সংখ্যালঘুদের উপর ৯৮ ভাগ রাজনৈতিক আক্রমণ প্রসঙ্গে পুলক ঘটকের ফেসবুক মতামত

সংখ্যালঘুদের উপর ৯৮ ভাগ রাজনৈতিক আক্রমণ প্রসঙ্গে পুলক ঘটকের ফেসবুক মতামত
 


১১ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে পত্রিকাগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে "সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-ভাঙচুরের ৯৮% ঘটনা রাজনৈতিক কারণে: পুলিশের অনুসন্ধান"। এ বিষয়ে পুলক ঘটক তার ফেসবুক পেজে মতামত দিয়েছেন। সে মতামত পাঠকের পাঠের উদ্দেশ্যে প্রকাশ করা হল।


-------------------

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ধন্যবাদ; তারা অন্তত সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলো স্বীকার করেছে। বলেছে, “সাম্প্রদায়িক নয়” দেশব্যাপী হিন্দুদের উপর “রাজনৈতিক” হামলা হয়েছে। 

সত্য স্বীকার না করলে সমস্যা সমাধান করা যায় না; বরং তা আরও ঘনীভূত হয়। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক সরকারগুলো সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের কথা অস্বীকার করে আসছিল। নেহায়েত বাধ্য না হলে কেউ যেন সত্য প্রকাশ করতেই চায় না। যতটা সম্ভব ঢেকে রাখ —এ এক বিশ্রি সংস্কৃতি। 

আজ সরকার যখন ১৭৬২টি অভিযোগের মধ্যে পুলিশি তদন্তের ভিত্তিতে অন্তত ১২৫৪ টি আক্রমণের সত্যতা প্রকাশ করল, তখন অধিকাংশ মিডিয়া “সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়নি” প্রমাণ করতে বা “ফেক নিউজ” প্রমাণ করতে ব্যস্ত! এত বিপুল সংখ্যক ঘটনা আড়াল করে রাখতে পারা চারটিখানি কথা নয়। একাজে সফল হওয়ার চেষ্টায় আমাদের মিডিয়া পেশাদারিত্বের চরম পরাজয় ঘটিয়েছে। দৃশ্যত স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও দেশে স্বাধীন মিডিয়া দাঁড়ায়নি, ঋজু হতে শেখেনি। কথাগুলো বলতে বিব্রত বোধ করছি। 

সাথে লজ্জিত হই সমাজ-মনস্কতা নিয়ে। দেশের বিবেকবান মানব-সমাজ সাহসী হয়ে সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াল না; প্রতিরোধ গড়ল না! সুশীল সমাজ একটি নাগরিক তদন্ত কমিটি করে আক্রান্ত মানুষের দ্বারে দ্বারে গেল না! 

মালায়ুনের গুষ্টি উদ্ধার করে হাসিনার কাছে পাঠাতে চাওয়া, পাড়াতো বন্ধু হিসেবে দুয়েক্টা চড়-থাপ্পর দেয়া, আদর করে চাঁদা দাবি এবং নইলে পরিণতি বোঝানোর মতো ছোটখাটো শান্তিপূর্ণ ব্যাপারগুলো গণনায় নিলে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের প্রকৃত পরিসংখ্যান বের করা পূর্ণাঙ্গ গণ-জরিপ ছাড়া সম্ভব হবে না। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের হিসাবে আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যস্ত ৪ মাসে হামলার ঘটনা দুই হাজারের অধিক। যেহেতু সকল অভিযোগ থানা পর্যন্ত যায়নি, বা থানা-পুলিশের সক্ষম অস্তিত্বও আলোচ্য সময়কালে ছিল না, সুতরাং পুলিশ যদি আপাতত ১২৫৪টি আক্রমণের সত্যতা পায় তবে তারা সত্যের অপলাপ ঘটানোর চেষ্টা করছেন না— এ কথা বলতেই পারি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সদিচ্ছা না থাকলে এই সত্য প্রকাশ পেতো না। ধন্যবাদ ড. মোহাম্মদ ইউনুস –আপনি যতটা পেরেছেন স্বীকার করেছেন। এই স্বীকারোক্তি সমাধানের পথ দেখাবে। আপনার প্রেস উইংকেও এজন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এবার বিচারের ব্যবস্থা করুন। নিরাপরাধ হিন্দুদের হয়রানি করা বন্ধ করুন। প্রতিবাদ সমাবেশ করা নাগরিকদের অপরাধ নয়; অধিকার।

আপনারা বলছেন, হিন্দুদের উপর আক্রমণ হয়েছে সত্য, কিন্তু সেগুলো সাম্প্রদায়িক আক্রমণ ছিল না। এগুলো আপনাদের ভাষায় “রাজনৈতিক আক্রমণ”। আমি আপনাদের সাথে একমত। আমি আগে থেকেই জানি, এই আক্রমণগুলো রাজনৈতিক। তার ভেতরে হিংসা, জিঘাংসা অর্থনীতি-সহ আরও নানাবিধ উপাদান আছে। যা হোক, ব্যাপারটা “রাজনৈতিক”। আমি একমত। 

কিন্তু এটা কী রাজনীতি, কেমন রাজনীতি স্যার? 

এটা সেই “রাজনীতি” কিনা, রাজনৈতিক জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই যার বিরোধিতা করে আসছি? হ্যাঁ, এ রাজনীতির নাম ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’। এটাই তো সমস্যা। সম্প্রদায়বোধ বা সম্প্রদায় প্রীতি প্রায় সকল মানুষের মধ্যে কমবেশি আছে, যা সবসময় রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ক্ষতিকর হয় না। বরং সম্প্রদায়-প্রীতি থেকে ব্যক্তি-মানুষ অনেক কল্যাণকর অবদানও রাখতে পারে। 

সমস্যা ঐ রাজনীতি –‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ – যা জিঘাংসার জন্ম দেয়। শুধু মানুষ ও সমাজের জন্য নয়, রাস্ট্রের জন্যই বিপদজনক এই ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কারণে ১৯৪৭ সালে ভারত ভেঙেছে। ঐ রাজনীতি জিইয়ে রাখলে দ্বিজাতিতত্ত্বের বা বহুজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে অনন্তকাল যাবত আমরা অবিরাম টুকরো টুকরো হতে থাকব। 

 ঐ অপ-রাজনীতিরই তো আমরা বিরোধিতা করি। বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকে এই ভূমিতে রাজনীতির প্রধান দুটি পক্ষ আছে – একটি সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষ, আরেকটি অসাম্প্রদায়িক বা ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষ। আপনারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যদি সত্যিই সংস্কার করতে চান, তবে দয়া করে এই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সংস্কার করুন। ‘মানুষের রাজনীতি’ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করুন। যে সমস্যা স্বীকার করেছেন তা থেকে সমাধানের শিক্ষা নিন। 

কোনো সম্প্রদায়ের উপর “রাজনৈতিক কারণে” হামলা করার অধিকার কারও নেই। হিন্দুরা সবাই যদি আপনার রাজনীতির বিপক্ষের লোক হয়, তবুও তাদের উপর হামলা করার অধিকার আপনার নেই ড. ইউনুস। “সাম্প্রদায়িক হামলা নয়, রাজনৈতিক হামলা” বললে হামলাটা পবিত্র হয়ে যায় না। আপনি যখন শপথ নিয়েছেন, তখন এই নাগরিকরা দিনরাত আপনার বিরোধিতা করলেও তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়া আপনার দায়িত্ব। রাজনৈতিক কারণে নির্যাতন করা আপনার দায়িত্বচ্যুতি। আপনার শাসনের ছায়ায় থেকে অন্য কোনো পক্ষ যদি এই রাজনীতি খেলে, তাদেরকে না ধরা আপনার কর্তব্যচ্যুতি। দেশ-বিদেশের জ্ঞান আপনার আছে, এখন তা প্রয়োগের সময়; নিয়ত ঠিক করার সময়। 

সহীহ নিয়তে রিসেট বাটনে চাপ দিলে বাংলাদেশের ফ্যাক্টরি সেটিংস ফিরে পাবেন। সাম্প্রদায়িক ভাইরাস ও নোংরা-আবর্জনাগুলো মুছে যাবে। ১৯৭১ সালের কারখানা সেটিংস ফিরে আসবে –যেখানে বাংলাদেশের উৎপাদন। সেখানে শুনতে পাবেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে নবজাত বাংলাদেশের সেই বিশুদ্ধ দুরন্ত অসাম্প্রদায়িক আওয়াজ –”জয় বাংলা”। জয় মানুষ।


সূত্র: পুলক ঘটকের ফেসবুক পোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ