যিনি কালী, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ - ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী

যিনি কালী, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ - ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
যিনি কালী, তিনিই শ্রীকৃষ্ণ - ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
 

এ জগতের সিংহভাগই অন্ধকার। আলো খুবই কম। জগত অন্ধকারের খেলাঘর। তাইতো জগতের পিতা-মাতা কালোরূপেই কল্পনা করা হয়েছে। আদিপুরুষ গোবিন্দ কালো এবং মহাকালের শক্তি জগন্মাতা কালীও কালো।অষ্টাদশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাংলা কবি এবং মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীর পরে যিনি আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম প্রর্বত্তক শ্রীরামপ্রসাদ সেন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান তিন উপাসনার ধারা শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব এ তিনমতের সমন্বয়ের অন্যতম অগ্রনায়ক ছিলেন। কৃষ্ণ কালীকে তিনি একসাথেই উপাসনা করেছেন। তাঁর কাছে কৃষ্ণ এবং কালী ছিলো একই ব্রহ্মের পুরুষ ও প্রকৃতির অভেদ রূপ। শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধেও কৃষ্ণ-কালীর অভেদ বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে-


ন বা এতদ্বিষ্ণুদত্ত মহদদ্ভুতং যদসম্ভ্রমঃ 

স্বশিরশ্চ্ছেদন আপতিতেঽপি বিমুক্ত-

দেহাদ্যাত্মভাবসুদৃঢ়হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বসত্ত্ব-

সুহৃদাত্মনাং নির্বৈরাণাং সাক্ষাদ্ভগবতা-

নিমিষারিবরায়ুধেনাপ্রমত্তেন তৈস্তৈর্ভাবৈঃ 

পরিরক্ষ্যমাণানাং তৎপাদমূলমকুতশ্চি-

দ্ভয়মুপসৃতানাং ভাগবতপরমহংসানাম্ ॥

(শ্রীমদ্ভাগবত : ৫.৯.২০) 


"ভগবান স্বয়ং ভদ্রকালী প্রভৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এসে সাধুদের রক্ষা করেন। যার দেহাভিমানরূপ হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে, যিনি সমস্ত প্রাণীজগতের সুহৃৎ, যিনি কারাের প্রতি বৈরী ভাব পােষণ করেন না, তাদের স্বয়ং ভগবান বিভিন্ন রূপ ধারণ করে রক্ষা করেন ; তাই ভগবানের শরণাগত নির্ভয় ভগবদ্ভক্ত পরমহংসগণ নিজের শিরচ্ছেদনের সময়েও বিচলিত হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।"


সমস্যা বাধে তখনই , যখন আমরা যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস থেকে যে যে মতাবলম্বী সবাইকে সেই সেই মতাবলম্বী বানাতে চাই। আমরা ভুলে যাই বেদান্ত দর্শনের চার নং সূত্র-তত্তু সমন্বয়াৎ।। (১.১.৪) এই সূত্রকে। এই সূত্রেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বিভিন্ন মত-পথ নির্বিশেষে সকল মত-পথই ব্রহ্ম লাভ এবং উপলব্ধির এক একটি পন্থা।সেই সমন্বয়ের ভাবসম্পদের রত্নভাণ্ডারকে সমৃদ্ধকারী অন্যতম বাঙালি কবি শ্রীরামপ্রসাদ সেন। তাঁর সেই সৃষ্টির রত্নভাণ্ডারে সনাতন বিভিন্ন মত-পথকে সমন্বয় করে বেশ কয়েকটি সংগীত পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি সমন্বয় সংগীত হল,"মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি"। সংগীতটি বাংলা ভাষায় এক অক্ষয় রত্নতুল্য।


"মন করোনা দ্বেষাদ্বেষি।

যদি হবিরে বৈকুণ্ঠবাসী।।

আমি বেদাগম পুরাণে, করিলাম কত খোঁজ- তালাসি।

ঐ যে কালী,কৃষ্ণ, শিব, রাম, সকল আমার এলোকেশী।।

শিবরূপে ধর শিঙ্গা, কৃষ্ণরূপে বাজাও বাঁশী।

ওমা রামরূপে ধর ধনু, কালীরূপে করে অসী।।

দিগম্বরী দিগম্বর, পীতাম্বর চিরবিলাসী।

শ্মশানবাসিনী বাসী, অযোধ্যা গোকুলনিবাসী।।

ভৈরবী ভৈরব সঙ্গে, শিশু সঙ্গে এক বয়সী।

যেমন অনুজ ধানুকী সঙ্গে জানকী পরম রুপসী।।

প্রসাদ বলে ব্রহ্ম নিরুপণের কথা দেঁতোর হাসি।

আমার ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে, পদে গঙ্গা গয়া কাশী।।"


 বৈষ্ণব শিরোমণি ষড় গোস্বামীর অন্যতম শ্রীজীব গোস্বামী ব্রহ্মসংহিতার পঞ্চাধ্যায়ের ৩/৪ শ্লোকের টীকায় গৌতমীয়তন্ত্রের শ্লোক উদ্ধৃত করে বলেছেন:


যঃ কৃষ্ণঃ সৈব দুর্গা স্যাৎ যা দুর্গা কৃষ্ণ এব সঃ।

অনয়োরন্তরাদর্শী সংসারান্ন বিমুচ্যতে।।


"যিনি কৃষ্ণ, তিনিই দুর্গা এবং যিনি দুর্গা তিনিই কৃষ্ণ। এঁদের মধ্যে যে ভেদ দেখে সে সংসার সমুদ্র থেকে মুক্ত হয় না।"

(ড. নিকুঞ্জবন্ধু ব্রহ্মচারী, ২০২২: পৃ. ৩৪)


যেই শ্যাম, সেই শ্যামা। যেই ব্রহ্ম, সেই শক্তি; যেই লক্ষ্মী, সেই নারায়ণ ; যেই শিব, সেই শক্তি ; যেই রাধা, সেই কৃষ্ণ। একই সত্ত্বার শুধুমাত্র প্রকাশ বিভিন্ন। আর আমরা এই দৃশ্যমান বিভিন্নতায় মায়ার প্রভাবে বিভ্রান্ত হয়ে যাই।ব্রহ্ম এবং তাঁর শক্তি অভেদ-এ তত্ত্বটি বোঝাতে গিয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস তাঁর শ্রীম লিখিত কথামৃতে বলেছেন:


''ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ, এককে মানলেই আর-একটিকে মানতে হয়। যেমন অগ্নি আর তার দাহিকাশক্তি; ... অগ্নি মানলেই দাহিকাশক্তি মানতে হয়, দাহিকাশক্তি ছাড়া অগ্নি ভাবা যায় না; আবার অগ্নিকে বাদ দিয়ে দাহিকাশক্তি ভাবা যায় না। সূর্যকে বাদ দিয়ে সূর্যের রশ্মি ভাবা যায় না।"


"আদ্যাশক্তি লীলাময়ী; সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয় করছেন। তাঁরই নাম কালী। কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী! একই বস্তু, যখন তিনি নিষ্ক্রিয় - সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় কোন কাজ করছেন না -এই কথা যখন ভাবি, তখন তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন তিনি এই সব কার্য করেন, তখন তাঁকে কালী বলি, শক্তি বলি। একই ব্যক্তি নাম-রূপভেদ।''


 ব্রহ্ম ও শক্তি এবং শ্যাম ও শ্যামা বা কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বকেই কবি নজরুল ইসলাম তার অনন্য অসাধারণ একটি সংগীতের মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। কোন প্রকার বিভেদের জালে না জড়িয়ে প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জীবনে চলে আসছে শ্যাম ও শ্যামার যুগ্ম আরাধনা। যেখানেই কালী মন্দির, সেখানেই কৃষ্ণ মন্দির। ব্রহ্ম ও তাঁর শক্তি এবং কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বকে নিয়ে মধ্যযুগের কবি রামপ্রসাদ সেন সহ অনেকেই বিভিন্ন  মর্মস্পর্শী  সংগীত  লিখেছেন। আধুনিক যুগে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হয়েও,শাক্ত-শৈব-বৈষ্ণব মিলনের বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংগীত লিখেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ অনন্য অসাধারণ সংগীতটিতে কবি, শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে শ্যামের নাম জপ করতে চেয়েছেন। তিনি শ্যামা নামের যমুনাতে ডুবে, শ্যামের সাথে খেলা করতে চেয়েছেন।সংগীতটির প্রত্যেকটি বাক্যে শ্বাশত সম্প্রীতির ভাব প্রকাশ পেয়েছে।


"শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে

জপি আমি শ্যামের নাম।

মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু

ঠাকুর হলেন রাধাশ্যাম॥

ডুবে শ্যামা-যমুনাতে

খেলব খেলা শ্যামের সাথে

শ্যাম যবে মোর হানবে হেলা

মা পুরাবেন মনস্কাম॥

আমার মনের দো-তারাতে

শ্যামা ও শ্যামা দুটি তার,

সেই দো-তারায় ঝংকার দেয়

ওঙ্কার রব অনিবার॥

মহামায়ার মায়ার ডোরে

আনবে বেঁধে শ্যাম কিশোরে,

কৈলাসে তাই মাকে ডাকি

দেখব সেথায় ব্রজধাম॥"


বাঙালির প্রধান দুই আরাধ্য কালী এবং কৃষ্ণ যে এক। এ কথা গৌতমীয়, তন্ত্র কুব্জিকা তন্ত্র সহ বিভিন্ন তন্ত্রশাস্ত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে।

কলৌ কৃষ্ণত্বমাসাদ্য বৃন্দাবনবিহারিণী

বংশীনাদ-বিনোদেন মোহয়ত্যখিলং জগৎ।।

(কুব্জিকা তন্ত্র: ১.৩৪)

"দেবী কালীই কলিযুগের প্রারম্ভে, বৃন্দাবনে কৃষ্ণরূপে নিজের বংশীধ্বনিতে ত্রিভুবন মোহিত করেছিলেন।"


 শ্রীমহাভাগবত পুরাণে আদ্যাশক্তি মহামায়া কালীর দ্বাপরযুগের শেষে কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হওয়া প্রসঙ্গে সম্পূর্ণ একটি অধ্যায় আছে। সেই পুরাণে দেবর্ষি নারদ ভগবান শিবকে জিজ্ঞাসা করেন যে, আদ্যাশক্তি মহামায়া কালী কেন পুরুষরূপে জগতে  অবতীর্ণ হয়েছিলেন।


ভূয়োঽপি শ্রোতুমিচ্ছামি দেব্যাশ্চরিতমুত্তমম্।

সুগুপ্তং ত্রিদশশ্রেষ্ঠ ত্বন্মুখাম্ভোজনিঃসৃতম্ ॥

বদন্ত্যনেকে তত্ত্বজ্ঞাঃ কালী বিদ্যা পরাৎপর।। 

যা সৈব কৃষ্ণরূপেণ ক্ষিতাববতরৎ স্বয়ম্ ॥ 

বসুদেবগৃহে দেব্যা দেবক্যাং নিজলীলয়া।

কংসাদিদুষ্টভূভারনিবৃত্ত্যৈ জগদীশ্বরঃ॥ 

তদেতৎ শ্রোতুমিচ্ছামি কস্মাদ্দেবী মহেশ্বরী।  

পুংরূপেণাবতীর্ণাভূৎ ক্ষিতৌ তন্মে বদ প্রভো।। 

(শ্রীমহাভাগবত: ৪৯.১-৪)


"হে ত্রিদশশ্রেষ্ঠ!  আপনার মুখকমলনিঃস্বত দেবীর সুগুপ্ত উত্তম চরিত্র পুনরায় শুনতে ইচ্ছা করছি। হে জগদীশ্বর ! তত্ত্বজ্ঞগণ বলে থাকেন, স্বীয় লীলা প্রকটচ্ছলে কংসাদিদুষ্টভার দূরীভূত করার জন্য বসুদেবগৃহে দেবী দেবকীর উদরে পরাৎপর কালী কৃষ্ণরূপে ক্ষিতিতলে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।হে প্রভো! দেবী মহেশ্বরী কিজন্য পুরুষরূপে ক্ষিতিতলে অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা শ্রবণ করতে ইচ্ছা করছি। আপনি দয়াকরে বলুন।"


দেবর্ষি নারদের প্রশ্নে সন্তুষ্ট হয়ে,  ভগবান শিব বর্ণনা করলেন দেবীর অবতীর্ণ হওয়ার কারণ। দুষ্টদের বিনাশের জন্যেই আদ্যাশক্তি দেবী কালী মায়াকে অবলম্বন করে কৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হন।মহামায়া কালীই কৃষ্ণরূপে জগতকে মোহিত করেছেন।


শৃণু গুহ্যতমং বৎস সত্যমেব মহেশ্বরী । 

অবতীর্ণাভবৎ পৃথ্ব্যাং দেবক্যাং বসুদেবতঃ॥  

শম্ভোরিচ্ছানুসারেণ মায়াপুরুষরূপধৃক্।  

দুষ্টভূভারসংহত্যৈ দ্বাপরান্তে মহীতলে ॥

(শ্রীমহাভাগবত: ৪৯.৫-৬)


"হে বৎস! সত্যই সেই মহেশ্বরী, শঙ্করের ইচ্ছায় মায়াপুরুষবিগ্রহ ধারণ করে, দ্বাপরান্তে পিতা বসুদেব এবং মাতা দেবকীর গর্ভে পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে দুষ্টদের সংহার করেন।"


বৃহদ্ধর্ম পুরাণের মধ্যখণ্ডে দেবী সতী ভগবান শিবকে বলেন, শাক্ত ও বৈষ্ণবে কোন নূন্যতম ভেদাভেদ নেই৷ শক্তি ও বিষ্ণুর প্রতি যার অচলা ভক্তি সেই শাক্ত।


তস্মান্মদ্দীক্ষকাঃ শম্ভো ভবেয়ুঃ শাক্তবৈষ্ণবাঃ। 

শক্তৌঃ বিষ্ণৌঃ যস্য ভক্তিঃস শাক্তঃস্যান্ন চাপরঃ।।

(বৃহদ্ধর্ম পুরাণ: মধ্যখণ্ড, ৬.১৪৫)


"হে শম্ভু ! আমার মন্ত্রে দীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছে শাক্ত ও বৈষ্ণবে কোন ভেদ নেই৷ শক্তি ও বিষ্ণুর প্রতি যার অচলা ভক্তি সেই শাক্ত, এছাড়া অন্য কেউ শাক্ত নয়।"

শাস্ত্র বলছে, কৃষ্ণ এবং কালী অভেদ। যেই কালী, সেই কৃষ্ণ। এরপরেও অনেকে অজ্ঞানতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে কালী কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বে বিদ্বেষ করে।বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তাই সকল প্রকার বিদ্বেষপূর্ণ দাসদাসীতত্ত্ব ভুলে কালী-কৃষ্ণের অভেদ তত্ত্বটি স্মরণে, মননে এবং জীবনে আমাদের প্রতিফলিত করা প্রয়োজন। তবেই শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবের নিজ নিজ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ বিদূরিত হয়ে জাতিগত ঐক্যবদ্ধতা আসবে। মনে রাখতে হবে বিভেদে বিচ্ছিন্নতা, এবং অভেদেই ঐক্যবদ্ধতা।বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণব এ সকল মতের একটি অত্যন্ত সুসমন্বয় দেখা যায়। একই পরিবারে অথবা একই মন্দিরে এ সকল মতই একইসাথে অনুসৃত হয়। বাঙালি হিন্দুরা প্রধানত শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবের মিশ্র উপাসক। বাঙালির প্রধান উৎসব দুর্গাপূজা এবং প্রধান তিথিকৃত্য জন্মাষ্টমী ও শিবচতুর্দশী। একই মন্দিরে যেমন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা হয়, তেমনি জগজ্জননী আদ্যাশক্তি কালী-দুর্গাও উপাসনা করা হয়। প্রায় প্রত্যেকটি মন্দিরে গণেশ, শিবসহ সনাতন পঞ্চমতের সকল ইষ্টেরই উপাসনা করা হয়। এই সমন্বয় এবং সমন্বয়ে আবহে উৎপাদিত সংগীত-নৃত্যকলা সহ সকল শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতাই আমাদের বাঙালি জীবনের অক্ষয় ভাব সম্পদ। 


শাক্ত-বৈষ্ণবের ইষ্ট একই। একই ব্রহ্মকে বৈষ্ণবগণ পুরুষোত্তম রূপে উপাসনা করে এবং শাক্তগণ  প্রকৃতিস্বরূপা আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে উপাসনা করে। এই পরমেশ্বরের পুরুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। এরপরেও বৈষ্ণবগণ ভগবান বিষ্ণুর শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে নিরামিষ আহার নিয়ে শাক্তের সাথে অহেতুক অর্কে জড়ায়। পক্ষান্তরে শাক্ত আদ্যাশক্তি মহামায়ার শ্রেষ্ঠত্ব এবং পশুবলির বাধ্যবাধকতা নিয়ে নিরামিষভোজী বৈষ্ণবের সাথে তর্কে জড়ায়। অথচ এই তর্কাতর্কির সম্পূর্ণ বিষয়টিই অপ্রয়োজনীয়। শাক্তদের উপলব্ধি করতে হবে, জগতের সবাই মন্দিরে পশুবলি দিবে না। পক্ষান্তরে আবার বৈষ্ণবদের উপলব্ধি করতে হবে জগতের সবাই শুধুই শাকসবজীর নিরামিষ আহার করেই জীবনধারণ করবে না। নিরামিষ এবং আমিষ এ উভয় আহারই জগতে সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। উভয় আহারের পক্ষে বিপক্ষে মানুষের  অবস্থান যেমন রয়েছে, তেমনি পক্ষে বিপক্ষে শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্তও রয়েছে। তাই কোন পক্ষই কোন পক্ষকে খাটো না করে, যার যার ইষ্টের পথে অগ্রসর হওয়া উচিত। এ প্রসঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন:


"এদেশে সেই বুড়ো শিব বসে আছেন, মা কালী পাঁঠা খাচ্ছেন, আর বংশীধারী বাঁশী বাজাচ্ছেন। ঐ বুড়ো শিব ষাঁড় চড়ে ভারতবর্ষ থেকে একদিকে সুমাত্রা, বোর্নিও, সেলিবিস, মায়, অস্ট্রেলিয়া আমেরিকার কিনারা পর্যন্ত ডমরু বাজিয়ে এককালে বেড়িয়েছেন, আর একদিকে তিব্বত, চীন, জাপান, সাইবেরিয়া পর্যন্ত বুড়ো শিব ষাঁড় চরিয়েছেন, এখনও চরাচ্ছেন; ঐ যে মা কালী - উনি চীন জাপান পর্যন্ত পূজা খাচ্ছেন, ওঁকেই যীশুর মা মেরী করে ক্রিশ্চানরা পূজা করছে। ঐ যে হিমালয় পাহাড় দেখছ, ওরই উত্তরে কৈলাশ, সেথা বুড়া শিবের প্রধান আড্ডা। ও কৈলাশ দশমুণ্ড-কুড়িহাত রাবণ নাড়াতে পারেননি, ও কি এখন পাদ্রী-ফাদ্রীর কর্ম! ঐ বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন—এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন? তোমাদের দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন হতে হবে বুঝি ? চড়ে খাওগে না কেন? এত বড় দুনিয়াটা পড়ে তো রয়েছে। তা নয়। মুরদ কোথায়? ঐ বুড়ো শিবের অন্ন খাবেন, আর নিমকহারামী করবেন, যীশুর জয় গাইবেন—আ মরি!"

(বাণী ও রচনা (ষষ্ঠ খণ্ড) ২০১৫: পৃ. ১১৮-১১৯)


 স্বামী বিবেকানন্দ  সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, যদি এদেশীয় পরম্পরাগত সংস্কৃতি পছন্দ না হয়, তবে সরে পড়তে। এ প্রসঙ্গে তিনি সুর চড়া করে আরও বলেন, দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন সহ্য করা কখনোই সম্ভব নয়। যাদের এদেশীয় মূলধারা সংস্কৃতি পছন্দ না হয়; তারা চড়ে অন্যত্র চলে যেতে পারে, তাদের জন্য সমগ্র পৃথিবী পড়ে রয়েছে। কিন্তু তা নয়, তাদের অন্যত্র যাওয়ারও মুরদ নেই আবার ; আবার এদেশে বসে এদেশের পরম্পরায়গত ধর্ম সংস্কৃতিরই দিবারাত্রি বিরোধিতা করবে। অর্থাৎ এই ভূখণ্ডে সকল মতপথই তাদের নিজস্ব ধর্মীয় তত্ত্ব, আচার নিয়ে বহমান থাকবে, এটাই সত্য। পক্ষান্তরে যদি কেউ মনে করে যে তার মতটি ছাড়া আর সকল মতই ধ্বংস হবে, তবে সে বোকার স্বর্গে বসবাস করে। 


তথ্য সহায়তা:

  • ১. স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (ষষ্ঠ খণ্ড), উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা: সেপ্টেম্বর, ২০১৫
  • ২. ড. নিকুঞ্জবন্ধু ব্রহ্মচারী, শ্রীচৈতন্যপ্রসঙ্গ, মহাপ্রকাশ মঠ, ঢাকা: মার্চ,  ২০২২


ড. শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


সূত্র: ফেসবুক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ