আমাদের দেশে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এলে হিন্দুদের দুর্গতি যেন আরো বেড়ে যায়। ভয় ও শঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয় তাদের। দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপে হামলা, বিভিন্ন গুজব তুলে বাড়িঘরে আক্রমণের ঘটনা অধিকহারে ঘটে।
"এবার দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আগমণের প্রাক্কালে নতুন করে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা"
Published : 14 Oct 2023, 07:32 PM, Updated : 14 Oct 2023, 07:32 PM
ছোটবেলায় দুর্গপূজা নিয়ে আমাদের মধ্যে সীমাহীন আবেগ ছিল। ভয়-ডরহীন আনন্দ-উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ এক সর্বজনীন উৎসবের নাম ছিল দুর্গাপূজা। তখন মন্দিরে হামলার কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ তেমন ছিল না। মন্দিরগুলোতে ধর্মনির্বিশেষে সবাই অংশগ্রহণ করত। দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করত মুসলিম ধর্মাবলম্বী পাড়া-প্রতিবেশীরা। কোথাও কোনো বিদ্বেষ নেই, কটাক্ষ নেই, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে গড়া অপূর্ব সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ ছিল পুরো সমাজ। আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা অন্তত তাই বলে।
বরাবরের মতো এবারও বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবের আগমনবার্তা ঘোষিত হলো মহালয়ার মাধ্যমে। পিতৃপক্ষের অবসানে, অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনের সূচনা ঘটে, সেই মহালগ্নটি মহালয়ার বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দুর্গতিনাশিনী দুর্গাই হচ্ছেন সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরণের লগ্নটির নাম মহালয়া।
মহালয়া এলেই বাংলার মাটি-নদী–আকাশ প্রস্তুত হয় মাতৃপূজার মহালগ্নকে বরণ করার জন্য। কাশফুল ফুটলে যেমন শরৎ আসে, মহালয়া এলেই ঠিক তেমনি দুর্গাপূজা এসে যায়। দেবী-বন্দনার সুর ধ্বনিত হয়। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাকের আওয়াজ। বুকের মধ্যে জাগে আনন্দ-শিহরিত কম্পন। শিউলির সুগন্ধ, কাশের শুভ্রতা, আর নীল আকাশে রৌদ্র মেঘের লুকোচুরি রচনা করে দেবী দুর্গতিনাশিনীর আগমনের পটভূমি।
শাস্ত্রবিশেষজ্ঞদের মতে, পিতৃপক্ষের অবসানে জীবনে মহা লগ্ন নিয়ে আসে ‘মহালয়া’। তর্পণের শেষে সূর্যপ্রণাম করে অসুরবিনাশিনী দেবীকে আহ্বান করে বলা হয়— শোক, তাপ, দুঃখ, অমঙ্গল, অন্ধকার কাটিয়ে আলোকে উত্তরণের এগিয়ে নিয়ে চলো দেবী।
মহালয়ায় তর্পণের সঙ্গে পুরাণেরও যোগ রয়েছে। মহাভারতে কর্ণ সম্পর্কে বলা হয়েছে সূর্য-পুত্র দান ধ্যান করলেও তা ছিল স্বর্ণ, রত্ন, মণিমাণিক্য। তিনি পিতৃপুরুষের পরিচয় না জানায় পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে কখনও জল বা খাদ্য দান করেননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত্যুর পর স্বর্গে গেলে খাদ্য হিসেবে তাই তাকে দেওয়া হয় শুধুই সোনা-রত্ন। জীবিত অবস্থায় যা দান করেছেন তারই অংশ। তখনই কর্ণকে দেবরাজ ইন্দ্র জানান, পিতৃপুরুষকে কখনও তিনি জল দেননি বলেই মৃত্যুর পরে তিনি জল পাবেন না। এই ভুল সংশোধনের জন্য এক পক্ষকালে মর্ত্যে ফিরে পিতৃপুরুষকে জল ও অন্ন দিয়ে পাপস্খলন করেন কর্ণ। সেই এক পক্ষ কালই পিতৃপক্ষ। যার শেষ মহলয়ায়।
মহালয়া মানে দুর্গাপূজার দিন গোনা। মহালয়ার ছয় দিন পরেই আসে মহাসপ্তমী। ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবীকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে সীতাকে উদ্ধারের জন্য। শ্রীরামচন্দ্র অকালে অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবীর অকাল-বোধন বলা হয়। আসল দুর্গাপূজা হলো বসন্তে, সেটাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। সনাতন ধর্মে কোনও শুভ কাজ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বজসহ সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয়, তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তর্পণ মানে হল খুশি করা। রামচন্দ্র লঙ্কা বিজয়ের আগে এমনই করেছিলেন। সেই থেকে মহালয়া পালনের রীতি চলে আসছে।
পুরাণ মতে, মহালয়ার দিনে, দেবী দুর্গা মহিষাসুর বধের দায়িত্ব পান। ব্রহ্মার বর অনুযায়ী কোনও মানুষ বা দেবতা কখনও মহিষাসুরকে হত্যা করতে পারত না। ফলত অসীম ক্ষমতাশালী মহিষাসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর হতে চায়। ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব ত্রয়ী সন্মিলিত ভাবে ‘মহামায়া’র রূপে অমোঘ নারীশক্তি সৃষ্টি করলেন এবং দেবতাদের দশটি অস্ত্রে সুসজ্জিত সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা নয়দিনব্যাপী যুদ্ধে মহিষাসুরকে পরাজিত ও হত্যা করলেন।
মহালয়া এলে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় মহালয়া দিয়ে আমাদের দুর্গাপূজার আনন্দপর্ব শুরু হতো, শেষ হতো দেবী বিসর্জনে। মহালয়ার আগের রাতে মনে থাকত দারুণ উত্তেজনা। ভোর রাতে রেডিওতে প্রচারিত হবে মহালয়া, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে “আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জরি, ধরণীর বহিরাকাশি অন্তর্হিত মেঘমালা।” মনে তুমুল আনন্দ নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। রাত তিনটে বাজতেই সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হতো। মা-বাবার সঙ্গে ভাইবোনেরা অপেক্ষা করতাম কখন ভেসে আসবে সেই সুর ‘আকাশবাণী কলকাতা’ থেকে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের দরাজ কণ্ঠে দেবী বন্দনা। দেড় থেকে দুই ঘণ্টাব্যাপী প্রচারিত মহালয়ার সুরেলা মোহনায় আটকে যেত মন। আশেপাশের প্রতিটি বাড়ি থেকে ভেসে আসতো মহালয়ার অপূর্ব সব সঙ্গীত, সঙ্গে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কম্পিত কণ্ঠে “ইয়া দেবী সর্বভুতেষু, মাতৃরূপেণ সংস্থিতা, নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ”।
ছোটবেলায় বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের সেই সব শ্লোক-কথার মানে তেমন বুঝতাম না, বোঝার মতো জ্ঞনি-বুদ্ধি কখনও তৈরি হয়নি; কিন্তু মহালয়ার আনন্দে মেতে ওঠার উৎসাহ ছিল ঢের । কেমন যেন একটা জাদু থাকতো ওই চণ্ডীপাঠ আর গানের মধ্যে। গীতিকাব্য শুনতে শুনতে সকালে সূর্যোদয় দেখতাম, আর ক’দিন পরেই দুর্গাপূজা। পূজার আগাম বার্তা।। আর নতুন জামার গন্ধ।
সেখান থেকে একটু একটু করে আমাদের সমাজ বদলে গেল। হিন্দু-বিদ্বেষ, হিন্দুদের মণ্ডপ, বাড়িঘরে আক্রমণ নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হলো। সাম্প্রদায়িকতা পুরো সমাজকে গ্রাস করে ফেলল। এখন শিশুদেরকেও ‘হিন্দুদের সঙ্গে না-মেশা’র পাঠ দেন অভিভাবকরা। ঢাকের বাদ্যকে ‘হারাম’ আখ্যায়িত করে কোনো কোনো শিশুকে এই সময় ঘরে আবদ্ধ করে রাখা হয়, এমন খবরও পাওয়া যায়। কোনো উদার মনের মানুষ, ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্ব উঠে যদি ফেসবুকে শারদীয় শুভেচ্ছা জানান, তাহলেও একদল ধর্মান্ধ ক্রুদ্ধ হয়, তার বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়। একটু একটু করে পুরো সমাজটা ভিন্ন ধর্মের প্রতি সংবেদনশীল না হয়ে বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। আর এ ব্যাপারে হাওয়া দিচ্ছে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত নেতারা।
গত কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে দুর্গতিনাশিনী দুর্গা এলে হিন্দুদের দুর্গতি যেন আরো বেড়ে যায়। ভয় ও শঙ্কার মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয় তাদের। দুর্গাপূজার সময় মণ্ডপে হামলা, বিভিন্ন গুজব তুলে বাড়িঘরে আক্রমণের ঘটনা অধিকহারে ঘটে। বছর দুই আগে নোয়াখালীর চৌমুহনী ও কুমিল্লায় অত্যন্ত ন্যক্কারজনক হামলার ঘটনা ঘটে।
এমনিতেই দেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অধিকার লঙ্ঘনের সংবাদ নিয়মিতভাবেই গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়। এসব সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী নানা উপায়ে বিভিন্ন নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। তাদের নিজ ধর্ম বিশ্বাস চর্চার অধিকার, ভূমির অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, চলাচলের অধিকারসহ অন্যান্য অধিকারসমূহ প্রতিনিয়ত নানামুখী প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। গত এক বছরে সারা দেশে ৩৫টি সংখ্যালঘু নির্যাতন ও মন্দির ভাঙচুরের ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা বিদ্যমান দায়হীনতার অপসংস্কৃতির কারণে এসব ঘটনা ক্রমাগতভাবে ঘটে চলেছে। ২০০৯ সালের আগে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট। এরপর যে হামলাগুলো হয়েছে তা রাজনৈতিক দলের মদদপুষ্ট।
![]() |
এমপি বাহারের ‘মদমুক্ত পূজা’ বক্তব্যের প্রতিবাদে কুমিল্লায় ১৩ অক্টোবর হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের ডাকা সমাবেশে ছাত্রলীগ-যুবলীগের হামলা |
![]() |
কুমিল্লায় ১৩ অক্টোবরের সমাবেশে করা হামলায় যুব ঐক্য পরিষদের কর্মী আদিত্য দাসের মাথা ফেটে যায়। |
এবার দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আগমণের প্রাক্কালে নতুন করে ভীতি সৃষ্টি করা হয়েছে বলে মনে করছেন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। বিশেষ করে কুমিল্লা ৬ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম বাহাউদ্দিন বাহার কার্যকারণহীনভাবে ‘মদমুক্ত পূজা’র আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে আঘাত করেছেন দেশের হিন্দুদের। দুর্গাপূজার উপাচারে ১০৮টা নীল পদ্মের কথা থাকলেও কোথাও মদের কথা উল্লেখ নেই। হিন্দু ধর্মাবলম্বী তো নয়ই, কোনো মদ্যপও বলবেন না যে, দুর্গাপূজায় মদ খাওয়ার রীতি আছে। দেশের কোথায় মদ-যু্ক্ত পূজা হয় এবং হিন্দুদের কোনো পূজায় আদৌ মদ প্রয়োজন হয়, এমন তথ্য বাহার সাহেব কোথায় পেলেন?
‘মদমুক্ত পূজা’র আহবান জানানোর মধ্য দিয়ে বাহার সাহেব হিন্দুসম্প্রদায়ের কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। এর প্রতিবাদে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগ-যুবলীগ চড়াও হয়েছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন জায়গায় পূজার প্রাক্কালে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের প্রতিবাদে শুক্রবার সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং তাদের ধাওয়া করেছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। তাহলে কি তারা সংখ্যালঘুদের মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরকে সমর্থন করেন? এই প্রশ্নের জবাব কে দেবে?
সত্যি বলছি, চারপাশের ঘটনা দেখে এখন দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আগমনে মনের মধ্যে আর চঞ্চলতা সৃষ্টি হয় না। বরং এক সর্বগ্রাসী ভয় তাড়া করে। দুর্গতিনাশিনীর প্রতি ক্ষোভ জন্ম নেয়। কেন দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করে শায়েস্তা করলেন? এক অসুরকে হত্যা করেই কি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের সমগ্র পাশবিক প্রবৃত্তিকে দমন করা সম্ভব? কেনই বা সকল দেবতাদের বলে বিপুল বলীয়সী দুর্গা মহিষাসুরের ‘অসুর মনের’ পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো পরিবর্তন করতে অসমর্থ হলেন?
নাকি তার কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি? সেই চেষ্টা না করার নেপথ্যে কী কী কারণ ছিল? দুর্গার কাছে অসীম শক্তি আর বিপুল অস্ত্রসম্ভারের প্রত্যয়েই কি তিনি ওই পথে হাঁটেননি? যার কাছে ক্ষমতা থাকে, শক্তি থাকে, অস্ত্র থাকে, তিনি কি ক্ষমতা, শক্তি আর অস্ত্রের ভাষাতেই জবাব দিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন? পৃথিবীর তথাকথিত ‘সভ্য’ মানবসমাজ আর স্বর্গের দেবতাদের মধ্যে এ ক্ষেত্রে কি অনেক মিল রয়েছে?
ক্ষমতার দম্ভের ঔদ্ধত্যে, শক্তির আস্ফালনের স্পর্ধায়, অস্ত্রসম্ভারের ঝলকানির মত্ততায়? ক্ষমতা, শক্তি আর অস্ত্রের দর্পে মানবসমাজের মনন থেকে কি ক্রমেই বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছে মানবতার নিষ্কলুষ মন্ত্রোচ্চারণ? বঞ্চনা, হাহাকার, শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ কি যুগ যুগ ধরে অবদমিত হয়েই থেকে যাবে উদ্যত মারণাস্ত্রের উদ্ধত স্পর্ধার কাছে?
সূত্র: বিডিনিউজ২৪
0 মন্তব্যসমূহ