ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বাদশা জাহাঙ্গীরের হিন্দুবিদ্বেষ - সুষুপ্ত পাঠক

ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে বাদশা জাহাঙ্গীরের হিন্দুবিদ্বেষ - সুষুপ্ত পাঠক

ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ পড়লাম। এই কাব্যের যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য ও মানসিংহের মধ্যে যুদ্ধ এবং যুদ্ধ শেষে মানসিংহের দিল্লি ফিরে সম্রাট জাহাঙ্গিরের সঙ্গে সাক্ষাত্কার পর্ব নিয়ে কৌতুহলী পাঠকের জন্য কিছু আলোচনা করব। প্রথমে বলি অন্নদামঙ্গল আমার কাছে সুপাঠ্য লেগেছে। ভারতচন্দ্র তার এই কাব্যে বাংলা আরবী ফারসি সংস্কৃত ভাষার চমত্কার মিশেল করেছেন। ভাষা নিয়ে সেই যুগের একজন কবির কোন শুচিবাই ছিলো না ভেবে আনন্দ লাগে।


মানসিংহ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আদেশে বাংলা দেশ আক্রমণ করতে বর্দ্ধমান থেকে যশোর আসতে গিয়ে প্রবল ঝড় ও শিলা বৃষ্টির আক্রমনে পড়েন। তার ঘোড়া হাতি বাহিনীর বহু সৈন্য মারা যায়। বাকীদের না খেয়ে মরার অবস্থা। সেই অবস্থায় ব্রাহ্মণ মজুন্দার এগিয়ে এসে মানসিংহ ও তার বাহিনীকে আশ্রয় ও খাবার দিয়ে রক্ষা করেন। কৃতজ্ঞ মানসিংহ কথা দেন যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যকে হারিয়ে তাকে যশোরের শাসনকর্তা বানাবেন দিল্লি শাহের কৃপায়। কথামত মজুন্দারকে সঙ্গে নিয়ে মানসিংহ যশোর আক্রমণ করেন এবং প্রতাপাদ্যিত্যকে পরাজিত করেন। প্রতাপাদিত্য ছিলেন বারো ভূঁইয়াদের সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদশালী রাজা। একই সঙ্গে অত্যাচারী নিষ্ঠুর। তাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস আছে “বউ-ঠাকুরানীর হাট”। সেখানে রবীন্দ্রনাথ মুখবন্ধে লিখেছেন স্বদেশী আমলে প্রতাপাদ্যের দেবতা জ্ঞানে পুজার সূচনার আগে তিনি যত তথ্য ইতিহাস সংগ্রহ করেছিলেন সেখানে তাকে অত্যাচারি ও নিষ্ঠুর বলেই জেনেছেন। প্রতাপাদ্যিত বিদেশী মুঘলদের শাসনকে মেনে নেয়নি সেকথা ঠিক। কিন্তু এটা ছিলো অসম প্রতিযোগীতা মুঘলদের সঙ্গে। প্রতাপাদিত্যের অহংকারই এই মেনে না নেওয়ার বাস্তবতা। কাজেই এই লেখায় সেকালের হিন্দু মুসলমানের সামাজিক সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গি দেখানো প্রাসঙ্গিক। হিন্দু রাজা বা মুসলিম সম্রাটের সাম্প্রদায়িক পক্ষ টেনে কাউকে বিচার করা নয়।


প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করা ছিলো মানসিংহের জন্য বড় রকমের সাফল্য। এমনকি সেটি ছিলো বাদশাহ জাহাঙ্গিরের জন্যও বড় সাফল্য। অথচ দেখুন আমাদের ইতিহাস রাজা প্রতাপাদিত্যর পরাজয়কে ‘বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত’ বলেনি! কেন? মুঘলরা মুসলমান ছিলো বলে? না হলে নবাব সিরাজদৌলার পরাজয়কে কেন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত বলা হয়?

মজুন্দারের পুরস্কার দিল্লির বাদশাহ কি দিলেন এবার দেখা যাক। পরাজিত প্রতাপাদিত্যকে ধরে বেঁধে মানসিংহ দিল্লির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন বাদশাহকে ভেট দিবেন বলে। দিল্লি যেতে যেতে পথে যত মন্দির আর তীর্থ পড়ল, পুরী, কাশি মথুরী সব স্থানে ঘুরে ঘুরে মানসিংহ আর মজুন্দার পুজা দিতে দিতে এগুতে লাগলেন। এদিকে অনাহারে প্রতাপাদিত্য মারা গেলেন পথে। পঁচা লাশ নিয়ে কি করে দিল্লি পর্যন্ত যাবেন? তাই ঘিয়ে ভেজে নিলেন প্রতাপাদিত্যকে! সেই লাশ দিল্লি বাদশাহর নিকট উপস্থিত করলেন। খুশিতে আত্মহারা বাদশাহ বলেন, কি পুরস্কার চাও মানসিংহ এখুনি বলো। যা চাইবে সব দিয়ে দিবো। মানসিংহ বলেন, জাঁহাপনা, এই ব্রাহ্মণ আমাকে ও আমার বাহিনীকে নিশ্চিত মৃত্যু হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন অন্নপূর্ণার কৃপায়। তার পুজা করে সে যাত্রা রক্ষা পাই ঝড় বৃষ্টি থেকে। তখন কখা দিয়েছিলাম যশোর তাকে দিবো শাসন করতে…।


জাঁহাঙ্গির বিস্মিত ক্ষুব্ধ মানসিংহের প্রস্তাবে! বলে কি এ পাগল? কাফেরকে রাজ্য দিবো? ভারতচন্দ্রে লিখেছেন এভাবে-


পাতশা কহেন শুন মানসিংহ রায়।

গজব করিলা তুমি আজব কথায়।।

লস্করে দু’তিন লাখ আদমী তোমার।

হাতী ঘোড়া উট গাধা খচর যে আর।।

এ সকলে ঝড় বৃষ্টি হৈতে বাঁচাইয়া।

বামণ খোরাক দিল অন্নদা পূজিয়া।।

সয়তান দিল দাগা ভূতেরে পূজায়।

আল চাউল বেঁড়ে কলা ভুলাইয়া খায়।।

আমারে মালুম খুব হিন্দুর ধরম।

কহি যদি হিন্দুপতি পাইবে সরম।।

সয়তানে বাজি দিল না পেয়ে কোরাণ।

ঝুট মুট পড়ি মরে আগম পুরাণ।।

গোসাঁই মর্দ্দের মুখে হাত বুলাইয়া।

আপনার নূর দিলা দাড়ি গোঁফ দিয়া।।

হেন দাড়ি বামণ মুড়ায় কি বিচারে।

কি বুঝিয়া দাড়ি গোঁফ সাঁই দিল তারে।।

আর দেখ পাঁঠা পাঁঠী না করে জবাই।

উভ চোটে কেটে বলে খাইল গোঁসাই।।

(অন্নদামঙ্গলঃ পাতশাহের দেবতা নিন্দা)


‘পাতশাহ’ মানে বাদশাহ। সেই বাদশাহ শুরুতেই মানসিংহকে অবিশ্বাসই করে ফেলল কারণ তার দুই লাখ সৈন্যকে এই বামুন কি করে খাওয়ালো? বাদশাহকে হিন্দু ধর্ম শেখাতে আসছ মানসিংহ? অন্নপূর্ণার পুজা হচ্ছে শয়তানের পক্ষ থেকে ভূতের পুজা। এই বামুনগুলি সু্‌ন্নতি নূরে যে দাড়িগোফ তা চেঁছে ফেলে অবিচার করছে। পুরো কবিতা তুলে দেয়া এই রচনায় সম্ভব নয়। বাহশাহ হিন্দুদের ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে আরো কটুক্তি করতে থাকেন। তারা গাছের গায়ে সিঁদুর দিয়ে পুজা করে। পাঁঠা নাপাক করে জবাই করে খায়। আর এসব তারা করছে কারণ তারা তো কুরআন পায়নি। শয়তান ধোঁকা দিয়ে তাদের কুরআন বঞ্চিত করেছে। ভারতচন্দ্রে ভাষায়-


“সয়তানে বাজী দিল না পেয়ে কোরাণ।

ঝুটমুট পড়ি মরে আগম পুরাণ।।“

শেষে জাহাঙ্গির অভিপ্রায় জানান এভাবে-

“দেহ জ্বলি যায় মোর বামণ দেখিয়া।

বামনরে রাজ্য দিতে বল কি বুঝিয়া?…

আমার বাসনা হয় যত হিন্দু পাই।

সুন্নত দেওয়াই আর কলমা পড়াই।“


মজুন্দার নিজ ধর্মকে এভাবে কটুক্তি হতে দেখে পাল্টা জবাব শুরু করেন। যুক্তি দিয়ে বুঝান এগুলো যদি অধর্ম হয় তাহলে বাদশাহর ধর্মের নিয়মগুলোও অধর্ম। একের পর এক যুক্তিতে না পেরে উঠে বাদশাহ মজুন্দারকে বন্দি করার হুকুম দেন। রাজ্য লাভের পুরস্কার মজুন্দার এভাবেই পরিসমাপ্ত ঘটে। কাব্যের পরের দিকে দেবী অন্নপূর্ণা বাদশাহকে শাস্তিতে দিতে দিল্লিতে মরক লাগান এবং পরিশেষে বাদশা তার ভুল বুঝতে পেরে মজুন্দারের কাছে ভুল স্বীকার করে নেন। প্রতিষ্ঠিত হয় সব ঈশ্বরই আসলে একই। হিন্দুর যাহা মুসলমানের তাহা। যে কথা মজুন্দার শুরুতে বাহশাহকে বলেছিলেন। মহাকাব্যের যুগে এভাবেই দেবী দেবতারা নিজেদের প্রমাণ করতে ধরনিতে এনে আসতেন। সেসব বাদ দিলে এইসব মহাকাব্যে সমকালীন সামাজিক অবস্থার কিছু চিত্র পাওয়া যায় সেটাই বর্তমানকালের লাভ। যেমন ওডিসি ও ইলিয়াড থেকে প্রাচীন গ্রীক সমাজকে দেখা যায়। দেবী দেবীদের গল্প কল্পনা হলেও ট্রয় নগরিকে কেন্দ্র করে সে যুগকে আমরা খানিকটা দেখতে পাই। যেমন মহাভারত থেকে প্রাচীন ভারতের সমাজ ব্যবস্থা কিছু বুঝা যায়। অন্নদামঙ্গল কিংবা মনসামঙ্গল থেকেও সেকালের বাংলাকে খানিকটা দেখা যায়। কথিত অসাম্প্রদায়িকতার চিত্রও কেমন ফ্যাকাসে হয়ে উঠে…।



সূত্র: ফেসবুক 

Post a Comment

0 Comments