জগদ্বন্ধুসুন্দরের (২৮ এপ্রিল ১৮৭১-১৭ সেপ্টেম্বর ১৯২১) একটি অনন্য কীর্তি হলো, বাগদি সহ তৃণমূল পর্যায়ের অসহায় মানুষের কাছে পৌঁছে, তাদের মাঝে ভগবদ্ভক্তি প্রচার করা। তাঁর সেই প্রচারে ব্রাহ্মণকান্দার রজনী বাগদি শ্রেষ্ঠ কীর্তনীয়া এবং মোহান্তে পরিণত হয়েছিলেন। জগদ্বন্ধু সুন্দর বলেছিলেন, "সমাজের বাঁধ ভেঙ্গে দেব"। তিনি সত্যিই সমাজের বাঁধকে ভেঙে দিয়েছিলেন। সনাতন ধর্মে বেদাদি শাস্ত্রে সর্বদাই সাম্যাবস্থা কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিপরীতে সমাজে বিভিন্ন সময়ে অসাম্যের বিষফোড়া জন্ম নিয়ে সমাজকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে। সেই ক্ষত-বিক্ষতের সুযোগ নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তরিত করেছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরা। তাই অসাম্যের পঙ্কিলতাকে জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের আবার নতুন করে বৈদিক সাম্যবাদী চেতনায় উপনীত হতে হবে। মানুষে মানুষে সামাজিক অসাম্য কখনই মঙ্গলকর নয়। সামাজিক অসাম্যের সামান্যতম ছিদ্র দিয়েও বৃহত্তর বিপদের কালসাপ প্রবেশ করে জাতির সর্বোচ্চ ক্ষতি করতে পারে। এর প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময়েই পেয়েছি।সাম্যবাদী মানবতাবাদী সনাতন ধর্মের সমাজের কিছু কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত অসাম্য প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত ব্যথিত ছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে তাঁর 'গীতাঞ্জলি' কাব্যে বলেছেন:
"হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান!
মানুষের অধিকারে
বঞ্চিত করেছ যারে,
সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।"
সনাতন ধর্মাবলম্বী সকল মহামানবেরাই মানুষের সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এর মধ্যে জগদ্বন্ধু সুন্দর এক অনুপম দৃষ্টান্ত। তাঁর আদর্শ এবং দৃষ্টান্তকে অনুসরণ করে যদি সাধু-সন্ন্যাসীরা তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের জীবনে পৌঁছে তাদের দুঃখবেদনার খোঁজ নিতেন, তবে হয়ত ধর্মান্তর শূণ্যের পর্যায়ে চলে যেত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অশেষ কল্যাণ হতো। গোপীবন্ধুদাস ব্রহ্মচারী রচিত 'শ্রীশ্রীবন্ধুলীলা-তরঙ্গিণী' গ্রন্থে বুনো বাগদি রজনী সর্দারের ভক্ত হরিদাসে রূপান্তরিত হওয়ার ঘটনাটি অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণিত হয়েছে। সেই দৃষ্টান্তমূলক কাহিনীটি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণনা করছি।
বৃহত্তর ফরিদপুর, ঢাকা, যশোহর শহরে সনাতন ধর্মাবলম্বী বাগদী সম্প্রদায়ের বহু মানুষ বসবাস করত। খ্রিস্টান মিশনারী পাদ্রীরা তাদের ধর্মান্তরিত করার জন্যে ব্যাপকভাবে প্রচেষ্টা শুরু করে। এই লক্ষ্যে তারা গরীব এই সম্প্রদায়ের মাঝে বিভিন্ন প্রকারের সাহায্যের নামে ধর্মান্তরিত করার ফাঁদ পাতে। এই বাগদীরা কোল, ভীল, সাঁওতাল মুণ্ডাদের সমগোত্রীয়। ব্রিটিশ শাসনামলে নীলের চাষের জন্যে নীলকুঠিয়ালরা ঝাড়খণ্ডের ও অন্যান্য পার্বত্য দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চল থেকে তাদের দলে দলে বাংলায় নিয়ে আসে। নীলকুঠিয়ালরা এই অসহায় দরিদ্র মানুষদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করতো। দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ' নাটকটি এর একটি সাহিত্যিক নিদর্শন। শত অত্যাচারের মধ্যেও যতদিন নীলের চাষাবাদ সচল ছিল, ততদিন এই অসহায় বাগদীদের কপালে দুটি অন্ন জুটতো। কিন্তু পরবর্তীতে রাসায়নিক উপায়ে নীলের উৎপাদন শুরু হলে, নীলের চাষ প্রায় উঠেই গেলো। ফলে অন্যস্থান থেকে বাংলায় আগত এই অসহায় মানুষগুলো ভয়ংকরভাবে আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পরে গেলো। তখন তারা ধীরেধীরে বিভন্ন স্থানে ছড়িয়ে পরে। তখন তারা রাস্তা তৈরির শ্রমিক, ঘর বাঁধা, ইদের সুরকী ভাঙা, শূকর চরানো ইত্যাদি বিবিধ উপায়ে কোনমতে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকে। অচেতন হিন্দু সমাজের চোখের আড়ালেই থাকে গরীব অসহায় এই মানুষগুলোর জীবপ্রবাহ। বন থেকেই জীবন জীবিকা নির্বাহ করতো বলে এই বাগদিদের অনেকে ‘বুনা’ বা 'বুনো' বলতো। জগদ্বন্ধু সুন্দরের সময়ে ফরিদপুর শহরের মেলার মাঠের আশেপাশে এই বুনো বাগদি সম্প্রদায়ের কয়েক সহস্র লোক বসবাস করতো। তাদের প্রত্যেকটি এলাকাতেই একজন করে প্রধান থাকতো। সেই প্রধানকে বলা হতো সর্দার। তেমনি ফরিদপুর শহরের মেলার মাঠের বাগদিদের সর্দার ছিলেন, রজনী সর্দার। লম্বা লম্বা চুল, লম্বা লম্বা দাড়ি, বড় বড় গোঁফ, কপালে সিন্দুরের রাঙ্গা ফোঁটা, বৃহৎ চক্ষু, জবাফুলের মত রক্তবর্ণ আকৃতি ছিলো রজনী সর্দারের। লাঠি খেলা, শরকী খেলা, তীর-ধনুকের খেলা, এ সকল বিষয়ে রজনী সর্দার ছিলেন পারদর্শী। গায়ের বর্ণ চাঁদহীন রজনীর মত কাল হইলেও রজনীর গুণ অনেক। নরনারী রজনীর কাছে অনেক প্রকার উপকার পায়। কেবল ফরিদপুর সহরে নহে, সমস্ত জেলায় রজনী সকলের পরিচিত। নানা জনে নানা প্রয়োজনে রজনীকে ডাকে।
এই অসহায় মানুষদের অসহায়ত্বের সুযোগে খ্রিস্টান মিশনারী পাদ্রীরা প্রতিনিয়ত বুনো বাগদিদের পাড়ায় আসা শুরু করে। বুনাদের দারিদ্র্য দুঃখের সুযোগ নিয়ে ধর্মান্তরিত করার ছক কষতে থাকে। খ্রিস্টান মিশনারীরা চিন্তা করে যদি রজনী সর্দারকে ধর্মান্তরিত করা যায়, তবে সকল বাগদিদের ধর্মান্তরিত করা যাবে। সেই লক্ষ্য তাদের একদিন সফলতার কাছাকাছি পৌঁছে যায়। মিশনারীদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজের সম্প্রদায়কে নিয়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে রজনী সর্দার ধর্মান্তরিত হতে সিদ্ধান্ত নেয়। সহস্রাধিক বুনো বাগ্দী-সহ রজনী সর্দার খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হবে। সেই লক্ষ্যে আগামী পরশু পাদ্রীরা আসবে। এই অসহায় মানুষগুলোর ধর্মান্তরিত হওয়ার সকল আয়োজন সম্পন্ন। সহস্রাধিক বুনো বাগদী ধর্মান্তরিত হবে, এই সংবাদে ফরিদপুরের তৎকালীন অচেতন হিন্দু সমাজের কাউকেই সামান্যতম বিচলিত হতে দেখা গেলো না। শুধু একজনের হৃদয় কেঁদে উঠিলো। তিনি হলেন, ফরিদপুর শহরতলীর ব্রাহ্মণকান্দার নবীন সাধক শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর।সকালবেলা দুঃখীরাম ঘোষ এসে শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরকে বলেন,
“প্রভু, যে রজনী বাগদী সেদিন চৌদ্দমাদল কীর্তনের সময় ছুটে এসেছিলো, তারা সকলেই খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হচ্ছে।”
দুঃখীরাম ঘোষ ফরিদপুরের বাজারে সংবাদটি শুনেছে। নির্মম এই সংবাদটি শুনে তার হৃদয় বেদনার্ত হয়ে উঠে। দুঃখীরামের কথা শুনে, বাগদিদের ধর্মান্তরিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দর অস্থির হয়ে যান। তিনি বলেন,
“দুঃখী, তুমি এখনই যাও, আমার নাম করে রজনীকে ডেকে আন।”
শ্রীজগদ্বন্ধুসুন্দরের আজ্ঞায় কালবিলম্ব না করে দুঃখীরাম তৎক্ষণাৎ রজনী সর্দারের কাছে ছুটে গেলেন।
দুঃখীরাম সুদীর্ঘ দেহী পুরুষ। দ্রুতগতিতে তিনি চলতে অভ্যস্ত। বিপদে পড়লে মানুষ যেমন বেগে ধাবমান হয়, প্রভুবন্ধুর আদেশ মাথায় লয়ে দুঃখীরামও সেই মত বাগদি সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে ছুটলেন। কিছু সময়ের মধ্যেই তিন মাইল পথ অতিক্রম করে তিনি বুনো পাড়ায় পৌছে গেলেন। রজনীর কুটিরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে বললেন, “রজনী, তোমাকে প্রভু ব্রাহ্মণকান্দায় ডেকেছেন।” রজনী সর্দারের চোখে আনন্দাশ্রু বয়ে গেলো। তিনি বললেন, “প্রভু আমাকে ব্রাহ্মণকান্দায় ডেকেছেন!” রজনী সর্দারের মনে পরে গেলো, পূর্বদিনের চৌদ্দমাদল মহোৎসবের কথা। সেই মহোৎসবে সে সকল মানুষের সঙ্গে, মানুষের মত এক পঙ্ক্তিতে বসে পরমানন্দে খিচুরী প্রসাদ গ্রহণ করেছিলেন।রজনী সর্দার আজও তা ভুলে যাননি। সর্বোপরি কীর্তনের মধ্যে যে জ্যোতির্ময় মানুষটিকে সে দর্শন করেছিলো, সেই মানুষটির কথা সে ক্ষণেকের তরেও ভুলে যান নি। মাথার লম্বা লম্বা বাবরি চুল গুলোকে ঠিক করে, কোমরে চাঁদর বেঁধে এক খানি গামছাকে কাঁধে ফেলে, লাঠি হাতে রজনী সর্দার দুঃখীরাম ঘোষের সাথে ব্রাহ্মণকান্দা আসলেন। পথে রজনীকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করলেন, "রজনী, সকাল বেলা কোথায় চলেছ?" সকলের প্রশ্নেরই এক উত্তর দিলেন রজনী সর্দার—“প্রভু ডেকেছেন।” “প্রভু ডেকেছেন” এই গৌরবে রজনী গৌরবান্বিত। তাঁর হৃদয় যেন প্রস্ফুটিত হয়ে অনেকখানি বড় হয়ে গিয়াছে। ক্ষুদ্রত্বের বেদনা-ভার ইতিমধ্যেই অনেকখানি লাঘব হয়েছে।বড় বড় চোক দু'টিতে আজ ছলছল করছে।
রজনী সর্দার এসেছে শুনে জগদ্বন্ধুসুন্দর অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে “রজনী এসেছ!” বলতে বলতে ঘর থেকে বাইরে এলেন।জগদ্বন্ধুসুন্দরকে দেখে রজনী প্রণাম করার জন্যে এগিয়ে গেলেন। কিন্তু প্রণামের পূর্বেই দুইহাত প্রসারিত করে জগদ্বন্ধুসুন্দর রজনীকে বুকের মধ্যে চেপে ধরলেন। রজনী এক দৈব সংস্পর্শ লাভ করলেন। মুক্তপুরুষের আলিঙ্গনে রজনীর দেহমনে এক অভূতপূর্ব আনন্দের স্রোত বইতে লাগলো। তাঁর বজ্রদেহ নবনীতের মত ভক্তিতে গলে গেলো। কিছুটা সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরে রজনী সর্দার বললেন, “প্রভু, এ অধমকে ডেকেছেন?” উত্তরে জগদ্বন্ধুসুন্দর বললেন, “হাঁ, ডেকেছি রজনী, তোমরা নাকি খৃষ্টান হবে?” জগদ্বন্ধুসুন্দর প্রশ্নের উত্তরে রজনী বললেন, “হা প্রভু, কাল পাদ্রীরা আসবে।” জগদ্বন্ধুসুন্দর পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন,“কি কারণে?” রজনী সর্দারের উত্তর, “আপনি তো সকলই জানেন। আপনাকে আর কি বলব! সমাজে আমাদের তেমন স্থান নেই। অপমান অত্যাচার আর সহ্য হয় না, প্রভু। আমরা হীন বুনা জাত। এ সমাজে আমাদের স্থান কোথা?” বলতে বলতে রজনীর কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। জগদ্বন্ধুসুন্দর বললেন, “রজনী, কে বলেছে তোমরা হীন? তোমরা হীন নও, তোমরা মহান। হরিনাম করলে তোমরা আরও মহান্ হবে। তোমরা বুনা জাতি নও। তোমরা মানব জাতি। তোমরা আমার অতি প্রিয়। শ্রীহরির দাস তোমরা, এই তোমাদের প্রকৃত পরিচয়। রজনী, তুমি সেই নিত্যকালের পরিচয়ে পরিচিত হও। সকল দুঃখ ঘুচিবে। আজ হ’তে তুমি আর রজনী নও। তুমি হরিদাস! হরিনাম কর। প্রাণ ভরে নিতাই গৌরের জয় গাও। সগোষ্ঠী ধন্য হও। আর এইক্ষণ হাঁতে তোমরা আর বুনা নও। তোমাদের উপাধি হবে মোহান্ত।” রজনী সর্দারকে জগদ্বন্ধুসুন্দর ডাকলেন, “হরিদাস!” এই ডাকে সদ্য হরিদাস নামক রজনী সর্দারের চোখে অঝর ধারায় আনন্দাশ্রু বয়ে যেতে লাগলো।জগদ্বন্ধুসুন্দর বললেন, “কাল তুমি সগোষ্ঠী এখানে এসে শ্রীরাধাগোবিন্দের প্রসাদ গ্রহণ করবে। তোমাদের যত লোক আছে, নর-নারী বালক-বৃদ্ধ সবাইকে নিয়ে আসবে।" এই কথা বলে জগদ্বন্ধুসুন্দর গৃহমধ্যে প্রবেশ করলেন। বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে আত্মহারা হরিদাস কিছু সময় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর কাছে সকল ঘটনাগুলো স্বপ্নের মত মনে হতে লাগলো। তাঁর মধ্যের সকল সংশয়, বিলীন হয়ে গেলো। তিনি আজ সম্পূর্ণ নতুন মানুষ। সমাজ যেহেতু মানুষ তৈরি করে। তাই স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে সমাজে অসাম্য রয়েছে। কিন্তু বেদে সকল মানুষের মাঝেই একত্বের সাম্যবাদী প্রেরণা দেয়া হয়েছে। সকল মানুষের আধ্যাত্মিক সহ জাগতিক সকল বিষয়ে সমানাধিকার প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ সংহিতার শাকল শাখার দশম মণ্ডলের শেষ সূক্তে বলা হয়েছে:
সং গচ্ছধ্বং সং বধ্বং সং বাে মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে॥
সমানাে মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বাে হবিষা জুহােমি॥
সমানী ব আকুতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমন্ত বাে মনাে যথা বঃ সুসহাসতি॥
(ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২-৪)
"হে মানব, তােমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলে একই ঐক্যের কথা বলো, তােমাদের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হােক। পূর্বকালীন জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেমন করে কর্তব্য কর্ম এবং উপাসনা করেছে, তােমরাও তেমন করে আমার পথে চল।
তােমাদের সকলের মিলনের মন্ত্র এক হােক,
মিলনভূমি এক হােক এবং মনসহ চিত্ত এক হােক। তােমরা একতার মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে অগ্রগামী হও। তােমাদেরকে দেয়া খাদ্য-পানীয় ঐক্যবদ্ধভাবে সুষম বণ্টন করে গ্রহণ কর।
তােমাদের সকলের লক্ষ্য এক হােক, হৃদয় এক হােক এবং মন এক হােক। তােমরা সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ হও এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও।"
বুনো বাগদিদের 'মোহান্ত' হওয়ার সংবাদটি সর্বত্রই প্রচারিত হয়ে গেলো। খ্রিস্টান মিশনারীদের দশ বৎসরের অক্লান্ত প্রচেষ্টা জগদ্বন্ধুসুন্দরের কয়েকটি কথায় সম্পূর্ণভাবে নিস্ফল হয়ে ভেসে গেলো। মিশনারীদের বিদায় দিয়ে হরিদাস (রজনী সর্দার) শত শত বালক-বালিকা নরনারী সঙ্গে ব্রাহ্মাণকান্দায় উপস্থিত সংকীর্তন করছে। তাদের জাতি বর্ণের ভেদ ঘুচে গেছে। সকলে সমান আসনে, সমান আদরে, পরম তৃপ্তির সহিত মহাপ্রসাদ গ্রহণ করছে। বুনো বাগদি জাতির নূতন জন্ম হয়েছে। শিক্ষিত মহলে সাড়া পড়ে গেলো। সকলেই জগদ্বন্ধুসুন্দরের জাতিরক্ষার প্রশংসা করতে লাগলো। কলিকাতায় এই ঘটনা নিয়ে পত্রিকায় লেখা হলো। কিন্তু বিষয়টিতে মিশনারীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হলো। ইংরেজদের “আবগারী” নামক পত্রিকায় এ প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো।
বুনো বাগদিদের ধর্মান্তরিত হওয়া থেকে রক্ষা করা; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের মাঝে হরিনাম সংকীর্তনের প্রচার; কোলকাতায় সুরুতকুমারী দেবীর মত অসংখ্য বিপথগামী নারীদের ধর্মপথে ফেরানো; ১৯২০ সালের প্লেগ মহামারী নির্মূলে কলকাতায় মানুষের পাশে থাকা; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে বৈষ্ণব, শাক্ত ও শৈব এ সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ বিদূরিত করা সহ জাতি-ধর্ম রক্ষায় জগদ্বন্ধুসুন্দরের অবদান অনন্য। তাই তিনি আজও বরণীয় ও পূজনীয়।
তথ্য সহায়তা:
- ১. গোপীবন্ধুদাস ব্রহ্মচারী, শ্রীশ্রীবন্ধুলীলা-তরঙ্গিণী
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
0 মন্তব্যসমূহ