আহমদ ছফা "হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের" নিজেদের জন্য বিপদ মনে করতেন। তারা এদেশে থাকলে এই সেক্টরে কল্কে ছফাদের হাতে থাকত না। ছফা বিশ্বাস করতেন বাঙালি মুসলমান হিন্দুদের চেয়ে আলাদা জাতি। তিনি মনে করতেন আরব আফগান তুর্কী মুসলমানদের সঙ্গে বাঙালি মুসলমানদের কোন সম্পর্ক নেই। বাঙালি মুসলমান বাঙালি হিন্দুদের চেয়ে স্বাতন্ত্র্য এক জাতি। তাদের ভাষা সাহিত্যে আলাদা এক সাক্ষর থাকবে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এক বড় রকমের বাধা। ফলে ছফা ও তার সমগোত্রীয়দের হাতে রবীন্দ্রনাথ হতে লাগলেন কখনো অত্যাচারী জমিদার, কখনো মুসলিম বিদ্বেষী, কখনো ইংরেজদের দালাল। এখান থেকেই পশ্চিমবঙ্গের কবি কাজি নজরুল ইসলাম এখানে অতি আদরের হয়ে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে তাকে সমতুল্য মুসলমানদের কবি বানানো হলো। এর সবই ছফা করেছিলেন তা নয়। তার এত ক্ষমতা কোথায়?
দেশভাগের ফলে বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক সামাজিক আধিপত্য চিরতরে উচ্ছেদ হলেও বাংলার অভিন্ন সাহিত্য সংস্কৃতি যে মুসলিম জাতীয়তাবাদ গড়তে বড় বাধা সেটি ছফা বুঝতেন। বাঙালি মুসলমানের নিজস্বতা নামের সোনার পাথরবাটি তাই তিনি খোঁজা শুরু করলেন। বাংলাদেশের "মুসলিম বাংলা" আবার গেঁড়ে বসল ষাটের দশকের অর্জন প্রগতিশীলতার উপর। ছফার ভারত বিরোধিতা ছিলো বুদ্ধিবৃত্তিক হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরোধিতা। এটা করতে গিয়ে বাঙালি মুসলমান সমাজের মুক্তি মিলেনি। তার মানে এই না ছফার একার চেষ্টায় এটা সম্ভব হয়েছে। তাহলে তো তাকে রবীন্দ্রনাথের পর সব চেয়ে প্রভাবশালী বলা যেত। তিনি লেখক হিসেবে মাঝারি মানের ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য বিশেষত আনন্দবাজারের উপর তার রাগ ছিলো সাংঘাতিক। ছফার লেখা যদি আনন্দবাজার চেয়ে নিয়ে ছাপতো আমার ধারণা তিনি এতখানি পশ্চিমবঙ্গ বিরোধী হতেন না! বাংলাদেশের মানুষ সহজাতভাবে ভারত ও হিন্দু বিরোধী হয়। ছফাকে কিছুই করতে হয়নি। মুসলিম জাতীয়তাবাদ এমনিতেই এখানে জাগ্রত ছিলো। ছফা শুধুমাত্র স্বাধীনতার পর "মুসলিম লীগ বুদ্ধিজীবীদের" প্রগতিশীল কাতারে এনে আওয়াজ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ ছফার সেরকম ইমেজ ছিলো। ফরুখ আহমদ গোলাম মুস্তফারা বাংলাদেশ স্বাধীনের পর নিস্প্রভ হয়ে পড়েছিলো। ছফা এই ঘরোনার লেখক বুদ্ধিজীবীদের একটা প্লাটফর্ম দিলেন ভারত বিরোধিতার ছলে। দেশভাগের পরও তাই চট্টোপাধ্যায় গঙ্গোপাধ্যায়দের ভূত দর্শন করে তাদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানানো হলো। "দাদারা আমাদের বাজার খেয়ে ফেলল" এই আহাজারি করাই হয়ে উঠলো ঢাকার লেখক পাড়ার আসল চর্চা।
ছফা গাদ্দাফির গ্রীণ বুক অনুবাদ করেছিলেন। গাদ্দাফি ছিলেন লিবিয়ার ইসলামিক সমাজতন্ত্রের ধারকবাহক। লিবিয়ায় সমাজতন্ত্রের পাশাপাশি শরীয়া আইন চালু করেছিলেন গাদ্দাফি। ১৫ আগস্টের খুনিদের অনেকে "ইসলামিক সমাজতান্ত্রিক" ছিলো। ধারণা করা যায় ১৫ আগস্টের পর টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ছফাদের গাদ্দাফির ইসলামিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিলো। ছফার গুরু প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ১৫ আগস্টের খুনিদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের মধ্যে ইসলামপন্থী আগে থেকেই ছিলো। খন্দকার মুশতাক তাদের প্রতিনিধি। তিনি ইসলামিক রিপাবলিক করতে চেয়েছিলেন। পারেননি ভারতের চাপের কারণে। অপরদিকে ইসলামিক সমাজতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হলো না। ছফারা ব্যর্থ হলেন। ক্ষমতায় চলে এলেন জিয়াউর রহমান। তিনি আধাখেঁচড়া একটা রাষ্ট্র গঠন করলেন। যেমনটা পাকিস্তান হয়েছিল। ইসলাম রাখলেন রাষ্ট্রের মধ্যে তবু পুরোপুরি ইসলামিক নয়। জিয়াউর রহমান ধার্মিক মুসলমান ছিলেন না। ছফার কাছে জিয়াউর রহমান হয়তো অনেক স্বস্তির ছিলেন তাই। যাই হোক, ছফার একটা অবদান আছে স্বীকার করতে হবে। তিনি কিছু মুরিদ রেখে গিয়েছিলেন। তারা বাঘ নাই বনে শিয়াল রাজা। ফলে তারাই দেশের বুদ্ধিজীবী সেজে আছে। তারাই এখন মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রধান কান্ডারী। ছফার অবদান এতটুকুই।
©সুষুপ্ত পাঠক
0 মন্তব্যসমূহ