'যজ্ঞ' সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা

'যজ্ঞ' সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা
 


যজ্ঞ, বৈদিক সনাতনের ধর্মের এক অভিন্ন অঙ্গ। মঙ্গল ও শুদ্ধতার প্রতিক স্বরূপ এর যজ্ঞ শুধু ভারত বর্ষে নয়। প্রাচীন অনেক সভ্যতায় প্রচলিত ছিল।


প্রথমত আমরা বেদাদী শাস্ত্র অনুযায়ী যজ্ঞ সম্পর্কে শাস্ত্রীয় মত দেখে নিব। 


“যজ্ঞ” শব্দটি ব্যাপক। ঋগ্বেদে এই শব্দ ৫৮০ বার, যজুবেদে ২৪৩ বার, সামবেদে ৬৩ বার এবং অর্থব বেদে ২৯৮ বার অর্থাৎ চার বেদে যজ্ঞ শব্দ মোট ১১৮৪ বার এসেছে। 


যজ্ঞ শব্দ ‘যজ্‌’ ধাতু দিয়ে তৈরি। ‘যজ্’ ধাতুর তিনটি অর্থ-‘যজ্ দেবপূজা সঙ্গতিকরণ দানেষু' অর্থাৎ 


  • ১। দেবপূজা 
  • ২। সঙ্গতিকরণ ও 
  • ৩। দান। 


সুতরাং যজ্ঞের বিভিন্ন প্রকার এইরূপ-দেবযজ্ঞ (অগ্নিহোত্র বা হবন), ব্রহ্মযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, বলিবৈশ্যদেবযজ্ঞ, অতিথিযজ্ঞ, অশ্বমেধযজ্ঞ ইত্যাদিতে যজ্ঞের প্রায় সমস্ত অর্থ নিহিত আছে।


যজ্ঞ শব্দের অর্থ খুবই ব্যাপক। সংস্কৃতের 'য়জ্' ধাতু থেকে 'যজ্ঞ' শব্দ উৎপন্ন হয়। এর অর্থ হলো 'সংকল্প'। অর্থাৎ যে কোন শুভকর্ম বা লোক কল্যাণকারী কর্মের উপর ব্রতী হওয়াকেই যজ্ঞ বলা যেতে পারে ।


কিন্তু এখানে অগ্নিহোত্র বা হবনের জন্যই যজ্ঞ শব্দের ব্যবহার করা হয়। এই স্থানে যজ্ঞের অর্থ হবে, প্রকৃতি-আবহাওয়া-পরিবেশকে রক্ষা করার জন্য সংকল্প গ্রহণ করে কার্যান্বিত করাই যজ্ঞ। কিছু অনাস্থাবাদী যজ্ঞকে অর্থহীন, অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক, স্বার্থাম্বেষী কর্মকাণ্ড ক্রিয়া মনে করে প্রচার করে থাকে। বৈদিক কর্মকাণ্ডের অন্তর্গত যজ্ঞের ঠিক ঠিক অভিপ্রায়কে না বোঝার জন্যেই বিভিন্ন মতবাদের জন্ম হয়েছে।


এইরকম নানাবিধ মত, পথ, সম্প্রদায়, গোষ্ঠি ও বর্গকে দেখে তৎকালীন বিদ্বান্ স্বামী শঙ্করাচার্য এদের প্রবল খণ্ডন করেছিলেন। যদ্যপি কিছু সম্প্রদায় সম্বন্ধিত লোক এই যজ্ঞের উপর চিন্তন, মনন, অধ্যয়ন করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে এর কারণ ছিল বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের অভাব, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে যজ্ঞের সামাজিকতা, আধ্যাত্নিকতা ইত্যাদির পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়। মীমাংসা সূত্রের মধ্যে নানাবিধ যজ্ঞের আলোচনা করে যজ্ঞকে নিত্যকর্মের মধ্যে সন্নিহিত করে বোঝানো হয়েছে।


যজ্ঞের বিভেদের মধ্যে অনেক প্রকারই উপস্থিত হয়। কিন্তু আর্য নর-নারীদের মধ্যে পঞ্চ-মহাযজ্ঞের বিধান মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী করে দিয়েছেন।


যেমন-


  • ১) ব্রহ্মযজ্ঞ
  • ২) দেবযজ্ঞ
  • ৩) পিতৃযজ্ঞ
  • ৪) বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞ
  • ৫) অতিথি যজ্ঞ।


এখানে কেবল দেবযজ্ঞের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। দেবযজ্ঞের অন্য নাম হলো অগ্নিহোত্র, হবন, যজ্ঞ ইত্যাদি। মহর্ষি স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী যে দেবযজ্ঞের প্রতিপাদন করেছেন তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই এখানে উদ্দেশ্য। কারণ হল- যে এখানে এই সব বিধি কেন চয়ন করা হচ্ছে? অন্য কোন বিধিকে কেন গ্রহণ করা হলো না?


মহর্ষি দয়ানন্দের অর্থ অনুসারে অর্থ হল- দেবপূজা, সংগতিকরণাদি কিন্তু প্রচলিত অর্থে হবন বা অগ্নিহোত্রকেই নেওয়া হয়েছে। ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্ত অনুসারে সৃষ্টি যজ্ঞে দিব্যপুরুষের প্রেরণায় দেবতাগণ হবি প্রযুক্ত যজ্ঞের প্রসার করেন, যার মধ্যে ঋতু অনুকুল সামগ্রীর প্রয়োগ দেখা যায়। যাজ্ঞিকের অনুসারে যজ্ঞের তিনটি আংশ- সংকল্প, মন্ত্র ও আহুতি।


কালাক্রমানুসারে উত্তর বৈদিক কালের পর ব্রাহ্মণ কালের সময়ে ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল যজ্ঞের বৈজ্ঞানিক ব্যখ্যা। তাই তখন দৈনিক পাক্ষিক, মাসিক, চাতুর্মাসিক, ষান্মাসিক এবং বার্ষিক যজ্ঞের আয়োজন করা হতো। বাসন্তি, আষাঢ়ী ছাড়াও দশেষ্টি ও পৌণমাসেষ্টির সময়েও বৃহৎ যজ্ঞের আয়োজন করা হতো।


এবারে যজ্ঞের মহত্বের উপর দৃষ্টিপাত করা হচ্ছে।


ভৌতিক যজ্ঞ এক রাসায়নিক ক্রিয়া। এই যজ্ঞের ফলে নানা রকম রাসায়নিক গ্যাস উৎপন্ন হয়। এই গ্যাসের মাধ্যমে সদ্ভাবনা সর্বত্রই ছড়িয়ে লোককল্যাণ সাধন হয়ে থাকে। তাছাড়া যজ্ঞের মাধ্যমেই সমস্ত জীবজগৎ ও প্রাণীজগতের কল্যাণ সাধন করা যায়। যজ্ঞ একপ্রকার সুষম বিতরণ প্রণালীর নাম। মানুষ বা জীব ও প্রাণী নিজ সামর্থ অনুসারে যজ্ঞের পরে উৎপন্ন সুগন্ধ, উপকারিতা গ্রহণ করতে পারে। এর মধ্যে কোনরকম বিদ্বেষপূর্ণ পক্ষপাত নেই।পক্ষপাতই হল সমস্তপ্রকার হিংসার মূল কারণ। একে দৈব প্রণালীও বলা যেতে পারে।যজ্ঞের মাধ্যমেই সমস্ত মানবের অর্থাৎ মানব মাত্রেরই কল্যাণ সম্ভব। তাই যজ্ঞ সার্বভৌম মানবের জন্য।


 শতপথ ব্রাহ্মণ ১.৭.১.৫ অনুযায়ী -


"যজ্ঞ বৈ শ্রেষ্ঠতমং কর্ম"

অর্থাৎ, যজ্ঞই শ্রেষ্ঠ কর্ম।


(c) শাস্ত্রপৃষ্ঠা

Post a Comment

0 Comments