আমরা হিন্দু, মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রী রাম এবং যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ কে ভগবান মেনে তাদের ভক্ত তো হয়েছি, কিন্তু একইসাথে তাদের প্রকৃত অনুসারী হতে পারি নি, ফলস্বরূপ অজান্তে অন্ধবিশ্বাস এর কারণে তাদের আজ্ঞার অনুসরণ করার জায়গায় তাদের উলঙ্ঘন করতে থাকি। উদাহরণস্বরূপ যেমনভাবে মহান নীতিজ্ঞ এবং ধর্মদ্রষ্টা — ভগবান শ্রী কৃষ্ণ পবন গীতার মধ্যে বারবার উচ্চারণ করে গেছেন এবং নিজের জীবন দশার মধ্যে তা করেও দেখিয়েছেন … যে কোনো অত্যাচারী দুষ্ট প্রকৃতির দানব কে কখনোই কোনো সময়ের মধ্যে তিনি ক্ষমা করে না। শৌর্য এবং যুক্তি যুক্ত রীতিনীতি থেকে তার কুকর্মের শাস্তি দিয়েছিলেন, তাদের শেষ করেছে যেমন কংস, জরাসন্ধ, জয়দ্রথ, দুর্যোধন ইত্যাদি এদের মৃত্যুর উদাহরণ আমাদের সামনে।
পরাক্রমশালী কর্ণ যেমন দানবীর এবং একইসাথে দুষ্ট দুর্যোধনকে সঙ্গ দেওয়ার শাস্তি দিয়েছেন, যখন তারা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ স্থানের মধ্যে অর্জুনের সাথে যুদ্ধ করে রথের চাকা জলাভূমি মধ্যে ডুবে যায় তখন তিনি চাকা বের করার জন্য যুদ্ধ বন্ধ করেছিল, অনুরোধ করেছিল অর্জুনকে, তিনিও যুদ্ধবন্ধীর মতো যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বারণ করেছেন… হে অর্জুন, অন্যায়কারী দুষ্টের সহযোগীও অন্যায়ের দোষের শাস্তির ভাগী হয়, ভূলে যেও না এই মহারথী কর্ণ যার সাথে অন্যান্য মহারথীরা মিলে নিরস্ত্র অবস্থায় তোমার বীর পুত্র কে বধ করেছিল। উঠাও অস্ত্র আর একে বধ করো, অন্যথা তুমি যুদ্ধ ভূমি মধ্যে শত্রুকে ক্ষমা করার পাপের শাস্তি, শত্রুর বিজয় এবং নিজের পরাজয়ের মতো রূপ পাবে এবং অপমানিত মৃত্যু প্রাপ্ত হবে। দানব দুশমনদের ক্ষমা করা ধর্ম নয় অধর্ম, মানব ধর্মের বিরুদ্ধে এবং ক্ষত্রিয় ধর্মের উলঙ্ঘন হয় এবং এসব মূর্খতা রূপী দোষ। যেই দোষের পরিণাম, মানব সমাজে ভূগতে হবে।
কিন্তু এইরকম, দুষ্টদের দমনকারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নাম নেওয়া ভক্তরা (হিন্দু) নিজের মহান ইষ্ট দেবের এই আদেশের বিরুদ্ধে, একবার নয় অনেকবার আক্রমণকারী যবনদের ক্ষমা করে মূর্খতা করেই যাচ্ছে। এরা রাষ্ট্রধর্মের ঘোর উলঙ্ঘন করছে যেমন মহারাজা পোরস সিকান্দারকে ক্ষমা করেছিলেন। যখন এই ঝিলম নদীর পাড়ে যুদ্ধভূমি মধ্যে ওনার বর্ষার সম্মুখে পরে গিয়েছিল এবং মহারাজ পৃথ্বীরাজ মৈহম্মদ গৌরি কে অনেক বার সতের বার ক্ষমা করেছিলেন। যখন ১১৯২ইং সালে আঠারো তম যুদ্ধের মধ্যে যনব দুষ্টরা ধোকা দিয়ে পৃথ্বীরাজকে বন্দী করে নিয়েছিল এবং তাঁর চোখ বের করে কষ্টদায়ী মৃত্যু দিয়েছিল, একবারও ক্ষমা করে নি।
ফলস্বরূপ সফলতার বদলে শতাব্দী পর্জন্ত গোলামীর কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে। কষ্টের সময় আমরা (হিন্দু) তাঁকে (ভগবান শ্রীকৃষ্ণ) ডেকেই তো যাচ্ছি, কিন্তু তাঁর মহান গীতা রূপী জ্ঞানের উপকারের কর্মরূপী মূল্য শোধ করে পারিনি… অন্যথা সমস্ত সংসার মধ্যে এই শক্তি কোথায় যা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুসারীদের মাথা নত অথবা গোলাম বানাতে পারে। সংসারে সবচেয়ে ভয়ংকর ভয় হলো মৃত্যু এবং যে জাতি মৃত্যুকে অস্বীকার করে, অমর আত্মা গীতার সার প্রাপ্ত করে, তাদের সংসারেকে পরাজিত করতে পারে অথবা গোলাম বানাতে পারে?
কিন্তু আমরা তাঁর (শ্রীকৃষ্ণের) বাল্য লীলা অর্থাৎ রাস লীলা তো খুব রচনা করি, অথচ তারঁ বাল্যকালের পরাক্রমীর অনুসরণ করা ভূলে গিয়েছি। ৯-১০ বছরের বালক কৃষ্ণ অত্যাচারী কংসকে যমলোকে পৌঁছে দিয়েছিল। এই ভাবে… তাঁকে মাখন চোর ও সখিদের কাপড় লুকানোর দাবি তো আমরা খুব ছুরেছি। কিন্তু তাঁর এই অবদানের কথা পড়তে পারি নি, যে বাস্তবে রাষ্টদ্রোহ এবং অত্যাচারী কংসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।
…যদি ভগবান কৃষ্ণের জীবনের অভিনয় অথবা জীবনের ঘটনাগুলো গভীর দৃষ্টি থেকে অধ্যয়ন করি, তো স্পষ্ট হয়ে যায় যে তাঁর প্রত্যেক কার্যক্রম, কোনো বিশেষ লক্ষ্যের জন্য ছিল। উদাহরণস্বরূপ মাখন চুরি যা দুধের হাড়ি ভাঙা, তাদের শৈশব ছিল না, বরং সেই অত্যাচারী কংসের বিরুদ্ধে, গোকুলবাসীদের উন্নতি এবং তরুণ গোয়ালাদের মধ্যে অভয় তৈরি করেছিলেন, যে কংস গোকুলবাসীদের থেকে মনমতো নির্বিচারে করের নাম করে মাখন এবং দুধ উসুল করেছিল এবং বাধা দেওয়ার পরেও যে গোয়ালা বা গোয়ালিনী কংসের ভয়ে দুধ মাখন মথুরায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তখন রাস্তার মধ্যে তাদের কলস ভেঙে দিয়েছিলেন। বাস্তবে এই সব আতঙ্ক, কংসের বিরূদ্ধে এক বড় বিপ্লবের সুত্রপাতের সৃষ্টি হয়েছিল।
কষ্ট হয় এগুলো পড়ে শুনে যে, ভগবান কৃষ্ণ যেমন ভাবে শ্রেষ্ঠতম আত্মা হয়েও সাধারণ স্তরে রেখে মাখন চোর, হাড়ি ভাঙা, নগ্ন স্ত্রীদের কাপড় চুরি, আড়ালে ও প্রেম রাসলীলার রচয়িতা ভেবে বসে আছে, যে কৃষ্ণ বেদের পরমগত পণ্ডিত এবং মহান বেদ বেত্তা ছিলেন, ঋষি মুনি, যাকে ব্রহ্মজ্ঞানী মেনে যজ্ঞের মধ্যে ব্রহ্মবেদীর আসনে বসাতেন, রাজসভার মধ্যে পদার্পনের পরে তাঁর জন্য পিতামহ ভীষ্ম এবং গুরু দ্রোণের মতো মহান ব্যক্তিত্বরা নিজের আসন ছেড়ে দিতেন। সেই বৈদিক ব্যক্তি কৃষ্ণকে ১৬০০০ গোপীদের সাথে ক্রিয়ায় রত ছিল এভাবে বলে অপমানিত করেই যাচ্ছে। যে কৃষ্ণ ঈশ্বরীয় জ্ঞান বেদ মন্ত্রের জ্ঞাতা ছিলেন। মায়াবী অসুর মুরাকীকে মৃত্যু প্রদানকারী কৃষ্ণ সূদর্শনধারীর মুরালীধর নাম স্বরণ করে আমরা সন্তুষ্ট হই, যেই কৃষ্ণের চরণে ভক্তিভরে ভীষ্মের মতো অজেয় যোদ্ধা মহাভারতের সংগ্রামে অস্ত্র ছেড়ে নত মস্তক হয়েছিল, যেই ব্রহ্মজ্ঞানীর জ্ঞান ধারায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে, মোহমায়ার মধ্যে ফেঁসে থাকা বীর অর্জুনের মধ্যে ক্ষত্রিয় ধর্মের জন্ম দিয়েছিলেন। আজ সেই মহান গীতা রচয়িতা কৃষ্ণকে, রাস রচয়িতা কৃষ্ণ বানিয়ে আমরা তাঁকে, হিন্দু ধর্ম ও জাতির এবং রাষ্ট্র থেকে কত বড় লম্পট বানিয়ে রেখেছি, ইতিহাস আমাদের এই দোষের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।
সংগৃহিত
0 মন্তব্যসমূহ