএনপি সাপোর্টরাদের বিশাল অংশ তারাও এই বই পাঠ করলে শেখ মুজিবকে তাদের নিজেদের মানুষ বলেই মনে হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে থাকলে বাঙালি মুসলমানদের কোনদিন রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তি মিলবে না তাই পাকিস্তান ভাঙ্গার বিকল্প কিছু ছিলো না। লাহোর প্রস্তাবেও বলা হয়েছে একাধিক মুসলিম স্ট্রেট গঠনের কথা। তাই বাংলাদেশের জন্ম ভুল কিছু হয়নি। হ্যাঁ, ভারত বাংলাদেশের জন্মের সময় বড় ভূমিকা রেখেছিলো। ভারতের সহায়তা নেওয়াটা বেশ অস্বস্তিকর হতেই পারে। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেরই মনোভাব তাই ছিলো। তারা ভারতের নেতৃত্র মেনে নিতে পারছিলো না। মিত্রবাহিনীর সহায়তা ছাড়া, ভারতের সহায়তা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সফলতা সম্ভব ছিলো না কিন্তু ভারতকে সঙ্গে এই যুদ্ধ তাদের মনঃপুত ছিলো না। জেনারেল ওসমানী, জিয়াউর রহমান, মেজর জলিল এরকম অনেকজন পাওয়া যাবে যারা ৬৫ পাক ভারত যুদ্ধে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান রক্ষার চেতনা নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশ ভারতের বলয়ে চলে আসবে কিনা, পাকিস্তানের যে আদর্শ মুসলমান হিসেবে তারা এতকাল বিশ্বাস করে এসেছেন বাংলাদেশ তা ধারণ করবে কিনা সেটি নিয়ে তাদের সন্দেহ ছিলো। এই সন্দেহ তাদের শেখ মুজিবকে নিয়েও ছিলো। যদিও স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে “ধর্মনিরপেক্ষতার’ একটি ধারা বাদে এই সন্দেহের আসলে কোন বাস্তব ভিত্তি ছিলো না।


মূল যে পয়েন্টে আজকাল বঙ্গবন্ধুর বইটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি হচ্ছে, হিন্দুরা জোর করে কোলকাতা আসাম ত্রিপুরা দখল করে নিয়েছে। এগুলি বাংলাদেশের অংশ। একই কথা মাওলানা ভাসানীও মনে করতেন। তিনি বলতেন, আসাম আমার, কোলকাতা আমার, ত্রিপুরা আমার এগুলি না পেলে আমাদের মানচিত্র পূর্ণতা পাবে না…। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “যে কলকাতা পূর্ব বাংলার টাকায় গড়ে উঠেছিল, সেই কলকাতা আমরা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলাম। কেন্দ্রীয় লীগের কিছু কিছু লোক কলকাতা ভারতে চলে যাক এটা চেয়েছিল বলে আমার মনে হয়। অথবা পূর্বেই গোপনে রাজী হয়ে গিয়েছিলেন”।


সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চাইলেই সংখ্যালঘুর দেশ কেড়ে নিতে পারে? সংখ্যাগরিষ্ঠরাই ঠিক করে দিবে সংখ্যালঘুদের দেশ কোনটি হবে- এরচেয়ে মর্মান্তিক আর কি হতে? আসাম ত্রিপুরা কিংবা কোলকাতা ভাগাভাগিতে ঠিক কিসের জোরে পাকিস্তানে পড়বে তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা কি? পাকিস্তান ঘোষিতভাবেই মুসলমানদের দেশ। তাহলে আসাম ত্রিপুরা কোলকাতার অমুসলিমরা কেন পাকিস্তানে সংখ্যালঘু হতে চাইবে? আবার মুর্শিদাবাদ করিমগঞ্জের মত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা ভারতে কেন পড়বে যেখানে ভারতে তারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে? কাজেই এগুলো যে কোন নিয়ম নীতির মধ্যে পড়ে না সেটা না বুঝার কিছু নেই। তাই এই দাবী যখন তোলা হয়- ঐ জায়গাগুলি আমাদের পাওনা ছিলো- তখন নিশ্চিত করেই ঐ জায়গার মানুষদের কথা ভাবা হয় না। ভাবা হয় কেবল মাটিটুকুর কথা। রাজনীতিতে যাকে ‘পোড়ামাটি’ নীতি বলা হয়।


দেশভাগের বলি হয়ে পূর্ববঙ্গ থেকে ত্রিপুরায় শরণার্থী হয়ে আসা বাঙালীদের সেখানে বহিরাগত হিসেবে দেখে স্থানীয় জনগোষ্ঠি। সেখানকার বাঙালী কবিদের কবিতায় সে বেদনার কথা ফুটে উঠে। আসাম, ত্রিপুরা কোলকাতার বাঙালিরা পাকিস্তানে টিকতে না পারলে আজ তারা কোথায় পালাতো সেই প্রশ্ন কেউ তোলে না। আবুল হাশিমের ‘প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার ও নিরাপত্তা’ কি তাদের কোন গ্যারান্টি দিতে পারত? এই লেখায় আমি বাংলা ভাগের যৌক্তিকতা তুলে ধরছি সেরকম মনে করলে নিশ্চিত করেই আমার লেখার ভুল অর্থ করে ফেলছেন আপনি। আমি বলতে চেয়েছি ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বাঙালি জাতিকে দুর্বল করে দিতে চাওয়া লর্ড কার্জনের সেই ইতিহাস থেকে আমাদের শুরু করতে হবে। আপনি কি বাঙালি নাকি ‘মুসলমান’ সেটি ঠিক করে নিতে হবে। নইলে আপনাকে হয় বঙ্গভঙ্গ, দ্বিজাতিতত্ত্ব, পাকিস্তান এগুলিকে উদাত্ত চিত্তে মেনে নিতে হবে না হয় সবগুলিকে অস্বীকার করতে হবে।


তথ্যসূত্র: দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রীতির সাধনা, মফিদুল হক/ সম্প্রীতি ও সংকটে জনজাতি ও বাঙালি:প্রসঙ্গ তিপুরার বাংলা কবিতা, ড. রূপশ্রী দেবনাথ/ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।


লিখেছেন: সুষুপ্ত পাঠক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ