নবাব সলিমুল্লাহ'র জমিতে গড়ে উঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক অহম ও দেশের বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিকথা! - জামান ফিরোজ

নবাব সলিমুল্লাহ'র জমিতে গড়ে উঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক অহম ও দেশের বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিকথা! - জামান ফিরোজ

নবাব সলিমুল্লাহ'র জমিতে গড়ে উঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে সাম্প্রদায়িক অহম ও দেশের বাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিকথা!


২০০২ সাল৷ 


তখন আমি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারন সম্পাদক। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সারাদেশের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসমূহের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিশেষ করে সংকট সমূহ উল্লেখ করে ২০০৩ সালে জাতীয় কনভেনশন উপলক্ষে একটা প্রকাশনা বের করার উদ্যোগ নেয়া হয়।

কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তৎকালীন নেতা Nurul Islam, Khalequzzaman Lipon, Nikhil Das, Khokan Das, Ashanur Rahman, Mosharrof Hossen, Ruseli Khan Jhumpa, আলী নাঈম, Janardon Datta Nantu  সহ কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের নেতৃত্বে সংগঠনের নেতা কর্মীরা সারাদেশের প্রধান প্রধান কলেজ নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি করে। আমি গোটা খুলনা বিভাগের প্রতিটা জেলা সদরের প্রধান প্রধান কলেজগুলো নিয়ে কাজ করি। প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথে কথা বলে ও লিখিত দলিল থেকে আমরা নিরপেক্ষ প্রতিবেদন তৈরি করার মাধ্যমে জাতীয় কনভেনশনের স্মরণিকা প্রকাশ করি। সেখানে দেখা যায় দু-চারটি কলেজে মুসলমান দানশীল ব্যক্তি ভুমিকা রাখলেও প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিন্দু জমিদারের জমি ও অর্থ সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে। মুসলিম দানশীল ব্যক্তিবর্গের প্রতি শ্রদ্ধা ও সন্মান রেখে সাম্প্রদায়িক অহম ভেঙ্গে হিন্দু দানশীল ব্যক্তিবর্গের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ও কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসের সারমর্ম প্রকাশ করছি।

১। ঢাকা কলেজ (১৮৪১ সাল): দেশের শীর্ষস্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কলেজ এবং উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তা ও স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের দ্বারা ঢাকা কলেজ গড়ে ওঠে।

২। চট্টগ্রাম কলেজ (১৮৬১ সাল): দেশের শীর্ষস্থানীয় ঐতিহ্যবাহী কলেজ, পর্তুগীজ আমলের স্থাপনায় এবং জে সি বোসের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ।

৩। রাজশাহী কলেজ (১৮৭৩ সাল): রাজশাহী শহরে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারে হিন্দু জমিদারদের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এদের মধ্যে দুবলাহাটির হরনাথ রায় চৌধুরী, দীঘাপতিয়ার রাজা প্রমথ নাথ রায়, রাজা প্রমোদ রায়, রাজা বসন্ত রায়, পুঠিয়ার রাণী শরৎসুন্দরী দেবী, হেমন্তকুমারী দেবী, বলিহারীর রাজকুমার শরবিন্দু রায় এবং রাজশাহী কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ ছিলেন হরগোবিন্দ সেন।

৪। মুরারী চাঁদ (এমসি) কলেজ, সিলেট (১৮৯২ সাল): অখন্ড আসাম রাজ্যের প্রথম ও ঐতিহ্যবাহী সেরা কলেজ। তৎকালীন সিলেটের শিক্ষানুরাগী রাজা গিরিশচন্দ্র রায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজের নামকরণ করা হয় তাঁর প্রমাতামহ মুরারী চাঁদের নামে।

৫। আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ (১৮৮৩ সাল): বাঙ্গালি শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক আনন্দ মোহন বসু কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

৬। এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা (১৮৮৯ সাল): তৎকালীন শিক্ষানুরাগী গোপাল চন্দ্র লাহিড়ী ভারতের তৎকালীন সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ডের নামানুসারে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকে সাহায্য করেন তাড়াশের জমিদার রায় বনমালী রায় বাহাদুর, কুষ্টিয়ার আমলা সদরপুরের জমিদার ও নীল বিদ্রোহের নেত্রী প্যারীসুন্দরী দেবী, দেবেন্দ্রনারায়ণ সিংহ, অধ্যাপক হেমচন্দ্র রায় এবং রাধিকানাথ বসুসহ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।

৭। ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, বরিশাল (১৮৮৯ সাল)

প্রখ্যাত সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ ও শিক্ষানুরাগী অশ্বিনী কুমার দত্ত কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

জেলা ম্যাজিস্টেট রমেশচন্দ্র দত্তের অনুরোধে অশ্বিনী কুমার দত্ত তাঁর পিতা ব্রজমোহন দত্তের নামে কলেজটির নামকরণ করেন ।

৮। ভিক্টোরিয়া কলেজ, কুমিল্লা (১৮৮৯ সাল): অখন্ড ত্রিপুরা রাজ্যের বিখ্যাত ভিক্টোরিয়া কলেজ। কুমিল্লার শিক্ষানুরাগী রায় বাহাদুর আনন্দচন্দ্র রায় রানী ভিক্টোরিয়ার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

৯। কারমাইকেল কলেজ, রংপুর (১৯১৬ সাল): বাংলার গভর্নর লর্ড ব্যারণ কারমাইকেলের নামানুসারে তৎকালীন রংপুরের জমিদার অন্নদামোহন রায়চৌধুরী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

১০। বৃন্দাবন কলেজ, হবিগঞ্জ (১৯৩১ সাল): আসাম লোকাল বোর্ডের সদস্য এডভোকেট বিনোদলাল রায় এবং সুনেন্দ্রলাল দাসচৌধুরী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। বানিয়াচং -এর শিক্ষানুরাগী বৃন্দাবন চন্দ্র দাশের নামে কলেজটির নামকরণ করা হয়।

১১। রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর (১৯১৮ সাল): অম্বিকা চরণ মজুমদার ফরিদপুরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সভা করেন। আর্থিক সহায়তায় রমেশনারায়ণ রায়চৌধুরী তাঁর পিতা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়চৌধুরীর নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

১২। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজ (১৯৪৪ সাল): অখন্ড আসাম রাজ্যের শিক্ষানুরাগী প্রফুল্ল কুমার চক্রবর্ত্তীর নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৩। ফেণী সরকারি কলেজ (১৯২২ সাল): ফেণী মহকুমাতে প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মহেন্দ্র কুমার ঘোষ, কালীচরণ নাথ, প্রতিষ্ঠাকালীন কলেজের অধ্যক্ষ বীরেন্দ্র ভট্টাচার্য্য এবং অম্বিকাচরণ রক্ষিত রায় বাহাদুরের নেতৃত্বে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৪। চাঁদপুর সরকারি কলেজ (১৯৪৬ সাল): চাঁদপুরের শিক্ষাবিদ এবং প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ পরেশচন্দ্র গাঙ্গুলীর অক্লান্ত চেষ্টায় কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয় ।

১৫। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ (১৯৫৪ সাল):

নবাবগঞ্জের শিক্ষাবিদ নগেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী, বিমলরঞ্জন সিংহ, এডভোকেট অনিমেশচন্দ্র মৌলিক, রমেশচন্দ্র বাগচী, ডা: তারাপদ সাহা এবং সাতকড়ি বাবুর প্রচেষ্টায় কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৬। দিনাজপুর সরকারি কলেজ (১৯৪২ সাল): প্রথমে কলকাতা রিপন কলেজের অধীনে একটি শাখায় যুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে রাজা গিরিজানাথ, অধ্যাপক অমরেন্দ্র কুমার ঠাকুর এবং কে সি ব্যানার্জী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন ।

১৭। মকবুলার রহমান সরকারি কলেজ, পঞ্চগড় (১৯৬৫ সাল): কলেজটি মূলত: পঞ্চগড়ের শিক্ষাবিদ বিষ্ণু প্রসাদ প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু পরবর্তীকালে কয়েকটি ভবন তৈরি করেন মকবুলার রহমান। তারপর কলেজের নাম পরিবর্তন করে মকবুলার রহমান কলেজ করা হয়।

১৮। ব্রজলাল (বিএল) কলেজ, খুলনা (১৯০২ সাল): বোর্ড অব ট্রাস্টির মাধ্যমে পরিচালনা করা হত যার সভাপতি ছিলেন শাস্ত্রী ব্রজলাল চক্রবর্তী। সেই ব্রজলালের নামেই কলেজটির নামকরণ হয়েছে। প্রতিষ্ঠালগ্নে ঘাটভোগের (ফকিরহাট, বাগেরহাট) জমিদার ত্রৈলোক্যনাথ চট্টোপাধ্যায় জমি ক্রয় করে দেন।

১৯। প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) কলেজ, বাগেরহাট (১৯১৮ সাল): বাঙ্গালি তথা ভারতের বিজ্ঞান ভাবনার অগ্রদূত বিশিষ্ট পদার্থ বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

২০। কেশব চন্দ্র (কেসি) কলেজ, ঝিনাইদহ (১৯৬০ সাল): বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী কেশব চন্দ্র পাল ১২ একর জমির ওপর নিজ প্রচেষ্টায় কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

২১। মাইকেল মধুসূদন (এমএম) কলেজ, যশোর (১৯৪১ সাল): যশোরের শ্রেষ্ঠ সন্তান অধ্যাপক মহীতোষ রায়চৌধুরী, কেশবলাল চৌধুরী এবং যশোহর পৌরসভার সভাপতি সুরেন্দ্রনাথ হালদার কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যশোরের শ্রেষ্ঠ মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের নামে নামকরণ হয়।

২২। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ (১৯৪৬ সাল): সাতক্ষীরা মহকুমা প্রশাসক পি সি মজুমদার, সাতক্ষীরা পৌর চেয়ারম্যান লীলাপদ মজুমদার, নিরোধ চ্যাটার্জী এবং হরিচন্দ্র ঘোষ কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন ।

২৩। ভিক্টোরিয়া কলেজ, নড়াইল (১৮৮৬ সাল): নড়াইলের জমিদার রতন রায় কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র চন্দ্র রায় চিত্রা নদীর তীরে মহারাণী ভিক্টোরিয়ার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

২৪। তোলারাম কলেজ, নারায়ণগঞ্জ (১৯৩৭ সাল): প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ খগেন্দ্রনাথ চক্রবর্ত্তী কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

২৫। সরকারি হরগঙ্গা কলেজ (১৯৩৮ সাল): শিক্ষাবিদ আশুতোষ গাঙ্গুলী প্রতিষ্ঠা করেনএবং স্থানীয় আইনজীবি সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্য্যের মাতা গঙ্গেশ্বরী দেবীর নামে কলেজটি নামকরণ করেন।

২৬। গুরুদয়াল কলেজ, কিশোরগঞ্জ (১৯৪৬ সাল): ইটনা উপজেলার কাটৈর গ্রামে নিরক্ষর কৈবর্তরাজ গুরুদয়াল সরকার কলেজটির জন্য বহু অর্থ ব্যয় করেন। 

২৭। দেবেন্দ্র কলেজ, মানিকগঞ্জ (১৯৪২ সাল): তৎকালীন জমিদার সিদ্ধেশ্বরী প্রসাদ রায়চৌধুরী এবং কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকার কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরের ব্যবসায়ী রণদাপ্রসাদ সাহার পিতা দেবেন্দ্র সাহার নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

২৮। ঢাকা ইডেন মহিলা কলেজ (১৮৭৩ সাল): 'শুভসাধিনী' সভা নামক একটি সমাজসেবামূলক সংগঠন তৎকালীন ব্রাহ্মণ মেয়েদের জন্য কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সরকারী তথ্য অনুযায়ী ১৯৪২ সালে পূর্ববঙ্গে ১২৯০টি হাইস্কুল ছিল যার মধ্যে ৬৮টি মেয়েদের। ছিল ৪৭টি কলেজ। এর মধ্যে ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ বেসরকারী, সেগুলো হিন্দুদের অর্থানুকুল্যে তৈরি হয়।


সূত্র: লেখকের ফেসবুক পোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ