একেশ্বরবাদ বা ইশ্বর একজন- এই ধারনা আব্রাহামিক ধর্মগুলির মূল কথা। অর্থাৎ স্রষ্টা সংখ্যায় কয়জন সেটাই মূল কথা। অনেক হিন্দুই মনে করেন যে হিন্দু ধর্মেও নানা দেব দেবী থাকলেও তারা একজন ইশ্বরেরই উপাসনা করছেন এবং দেব দেবীরা সেই একমাত্র ইশ্বরের প্রতীক। এবং মনে করেন হিন্দু ধর্মও একেশ্বরবাদী। কিন্তু প্রকৃত সত্য হল হিন্দু ধর্মীয় দর্শণে ইশ্বর এক না বহু সেসবের কোন স্থান নেই। অদ্বৈতবাদ আর একেশ্বরবাদ এক কথা নয়।
যদি এতো সহজে হিন্দু ধর্মকে বুঝা যেত তবে বিপুল দর্শণ শাস্ত্রের উদ্ভব হতোনা।তবে সংক্ষেপে একটু বলি। হিন্দু ধর্মে একেশ্বরবাদ বলতে কিছু নেই। হিন্দু ধর্ম দর্শণ ভিত্তিক। ইশ্বর এক না দুই না বহু এসব দর্শণের বিষয় নয় এটা একান্ত ব্যক্তির বিশ্বাস। আব্রাহামিক গ্রন্থে ইশ্বর নিজের কথা বলতে গিয়ে একবার একবার একবচন ‘আমি’ আরেকবার বহুবচন ‘আমরা’ ব্যবহার করেছেন। একই সাথে বলা চলে যে একজন ইশ্বরকে গড বলবে, আরেকজন ভগবান বলবে কারন এটা ব্যক্তির সংস্কৃতি বা বিশ্বাস। একজন মাটির মূর্তি গডবে আরেকজন ইশ্বরের ঘর বানাবে ইত্যাদি। এসবই স্থানীয় সংস্কৃতি বা বিশ্বাসজাত ব্যাপার। আর এটাই হচ্ছে রিলিজিয়ন সমূহের পার্থক্য। এগুলো কোন যুক্তি দ্বারা চলেনা। চলে হুজুগে ফলে পীর ফকির ধর্মগুরুর উদ্ভব হয়। সৃষ্টি হয় নানা আচার ভিত্তিক সমাজ।
আসলে হিন্দু ধর্মের অদ্বৈতবাদ হচ্ছে স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক নিয়ে। স্রষ্টা আর সৃষ্টি কি আলাদা ? - নাকি স্রষ্টা ও সৃষ্টি অভিন্ন? যদি দুটি আলাদা হয় তবে তা দ্বৈতবাদ। আর যদি স্রষ্টা আর সৃষ্টি অভিন্ন হয় তবে তাকেই বলা হয় অদ্বৈতবাদ। প্রসংগক্রমে বলি, মাধবাচর্যের দ্বৈতবাদ বলে একটা মতবাদ আছে যাতে ইশ্বর ও সৃষ্টি আলাদা। একজন মানুষ দ্বৈতবাদী হয়েই জন্মগ্রহণ করে। দ্বৈতবাদে ঈশ্বরকে সব থেকে সহজে কল্পনা করা যায়। তাই অধিকাংশ মানুষই দ্বৈতবাদী।জ্ঞানের বিকাশ ঘটলে মানুষ দ্বৈতবাদ থেকে অদ্বৈতবাদ স্তরে উপনীত হয়।
মৃত্যুর পর আমি যদি প্রকৃতিতে বা ইশ্বরে বিলীন হয়ে যাই বলে মনে করি তবে আমি অদ্বৈতবাদী। আর যদি মনে করি আমি মরলেও প্রকৃতিতে বিলীন হবোনা এবং পাপ পূন্য বিচারের সম্মূখীন হব বা আমাকে স্বর্গে নয়ত নরকে যেতে হবে-তবে আমি দ্বৈতবাদী। পুনর্জন্মে বিশ্বাসটা আবার দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদের মধ্যবর্তী অবস্থান। বৌদ্ধ ধর্মে সেটা প্রধান। বারবার জন্ম হবে যতক্ষণ না চক্র থেকে মুক্তি হচ্ছে।
লক্ষণীয় যে এখানে “ইশ্বর এক না বহু” -এই স্থূল ভাবনার স্থান নেই। “মরনরে তুঁহু মম শ্যাম সমান”- অর্থাৎ মৃত্যুই ইশ্বর ও আমার বিভেদ ঘুচিয়ে দেবে। “ মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে”- এটাই অদ্বৈতবাদ। ” তাই তোমার আনন্দ আমার পর তুমি তাই এসেছ নীচে”- সেই একই কথা।
শংকরাচার্য অদ্বৈতবাদের কথাই বলেছেন। ইশ্বরের সংখ্যা নিয়ে কথা বলা হাস্যকর।কে আস্তিক আর কে নাস্তিক এসব যারা বিচার করছে তারা নিতান্ত অন্ধ। বোকার হাতী দর্শনের মত এরা সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে দেখছে।
একেশ্বরবাদ প্রকৃতপক্ষে দ্বৈতবাদী ধারনা কারন তাতে ইশ্বর আর প্রকৃতি দুটো সম্পূর্ণ আলাদা সত্বা হয়ে যায়। যদি প্রকৃতি না থাকত তবে নিশ্চয় ইশ্বরেরও অস্তিত্ব থাকত না।কারন অস্তিত্ব মাত্রই প্রকৃতি - হয় energy নয় matter. তাই তখন উল্টো স্বীকার করতে হবে প্রকৃতিই ইশ্বরেরও জন্মদাতা।
সুত্র লিংক
0 মন্তব্যসমূহ