মকর সংক্রান্তি উৎসব - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

মকর সংক্রান্তি উৎসব - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

মকর সংক্রান্তি বা পৌষ সংক্রান্তি হল পৌষ মাসের শেষ দিন। সূর্য ধনু রাশি অতিক্রম করে মকর রাশিতে প্রবেশের কারণে মকর সংক্রান্তি বলা হয়। মকর শব্দটি মকর রাশিকে বুঝানো হয়েছে। আর সংক্রান্তির অর্থ হচ্ছে সংক্রমণ অর্থাৎ প্রবেশ করাকে বুঝায়।নাক্ষত্রিক মাস গণনায় সংক্রান্তি বারোটি। এর মধ্যে মেষ, কর্কট, তুলা ও মকর সংক্রান্তি অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ। মকর সংক্রান্তির বিশেষ মাহাত্ম্য কারন এই দিনে সূর্য দক্ষিণায়ন থেকে উত্তরায়ণে যাত্রা করে। সূর্য উত্তরদিকে যাত্রা শুরু করে। এর আগে সূর্যদেব দক্ষিন দিকে যাত্রা শুরু করেছিল, এখন উত্তর দিকে যাত্রা শুরু করবে। সূর্য এভাবে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এবং পৌষ এ ছয়মাস দক্ষিণে পরিক্রমা করলে দক্ষিণায়ণ হয়। পরবর্তী মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য এবং আষাঢ় এ ছয়মাস উত্তরদিকে পরিক্রমাকালীন সময়কে উত্তরায়ণ বলে। উত্তরায়ণ দিনটি ধর্মশাস্ত্রে অত্যন্ত পবিত্র বলে বর্ণিত হয়েছে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাতেও উত্তরায়ণ সময়কাল প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। 


অগ্নির্জ্যোতিরহঃ শুক্লঃ ষণ্মাসা উত্তরায়ণম্।

তত্র প্রয়াতা গচ্ছন্তি ব্রহ্ম ব্রহ্মবিদো জনাঃ।। 

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ৮.২৪)

"ব্রহ্মবিৎ পুরুষগণ অগ্নি, জ্যোতি, শুভদিন, শুক্লপক্ষে ও ছয় মাস উত্তরায়ণ কালে দেহত্যাগ করলে ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়ে মুক্তি লাভ করেন।"


মকর সংক্রান্তি থেকে শুরু করে মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য এবং আষাঢ় এ ছয়মাসের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করে তারা ব্রহ্ম প্রাপ্ত হয়ে মুক্তি লাভ করেন। পক্ষান্তরে শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ এবং পৌষ দক্ষিণায়নে এ ছয়মাস যারা দেহত্যাগ করবেন তারা নিম্নলোক প্রাপ্ত হয়ে পুনরায় জগতে ফিরে আসেন। বিষয়টি মহাভারতে পিতামহ ভীষ্মের জীবনেও দেখা যায়। ইচ্ছামৃত্যুর বর থাকায় কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে অর্জুনের অসংখ্য তীরদ্বারা ক্ষত-বিক্ষত হয়েও দেহত্যাগের জন্য তিনি উত্তরায়ণের শুরুর দিনটিকেই বেছে নেন। গঙ্গাপুত্র দেবব্রত, যাঁর ভীষণ প্রতিজ্ঞাবাক্যের কারণে তাঁর নাম হয় ভীষ্ম। মহাভারতে তাঁকে নিয়ে একটি পর্বই আছে, যে পর্বের নাম ভীষ্মপর্ব। পিতা চন্দ্রবংশীয় রাজা শান্তুনু থেকে তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর পেয়েছিলেন যে, তিনি তাঁর ইচ্ছানুযায়ী মৃত্যুবরণ করতে পারবেন । অর্থাৎ তাঁর নিজের ইচ্ছা বিহীন তাঁর কখনই মৃত্যু হবে না। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীর সহায়তায় অর্জুন পিতামহ ভীষ্মকে  অসংখ্য তীর দ্বারা বিদ্ধ করে এক শরশয্যা নির্মান করে। পিতামহ সেই শরশয্যায় তৎক্ষনাৎ দেহত্যাগ না করে ৫৮ দিন পরে পৌষ সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণের প্রথম দিনে স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পূর্বে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারায়ণরূপে পিতামহ ভীষ্মকে দর্শন দিয়ে তাঁকে আশ্বস্ত করেন যে, মৃত্যুর পরে তিনি অবশ্যই মোক্ষ লাভ করবেন ।


পৃথিবী বছরে ৩৬৫ দিনে একবার সূর্যকে পরিভ্রমণ করে আসে। সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর এ অতিক্রমকেই বলে এক সৌর বছর । কিন্তু দেবতাদের গননা অনুসারে মনুষ্যের এক বছর দেবতাদের এক দিন অর্থাৎ ২৪ ঘন্টা। দেবতারা পৃথিবী সময়ানুযায়ী এক বছরে একবার সূর্যের পরিক্রমা করে। আর দেবতাদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১২ ঘন্টা দিন আর ১২ ঘন্টা রাত্রি। আমাদের পৃথিবীর ৬ মাস আর দেবতাদের ১২ ঘন্টার সমান। আর দেবতাদের দিন শুরু হয় এই মকর সংক্রান্তির দিনে। সারা ভারতবর্ষেই পৌষ সংক্রান্তি এবং উত্তরায়ণের প্রথম দিনটি পালিত হয় বিভিন্ন নামে ও বিভিন্ন বৈচিত্র্যময় রূপে। বাংলায় পৌষ সংক্রান্তি, তামিলনাড়ুতে পোঙ্গল, গুজরাতে উত্তরায়ণ, অসমে ভোগালি বিহু, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ ও জম্মুতে লোহ্রি, কর্নাটকে মকর সংক্রমণ, কাশ্মীরে শায়েন-ক্রাত। উত্তর ভারতের অন্যান্য অঞ্চল, ওডিশা, মহারাষ্ট্র, গোয়া, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা এবং কেরলে মকর সংক্রান্তি নামটিই প্রচলিত।  যদিও পাশাপাশি স্থানীয় নামেরও প্রচলন রয়েছে। যেমন মধ্যপ্রদেশে সুকরাত বা বিহার, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের কোনও কোনও এলাকায় খিচড়ি পর্ব। সারা ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই এ উৎসবটি পালিত হয়। নেপালে এ উৎসবটি 'মাঘে' নামে, থাইল্যান্ডে 'সোংক্রান', লাওসে 'পি মা লো', মিয়ানমারে 'থিং ইয়ান' এবং কম্বোডিয়ায় 'মোহা সোংক্রান' নামে উদযাপিত হয়।

পৌষ সংক্রান্তিতে ভগবানকে বিভিন্ন রকম পিঠা, পায়েস এবং খিচুড়ির ভোগ দেয়া হয়।ভারতের উত্তর প্রদেশে এই দিনে বিভিন্ন প্রকারের খিচুড়ি রান্না করা হয়। তাই এ দিনটিকে উত্তর ভারতে খিচুড়ি উৎসব নামে অবিহিত করা হয়। সূর্যদেবের পূজা করে থাকে আর সূর্যদেবকে বিভিন্ন প্রকার চাল, ডাল দিয়ে সুস্বাদু খিচুড়ি ভোগ দেয়া হয়।গুজরাট আর রাজস্থানে তারা ঘুড়ি উড়িয়ে থাকে। তারা একে ঘুড়ি উৎসব বলে থাকে। আর তারা গজা ও পিঠা করে থাকে। অন্ধ্রপ্রদেশে তিন দিন ধরে এই উৎসব করে থাকে।তামিলনাড়ুতে নতুন ফসলের ধানের চাল দিয়ে দুধ ও ঘি দিয়ে একরম পায়েশ রান্না করে থাকে যাকে পোঙ্গল বলা হয়ে থাকে৷ আর ডাল চাল দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে থাকে। মহারাষ্ট্রে এদিনে তিলের তৈরি লাড্ডু বানিয়ে সবাইকে বিতরণ করে।বাংলাদেশে প্রতিটি গ্রামে এই সংক্রান্তিতে পিঠা উৎসব করে থাকে। এ দিনে গ্রাম এলাকায় বাস্তু দেবতাকে নতুন চালের নবান্নও দেয়া হয়। বাংলাদেশের বরিশালে সহ দক্ষিণাঞ্চলে প্রত্যেকের বাস্তুভিটায় মাটির একটি কুমিরের মূর্তি বানিয়ে বাস্তুদেবতার পূজা করা হয়।কিছু কিছু অঞ্চলে বাস্তু পূজা শেষে মাটির  কুমিরটিকে বলি দেয়া হয়।কুমিরটি যেন সে গৃহ এবং নগরের কোন অনিষ্ট  করতে না পারে। সংস্কৃত ভাষায় হাতির মুখের সদৃশ গঙ্গায় বাসকৃত দেবী গঙ্গার বাহনকে মকর বলা হয় । আবার কুমিরকেও মকর নামে অবিহিত করা হয়। জ্যোতিষীয় ধারণায় সূর্যের ধনু রাশি থেকে মকর রাশিতে অতিক্রম  করাতে  এ সংক্রান্তিটির নাম মকর সংক্রান্তি। তাই এদিনে অনুষ্ঠেয় বাস্তুপূজায় বাংলার দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন স্থানে মকর বা কুমিরের মূর্তি তৈরি করা হয়। বাস্তুদেবতা পূজার দুটি ধ্যানমন্ত্র  অত্যন্ত জনপ্রিয়। বাস্তু দেবতার মূর্তিবিহীনভাবে পূজা করা হয়। কারণ ভুবনই তাঁর স্বরূপ। 


সিংহিকাতনয়ং বাস্তং দেবৈর্ভূমিনিপাতিতম্। 

ধরাং ব্যাপ্য স্থিতমুগ্রং সর্বভূতবিনাশকম্।।

প্রােত্তনং কৃষ্ণবর্ণঞ্চ পুরুষমসুরাকৃতিম্। 

অধােমুখং মহাকায়ং শালাদিকসমন্বিতম্।।


অথবা,


শশধরসমবর্ণং রত্নহারােজ্জ্বলাঙ্গং

কনকমুকুটচূড়ং স্বর্ণযজ্ঞোপবীতম্। 

অভয়বরদহস্তং সর্বলােকৈকনাথং

তমিহ ভুবনরূপং বাস্তুরাজং ভজামি।।


মকর সংক্রান্তির সময়টি যেহেতু  ঋতু পরিবর্তনের সময়, ফসল পাকানোর সময়, তাই নতুন ঋতুতে বিভিন্ন বস্তুতে সূর্যের সরাসরি প্রভাব থাকে। সূর্যের প্রকাশ, দীপ্ত, উজ্জ্বলতা মকর সংক্রান্তি দিনে সংক্রমণ করে উত্তরায়ণের শুরু হয়। পুরাণ ঢাকায় সংক্রান্তি দিনটি অত্যন্ত আনন্দঘন উৎসবমুখরভাবে পালিত হয়। পুরাণ ঢাকার মানুষ দিনটিকে 'সাকরাইন' নামে অবিহিত করে। এ পৌষ সংক্রান্তির দিনে পুরাণ ঢাকায় হিন্দু- মুসলিম নির্বিশেষে সারাদিনব্যাপি এক ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।আকাশজুড়ে শুধুই লাল, নীল, বেগুনি নানা বাহারি রঙের ঘুড়ির মেলায় বানিয়ানগর, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজারসহ প্রায় সম্পূর্ণ পুরাণ ঢাকা জুড়ে অধিকাংশ ছাদেই শিশু, তরুণ এবং বৃদ্ধের আনন্দ উচ্ছ্বাস। ছাদে গানবাজনার তালে ঘুড়ি বর্ণিল রঙের ঘুড়ি ওড়ানো হয়। ঘুড়ি উৎসব বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী একটি উৎসব।দিনভর ঘুড়ি ওড়ানোর পর রাতেও থাকে ফানুস এবং আতশবাজির বর্ণাঢ্য আয়োজন। আমরাও বাল্যকালে এ ঘুড়ি উৎসবে বিভিন্ন সময়ে অংশগ্রহণ করেছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি গানে পৌষে প্রকৃতির স্বতঃস্ফূর্ত রূপ এবং অনন্য সৌন্দর্য অসাধারণ কাব্যময়তায় ধরা পরেছে।


"পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে,  আ য় আ য় আয়।

ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে,  মরি   হায়   হায়   হায়॥

হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে   দিগ্‌বধূরা ধানের ক্ষেতে-

রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে মাটির আঁচলে, মরি  হা য় হা য়  হায়॥

মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।

 ঘরেতে আজ কে রবে গো,   খোলো   খোলো দুয়ার খোলো।

আলোর হাসি উঠল জেগে   ধানের শিষে শিশির লেগে-

ধরার খুশি ধরে না গো, ওই-যে উথলে, মরি  হা য়   হা য় হায়॥"


বীরভূমের কেন্দুলী গ্রামে মকর সংক্রান্তিকে কেন্দ্র করে কবি জয়দেব গোস্বামীর নামে এক বাউল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। দেশবিদেশের অসংখ্য  বাউলদের বাউল সংগীতই এ মেলার অন্যতম আকর্ষণ। পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত সাগরদ্বীপে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে কপিল মুনির আশ্রমে পুণ্যস্নান এবং মেলা অনুষ্ঠিত হয়। লাখো লাখো ভক্তের সমাগম হয় এই মেলায়।পশ্চিমবঙ্গে হুগলি নদীর তটে গঙ্গা সাগর মেলা হয়ে থাকে। এই মকর সংক্রান্তি দিনেই ভগীরথের পিছনেই গঙ্গা মাতা তার পূর্বপুরুষদের উদ্ধার করে থাকেন। আর এই গঙ্গা মাতা সাগরের সাথে মিশে যায়। তাই এই দিনে সবাই গঙ্গা স্নান সম্পূর্ন করে থাকে আর পিতৃপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পন করে থাকে। আর সূর্যদেবের পূজা করে থাকে।মকর সংক্রান্তিতে সূর্যরশ্মি গায়ে লাগানো স্বাস্থ্যের পক্ষে ভীষণ উপকারী। এই দিন থেকেই মূলত ঠাণ্ডা একটু একটু করে কমতে শুরু করে।



**********

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়



Source Link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ