দখলে নিশ্চিহ্ন ৩০০ বছরের বৌদ্ধ বিহার, জমি উদ্ধারের দাবি

দখলে নিশ্চিহ্ন ৩০০ বছরের বৌদ্ধ বিহার, জমি উদ্ধারের দাবি

৩১ দখলদারের দখলে থাকা ১১ একর জায়গায় এখন আর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ থাকেন না। গ্রামের নামও পরিবর্তন হয়েছে।


দখলে নিশ্চিহ্ন ৩০০ বছরের বৌদ্ধ বিহার, জমি উদ্ধারের দাবি


টেকনাফ প্রতিনিধি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, Published : 14 Nov 2024, 07:13 PM

 

কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের হ্নীলা ইউনিয়নের দরগা পাড়া এলাকা হয়ে একটি রাস্তা চলে গেছে পশ্চিম দিকে। এই সড়ক দিয়ে অনুমানিক আড়াই থেকে তিন কিলোমিটার ভেতরে জরাজীর্ণ এলাকার এক সময় নাম ছিল ‘ক্যাংপাড়া’। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস ঘিরে যেখানে এক সময় ঐতিহ্যবাহী বড় ক্যাং বা বৌদ্ধ বিহার ছিল।


কিন্তু এটা এখন কেবল কালের সাক্ষী। এখানে ৩০০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী বিহারটির এখন কোনো চিহ্নই নেই। গত ১৪ বছরে দখলদারদের থাবায় এটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। বিহারটি ঘিরে বৌদ্ধ পল্লীটি নেই।


সময়ের সঙ্গে বদলে গেছে গ্রামের নামটিও। এটা এখন হ্নীলার ‘উত্তর পাড়া’ হিসেবে পরিচিত। বিহারের ১৩ একর জায়গার মধ্যে কোনোমতে বিহারটির দুটি মূর্তি ঘিরে দুই একর পাহাড়ি জায়গা অবশিষ্ট রয়েছে। বেদখল হওয়া অপর ১১ একর জায়গায় দখলদাররা ঘর, ভাড়া বাসা ও খামারসহ অন্যান্য কিছু করে দখল করে নিয়েছে। বিহারের কাজে এক সময় ব্যবহৃত পুকুরটিও এখন অন্যের দখলে। যেখানে চলছে মাছ চাষও। ৩১ দখলদারের দখলে থাকা ১১ একর জায়গায় এখন আর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ থাকেন না।


এমনটাই বলছিলেন ওই এলাকার প্রবীণ ব্যক্তি রফিকুল ইসলাম। ২০ বছর আগে তিনি ছিলেন বিহারটির একজন পাহারাদার। বৌদ্ধ ভান্তের নানা কাজে সহায়তা করতেন তিনি।


রফিকুল ইসলাম বলেন, এক সময় এই বিহারটিতে পুরোনো সভ্যতার নিদর্শন ও ১৯টি বুদ্ধ মূর্তি ছিল। এখন একটি ছোট্ট টিন ঘরে দুটি বুদ্ধ মূর্তির অংশ বিশেষ রয়েছে। গত ১৪-১৫ বছরে ক্রমাগত বিহারটি অস্তিত্ব হারিয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মের মানুষরাও একে একে চলে গেছে পাঁচ কিলোমিটার দূরে চৌধুরী পাড়ায়। ওখানে তৈরি হয়েছে আলাদা আরেকটি বৌদ্ধ বিহারও।


বৃহস্পতিবার ওই ঐতিহ্যবাহী বড় ক্যাং বা বিহারটি পরিদর্শন করেন বিশিষ্টজনদের একটি প্রতিনিধিদল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দীপায়ান খীসার নেতৃত্বে ১০ সদস্য পরিদর্শনকালে বিহারটির জায়গা দ্রুত উদ্ধার করে বিহার পুনর্নিমাণের দাবি জানান।


এ সময় অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, “১৪ বছরের পাঁচবার বিহারটি পরিদর্শনে এসেছি। সর্বশেষ পাঁচ বছর আগেও এসে দেখে গেছি। পাঁচ বছর আগে যা ছিল তাও নেই। এটি রক্ষার জন্য নানা উদ্যোগ, নানা পদক্ষেপ ১৪ বছর ধরে করা হচ্ছে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না।”


বিহার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বিহারটির পুরোহিত উপিঞ ওয়াংশ মহাথেরো ২০০১ সালে উখিয়া-টেকনাফ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (প্রয়াত) মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে একটি নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তি করেন। যে চুক্তিতে বিহারের দুই একর জমিতে গাছ রোপণ করে লাভের অংশ ভাগ করার কথা রয়েছে। একইভাবে ২০০৯ সালে বিহারের পুরোহিত উ কুশল্যা মহাথেরোর সঙ্গেও মোহাম্মদ আলী বিহারের অন্যান্য জমিতে গাছ রোপণের জন্য আরও একটি চুক্তি করেন।


দখলে নিশ্চিহ্ন ৩০০ বছরের বৌদ্ধ বিহার, জমি উদ্ধারের দাবি


এর মধ্যে ২০১০ সালের ২৬ অগাস্ট বিহারটিতে মুখোশধারী কিছু ব্যক্তি হানা দেয়। তারা বিহারের পুরোহিতকে হুমকি দিলে তিনি পালিয়ে যান। ওই দিন বিহারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু মালামাল লুট হয়। মূলত ওই দিন থেকে বিহারটি দখল বা নিশ্চিহ্ন হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয় বলে অভিযোগ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের। এর মধ্যে বিহারের সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে পল্লীটিও। বদলে গেছে গ্রামের নাম।


স্থানীয় বৌদ্ধরা জানান, ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর টেকনাফ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আবদুল্লাহ আল মামুনের একটি প্রতিবেদন ধরেই ৩১ দখলদারের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ মামলা করা হয়। যে মামলায় দখলদারদের উচ্ছেদের আদেশও দেওয়া হয়।


মামলায় যে ৩১ দখলদারের নাম বলা হয়েছে, তারা হলেন- টেকনাফের হ্নীলা ইউপি চেয়ারম্যান রাশেদ মাহমুদ আলী, ওসমান গনি, রহিমা খাতুন, আবদুস ছালাম, জহুরা খাতুন, হাসিনা খাতুন, নুরুল ইসলাম, আবদুল ওয়ারেছ, পেটান আলী, জলিল আহমদ, মো. কায়সার, আবুল কালাম, মকবুল হোসেন, বাদশা মিয়া, হাবিবুর রহমান, ওসমান সওদাগর, আবদুল্লাহ, কফিল আহমদ, মো. হাছন, ছৈয়দ হোছন, নবী হোছন, সোনা মিয়া, হাবিবুর রহমান, আবু ছিদ্দিক, ইসমাইল মিস্ত্রি, আবদুল গফুর, রশিদ আহমদ, মো. এলাহাত, মো. আলমগীর, খাইলুল বশর, বেলাল উদ্দিন।


বৌদ্ধ বিহার রক্ষা কমিটির সদস্যসচিব ও আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা কমিটির সহসভাপতি ক্যা জ অং বলেন, 


“ওই সময়ের ৩১ দখলদারের সংখ্যা এখন ক্রমাগত বেড়েছে। গত ১৪ বছর ধরে সরকারের একাধিক তদন্ত কমিটি জমির ধরণ ও পরিমাণ চিহ্নিত, সীমানা নির্ধারণ, সুনির্দিষ্ট দখলদারদের তালিকা করে তাদের উচ্ছেদ করার সুপারিশ করে। তদন্তের আলোকে উচ্ছেদ করে বিহারের ভূমিটি পরিচালনা কমিটির কাছে হস্তান্তরে জেলা প্রশাসনের নির্দেশনা থাকলেও সংশ্লিষ্টদের কোনো পদক্ষেপ ছিল না। ফলে এখন প্রভাবশালীদের দখলে রয়েছে পুরো জায়গা।”


বিহারের জায়গা পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধিদলটি টেকনাফ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) আরিফ উল্লাহ নেজামির সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় তিনি বিহারের জমি উদ্ধারে দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণের আশ্বাস দেন।


দখলে নিশ্চিহ্ন ৩০০ বছরের বৌদ্ধ বিহার, জমি উদ্ধারের দাবি


এ বিষয়ে সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে ও হ্নীলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রাশেদ মাহামুদ আলী বলেন, 


“২০০১ সালে বাবার সঙ্গে বিহারের পুরোহিতের একটি চুক্তি হয়। যার শর্ত ছিল, বাবা গাছ লাগাবেন এবং লাভের অংশ সমানভাবে ভাগাভাগি করা হবে। যেহেতু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক তা চান না তখন আমরা দখল ছেড়ে দেব।

“যে কেউ এসেই বিহারের খালি জায়গায় বিহারের কাজ পরিচালনা করতে পারেন। বিহার তৈরিতে আমি বারবার সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিচ্ছি। আমরা যে গাছ লাগিয়েছি তাও বিহারকে দিয়ে দেব। অন্যান্য দখলদারদের উচ্ছেদে প্রশাসনকে সহযোগিতা করব।”



সূত্র: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ