জালিয়াতি নয়, নিখুঁত নকশায় নিঃস্ব কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠী

 

জালিয়াতি নয়, নিখুঁত নকশায় নিঃস্ব কলাপাড়ার রাখাইন জনগোষ্ঠী


দৈনিক জনকণ্ঠ, নিজস্ব সংবাদদাতা, কলাপাড়া, পটুয়াখালী , প্রকাশিত: ০০:২৮, ১০ জুন ২০২৫


 ১৯৯১ সালের আদম শুমারি কমিউনিটি সিরিজ পটুয়াখালী জেলার বইয়ের ৭৫ নম্বর পৃষ্ঠায় এখনও গ্রামটির নাম লেখা রয়েছে হুইচ্যানপাড়া (Huichan para) । যার ভিলেজ কোড নম্বর-২৪। তখনকার তথ্যমতে গ্রামটিতে মোট ১০৫টি পরিবারের বসবাস ছিল। লোকসংখ্যা ছিল ৬০০ জন।


একইভাবে ২০১১ সালের জনসংখ্যা ও আদমশুমারি, সম্প্রদায়ের প্রতিবেদন পটুয়াখালীর বইয়ে ১৮১ নং পৃষ্ঠায় কুয়াকাটার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে নাম (Huichan para ) হুইচ্যান পাড়া লেখা রয়েছে।


অথচ এখন গ্রামটির নাম এখন করা হয়েছে হোসেনপাড়া। কুয়াকাটা পৌরসভায় বর্তমানে এই গ্রামের অবস্থান। কবে, কারা, কীভাবে এমনটি করেছে তা জানা যায়নি। রাখাইনদের সৃজিত এই জনপদে তাদের পাড়ার মাদবরদের অর্থাৎ হেডম্যানদের নামানুসারে হয়েছে গ্রাম কিংবা এলাকার নামকরণ।


কিন্তু এক শ্রেণীর ভূমিদস্যুরা গভীর চক্রান্ত করে সাগরপারের এই জনপদের সঠিক ইতিহাস বিকৃত করে দিয়েছে। এই প্রক্রিয়া এখনও অব্যাহত রয়েছে। এই গ্রামটির পূর্বদিকের গ্রামটির নাম এখনও মম্বিপাড়া রয়েছে।


এটিও রাখাইনদের নাম অনুসারে। এই গ্রামের নাম পাল্টে দেয়া না হলেও রাখাইন পাড়ার দেবোত্তর সম্পত্তি জালিয়াতির মাধ্যমে দলিল করে নেয়া হয়েছে। কলাপাড়া পৌরসভার নাচনা পাড়াকে কয়েকটি গ্রামে নামকরণ করা হয়েছে।


কলাপাড়ায় রাখাইনদের এভাবেই শুধু বঞ্চনা দূর হয়। নানাভাবে প্রতারিত করা হয়েছে। চর ধুলাসার গ্রামে এখনও রাখাইনদের সমাধিস্থল এবং শ্মশান দৃশ্যমান। কীভাবে শ্মশান কিংবা পাড়ার সম্পত্তির মালিকানা বদলে গেল তা উদ্‌ঘাটন করা খুব কঠিন কাজ।


তবে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে জানা গেছে ভূমি অফিসের এক শ্রেণীর কর্মীদের যোগসাজশে লুজ খতিয়ান খুলে এসব জমির মালিকানা পাল্টে দেওয়া হয়েছে। লতাচাপলী ইউনিয়নের কালাচান পাড়ার রাখাইনদের সবচেয়ে বড় শ্মশান রয়েছে। ওই শ্মশানের চারদিকে দখল করে তোলা হয়েছে বাড়ি-ঘরসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। এমনকি শ্মশান ঘেঁষে ল্যাট্রিন করা হয়েছে।


রাখাইনদের কেউ প্রয়াত হলে যথাযথ মর্যাদায় সৎকার পর্যন্ত করা যায় না। বর্তমানে রাখাই নদের এসব স্পর্শকাতর বেদনার কথা কেউ শোনারও নেই। এসব নিয়ে বহুবার দেন দরবার করে এরা এখন কাহিল।


জালিয়াতির কয়েকটি নমুনা ।


লতাচাপলী মৌজার এস এ ২৬১ নং খতিয়ানের ৫৪১৯ দাগের জমি ভূমি অফিসের মূল রেকর্ড বইতে এখনও দেবালয় লেখা রয়েছে, বৌদ্ধবিহার। এস এ ৫৪১৮ নং দাগে লেখা রয়েছে, ইন্দিরা (কুয়া)। অর্থাৎ খাবার ও ব্যবহারের পানির জন্য পাড়ার রাখাইনরা কুয়া খনন করেছিল।


এখানে মোট ২৫ শতক জমি রয়েছে। মূল মালিক ছিলেন ক্রাউনসে মগসহ অন্যান্যরা। কিন্তু জালিয়াতচক্র বৌদ্ধবিহার ও ইন্দিরার ওই জমিসহ সব রেকর্ড সংশোধন করে দেয়। ১৯৭৫ সালের ১৪ অক্টোবর এই কমিটি করা হয়েছে। বয়োবৃদ্ধ রাখাইনদের ভাষ্যমতে ক্রাউনসে মগ ১৯৪৮ সালে দেশ ছাড়েন। তারপরও কীভাবে ৭৫ সালে তার নামের রেকর্ডিং জমি ভিন জাতির নামে চলে গেছে এমন প্রশ্ন রাখাইনদের।


লতাচাপলী মৌজার ১৩-কে/১৯৭৮-১৯৭৯ নম্বর মিস কেসের মাধ্যমে এস এ ৫৮৫৩, ৫৮৫৪/৫৯৪৪ এবং ৫৯৪৪ নম্বর দাগের ছয় একর ১৭ শতক জমি রাখাইন লুফ্রুমে কে মালিক দেখানো হয়েছে। দিয়ারা আমখোলা পাড়ায় এই জমির অবস্থান।


১১৭৭ নম্বর লুজ খতিয়ানের মাধ্যমে দাগ নম্বর ৮৪৮৬ থেকে দুই একর ৫৫ শতক, ৮৪৯০ থেকে চার একর ৪৭ শতক, ৭৬৫৪ থেকে ৩৬ শতক, ৭৬৫৮ থেকে ২৫ শতক, ৮৪৮৫ থেকে ৪০ শতক, ৮৪৯১ থেকে ১৯ শতক, ৮৪৯৩ থেকে ৪৪ শতক, ৭৬৫৫ থেকে চার একর ১৩ শতক, ৭৬৫৭ থেকে ৭৩ শতক, ৮৪৮৭ থেকে ২৭ শতক,


৮৪৮৮ থেকে ছয় শতক, ৭৬৫৬ থেকে ৩৯ শতক, মোট ১৪ একর ৩৯ শতক জমি হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। যার মিস কেস নং-২৬১-কে/১৯৭৪-১৯৭৫ এর মাধ্যমে মালিকানা দাবিদার রয়েছে হাজী আব্দুল গফুর। যার পিতার নাম হাজী চান গাজি। বাড়ি গলাচিপার টুঙ্গিবাড়িয়া গ্রামে।


এমনিভাবেই ৭৭ একর পাঁচ শতক খাস জমির মালিকানা বনে গেছেন কয়েকটি চক্র। মহিপুর ভূমি অফিস ২০০৬ সালের ৬জুন এসব খতিয়ান ভাক্ত উল্লেখ করে বাতিলের সুপারিশ করেছে। বর্তমানে এসব রেকর্ডপত্র নষ্ট করা হয়েছে বলেও শঙ্কা করছেন অনেকে।


কলাপাড়া ভূমি অফিসের বইতে ৬৩৬৩ নম্বর দাগের জমি এখনও রাখাইনপাড়া ও বাড়ি লেখা রয়েছে। অথচ এই জমিও ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে দখল করে নেয়া হয়েছে। অথচ নিয়ম অনুসারে এসব জমি কখনও হস্তান্তর হওয়ার কথা নয়। ভূমি অফিসের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ চক্র নির্দিষ্ট দালালের মাধ্যমে অন্য খতিয়ানের কেস রেফারেন্স দেখিয়ে মালিক সাজানে হয়েছে।


এমনকি অন্য এলাকার দলিল নম্বর দিয়ে পর্যটন এলাকার জমি পর্যন্ত হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এস এ ১০২৩ নম্বর খতিয়ান খুলে কুয়াকাটার চার একর ৮৫ শতক জমি হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সুইচাপাড়ায় এই জমির অবস্থান। যা পাড়ার মগগণের পক্ষে সুইথয় মগের নামে রেকর্ড সংরক্ষণ করা রয়েছে।


অথচ মিস কেস নং ৬২-কে/১৯৯৬-১৯৯৭ এর মাধ্যমে ১৯৬৫ সালের ২০ আগস্টের সম্পাদিত ১১৮৪ নম্বর দলিলের মাধ্যমে এই জমির মালিকানা পাল্টে নেয়া হয়েছে। অথচ ওই দলিলের বর্ণিত জমির অবস্থান কুয়াকাটা থেকে আট কিলোমিটার দুরে, বিভিন্ন গ্রামে।  


এই জমি থেকে আবার ৬২ কে- (p-2) নামজারি কেসের মাধ্যমে ১৯৯৬-১৯৯৭ সনে মোট জমি থেকে তিন একর তেত্রিশ শতক জমি এএম রফিকউল্লাহসহ অন্যান্যের নামে রেকর্ড সংশোধন করা হয়েছে।


তুলাতলী রাখাইন পল্লির বাসিন্দা মায়া রাখাইন নারী বলেন, 


তাদের জমিজমা এক ভূমিদস্যু জবরদখল করে নিয়ে গেছে বিগত সরকারের সময়। তাদের মারধর করা হয়েছে। মামলা করা হয়েছে। রুবেল সিকদার নামের ওই ব্যক্তিকে আসামি করে থানায় মামলা করেছেন। আজ পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাননি।


এমন জালিয়াতির অসংখ্য ঘটনা রয়েছে সাগরপারের এই জনপদে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক দিয়ারামখোলার বাসিন্দা রাখাইন মংম্যা জানান, ১৭৮৪ সাল থেকে বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলা থেকে রাখাইন অধ্যুষিত ২২০টি পাড়া বা গ্রাম ছিল।


তাদের হিসাব অনুসারে পটুয়াখালীতে মোট রাখাইনপাড়া ছিল ১২৭টি এবং বরগুনায় ছিল ৯৩টি। যার মধ্যে পটুয়াখালীতে রয়েছে মাত্র ৩৩টি, আর বরগুনায় রয়েছে ১৪টি। পটুয়াখালী জেলায় যে-সব রাখাইনপাড়া রয়েছে তার অধিকাংশ কলাপাড়া উপজেলায়, ২৮টি। দুই/তিনটি গলাচিপা উপজেলায়।


বর্তমানে কলাপাড়ায় রাখাইন পরিবারের সংখ্যা ৩০৬টি। এসব পাড়ার শত শত একর জমি কাদের দখলে রয়েছে প্রশ্ন করে তা উদ্ধারে সরকারের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন বলে মংম্যা’র দাবি। 


কলাপাড়ায় পর্যটন এলাকার অলংকার রাখাইন জনগোষ্ঠী এভাবে নানা বঞ্চনায় নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। সাগরপারের আদিবাসী এই সম্প্রদায়ের দাবি তাদের পাড়াগুলো রক্ষার্থে এখনই সরকারিভাবে প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি এও বলেন, সবশেষ বিএস জরিপে আবার বিভিন্ন পাড়ার দেবোত্তর জমি অন্যের নামে কিংবা খাস করা হয়েছে।


তিনি উল্লেখ করেই বলেন, 


সোনাপাড়ার দুই একর এবং নয়াপাড়া রাখাইন পল্লির জমি খাস করা হয়েছে।


ম্যা জানান, 


বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাস বাংলাদেশের সহায়তায় ২০০৭ সাল থেকে বরগুনা পটুয়াখালীতে রাখাইনদের দখল হওয়া কয়েক শ’ একর জমি উদ্ধার করা হয়েছে।


কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, 


রাখাইনদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারিভাবে বেশ কিছু পরিকল্পনা সরকারিভাবে নেওয়া হয়েছে। তাদের বিহার ও মঠ সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানান এই কর্মকর্তা।


হ্যাপী


সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ

Post a Comment

0 Comments