ফেসবুকের ‘ভুয়া খবরেই’ দেশের সব সাম্প্রদায়িক হামলা

বাংলাদেশে দুর্গাপ্রতিমা ধ্বংস


আমানুর রহমান রনি, ২৩ অক্টোবর ২০২১, ২৩:৩০


দেশে গত দশকে যত সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে তার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়িয়েছে নানা প্রকারের গুজব। একটি চক্র ভুয়া খবর ও ষড়যন্ত্রমূলক পোস্ট ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতেই সংখ্যালঘুদের ওপর একই ছকে হামলা হয়। প্রতিবারই এসব ঘটনা মোকাবিলায় হিমশিম খায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।


গত এক দশকে গুজব ছড়ানোতে বেশি ‘অবদান’ ছিল ফেসবুকের। এর গতি এত তীব্র ছিল যে সেটা দমানোর মতো প্রযুক্তি আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছেও নেই। গুজবের পাশাপাশি একটি মহল থেকে আবার বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে উসকানিও চালানো হয় সমানতালে। বেশ কয়েকটি ঘটনা পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে।


নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি চক্রের উদ্দেশ্যই হলো দেশকে অস্থিতিশীল করা। তারাই এসব গুজবের হোতা।

 

ভোলায় আইডি হ্যাক করে গুজব


ভোলার বোরহানউদ্দিনে ২০১৯ সালের ২০ অক্টোবর হিন্দুদের একটি এলাকায় সংঘবদ্ধ হামলা চালিয়ে মন্দির, বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর করা হয়। অভিযোগ করা হয়, বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য নামের এক তরুণ তার ফেসবুকের মেসেঞ্জারে মহানবীকে (সা.) নিয়ে অবমাননাকর বক্তব্য ছড়িয়েছে। সেই মেসেঞ্জার-বার্তার স্ক্রিনশট ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এরপর চালানো হয় হামলা। পুলিশ ও জনতার সংঘর্ষে নিহত হয় পাঁচজন। আহত হন অনেকেই। হিন্দুদের অসংখ্য বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়।


অথচ হামলার দুদিন আগে ১৮ অক্টোবর নিজের ফেসবুক আইডি হ্যাক হয়েছে বলে বোরহানউদ্দিন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলেন বিপ্লব চন্দ্র। পুলিশ বিপ্লবের অ্যাকাউন্ট হ্যাকের প্রমাণও পায় এবং দুজনকে গ্রেফতার করে।


ভুয়া আইডির কারণে হামলা


২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রসরাজ দাস নামের এক দরিদ্র জেলের নামে একটি আইডি খুলে ফেসবুকে ইসলাম নিয়ে অবমাননাকর পোস্ট দেওয়ার খবর ছড়িয়ে জেলার নাসিরনগরের হরিপুরে হামলা করা হয়। রসরাজকে মারধর করে পুলিশেও দেওয়া হয়। পরে জানা গেলো, ফেসবুক কী, সেটাই জানেন না অক্ষরজ্ঞানহীন রসরাজ। তার নামে থাকা আইডিও ভুয়া। এমনকি ফরেনসিক রিপোর্টেও পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে রসরাজের মোবাইল থেকে ফেসবুকে কোনও স্ট্যাটাসও দেওয়া হয়নি। এটা জানার আগেই তছনছ হয়ে যায় নাসিরনগরের হিন্দুদের ৫টি মন্দির ও কয়েক শ’ বাড়ি। নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয়। বেশিরভাগ মামলার তদন্ত এখনও চলছে।


বৌদ্ধ তরুণের নামে গুজব ছড়িয়ে রামুতে হামলা


বৌদ্ধদের অসংখ্য বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে
বৌদ্ধপল্লীর ১৯টি বৌদ্ধমন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল


উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ তরুণ ফেসবুকে ইসলাম অবমাননাকর কন্টেন্ট আপলোড করেছে—এমন অভিযোগ করে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর একদল দুষ্কৃতকারী সংঘবদ্ধ হয়ে কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালায়। তবে আজও উত্তম বড়ুয়া নামে সেখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ, এ নিয়ে স্থানীয়রা রীতিমতো সমাবেশ করে হামলা চালিয়েছিল।


ওই হামলায় বৌদ্ধপল্লীর ১৯টি বৌদ্ধমন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এ ছাড়াও বৌদ্ধদের অসংখ্য বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল। সরকারের পক্ষ থেকে পরে মন্দির ও মূর্তি নির্মাণ করে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়। এরমধ্যে একটি মামলা প্রত্যাহার হয়। তবে কোনওটির বিচার শেষ হয়নি।


ফেসবুকের কথিত পোস্ট নিয়ে রংপুরে হামলা


রংপুরের জেলে পল্লীর বাড়িঘরে মুসলিমদের আগুন
রংপুরের জেলে পল্লীর বাড়িঘরে মুসলিমদের আগুন

ফেসবুকের কথিত স্ট্যাটাসের সূত্র ধরে ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের গঙ্গাচড়ায় হিন্দু এলাকায় হামলা চালায় সংঘবদ্ধ মুসলিম সম্প্রদায়। নারায়ণগঞ্জে থাকা টিটু রায় নামে এক ব্যক্তির ফেসবুকের আইডি থেকে অবমাননাকর পোস্ট করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়। যার জেরে মিছিল নিয়ে হিন্দুদের বাড়িতে হামলা করা হয়।


সর্বশেষ কুমিল্লা


গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়াদিঘির পাড় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন রাখাকে কেন্দ্র করে দেশের রংপুর, চাঁদপুর, সিলেট, কিশোরগঞ্জসহ বেশকয়েকটি জেলার হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে নিহত হয় পাঁচজন। মামলা হয়েছে অন্তত ৭২টি। এখন পর্যন্ত গ্রেফতার পাঁচ শতাধিক।


কুমিল্লা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, ইকবাল নামের এক তরুণ একটি মাজারের মসজিদ থেকে কোরআন নিয়ে মণ্ডপের মূর্তির পায়ের কাছে রেখে আসে। পরের দিন ওরাই আবার ফেসবুকে লাইভ করে সবাইকে উত্তেজিত করে। এরপর সারাদেশে উত্তেজনা ও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।

 

কেন এসব ঘটানো হচ্ছে?


বাংলাদেশে গত একযুগে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, দুই-এক বছর পরপরই এমন গুজব বা ষড়যন্ত্রমূলক হামলার ঘটনা ঘটেছে। ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কেন এসব ঘটানো হয় জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ বলেন, ‘একটি চক্র পরিকল্পনা করে এই অস্থিরতা সৃষ্টি করে। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে কোনও কিছু ছড়ালে তাতে মানুষ দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাতে শুরু করে। অনেক মানুষ সম্পৃক্ত হয়। এই অস্থিরতার মধ্যে একটি গোষ্ঠী ফায়দা নিতে চায়। তারা এটা পরিকল্পনা করেই করে।’


এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক আরও বলেন, 

‘মানুষের মধ্যে ফেসবুক ব্যবহারের সংখ্যা বাড়ছে। ষড়যন্ত্রকারীদের বানানো তথ্য দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে সবার কাছে। এমনভাবে তারা খবর বানায় যা সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করে। যাচাই করতেও যায় না।’


সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কারও ব্যক্তিগত পোস্ট বা অখ্যাত কোনও ওয়েবসাইটের খবরকে বিশেষ প্রাধান্য না দেওয়ার কথাই বলেছেন আব্দুর রশীদ।


তিনি বলেন, 

‘জনগণকে সচেতন হতে হবে। ফেসবুকে যা আসবে সব তো সত্য নয়। মূলধারার গণমাধ্যম ছাড়া অন্য যেকোনও মাধ্যমের তথ্য বিশ্বাস করার আগে তা যাচাই করে নিতে হবে।’


দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল


সাম্প্রদায়িক হামলায় যে মামলাগুলো হচ্ছে সেগুলোর বিচার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, 

‘পুলিশ প্রতিবেদন পাওয়ার পরই বিচার শুরু হবে। এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজ তুলে ধরা হবে। চার্জশিট দেওয়া হলেই সেটা দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে দেওয়া হবে।’


/এফএ/


সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ