আলোর উৎসব দীপান্বিতা দীপাবলি: ইতিহাস, তত্ত্ব, তাৎপর্য - তমাল দাশগুপ্ত

আলোর উৎসব দীপান্বিতা দীপাবলি: ইতিহাস, তত্ত্ব, তাৎপর্য - তমাল দাশগুপ্ত

কয়েক বছর আগে আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং  মা কালীর আদলে আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছিল, সেই ছবি।

জয় মা কালী। জয় জয় মা। তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।


সাড়ে চার হাজার বছর আগে পরিণত হরপ্পা সভ্যতায় প্রদীপের ব্যাপক ব্যবহার হত। এছাড়া অনেক ক্ষুদ্রাকৃতি মাতৃমূর্তি পাওয়া গেছে যেগুলো ব্রতধর্ম পালনের সময় প্রদীপ হিসেবে ব্যবহার করা হত, অগ্নির আধার রূপে, সেই প্রমাণ আছে। তাই আলোর উৎসব প্ৰচলিত থাকার পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়।


হরপ্পা সভ্যতায় একজন বলাকামাতৃকা পূজিত হতেন। তাঁর মুখের আদল অনেক সময় করোটির ন্যায়। ভয়াভয় অর্থাৎ ভয় এবং অভয় উভয়ের উৎস তিনি।


এই প্রাচীন বলাকামাতৃকা থেকে মা কালী এসেছেন, এই মর্মে আমার গবেষণা আছে। "মা কালীর উত্থান" ও "মা কালীর উৎসরণ" পড়ুন।


হরপ্পা সভ্যতায় ঊষা নিশা পূজিত ছিলেন, একজন জগদকারণ অন্যজন জগদবিলয়। ঊষার শারদীয়া বোধন হত, নবপত্রিকা বা বৃক্ষ-শস্যমাতৃকা পূজিত হতেন, মহিষমেধ হত। অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে নবমীর দুর্গাপুজোর সমস্ত বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। যুক্তিসঙ্গত কারণেই হরপ্পা সভ্যতায় আদি দুর্গাপুজোর এক পক্ষকাল পরে আদি দীপান্বিতা কালীপুজোর উৎসব প্ৰচলিত থাকার পক্ষে সিদ্ধান্ত করা যায়।


★★★

বলাকামাতৃকা মোক্ষ দান করেন। পাণ্ডু রাজার ঢিবি, চার সহস্র বছর আগে বাঙালির সর্বপ্রাচীন সভ্যতাকেন্দ্র যা অন্তিম হরপ্পা সভ্যতার সমসাময়িক, সেখানে বলাকামাতৃকা পূজিত হতেন। আদি বাঙালির প্রধান দেবী সেদিনও কালী, আজও কালী। 

দীপান্বিতা উৎসবে প্রদীপের শিখা বলাকামাতৃকা প্রদত্ত কৈবল্য বা নির্বাণ দশার প্রতীক। এই আলোকমালা অন্ধকার থেকে আমাদের আলোর পথেও নিয়ে যায়, তমসো মা জ্যোতির্গময়। যেহেতু আগুন আলোকিতও করে এবং সেই সঙ্গে তার দাহিকা শক্তি সমস্ত কিছুর লয়ও ঘটায়, তাই দীপান্বিতা উৎসব আমাদের মায়ের উপযুক্ত প্রকাশ।


প্রসঙ্গত ইউরোপে কেল্ট জাতির মধ্যে একপ্রকার অনুরূপ Pagan উৎসব প্ৰচলিত আছে প্রাচীন কাল থেকে (Samhain, অনেক পরে যা Halloween) যা আমাদের ভূতচতুর্দশী ও দীপান্বিতা উৎসবের অনুরূপ। একটি ব্রাত্য অবৈদিক তন্ত্রাশ্রয়ী আর্য সংযোগ আছে সম্ভবত।

★★★


পরবর্তীতে অন্যান্য ধর্ম এই দীপান্বিতা উৎসবকে আত্মসাৎ করতে প্রয়াস পায়। হরপ্পা পতনের দেড় হাজার বছর পর জৈন ধর্ম এই দিনটিকে মহাবীরের প্রয়াণ দিবস রূপে পালন করতে থাকে, এবং অনেক প্রদীপের দ্যোতনায় মহাপরিনির্বাণ এক রূপকমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। আরও পরে, সঠিক করে বললে জৈন ধর্মের প্রায় হাজার বছর পরে, উত্তর ভারতে রামায়েত বৈষ্ণব ধর্মের উত্থান হলে রামের অযোধ্যা ফিরে আসার গল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় দীপান্বিতা উৎসব। প্রসঙ্গত জনপ্রিয় মাতৃকা উৎসব শারদ নবরাত্রিকে রাম রাবণের যুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াসও ঘটে।

★★★


কিন্তু বাঙালি এই সময় মায়ের উপাসনা করে। সেনযুগের অন্তিম পর্বে ত্রয়োদশ শতকে বৃহদ্ধর্ম পুরাণে কার্তিকী অমাবস্যা তিথিতে দীপান্বিতা কালীপুজোর উল্লেখ আছে।


এর তিনশ বছর পর ষোড়শ শতকে বৃহৎ তন্ত্রসারে কার্তিকী অমাবস্যায় দীপান্বিতা উৎসবে লক্ষ্মী পুজোর উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত লক্ষ্মী ও কালীর মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। উত্তর ভারতে এই দিন লক্ষ্মীপুজো হয়। প্রসঙ্গত মধ্যযুগে অনেক প্রাচীন ধর্মীয় প্রথা  বিস্মৃত ও বিলুপ্ত হয়েছিল কাজেই বৃহৎ তন্ত্রসারে দীপান্বিতা কালীপুজোর অনুল্লেখ আশ্চর্য নয়। কিন্তু মহালক্ষ্মী ও মহাকালীর একটি প্রাচীন সংযোগ আছে, আগে লিখেছি এই বিষয়ে।


অষ্টাদশ শতকে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রর সময় শ্যামাসপর্য্যাবিধি গ্রন্থে কার্তিকী অমাবস্যায় দীপান্বিতা কালীপুজোর উল্লেখ আছে এবং এই সময়েই রাজার উদ্যোগে দশ হাজার কালীপুজো অনুষ্ঠিত হয়েছিল নদীয়া নবদ্বীপ জুড়ে আমরা জানি।


© তমাল দাশগুপ্ত Tamal Dasgupta 


কয়েক বছর আগে আমেরিকার এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং  মা কালীর আদলে আলোকসজ্জায় সেজে উঠেছিল, সেই ছবি।

জয় মা কালী। জয় জয় মা। তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে।


সূত্র: তমাল দাশগুপ্ত

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ