পূর্বদিকে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ নিষিদ্ধ - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

পূর্বদিকে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ নিষিদ্ধ - কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী


উত্তর পূর্ব দিককে অপরাজিতা দিক বলা হয়। তাই সনাতন ধর্মে  দুইএকটা ব্যতিক্রম ছাড়া সকল আধ্যাত্মিক কর্মই  উত্তর-পূর্ব দিকে মুখ করে করতে হয়। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্রেও  উত্তর-পূর্ব দিক বা অপরাজিতা দিকের মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। 


অথাপরাজিতায়াং দিশ্যবস্থায় স্বস্ত্যাত্রেয়ং 

জপতি যত ইন্দ্ৰ ভয়ামহ ইতি চ সূক্তশেষম্।।

(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র:৩.১১.২)

"এরপর অপরাজিতা দিকে অথবা উত্তর-পূর্বদিকে দাঁড়িয়ে স্বস্ত্যাত্রেয় সূক্ত (ঋগ্বেদ সংহিতা:৫.৫১.১১) এবং ‘যত ইন্দ্ৰ-’ (ঋগ্বেদ সংহিতা:৮.৬১.১৩) এই অবশিষ্ট সূক্তাংশ জপ করতে হবে।"


আহিতাগ্নিশ্ চেদ্ উপতপেত্ প্রাচ্যাম্ উদীচ্যাম্ অপরাজিতায়াং বা দিশ্যুদবস্যেত্ ।।১।।

(আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র:৪.১.১)

"আহিতাগ্নি ব্যক্তি যদি ব্যাধিগ্রস্ত হন, তিনি গৃহ থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে অগ্নিসমেত অপরাজিতা দিকে অথবা উত্তর-পূর্ব দিকে যাবেন।"


মহাভারতে দেবগুরু বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্রকে বলেন, যারা সূর্য্যের অভিমুখে, অর্থাৎ পূর্বদিকে মুখ করে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ কবে;  যারা বায়ুর প্রতি বিদ্বেষ করে, অর্থাৎ বায়ুকে দুষিত করে; সামনে যজ্ঞের পবিত্র অগ্নি সম্মুখে প্রজ্বলিত হলেও, সে পবিত্র অগ্নিতে যারা সমিৎ প্রদান করে না; সদ্যজাত ধেনুকে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত করে  যারা দুগ্ধের জন্য বালবৎসা ধেনুকে দোহন করে;  তারা সকলেই অপরাধী।কারণ সূৰ্য্য, বায়ু, অগ্নি এবং লোকমাতা গো মর্ত্যের এ দেবতাদের স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছেন।সূৰ্য্য, বায়ু, অগ্নি এবং লোকমাতা গো দেবতারা মর্ত্যলোকের মনুষ্যদেরকে সকল বিপদ হতেই উদ্ধার করতে সমর্থ। তাই যে সকল দুর্বৃত্ত পুরুষ এবং স্ত্রী সূর্যের অভিমুখে প্রস্রাব করে, কিংবা যারা প্রাণস্বরূপ বায়ুকে দুষিত করে তাদের ষড়শীতি বৎসব যাবৎ অকালে গর্ভস্রাব হয়। অর্থাৎ তাদের সন্তানধারা রুদ্ধ হয়। দেবগুরু বৃহস্পতি তাদের বংশদূষক দুর্বৃত্ত নামে অভিহিত করেছেন। সেই  বংশদূষক দুর্বৃত্ত বংশ বা কুলকে দুষিত করে, দুর্বৃত্তায়িত করে, এবং অপবিত্র করে।

বৃহস্পতিরুবাচ।


প্রতিমেহন্তি যে সূৰ্য্যমনিলং দ্বিষতে চ যে ।

 হব্যবাহে প্রদীপ্তে চ সমিধং যে ন জুবতি ॥

 বালবৎসাঞ্চ যে ধেনুং দুহন্তি ক্ষীরকারণাৎ । 

তেষাং দোষান্ প্রবক্ষ্যামি তান্নিবোধ শচীপতে ॥ (যুগ্মকম্ )

ভানুমাননিলশ্চৈব হব্যবাহশ্চ বাসব৷ 

 লোকানাং মাতরশ্চৈব গাবঃ সৃষ্টাঃ স্বয়ম্ভুবা ॥

 লোকাংস্তারয়িতুং শক্তা মর্ত্যেষ্বেতেষু দেবতাঃ।

 সর্বে ভবন্তঃ শৃণ্বন্তু একৈকং ধৰ্মনিশ্চয়ম্ ॥

 বর্ষাণি ষড়শীতিন্তু দুর্বৃতাঃ কুলপাংসনাঃ । 

স্ত্রিয়ঃ সর্বাশ্চ দুর্বৃত্তাঃ প্রতিমেহন্তি যা রবিম্ । অনিলদ্বেষিণঃ শত্রু গর্ভস্থা চ্যবতে প্রজা ॥

 হব্যবাহস্য দীপ্তস্য সমিধং যে ন জুহ্বতি। 

অগ্নিকাৰ্য্যেষু বৈ তেষাং হব্যং নাশ্নাতি পাবকঃ ॥

(মহাভারত: অনুশাসন পর্ব, ১০৬.৫৭-৬২)

"বৃহস্পতি বললেন— যারা সূর্য্যের অভিমুখে প্রস্রাব কবে, যারা বায়ুর প্রতি বিদ্বেষ করে, যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত হলে তাতে যারা সমিৎ প্রদান করে না এবং যারা দুগ্ধের জন্য বালবৎসা ধেনুকে দোহন করে;  তাদের দোষের বিষয় আমি বলছি।  হে দেবরাজ,  আপনি তা শ্রবণ করুন।

হে দেববাজ!  সূৰ্য্য, বায়ু, অগ্নি এবং লোকমাতা গো এ দেবতাদের স্বয়ং ব্রহ্মা সৃষ্টি করেছেন।

এই দেবতারা মর্ত্যলোকের লোকদেরকে বিপদ হতে উদ্ধার করতে সমর্থ। সে যা হোক, আপনারা সকলে এক এক মাহাত্ম্যপূর্ণ ধর্মতত্ত্ব শ্রবণ করুন।

হে ইন্দ্র, যে সকল বংশদূষক দুর্বৃত্ত পুরুষ এবং দুর্বৃত্ত স্ত্রী সূর্যের অভিমুখে প্রস্রাব করে, কিংবা যারা বায়ুর সাথে বিদ্বেষ কবে, তাদের ষড়শীতি বৎসব যাবৎ অকালে গর্ভস্রাব হয়। যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত হলে সে অগ্নিতে যারা যজ্ঞের সমিধ প্রদান না করে, তাদের অগ্নিকার্য্যে অগ্নি হব্য গ্রহণ করেন না।"


সূর্য্যের অভিমুখে, অর্থাৎ পূর্বদিকে মুখ করে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ যেহেতু শাস্ত্রীয় মতে নিষিদ্ধ, তাই কিভাবে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ করতে হবে এ গার্হস্থ্য সদাচার  সম্পর্কে বিষ্ণুপুরাণ এবং  বিষ্ণুসংহিতায় বলা হয়েছে:


উদঙ্মুখো দিবা মূত্রং বিপরীতমুখো নিশি।   

কুর্বীতানাপদি প্রাজ্ঞো মূত্রোৎসর্গং চ পার্থিব৷৷

(বিষ্ণুপুরাণ: ৩.১১.১৪)

"কোন বিশেষ অসুবিধা না থাকলে প্রাজ্ঞপুরুষের উচিত দিনে উত্তর মুখ করে এবং রাত্রে দক্ষিণ মুখ করে মূত্রত্যাগ করা।"

ব্রাহ্মে মুহূর্ত্তে উত্থায় মূত্রপুরীষোৎসর্গং কুর্য্যাং

দক্ষিণাভিমুখো রাত্রৌ দিবা চোদম্মুখঃ সন্ধ্যয়োশ্চ ।।

(বিষ্ণুসংহিতা: ৬০.১)

 "ব্রাহ্মমুহূর্ত্তে (রাত্রির শেষ চারি দণ্ড অরুণোদয় কাল, এর প্রথম দুই দণ্ড বা ৪৮ মিনিট হলো ব্রাহ্মমুহূৰ্ত্ত ) সজ্জা থেকে গাত্রোত্থান করে রাত্রিকালে দক্ষিণমুখ হয়ে এবং দিবসে, প্রাতঃসন্ধ্যা  ও সায়ংসন্ধ্যা উভয় সন্ধ্যাকালে উত্তরমুখ হয়ে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ করবে।"


একথা সত্য যে ঈশ্বর সর্বভুতেই বিরাজ করেন।  এ পৃথিবীর দশদিক বা প্রধানত চারদিকেই তিনি আছেন। এরপরেও সূর্যের প্রকাশের দিক হিসেবে পূর্বদিক অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ। আধ্যাত্মিক অধিকাংশ কর্মই পূর্বদিকে মুখ করে করা হয়। তাই কখনো মনের ভুলেও সূর্যের প্রকাশের দিকে বা পূর্বদিকে মুখ করে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ করতে নেই। এতে পাপ গ্রাস করে।


--

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


Link

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ