বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমার পিছনে কিছু পর্যালোচনা - আশীষ ভট্টাচার্য

বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমার পিছনে কিছু পর্যালোচনা - আশীষ ভট্টাচার্য

 

মূলতঃ জনসংখ্যা নির্ভর করে জন্মহার, মৃত্যুহার ও স্থানান্তরের উপর। এই তিনটি বিষয়ের প্রত্যেকটিতেই বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠী পিছিয়ে আছে।


জন্মহারঃ

গবেষকেরা দেখেছেন, ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে কুমিল্লার মতলবের প্রতি হাজার জনসংখ্যায় হিন্দু জনগোষ্ঠী বৃদ্ধির হার মুসলমানের চেয়ে ২ পয়েন্ট কম। তিন বছরে একজন মুসলমান নারীর সন্তান জন্ম দেওয়ার সম্ভাবনা যেখানে ৩৫ শতাংশ, হিন্দু নারীদের মধ্যে তা ৩২ শতাংশ। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, হিন্দুদের মধ্যে জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহারের হার বেশি। তাঁদের মধ্যে গর্ভপাত করানোর হারও বেশি। দুটির পর আর সন্তান নিতে না চাওয়া নারীর হার হিন্দুদের মধ্যে বেশি। মুসলমানদের মধ্যে কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বেশি। এ ধরনের আরও কিছু সূচক বিশ্লেষণ করে গবেষকেরা বলছেন, হিন্দুদের প্রজনন হার তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম। হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৭৫ লাখ কমেছে।


মৃত্যুহারঃ

হিন্দুদের মধ্যে মৃত্যুহারও সামান্য বেশি। গবেষকেরা তথ্য বিশ্লেষণ করে বলছেন, মতলবে প্রতি ১০ হাজার জনের মধ্যে মুসলমানদের চেয়ে হিন্দুদের ৪টি মৃত্যু বেশি। তবে এটা কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন করতে পারে নি।


স্থানান্তরঃ

গবেষকেরা দেখেছেন, ১৯৮৯ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে কুমিল্লার মতলবের ৫ হাজার হিন্দু দেশত্যাগ করেছেন; তাঁদের ৮৯ শতাংশ গেছেন ভারতে। অন্যদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ১ হাজার ৯৩৭ জন দেশত্যাগ করেছেন; তাঁদের ৩১ শতাংশ গেছেন ভারতে, ৪৫ শতাংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং বাকি ২৪ শতাংশ গেছেন ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে। অন্যদিকে ১৯৮৯ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত মতলবের ২০ হাজার ১৭৫ জন মুসলমান দেশ ছেড়েছেন। তাঁদের ৬২ শতাংশের বেশি গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। গবেষকেরা বলছেন, মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেশি।


অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয় নিয়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কোনো মানুষ নিজের মাতৃভূমি, নিজের বাড়িঘর, ভিটামাটি ছেড়ে অন্য দেশে যেতে চান না। অত্যাচারের কারণে বাংলাদেশের হিন্দুরা দেশ ছাড়ছেন, তাঁদের সংখ্যা দ্রুত কমছে। শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি আইনের কারণে অনেকে নিঃস্ব হয়ে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। এটা বেশি ঘটেছে গ্রামের দুর্বল হিন্দুদের ক্ষেত্রে। কারণ আরও আছে।


হিন্দুর সংখ্যা বা হার কমে যাওয়ার প্রবণতা ঐতিহাসিক। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হওয়ায় পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) মুসলমানদের এবং ভারত হিন্দুদের দেশ বলে বিবেচিত হতে থাকে।


২০১১ সালের আদমশুমারি প্রতিবেদনে বাংলাদেশের জনসংখ্যা নিয়ে ১৯১১ সাল থেকে তথ্য দেয়া হয় তাতে দেখা যায় এই অঞ্চলে ১৯১১ সালে মোট জনগোষ্ঠীর ৬৭.২ ভাগ ছিলো মুসলিম৷ হিন্দু ৩১ ভাগ৷ ১৯২১ সালে ৬৮.১ ভাগ মুসলিম , হিন্দু ৩০.৬৷ ১৯৩১ সালে মুসলিম ৬৮.৫, হিন্দু ১৯.৪ ভাগ, ১৯৪১ সালে মুসলিম ৭০.৩, হিন্দু ২৮৷ ১৯৫১ সালে মুসলিম ৭৬.৯, হিন্দু ২২৷ ১৯৬১ সালে মুসলিম ৮০.৪, হিন্দু ১৮.৫৷ ১৯৭৪ সালে মুসলিম ৮৫.৪, হিন্দু ১৩.৫ ভাগ৷


অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসেন। এই দেশান্তর জনসংখ্যার অনুপাতে সামান্য প্রভাব ফেলে।


২০০১ সালের আদমশুমারির বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়া, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এ দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ।


প্রতি দশকে ১৫ লাখের বেশি হিন্দু কমে যাচ্ছে। এর পেছনে দেশান্তর হওয়ার পাশাপাশি প্রজনন হার কম এবং মৃত্যুহার বেশি হওয়ার বিষয়টি যুক্ত।


১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন। শরণার্থীদের বড় একটি অংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সব শরণার্থী দেশে ফিরে আসেননি, ফিরে এলেও কেউ কেউ আবার ভারতে চলে যান।


১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, যুদ্ধকালে তৈরি করা অর্পিত সম্পত্তি আইন হিন্দুদের দেশত্যাগে প্রভাবিত করেছে। ১৯৯০ সালে ভারতের বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হয়। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ও এর পরে একই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটে বিভিন্ন জেলায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস দেওয়া নিয়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে ২০১২ সালে এক তরুণের দেওয়া স্ট্যাটাসের কারণে রামু, উখিয়া ও পটিয়ার বহু বৌদ্ধমন্দির পুড়িয়ে দেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে।


রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে পাকিস্তান আমলে করা অর্পিত সম্পত্তি আইন বহাল থাকে, যা ছিল বৈষম্যমূলক। রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম আঘাতটি আসে ১৯৭৭ সালে, যখন পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এর ১১ বছর পর ১৯৮৮ সালের জুনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।


বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। ১৯৭৫ সালের পর সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে ধর্মের নামে বিভক্ত করা হয়েছে। হিন্দুদের রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।


হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজল দেবনাথ যোগ করেন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামের অন্তর্ভূক্তিকে তিনি বলেন, “হিন্দুদের ওপর আক্রমনের মূল টার্গেট হলো তাদের জমি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল৷ এটা যাদের ক্ষমতা আছে তারাই করে৷ এই টার্গেটে ক্ষমতাহীন মুসলমানরাও আছেন৷”


সাধারণ হিন্দু অনেকে মনে করেন, দেশত্যাগের অন্যতম কারণ অর্পিত সম্পত্তি আইন। এই আইনের অজুহাতে সারা দেশের হাজার হাজার হিন্দু পরিবার জমি হারিয়েছে, হয়েছে বাস্তুচ্যুত।


হিন্দু সম্প্রদায়ের এই দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রধান ছয়টি কারণঃ.


  • ১. এই অঞ্চলে মুসলমানদের ফার্টেইলিটি রেট বেশি
  • ২. ৬৪ সালের দাঙ্গা
  • ৩. ৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ
  • ৪. এনিমি প্রোপার্টি এ্যাক্ট
  • ৫. ভেস্টেড প্রোপার্টি এ্যাক্ট এবং
  • ৬. নিরপত্তাহীনতা।


কোন গবেষণা এখনো হিন্দু জনসংখ্যা হ্রাসের জন্য ধর্মান্তরকে তুলে আনে নি। পরিসংখ্যানে খুবই নগণ্য এর প্রভাব। তাহলে নারীর ভূমিকা কোথায়?


ধর্মান্তরের মূল কারণগুলো কি কিঃ

এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুদের রাজত্ব ছিলো। তাহলে লক্ষ্মণ সেন পশ্চাৎ দরোজা দিয়ে পলায়ন না করলে আজ এ জনসংখ্যার সূচক ভিন্ন হতো। কিন্তু খিলজী কেমন করে সেখানে রাজত্ব ও ইসলাম বিস্তার করলেন ? কারণ উচ্চ বর্ণের মূলতঃ ব্রাহ্মণ সমাজ যে বৈষম্যবাদ চালু করেছিলেন তাতে নিম্ন বর্ণের হিন্দুরা বীতশ্রদ্ধা হয়ে উচ্চবর্ণের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও ধর্মান্তরিত হতে থাকে। বাকীটা ইতিহাস।


বাংলাদেশে ধর্মান্তর:

মূলতঃ নিম্নবর্ণ ও উচ্চবর্ণের মধ্যেই সীমিত। জোর করে ধর্মান্তরের সংখ্যা খুব কম। তবে আছে এবং থাকবে। উচ্চবর্ণের বা নিম্ন বর্ণের সমস্যা অদ্ভুত। যারা অস্পৃশ্যতা সৃষ্টি করলো তারা বেশী ধর্মান্তরিত । মূলতঃ প্রথা চালিত বিবাহ , ধর্মের প্রতি প্রজ্ঞার অভাব ও অপসংস্কৃতি এই উচ্চবর্ণের ধর্মান্তরিত হবার মূল কারণ। আমার প্রচুর পরিচিত আছেন এই শ্রেণীর যারা ধর্মান্তরিত হয়েছেন। অন্যদিকে নিম্নবর্ণের সমস্যা উচ্চবর্ণের সৃষ্টি । তাদেরকে অস্পৃশ্য করাতে তাদের সহজেই প্রভাবিত বা জোর করে ধর্মান্তরিত করা যায়।


কিন্তু মূলকথা ধর্মান্তর সমস্যার আগে স্থানান্তর সমস্যা ।


ব্যাপক মাইগ্রেশনের কারণ কিঃ

এখানে আমার ব্যক্তিগত মতামত সর্বজনগৃহীত নাও হতে পারে। তবে আমি ২০০১ সাল থেকে এই ব্যাপারে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করেই বলছি।


মূলতঃ হিন্দু ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী শিক্ষা, দীক্ষা ও ব্যবসা বাণিজ্যে বেশ উন্নত। সনাতন ধর্ম একটি দর্শন যা আলগা ভাবে হিন্দুরা পালন করে। নিষ্ঠা বা ভক্তি দিয়ে করা আর সংস্কৃতি চর্চা এক জিনিস না। তার ফলে পরিবারে কোন নিয়মিত আচার বা অনুষ্ঠান বিধিনিষেধে মানা হয় না। আমি শুধু সমস্যার মূল যার সংখ্যা খুব বেশী তাদের কথাই বলছি। এরা স্বভাবতঃ কারণে আত্মকেন্দ্রিক। নিজেকে উপরে তোলা এদের মূখ্য উদ্দেশ্য। নিজের ধর্ম, নিজের জ্ঞাতী ও সমাজ অনেক পরে। এটা হিন্দুদের মধ্যে বেশী। এদিক থেকে মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদীরা অনেক সংবেদনশীল ও ত্যাগী।


২০২০ঃ তখন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনী টাউন হল মিটিংয়ে যাচ্ছেন। সেখানে সমস্ত সমর্থকরা একত্রিত। ট্রাম্পের মুসলিম বিরোধী নীতির প্রতিবাদ করতে একজন মুসলিম মহিলা প্রস্তুত । সে ঐ রূমে ঢুকে প্রতিবাদ করবে। যদিও তার এই খবর সোস্যালমিডিয়ায় আসার পরে তাকে হয়তঃ আগেই ঠেকানো হয়েছিলো। আফ্রিকার একটি দেশে মুসলিম জনসংখ্যা ছিলো মাত্র ৪-৫% । তবুও তারা দেশ ছাড়ে নি। সংখ্যালঘু পৃথিবীর সর্বত্রই নিপীড়িত। লেবাননে খ্রিস্টান জনসংখ্যা মুসলিমদের থেকে একসময় বেশী ছিলো। মুসলিমরা সেখানে এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ।


মুসলিমরা ভারতের পশ্চিম বাংলায় সংখ্যালঘু । কিল্তু তারা সেখানে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশে সংখ্যা লঘু অনেক বড় বড় পজিশনে আছেন, সেক্রেটারিয়েটে আছেন, ব্যবসায়ী আছেন, পুলিশে আছেন - কিন্তু হিন্দুদের জন্য তারা নেই ।


তাহলে সমস্যা কোথায় ?? সমস্যা হলো আমাদের মনে। সমস্যা হলো আমাদের জাত ভেদাভেদ। সমস্যা হলো আমাদের স্বার্থপরতা ।


যদি ২৮% হিন্দু কোথাও চলে না যেতো তাহলে কি সবাই মারা যেতো ? সবাই ধর্মান্তরিত হতো? কখনোই না বরং আরো ভালো থাকতো। আমার ৭৫% আত্মীয় ভারতে চলে গেছেন। আমি তো তাদের চলে যাবার কারণ কিছুই খুঁজে পাই নি। শুধু স্বার্থ ও নিজের ভবিষ্যৎG আমি মনে করি নিজের জাতিকে তোলার দায়িত্ব আমাদের ।


আমেরিকার সংবিধান ২৩৬ বছর আগের লিখা। সেই সময় বলা হয়েছিলো “ রাষ্ট্র ও ধর্ম আলাদা “। আমেরিকার ৬৫% জনগোষ্ঠী ধর্মকে বিশ্বাস করে । তাহলে হিন্দুদের সমস্যা কোথায়? 🙏🙏

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ