২০১০ সালে তিউনিশিয়ায় শুরু হওয়া বিপ্লব- ‘আরব বসন্ত’ বিস্তার ঘটেছিল সোস্যাল মিডিয়ার সহায়তায়। ওই একই সময়ে বাঙালির হাতেও এসেছিল ইন্টারনেট, সোস্যাল মিডিয়া, কিন্তু তা থেকে বিপ্লব হয়নি। হয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, যার পেছনে ছিল শাসকদের প্রচ্ছন্ন আসকারা। আর কী হয়েছে? হরিপদ-হরমুজ আলী-নগেন-খগেন-রহিম-রূপবানদের ফতোয়াবাজী এবং ইন্সট্যান্ট বুদ্ধিজীবী বনে যাওয়া। বিশেষ বিশেষ দিন এলেই তাদের বিশেষ বিশেষ অঙ্গে দাহ এবং প্রদাহ শুরু হয়।
#
শত শত বছর ধরে বাংলার চাষারা চৈত্র সংক্রান্তির পরদিন বাংলা নববর্ষ পালন করে আসছে। এতে প্রথম বাম হস্ত প্রবিষ্ট করে সামরিক শাসক এরশাদ। এরশাদ সাহেব বাংলা সনের ক্যালেন্ডার সংস্কারের নামে কিছু সুক্ষ কৌশলী বিষয় মাথায় রেখে কিছু পরিবর্তন করেন। এরশাদের শাসনামলের শেষের সময়ে সম্ভবত ১৯৮৮ সালের দিকে, বাংলা সনের বর্ষপঞ্জী সংস্কারের নামে একটি কমিটি গঠন করেন। তাঁর গঠিত এই কমিটি বাংলা বর্ষপঞ্জী এমনভাবে সংস্কার করে, যার ফলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে একসঙ্গে পালিত হওয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিন একই দিনে অনুষ্ঠিত না হয়ে অন্ততপক্ষে একদিনের পার্থক্য হয়।
#
গবেষকদের মতে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সনাতনী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের সনাতনী জনগোষ্ঠীর মানসিক ও মাঙ্গলিক উৎসবের মধ্যে দুরত্ব বৃদ্ধি করতে এই বাংলা সনের বর্ষপঞ্জী সংস্কার করেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এরশাদ। তারও পরিবার কোচবিহার থেকে পূর্ববঙ্গে এসেছিল। স্বভাবতই তিনি নিজেকে ‘বিতাড়িত’ মনে করতেন। তাই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি তার দ্বেষ ছিল।
#
পাশাপাশি দুই প্রতিবেশি দেশে যখন কোনো জাতি একই দিনে বর্ষবরণ, ঐতিহ্যবাহী, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে তখন তাদের মধ্যে এক ধরণের মানসিক বন্ধন বা সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরী হয়। এরশাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সনাতনীদের থেকে বাংলাদেশের সনাতনীগণ এবং মানবতাবোধ সম্পন্ন মুসলমানদেরকে যথাক্রমে মুসলিম সংস্কৃতি ও ধর্মান্ধ মুসলিম তৈরী করা।
#
এর মধ্যে ১৯৮৪-৮৫ সালে প্রথমে যশোরে, পরে ঢাকায় ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নাম দিয়ে উৎসব বা কার্নিভালের প্রচলন। আরও পরে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এর নাম বদলে করে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। তাতেও সমস্যা হয়নি তখন। সমস্যা হলো শাহবাগ গণজাগরণ আর শাপলা চত্তরের মহাসমাবেশের পরে। এক শ্রেণির মুসলিম বাঙালির মনে হলো ‘মঙ্গল’ হিন্দুয়ানি শব্দ, অতএব খারিজ। এরা বুঝল না ‘আনন্দ’ও হিন্দুয়ানি। সে অর্থে বাংলা ভাষাই হিন্দুয়ানি। যে গ্রহ-নক্ষত্র’র নামানুযায়ী বাংলা মাস এবং বারের নাম সেসবই হিন্দুয়ানি। আপনি যতোই বাংলা ভাষায় আরবী-ফার্সি-উর্দু প্রবেশ করানোর চেষ্টা করুন না কেন, বাংলার কথ্য এবং প্রমিত কোনও রূপকেই আমূল বদলে দিতে পারবেন না। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া, নাগলিঙ্গম, শিউলী-শেফালি স্ব স্ব নামেই ফুটবে।
#
এদের আরও এক স্ববিরোধীতা আছে। বাংলা নববর্ষকে, মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাতিল, শিরক, খারিজ, ‘মুসলমানরা যেতে পারে না’ বললেও বৈশাখী ভাতা নিতে ভোলে না! ইদানিং আবার খ্যাপ মারা মাওলানারা ইউটিউবে ফতোয়া দিচ্ছে-‘বাংলা ভাষা আল্লাহর দান’। তাই যদি হয় তাহলে সেই ‘আল্লাহর দান’কে অবজ্ঞা করা কী শিরক নয়?
#
আর এক গ্রুপ মাঠে নেমেছে বাংলা সনের প্রবর্তক সম্রাট আকবর প্রমাণের জন্য। কারণ কী? আকবর মুসলমান! এ বিষেয় প্রচুর তথ্য-প্রমাণ আছে যে তিনি প্রবর্তক নন। সে আলোচনায় গেলে আস্ত বই লিখতে হবে। সংক্ষেপে—মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে বিখ্যাত গ্রন্থ “আইন-ই-আকবরী”। কিন্তু মুঘলদের এই গ্রন্থে বাংলা সন অথবা ফসলী সন প্রবর্তনের বিষয়ে কোনো তথ্যের উল্লেখ নেই। তবে ঐ গ্রন্থে পাওয়া যায়, ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ইরানে প্রচলিত ”জেলালি সৌর পঞ্জিকা” অনুযায়ী ভারতবর্ষে ১৫৮৪ খ্রিষ্টাব্দে “তারিখ-ই-ইলাহী” নামক একটি সৌর পঞ্জিকা প্রবর্তন করেছিলো, কিন্তু কয়েক দশক পরে এই পঞ্জিকার ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
#
ঐতিহাসিকদের তথ্য মতে, ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি আকবরের রাজ্যভিষেক হয়েছিল মাত্র ১৩ বছর বয়সে। ঐ সময় থেকে যদি বাংলা সন প্রবর্তন হয়, তাহলে পহেলা বৈশাখ / বাংলা নববর্ষ ১৪ বা ১৫ এপ্রিল না হয়ে ১৪ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতো।
সবচেয়ে বড় কথা, ১৩ বছরের একজন ব্যক্তির পক্ষে অনেক দূরে অবস্থিত প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন এলাকায় কর আদায়ের সুবিধার জন্য ফসল তোলার সঙ্গে মিল রেখে এই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে একাকী সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেকটাই গোপনে বাংলা সন প্রবর্তন করা কিভাবে সম্ভব?
যদি কেউ মত প্রকাশ করে, পঞ্জিকা সংষ্কার করে ত্রুটিবিহীন করার কারণে বাংলা সন ১৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রবর্তিত হয়ে বর্তমানে ১৪/১৫ এপ্রিলে এসে পৌঁছেছে বাংলা নববর্ষ।
তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন চলে আসে, এই পঞ্জিকা কে কবে কিভাবে সংস্কার করেছিল?
কিন্তু মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলের বহু পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাফলক, সনাতন ধর্মীয় গ্রন্থে বাংলা সন ও তারিখের বিবরণ পাওয়া যায়, তাহলে এই বাংলা সনের তারিখগুলো কিভাবে আসল? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই।
#
তথ্য প্রমাণ অনুযায়ী ইতিহাসবিদদের ধারণা, রাজা শশাঙ্কের শাসনামল ছিল ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
বাংলা সনের নববর্ষের হিসাব অনুযায়ী এই বছর ১৪৩০ বাংলা সন যদি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ হয়, তাহলে বাংলা সনের প্রথম বছর ছিল- (২০২৪ – ১৪৩০) ৫৯৪ খ্রিস্টাব্দ। অতএব সেটা রাজা শশাঙ্কের শাসনামল।
স্বাধীন রাজা হিসাবে, শশাঙ্ক তাঁর রাজত্বকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী বঙ্গাব্দ তথা বাংলা সনের প্রচলন করেন।
#
আমাদের অর্থাৎ মার্কসবাদীদের দৃষ্টিতে এইসব বিষয়াদি নিয়ে কোনও বেগড়বাই থাকার কথা নয়। নেইও। মাও সেতুঙের মতানুযায়ী আমাদের কথা—‘শত ফুল ফুটতে দাও’। ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বলায় আপনার এই আয়োজন খারিজ করার পূর্ণ অধিকার আছে। আপনি যাবেন না। কেউ তো আপনাকে জোর-জবরদস্তি করেনি। যেমন ধর্মনিরপেক্ষবাদীরা ঈদে মিলাদুননবী মিছিলে যান না। কই তারা তো বলেন না- এটা নিষিদ্ধ করতে হবে?
#
২০১৯ সালে শফী মাওলানা বাণী দিলেন-
'কোন মুসলমান মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারে না'!
ব্যাস! সেটাকেই ‘সহি হাদিস’ ধরে নিয়ে একদল খারিজ খারিজ, বাতিল বাতিল মাতম তুলে দিল। যদিও তিনি নিজেই জীবনের শেষ কিছুদিন দিল্লির এক হাসপাতালে ‘হিন্দু’ ডাক্তার-নার্সদের সেবা-শুশ্রূষা গ্রহণে কোনো সমস্যা হয়নি।
#
আমার ব্যক্তি মত জানিয়ে লেখাটা শেষ করি……
একটি আধুনিক মুসলিম বাঙালি পরিবারের ক্রনোলজিঃ আমপারা-সিপারা শেষে কুরআন 'ধরা'র সময় মৌলবী সাহেবকে দাওয়াত দিয়ে শুরু....'মকসুদুল মোমীন বা বেহেস্তের কুঞ্জি' পড়ে ধর্ম-সমাজ-নৈতিকতা-নারী বিষয়ে (রগরগে যৌনতাও) জ্ঞানার্জন করতে গিয়ে বিকৃতির শুরু। এরপর ট্রেনে-বাসে ১০ টাকার 'কি করিলে কি হয়', 'নারী বশীকরণের ১০টি উপায়', 'ফুটন্ত গোলাপ' মার্কা পুস্তক পাঠে বড় হয়ে ওঠা... অতঃপর হুমায়ুন পড়ে 'হিমু' বাসনা লালন করা অবস্থায় হুমায়ুন আজাদ পড়ে অকস্মাৎ নিরিশ্বরবাদী হতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিসিএস পাশ করে ক্যাডার, বিবিধ চাকরি, ব্যবসা, ক্ষমতাবলয়ের পলিটিক্স, পার্টি, সেলিব্রেটি, বিদেশ ভ্রমণ, মসজিদ নির্মাণ, চেয়োরের পেছনে তোয়ালে, সরকারের (জনগণের) টাকার পয়মাল, নানাবিধ বিষয়ে আকসার জ্ঞানদান, বোকাবাক্সে ঘ্যানঘেনে প্যাচাল, রাষ্ট্রীয় ট্যুরে শ্যালিকা/বান্ধবীকে নিয়ে গিয়ে ক্রপড সেলফি....ইত্যকার ককটেল করে আমরা যে বাইপ্রডাক্ট পেলাম তারাই হল 'আধুনিক মুসলিম বাঙালি সমাজ'! এরাই সুশীল সমাজের স্টিয়ারিং হুইল? সোকল্ড সিভিল সোসাইটি?
#
আদপে অভাবী বাংলায় চৈত্র-বৈশাখের উৎসব কেমন?
দগ্ধ খরতাপে দহিত চরাচর। দুধহীন শুকনো মাইয়ের বোঁটায় বসে থাকা মাছিটাও অভুক্ত। কঙ্কাল প্রজাতির প্রাণীরা দলে দলে হত্যে দিতে ছুঁটছে মহাজনবাড়ি। গোঁড়ালিফাঁটা পায়েরও ক্লান্তি আছে, ওদের নেই। কচুটা ঘেচুটা, বকেয়া রসুন, বাড়ন্ত নেবুগাছটা বন্ধকে যায়। চিরতরে হাপিশ হয়। তেমনি শতেক বা হাজার মানুষের মিছিলে চৈত্রসংক্রান্তি আসে। কপর্দকহীন দে-হাতি চাষা ঘরে ফেরে বস্তুহীন বস্ত্রহীন। ওদের নিদ্রা ভেঙ্গে যে দিনটি আসে সে না চাইলেও আসে। তার পরও ওরা নববর্ষ বলেনা। সেইসব হা-ভাতে ম্লেচ্ছ বাঙালের কষ্টকল্পে রঙ্গিন ফানুস উড়িয়ে আদিখ্যেতা দেখানোর কিছু নেই। এখনকার বাংলা নববর্ষ উদযাপন বর্তামানে সার-জল-রোদ-ছায়া পেয়ে যে মহীরূহ হয়ে উঠেছে সেই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে এই জনপদের সংস্কৃতির যুদ্ধ।
..............................
১৪ এপ্রিল ২০২৪
১ লা বৈশাখ ১৪৩১
সংগৃহীত। লিংক
..............................
বাংলা নববর্ষ নিয়ে আরো কয়েকটি প্রবন্ধ পড়ুন...
0 Comments