ইতিহাস বইয়ে হিন্দুবিদ্বেষী উপাদান গোপন প্রসঙ্গে - অতনু

ইতিহাস বইয়ে হিন্দুবিদ্বেষী উপাদান গোপন প্রসঙ্গে - অতনু


সতর্কীকরণ: এইসব ফালতু বই পড়বেন না। এরা প্রাচীন বাংলার আসল ইতিহাস গোপন করে।


সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের মালদা-উত্তর দিনাজপুর ঘুরে এসে একটি বিষয় উপলব্ধি করেছি, বাংলার আসল হারিয়ে যাওয়া গৌরবময় ইতিহাস এই অঞ্চলেই লুক্কায়িত রয়েছে। আর সেই সঙ্গে এটিও উপলব্ধি করেছি, প্রাচীন বাংলার এই 'ডার্ক' ইতিহাস গোপন রাখার জন্য পশ্চিমবঙ্গের সরকারী উপরমহল ও তথাকথিত ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে এক অশুভ আঁতাত রয়েছে। এনারা সত্য প্রকাশ করেন না, মিথ্যা ও অর্ধসত্য প্রচার করেন। নামের আগে অনেক বড় বড় ডিগ্রী নিয়ে "স্কলার" সেজে এমন মিথ্যা লিখবে, ধরে কার বাপের সাধ্যি! এই পোস্ট লেখা উচিৎ হবে কি হবে না, সেই দোটানায় বিগত বেশ কিছুদিন একটি মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, লিখব। এই ধরণের মেরুদন্ডহীন মানুষদের জন্য বাংলার ইতিহাস বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, সেটি তথ্যপ্রমান-সহ সাধারণ মানুষের সামনে অবশ্যই প্রকাশ করা উচিত। জানি, আজকের পোস্টের পরে আমার শত্রুসংখ্যা আরও কয়েকটা বাড়বে। তবে, এইসব খুচরো ঝামেলা নিয়ন্ত্রণে রাখবার মতো ক্ষমতা ও সামর্থ্য ভগবান আমাকে দিয়েছেন বলেই মনে করি। তো আসুন, একজন খ্যাতনামা ইতিহাস গবেষকের প্রাচীন বাংলার ইতিহাস নিয়ে গবেষণার নমুনা দেখে জীবন কৃতার্থ করি।


সম্প্রতি উত্তরবঙ্গের মালদা-উত্তর দিনাজপুর জেলার কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থান দেখতে গিয়েছিলাম। স্থানগুলি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানবার জন্য কয়েকটি নতুন লেখকদের বই কিনি। তারমধ্যে একটি বই হল ডঃ সমিত ঘোষের 'উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও পুরাকীর্তি'। কলকাতার অমর ভারতী প্রকাশনের ৪৯০ টাকা দামের ঝকঝকে বইটি যথেষ্ট দৃষ্টিনন্দন। বাড়িতে পড়ার সময় পাতা উল্টে বেশ সুখানুভূতিও হচ্ছিল। কিন্তু গোল বাঁধল যখন বইয়ে বর্ণিত সেই ঐতিহাসিক স্থানের সামনে সশরীরে গিয়ে দাঁড়ালাম। এ কি রে ভাই! এ কি দেখছি! এমন কিছু তো বইয়ে ছিল না! ৪৯০ টাকার দামী বইয়ের দামী লেখকের লেখা, সে তো ভুল হবার কথা নয়! ভালো করে চোখ রগড়ে নিয়ে দেখলাম, নাঃ ভুল তো দেখছি না। ঐ যে পান্ডুয়ার একলাখী সমাধিসৌধের প্রবেশপথের উপর কোনও হিন্দু দেবতার প্রতিকৃতি দেখা যাচ্ছে। দরজার দুপাশেও রয়েছে তেমনই কোনও হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির ভগ্ন নিদর্শন। আশ্চর্য! বইয়ে তো এগুলি নেই।


কৌতুহলী হয়ে এবারে নিজেই ঘুরে দেখতে লাগলাম সমাধিসৌধটি। খুঁজে পেলাম এমন অনেক উল্লেখযোগ্য বিষয় যা আমাদের লেখক মহাশয় সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। এবারে ভীষন রাগ হল নিজের উপরে। এমন একটি জায়গায় এমন এক লোকের বই পড়ে আমি এসেছি, যার কাছে কি না কোনও সঠিক তথ্যই নেই। রাগে গজগজ করতে করতে হোটেলে ফিরে এলাম। ব্যাগ থেকে বইটি বের করে ঝটপট পড়ে ফেললাম লেখক একলাখী মসজিদ সম্পর্কে এগজ্যাক্টলি কি লিখেছিলেন। বইয়ে তাঁর বর্ণনা ছিল হুবহু নিম্নরূপ:


"একলাখী সমাধি সৌধ: আদিনা মসজিদের প্রায় তিন কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সুলতান জালালউদ্দিন মহম্মদ শাহ কর্তৃক নিজ জীবদ্দশায় নির্মিত (১৪১৪-২৮ খ্রিঃ) ইটের তৈরি ৭৫ ফুট বর্গাকার এবং ২৭ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট পান্ডুয়ার একলাখী সমাধি সৌধটি অবস্থিত। ইটের তৈরি এই সমাধি সৌধটিতে টেরাকোটার অনবদ্য কারুকার্য সকলকে আকর্ষিত করবে। সৌধটির অভ্যন্তরে তিনটি কবর আছে। এগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন গবেষক, ঐতিহাসিকেরা ভিন্ন ভিন্ন মত পোষন করেছেন। তিনটি কবরের মধ্যে দীর্ঘতম কবরটি সম্ভবতঃ রাজা গণেশের ধর্মান্তরিত পুত্র জালাল উদ্দিনের। যার আগের নাম ছিল যদু। মাঝেরটি তার পত্নী আসমান তারার এবং তৃতীয় পুত্র আহমেদ শাহের।

প্রাক্-মুঘল যুগের বাংলার টেরাকোটা শিল্পের উৎকৃষ্ট নিদর্শন হল একলাখী সমাধি সৌধ। দেওয়ালগুলির বাইরের দিকে কোথাও কোথাও নানা বর্ণের মীনা করা ইটের কথা কোনও কোনও লেখক উল্লেখ করলেও আজ তার কোনো চিহ্ন নেই। কোনের বুরুজগুলি সুদৃশ্য অলংকরণে এক সময়ে মন্ডিত ছিল। তাদের শীর্ষে ছাদের সমান্তরালের উপরিভাগে একটি 'ক্যাপস্টোন' আছে। সৌধটির চতুর্দিকের দেওয়ালে চারটি কুলুঙ্গীর মতো ছোট প্রকোষ্ঠ আছে। এগুলি কোরান পাঠকারীদের জন্যই থাকত। পূর্ব দিকের তিনটি দরজার চৌকাঠ পাথরের তৈরি। 'লিনটেল' অংশটি খাঁজকাটা লৌহদন্ড দিয়ে তা বন্ধ করার রীতি ছিল। বর্গাকার ক্ষেত্রের এই সমাধি সৌধটির অন্তঃপ্রকোষ্ঠের চতুঃষ্কোণে চারটি বুরুজ আছে যা একটি অষ্টকোণী প্রকোষ্ঠ তৈরি করেছে। গৌড়ের চিকা মসজিদের সঙ্গে একলাখী সমাধি সৌধের বহু সাদৃশ্য রয়েছে। অনেকে অনুমান করেন, রাজা গণেশই এই সমাধি সৌধের নির্মাতা। এ নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে একথা বলাই যায় যে, একলাখী সমাধি সৌধের টেরাকোটার সমৃদ্ধ রূপ গৌড়-পান্ডুয়ার শ্রেষ্ঠ শিল্প নিদর্শন।"


ইতিহাস গবেষক ডঃ সমিত ঘোষ বর্ণিত একলাখী সমাধিসৌধের বর্ণনাটি পড়লেন, এবারে পোস্টের সঙ্গে দেওয়া একলাখী সমাধিসৌধের প্রবেশপথের ছবিটি দেখুন আর একবার নিজে ভাবুন, তাঁর বর্ণনায় কোথাও কি এই বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমাধিসৌধের প্রবেশপথের দুপাশে ও উপরে হিন্দু বা জৈন বা বৌদ্ধ মন্দির থেকে সংগৃহীত প্রস্তরখন্ড ব্যবহৃত হয়েছে? না, করেন নি। সেখানে প্রবেশ করতে গেলে এই অংশটি প্রথমেই চোখে পড়ে, যা আপনি অন্ধ হলেও দেখতে পারবেন, অথচ আমাদের লেখক মহাশয় এমনই অন্ধ, তিনি দেখতে পাননি। এছাড়াও এই সমাধিসৌধে আরও অনেক উল্লেখযোগ্য বিষয় রয়েছে, যেগুলি আমাদের লেখক মহাশয় সযত্নে এড়িয়ে গিয়েছেন। এখন তিনি সেটি কি কারণে করেছেন, তিনিই বলতে পারবেন। কিন্তু যে বইটিকে তিনি ইতিহাস বই বলে চালাচ্ছেন, সেই স্থানের বাস্তবতা কিন্তু দর্শককে অন্য কাহিনী শোনাচ্ছে। এই সমাধিসৌধে হিন্দু মন্দিরের অংশ কিভাবে এল সেই বিষয়ের গভীরে না গিয়েও লেখক যদি একটি লাইনেও উল্লেখ করতেন "... আমি এমনটি দেখিলাম" তবুও কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য হতো লেখাটি। কিন্তু এ যে একেবারে বাদ! সেই দেবদেবীদের ইতিহাস থেকেই বাদ দিয়েছেন আমাদের ইতিহাস গবেষক। যদি এটি তাঁর রচিত ভ্রমণকাহিনী হয়, তবে তিনি বিষয়টি নাই লিখতে পারেন। কিন্তু ইতিহাস বলে বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে যে বই, সেই বইয়ে কোন সত্য ইতিহাসটি প্রচার করা হচ্ছে?


ইতিহাস বইয়ে হিন্দুবিদ্বেষী উপাদান গোপন প্রসঙ্গে - অতনু

লেখককে বিশ্বাস করে বইটি কিনেছিলাম। কিন্তু সেই বিশ্বাসে জোরদার ধাক্কা লাগায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, ইতিহাস চর্চার নামে পশ্চিমবঙ্গে যাঁদের মান্যগণ্য ব্যক্তি হিসাবে সম্মানিত করা হয়, তাঁদের সকলে সেই সম্মানের উপযুক্ত নন। এনারা নিজেদের সুশীল ইমেজ রক্ষা করে ইতিহাস চর্চা করেন আর সেখানে অবলীলায় ছেঁটে ফেলা হয় প্রাচীন বাংলার আসল হিন্দু ইতিহাস। এনাদের অধিকাংশই বিতর্কিত জায়গায় যান না, আর গেলেও সেই স্থান সম্পর্কে অর্ধসত্য ইতিহাস প্রচার করেন। আরও আশ্চর্যের যে, পশ্চিমবঙ্গের মেইনস্ট্রীম ইতিহাস গবেষণায় এনাদের এইসব পক্ষপাতদুষ্ট বকওয়াস্ লেখালেখিই গ্রহণযোগ্যতা পায়। এক ভীতু আরেক ভীতুর পিঠ চাপড়ে দেয়। আসলে দীর্ঘদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গে এমনটাই হয়ে আসছে, তো যারা নতুন গবেষক, তারাও মনে করছেন এদের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পেতে হলে আমাকেও এমনটাই করতে হবে।


লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হয়েও যদি সত্যি বলার বা সত্যের পাশে দাঁড়ানোর সাহস না থাকে, সেই শিক্ষা বৃথা। তো যাইহোক মরুক গিয়ে তারা, এসব দেখা আমার বিষয় নয়। তাদের বিচারের জন্য ভগবান আছেন। না তো আমি গবেষক হতে চাই, না কোনও বই লিখতে। আমি একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে একটি ফালতু ইতিহাস বই কিনে নিজেকে প্রতারিত মনে করেছি, তাই এই রচনা লিখে ফেললাম, যাতে আর কোনও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু সাধারণ মানুষ এই ধরণের বুলশিট্ (ষাঁড়ের গোবর) বই কিনে প্রতারিত না হন। আর এই বইয়ের প্রকাশক কলকাতার অমর ভারতী প্রকাশনকে বলি, নিরপেক্ষ ইতিহাস চর্চাকে প্রাধান্য দিন। আপনাদের প্রকাশিত বইগুলি শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম, কিন্তু দুঃখিত, দৃষ্টিভঙ্গী বদলাতে বাধ্য হচ্ছি। আর ভগবানকে বলি, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ যে আমাকে তথাকথিত ইতিহাস গবেষক বানাওনি আর বই লিখে খেতে হবে, এমন পরিস্থিতিও করে দাওনি। নইলে হয়তো আমিও এই মেরুদন্ডহীনদের স্রোতে শ্যাওলার মতোই ভেসে যেতাম।


সূত্র: লেখকের ফেসবুক পোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ