পূজা ২০২৪ - শুভদীপ চন্দ

পূজা ২০২৪ - শুভদীপ চন্দ
পূজা ২০২৪ - শুভদীপ চন্দ

 

সন্ধ্যা ৫ টা ৩৯। আজ মহা নবমী। শনিবার ছুটির দিন। এমনিই বেরিয়েছিলাম। দেখি মনিপুরী পাড়ায় মরিচবাতি দিয়ে সাজানো পূজা মণ্ডপ। কৌতুহল নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। তিনজন মহিলা দুইজন পুরুষ পুলিশ সদস্য। একজন ঢাকী ঢাক সামনে রেখে বসে আছে। পুরো মণ্ডপ ফাঁকা। এমনকি পুরোহিতও নেই। ফাঁকা বলতে এমন ফাঁকা, একজন দর্শনার্থীও থাকবে না- এ আমি সত্যি ভাবিনি।


কি করি, মনে হলো ফার্মগেটের পূজায় যাই। কৃষিবিদ ইন্সটিটিউটের পূজা এ দেশের সবচেয়ে বেশি জমজমাট পূজার একটি। তখন ৫ টা বেজে ৫৫ মিনিট। পূজা দেখার একদম মধ্য গগন। এমন দৃশ্য অচিন্তনীয়। কোনো লাইন নেই, ছাড়া ছাড়া ভাবে লোকজন ঢুকছে, মূল মণ্ডপের সামনে অসংখ্য চেয়ার খালি পড়ে আছে। মণ্ডপের বাইরে সারি সারি ফুচকার দোকান, ভাজা টাজার দোকান, ভ্রাম্যমাণ নানা দোকান- ক্রেতা শূন্য। কোনভাবেই মনে হচ্ছে না আজ দুর্গা পূজা। মনে হচ্ছে না আজ নবমীর সন্ধ্যা বিকেল।


তারপর রিকশা নিলাম। এবার লক্ষ্য ঢাকেশ্বরী মন্দির। দেশের প্রধানতম মন্দির। সতীর মুকুটের মনি পড়েছিল বলে এটি এক শক্তিপীঠ। ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দুর্গাপূজা মূল ভবনের বাইরে হয়। আমি যখন পৌঁছি তখন প্রায় সাতটা বাজে। নেই জাঁকজমক, নেই আলোকসজ্জা, নেই চিরাচরিত সে ভীড়। অভ্যস্ত চোখে পার্থক্যটি ধরা পড়ে। ভীড় আছে কিন্তু অন্যবারের সাপেক্ষে কিছু না। এ মন্দিরে এ সময় বসার চেয়ার সবচেয়ে দুর্লভ- তাও দেখলাম খালি পড়ে আছে। মূল মন্দিরে ঢাকেশ্বরী দেবীর আরতি হচ্ছিল। ঢাক কাঁসার তালে তালে ঢাকী নাচছিল- তাও ফাঁকা ফাঁকা।


একই দৃশ্য নাকি সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরে। যাইনি, শুনলাম- সেখানে মূল ভক্ত পূজারির চেয়ে পাহারাদার বেশি। ভীড় ছিল তবে অন্যবার সাপেক্ষে অনেক কম। রমনা কালীমন্দিরে একই দৃশ্য। আমার মনেহয় পুরান ঢাকাতে এবার একই চিত্র হবে। পুরান ঢাকায় সরু সরু রাস্তা ধরে অনেকগুলো পূজা হয়। শাখারিপট্টি তাঁতীবাজার এলাকায়। মণ্ডপের নিচে মানুষজনের চলাচল করে। পুরো রাস্তা আলোকসজ্জায় ঝলমল করে আর একেক মণ্ডপে একেক গান বাজতে থাকে। এমন চলে অনেক রাত পর্যন্ত। আমি জানি না- এবার যাইনি কিন্তু অনুমান করি এ ঐতিহ্য অর্ধেকে নেমে আসবে।


এটি এবারের দুর্গাপূজার মূল ছবি। ভয় মানুষকে কোথায় পৌঁছে দিছে ভাবলে অবাক হতে হয়। মাত্র একবছরে এমন পরিবর্তন এতটা সংকোচন ভীতিকর। গতবার যে ফার্মগেটের পূজায় ভীড়ের ভয়ে লাইনে দাঁড়ানোর ভয়ে যাইনি- এবার এটি একপ্রকার নির্জীব। আমাদের মূল ধারার মিডিয়ার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। তারা আসল সত্যটি সামনে আনে না। একই পূজা, একই মণ্ডপ, অথচ কত পার্থক্য। কী পরিমান মানসিক যন্ত্রণা এতে ভূমিকা রাখছে তা আন্দাজ করা যায়। অথচ তারা এসব নিয়ে কিছু বলে না। পুরনো মহিষাসুর বধের গল্প শোনায়।


হিন্দুরা ভয় পাচ্ছে- এ তিতা সত্যকে এখন স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন। মূর্তি ভাঙা, 'দুর্বল' বলে পাহারা দেয়া, মণ্ডপে ইসলামি গান গাওয়া, সর্বশেষ বোমা হামলা- এগুলো ভাসমান হিমশৈলের দৃশ্যমান অংশ। নিচে পাহাড় সমান অংশ রয়েছে যা কেউ দৃশ্যমান করতে চায় না। অনবরত হুমকি ধামকি, গায়ে পড়ে অপমান করা, বুঝিয়ে দেয়া এ দেশ তোমার নয়- এগুলোর যোগফল হচ্ছে এবারের পূজা। একসাথে সব হিন্দু মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে যেন। ধর্ম পালন করার সুযোগ তাদের মানবাধিকার। তারা নিচ্ছে না, করছে না, ফিরিয়ে দিচ্ছে- এ অনেক দুশ্চিন্তার কথা।


আমরা সাক্ষী থাকছি, দেখছি- কিভাবে ফু দিয়ে দিয়ে সব মোমবাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। আমরা দেখছি- কিভাবে এক আলোকোজ্জ্বল রাজপুরী অন্ধকারে ডুবে যায়। আমরা দেখছি মাত্র এক বছরে একই উৎসব কি পরিমাণ ভীড় হারায়। চোখ বন্ধ করে প্রলয় ঠেকিয়ে রাখা যায় না। সবকিছু ভাল চলছে, সবকিছু স্বাভাবিক- বলে গৎবাঁধা কথা কারোরি ভাল ডেকে আনে না। জবাবদিহি অন্য দেশের কাছে নয়, এ দেশের মানুষের কাছে দেয়ার চর্চা করতে হবে। কেন খুশি নেই হিন্দুরা? কেন তাদের ঘুরেঘুরে মণ্ডপ দেখার প্রবণতা হারাচ্ছে? কেন তারা কথা বলে না? কেন তারা নিজেদের নিরাপদ ভাবে না? তাদের কষ্ট কি? এসব প্রশ্নের উত্তর এখন খোঁজা প্রয়োজন। 


এ দেশ খুব দ্রুত তার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা হারাচ্ছে। ফিকে হচ্ছে সংখ্যালঘুদের উৎসবের রঙ। আজ এ নির্মম বাস্তবতা আমি ঢাকার মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে অনুভব করেছি।

...

১২/১০/২০২৪


লিংক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ