বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে যে ভারত-বিদ্বেষ সেটার মূল (একমাত্র বলছি না) কারণ সাম্প্রদায়িকতা। বাংলাদেশে এমন কোনো সাম্প্রদায়িক মানুষ পাওয়া যাবে না, যারা ভারত-বিদ্বেষী না। তবে হ্যাঁ, সরলীকরণটা এভাবে করা যেতে পারে: ”সাম্প্রদায়িক মাত্রই ভারতবিদ্বেষী, কিন্তু ভারত-বিদ্বেষী মানেই সাম্প্রদায়িক না।”
সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনৈতিক ইস্যু। শুনেছেন কোনো জামাতি লোক ভারতকে সমর্থন করতে? কেন করে না? কারণ মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ হিসেবে পরিচিত ভারত সরকার। আওয়ালী লীগকে গদিতে থাকতে সহযোগিতা করছে ভারত। বিরোধিতার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। শুনেছেন না, এক সময় বলা হতো, শেখের বেটি ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশকে বিক্রি করে দেবে ভারতের কাছে। কত সালে বলা হতো মনে আছে? নব্বই দশকে। অথচ তখন ভারত-বিরোধিতার এত এত কারণও ছিল না, আই মিন এখন যতটা কারণ দেখানো যাবে। ফেলানি হত্যা, বা ট্রানজিটের ঘটনার অনেক আগে। এটা তো সত্যিই যে রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সবখানে ভারতের আধিপত্যবাদী আচরণ স্পষ্ট। বাংলাদেশকে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত সার্বিকভাবে সহযোগিতা করেছে বলে যে এই কর্তৃত্ববাদী আচরণ দেখাচ্ছে এমন না। এটা বৈশ্বিক রাজনীতির চরিত্র। বাংলাদেশের রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে আমেরিকা কি আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া না? এক্ষেত্রে কি চীনের আধিপত্য নেই? রাশিয়া বা জাপান কি বসে আছে? পৃথিবীর এত দেশ থাকতে খুনি এবং ফিলিস্তিনে গণহত্যার সহযোগী রাষ্ট্র আমেরিকা কেন বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে পড়ে আছে? কারণ ভৌগলিকভাবে দেশটার অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বঙ্গপসাগরের নিচে তেল-গ্যাস আছে। চীন কেন মিয়ানমারকে পেছন থেকে লেলিয়ে দিচ্ছে? দেশকে ভোবাতে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা পাঠাল কারা? ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে চীন বা আমেরিকার আধিপত্য হুমকিস্বরূপ। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের আধিপত্যবাদ অনেক ক্ষেত্রে স্পষ্ট, অসহনীয়। বাণিজ্যে চীন বা রাজনীতিতে আমেরিকার আধিপত্যবাদী আচরণও তীব্রতর হচ্ছে, কিন্তু খালি চোখে চীন বা আমেরিকারটা আমরা দেখছি না। এই না দেখতে পাওয়ার মধ্যেও এক ধরনের রাজনীতি আছে। চীন আমাদের স্বাধীনতা চায়নি। কবে স্বীকৃতি দিয়েছে দেখেন, সর্বশেষ দেশ হিসেবে চীন বাংলাদেশকে ১৯৭৫ সালের ৩১ আগস্ট স্বীকৃতি দেয়। তাও স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান নেতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে। অন্যদিকে আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছিল। গাজায় গণহত্যায় ইসরাইলের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক নষ্ট করার মূলে ছিল আমেরিকা। তারপরও কারো কারো কাছে আমেরিকা ভালো। এটাও রাজনৈতিক স্ট্যান্ড।
আমরা যে ভারতের আধিপত্যবাদী চরিত্রের সমালোচনা করছি, দেখা যাবে ভারতবিদ্বেষী যারা তাদের অধিকাংশ এসব বোঝেই না। আমি গ্রামের ছেলে। ছোটোবেলায় দেখেছি গ্রামের মানুষ এসব কিছুই বুঝত না, তিস্তা চুক্তি কি জানতই না, কিন্তু তাদের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব ছিল ষোলো আনা। ভারত আমাদের কিভাবে ঠকায় জিজ্ঞেস করেন, এখনো নব্বইভাগ ভারতবিদ্বেষী বলতে পারবে না। অথচ বলার মতো অনেক যুক্তি আছে। কিন্তু শুধু সাম্প্রদায়িকতার কারণেই যদি বিরোধিতা করতে হয় তাহলে এসব যুক্তির প্রয়োজন হয় না, ভারত প্রধানত হিন্দুরাষ্ট্র, এটাই যথেষ্ট। যদিও খাতা কলমে ভারত হিন্দুরাষ্ট্র না, যদিও বাংলাদেশের মোট মুসলমান জনসংখ্যার চেয়ে অধিক মুসলমানের বসবাস ভারতে, তারপরও, ভারত হিন্দুরাষ্ট্র! এটা তো সত্যিই যে, ভারতের হিন্দু জনগোষ্ঠীর বৃহৎ একটা অংশ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র প্রমাণ করতে মরিয়া এখন। সেটা সরকারিভাবেও। কিন্তু বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক লোকজনের যে ভারতবিদ্বেষ, সেটা তো মোদির আমলে শুরু হয়নি। আমি নব্বই দশকে দেখেছি। শিখেছি, লাল পিঁপড়ে হলে মারতে হবে, ওরা ভারতীয়, ওরা হিন্দু। নজরুল শ্রেষ্ঠ কারণ সে মুসলমান। তাকে পাগল বানিয়েছে কে? হিন্দু রবীন্দ্রনাথ। এসব কে শিখিয়েছে? যে অর্থনীতি, রাজনীতি, আধিপত্যবাদ—এসবের কিছুই বোঝেনি। আমি বলছি নব্বই দশকের কথা, কারণ আমার বেড়ে ওঠা এই সময়টাতে। কিন্তু ভারতবিদ্বেষের ভিত মজবুত হয়েছে তো সেই একাত্তরেই। ভারত যখন বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি আদায়ে কাজ করছে, ভারত যখন সীমান্ত খুলে দিয়ে হিন্দু-মুসলিম বাছাই না করে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের আশ্রয় দিচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিচ্ছে, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিচ্ছে, ভারত যখন বাংলাদেশে সৈন্য পাঠাচ্ছে—তখনই এদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা চিরকালের জন্য ভারতবিদ্বেষী হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িকতা যতদিন থাকবে—ধরে নিতে পারি মানুষের পরিচয় হিন্দু-মুসলিম সর্বস্ব হলে সাম্প্রদায়িকতা থেকেই যাবে—ততদিন বাংলাদেশ থেকে ভারত-বিদ্বেষ যাবে না, তাতে বাংলাদেশের হাজারটা মুক্তিযুদ্ধে ভারত সমর্থন করলেও। এবং পাকিস্তান হাজার বার অত্যাচার-নির্যাতন-গণধর্ষণ-গণহত্যা করলেও, পাকিস্তানপ্রেমীও এদেশ থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল হবে না।
সাম্প্রদায়িকতা যেমন ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সত্য, তেমনি পরস্পর বিরোধিতাও ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক সত্য।
এর বাইরে অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক আধিপত্যবাদের যে বিষয় সেটা গোটা বিশ্বের চরিত্র। মাৎস্যন্যায় নীতি আমরা জানিই। ছোটদেশগুলোর উপর বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর উপর বড়ো দেশগুলো বা সবল দেশগুলোর মোড়লিপনা আছে বিশ্বজুড়ে আছে। আছে বলে কি আমরা মেনে নেব? বিশেষ করে ছোটো কিংবা দুর্বল দেশ বলে আজ একইসঙ্গে ভারত-চীন-আমেরিকা (মৃদুভাবে জাপান-রাশিয়া) বাংলাদেশের সব বিষয়ে যেভাবে মোড়লিপনা করে তার বিরুদ্ধে আমাদের অবশ্যই কথা বলতে হবে। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রচর্চা থাকলে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোও তখন তাদের প্রতি ততোটা নতজানু হবে না, যেভাবে এখন হচ্ছে। আমার দেশের নির্বাচন: সিদ্ধান্ত দিল্লি বা ওয়াশিংটন নেবে কেন? জনগণ ঠিক করবে। ভারত ঠিক করার কে?? এই কারণে জনগণকে রাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। ভারত-বাংলাদেশের যে কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক, সেখানে কোনো ফাঁক থেকে গেলে সমালোচনা করতে হবে। কিন্তু সেই সমালোচনা যেন এমন বিদ্বেষে রূপ যেন না নেয় (মানে রাষ্ট্র টু রাষ্ট্র বিষয়টি ব্যক্তি টু ব্যক্তিতে না দাঁড়ায়), যাতে আমাদের সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা চাড়া দেওয়ার সুযোগ পায়। এদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি মত্ত হলে, ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিও হুঙ্কার ছাড়বে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষীর সংখ্যা বাড়ার পেছনে ভারতের মুসলিম-বিদ্বেষী আচরণ বৃদ্ধি পাওয়াও একটা কারণ। উভয় দেশের সুচিন্তার মানুষদের মনে রাখতে হবে, ইসলামী মৌলবাদ এবং আরএসএস কিন্তু পরস্পর বিপরীত বাস্তবতা। তাই কুচিন্তার লোকদের লেলিয়ে দিয়ে লাভ নেই। তাতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার জায়গাটা হালকা হয়ে যাবে।
আগুন দিয়ে আগুন নেভাতে গেলে ঘরটা (পড়ুন দেশটা) কিন্তু পুড়বে।
সংগ্রহীত। লিংক
0 Comments