প্রতিমা পূজা বিষয়ক ভ্রান্তি নিরসন।। পর্ব-২।। - অনিক কুমার সাহা

প্রতিমা পূজা বিষয়ক ভ্রান্তি নিরসন


প্রথম পর্বের পর ...


।। পটল-সুপ্রতীম যুক্তিতর্ক ।।


পটল: বেদে ত ঈশ্বর নিরাকার। তিনি আবার সাকার হন কিভাবে? কিভাবেই বা তার প্রতিমা নির্মাণ করে পূজা করা হয়? 


সুপ্রতীম: বেদে ঈশ্বরকে যেই অর্থে নিরাকার বলা হয়েছে তা হলো যাঁর কোন নির্দিষ্ট আকার নেই। বেদ সংহিতায় তাঁর অবয়ব নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগ্বেদ সংহিতায় (১০/৯০/১) বলা হয়েছে, "সহস্রাশীর্ষা পুরুষাঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রাপাৎ।" অর্থাৎ পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। শুক্ল যজুর্বেদ (১৬/২) ও শ্বেতাশ্বতরোপনিষদে (৩/১১) বলা হয়েছে, ঈশ্বরের তনু বা শরীর রয়েছে। এছাড়াও আলাদাভাবে তাঁর হস্ত, পদ, মুখ ও বর্ণের উল্লেখও রয়েছে বেদে। তাঁর ভিন্ন ভিন্ন রূপের কারণ সম্পর্কে অথর্ববেদে (১/১/১) বলা হয়েছে, "ঈশ্বর অসংখ্য রূপ গ্রহণ করেন জগৎকে কল্যান করেন।"


পটল: তাহলে কি তোমাদের ঈশ্বর অনেক? 


সুপ্রতীম: এক থেকে অসংখ্য হলে, তিনি অনেক হয় কিভাবে? ছান্দোগ্য উপনিষদে (৬/২/১) বলা হয়েছে ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় অর্থাৎ তিনি একজনই। কিন্তু সৃষ্টি পরিচালনায় সেই তিনিই আবার বহু হোন এবং ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও নামে ভূষিত হোন। ঋগ্বেদ সংহিতার (১/১৪৬/৪৬) একটি  মন্ত্রে তাই বলা হয়েছে, "একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি" অর্থাৎ এক সত্ত্বাকেই বিদ্বানগণ ভিন্ন ভিন্ন নামে চিন্তা করেন। শ্রীমদভগবদগীতায়ও (৯/১৫) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, "একত্বেন পৃথক্ত্বেন বহুধা" অর্থাৎ আমি এক কিন্তু বহুরূপে প্রকাশিত হচ্ছি। বহুরূপে প্রকাশিত একেকটি সত্ত্বাই একেকজন দেবতা। যজুর্বেদের মাধ্যন্দিনীয় বাজসনেয়ি সংহিতার (১৪/৩০-৩১) দুইটি মন্ত্রে দেখা যায় স্বয়ং প্রজপতি জগৎ ও জীবের সৃজন করছেন এবং একেকজন দেবতাকে ভিন্ন ভিন্ন কার্যের অধিপতি নিয়োগ করছেন। তিনি এক থেকেই বহু কিন্তু মূলে এক ঈশ্বরই এমনকি দেবতারাও সেই একেরই প্রতিনিধি। যেমন: অথর্ববেদ সংহিতার একটি মন্ত্রে (১৩/৩/১৩) বলা হয়েছে 


“সেই অগ্নি সন্ধ্যাকালে বরুণ হন, প্রভাতে উদিত হয়ে তিনি হন মিত্র, তিনি সবিতারূপে অন্তরীক্ষ পরিক্রমণ করেন এবং তিনিই ইন্দ্র হয়ে মধ্যদিনে কিরণ প্রদান করে থাকেন।”


তিনি শুধু বহুই হোন তা নয় বরং এই সৃষ্টিজগতের সবকিছুতেই তিনি প্রকাশিত হোন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে (২/৫/১৯) বলা হয়েছে, "রূপং রূপং প্রতিরূপো বভুব..." অর্থাৎ তিনি প্রতিটি বস্তুর রূপ ধারণ করিয়াছেন। এখানে স্পষ্ট যে এই চরাচার জগতের সকল রূপেই তিনি প্রকাশিত, আলো যেমন যে বস্তুতে পতিত হয় সেই রূপেই প্রকাশিত হয় ঠিক তেমন।


পটল: তোমরা যেই গীতাকে এতো মানো, ওখানে কি কোথায় আছে মূর্তি পূজার কথা?


সুপ্রতীম: গীতায় মূলত কর্ম, জ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে নিজের আত্মিক উন্নত ও জগতের কল্যাণের কথা বলা হয়েছে। এই জন্য ভারতের মিসাইলম্যান এপিজে আব্দুল কালাম প্রাক্টিসিং হিন্দু না হয়েও গীতা পড়তেন। গীতায় আলাদা করে সরাসরি প্রতিমা পূজার উল্লেখ নেই। কিন্তু গীতার ১২/২নং শ্লোকে তাঁর সবিশেষ রূপের (সাকার) উপাসককে শ্রেষ্ঠ যোগী বলা হয়েছে। গীতায় মূলত ভক্তি ও শ্রদ্ধার সাথে সকল উপাসনাকেই সমমর্যাদা দেওয়া হয়েছে। 


কিভাবে?


ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় (৪/১১) স্পষ্ট বলেছেন, "যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম্..." অর্থাৎ যে যেভাবেই তাঁর ভজনা করে তিনি সেভাবেই তাতে সাড়া দিয়ে তার কল্যাণ করেন। এখন আমি যদি তাঁকে প্রতিমায় উপাসনা করি বা পাথরেও উপাসনা করি তিনি তাতেই সাড়া দিবেন।


পটল: তোমরা ত কৃষ্ণ ও রামকে আদর্শ মানো। উনারা কখনও মূর্তি পূজা করেছিলেন? উনারা ত শুনেছি আমাদের মতো নিরাকার উপাসনা করতেন। 


সুপ্রতীম: ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরামচন্দ্র স্বয়ং ঈশ্বর, তথাপি উনারা লোকশিক্ষার জন্য নানান কর্ম করেছেন যা আমাদের জন্য অনুসরণীয়। উভয়ই যুগৎপদ নিরাকার ও সাকারোপাসনা করে গিয়েছেন যার প্রমাণ আমি রামায়ণ ও মহাভারত থেকে দেখাচ্ছি। বাল্মিকী রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডের (৬/১-৭)নং শ্লোকসমূহে দেখা যায় ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁর স্ত্রী ও ভ্রাতার সহিত বিষ্ণুমন্দিরে হব্য আহুতি দিয়ে নারায়ণ পূজা করেছিলেন। একই ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় রামায়ণের ক্রিটিকাল এডিশনেও (চ্যাপ্টার: ২/৬)৷ ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের মাতা কৌশল্যা কর্তৃকও বিষ্ণু পূজার উল্লেখ পাওয়া যায় বাল্মিকী রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডের ২০/১৩-১৪নং শ্লোকদ্বয়ে। এছাড়াও রাক্ষসরাজ রাবণ কর্তৃক শিবলিঙ্গের উপাসনার উল্লেখ রয়েছে বাল্মিকী রামায়ণের উত্তরকাণ্ডের ৩১/৪২-৪৪নং শ্লোকসমূহে। এই ঘটনার উল্লেখ রামায়ণের ক্রিটিকাল এডিশনেও রয়েছে।


এছাড়াও মহাভারতের বহু জায়গায় প্রতিমা পূজা ও সাকারোপাসনার উল্লেখ পাওয়া যায়। নিচে কিছু রেফারেন্স দিচ্ছি, নিজ দায়িত্বে মিলিয়ে নিবেন। যথা:- আদিপর্ব: ৬১/২৯-৩০, বনপর্ব: ৩৫/৬৪-৬৮, বিরাটপর্ব: ৬, ভীষ্মপর্ব: ২/২৬ ও ২৩, দ্রোণপর্ব: ৭০/১-৮, দ্রোণপর্ব: ১৬৯/৫৯-৬৪, শান্তিপর্ব: ৩৮/১৪, অনুশাসনপর্ব: ১৪/১-৫, অনুশাসনপর্ব: ১৩৯ এবং হরিবংশ: বিষ্ণুপর্ব- ৮৭। মহাভারতের ভীষ্মপর্বে (২৩) ও বিরাটপর্বে (৬) সরাসরি দুর্গাস্তবও পাওয়া যায়। উল্লেখ্য যে, বৈদিক শাস্ত্র ষড়বিংশ ব্রহ্মণে (১০/১) দেবপ্রতিমার (দৈবপ্রতিমা হসন্তি) উল্লেখ সরাসরি পাওয়া যায়। 


পটল: প্রত্নতাত্ত্বিক কোন প্রমাণ কি আছে যে প্রাচীনকালেও তোমাদের সমাজে প্রতিমা পূজার প্রচলন ছিলো?


সুপ্রতীম: অবশ্যই আছে। দুই থেকে তিন হাজার বছরের প্রাচীন মন্দিরের অস্তিত্ব এখনও টিকে আছে ভারতে, অথচ বর্তমানে প্রচলিত বড় বড় অনেক রিলিজিয়নের জন্মও হয় নি তখন। যাইহোক এবার কিছু দেবপ্রতিমার প্রাচীন নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করা যাক। 


১/ মেহেরগড় সভ্যতায় (৭০০০-৩৩০০ খ্রিঃপূঃ) পাওয়া দেবমূর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য "Seated Mother Goddess" (আসন উপবিষ্ট দেবীমাতা)। এটা কেন দেবীমাতারই বিগ্রহ, সাধারণ কোনো পুতুল নয় তার সম্পর্কেও বিশেষ যুক্তি ও গবেষণাপত্র পাওয়া যায়৷ এছাড়াও খননকাজে প্রাপ্ত বিভিন্ন সামগ্রী প্রমাণ করে যে মেহেরগড় সভ্যতায় মূর্তি পূজা তথা দেবদেবী বিগ্রহ পূজা প্রথার প্রচলন ছিলো।

২/ মহেঞ্জোদাড়ো (২৬০০-১৯০০ খ্রিঃপূঃ) সভ্যতায় সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃষ্টান্তগুলো পাওয়া যায়। প্রতিমা পূজার বিশেষ নিদর্শন এই সময়টায় বেশি পাওয়া যায়। সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন হলো Pashupati Seal (পশুপতি সীল) অর্থাৎ শিবের বিশেষ রূপ পশুপতি অঙ্কিত সীল। মহেঞ্জোদাড়োর আরেকটা উল্লেখযোগ্য মূ্র্তি হচ্ছে, 

"Mother Goodess Idol"(দেবীমাতার বিগ্রহ)। 

৩/ পোস্ট হরপ্পার কালিবঙ্গান সাইটের খননকাজেও বিষ্ণু প্রতিমা, যজ্ঞকুণ্ডের পাশে শিবলিঙ্গ এবং মহাদেবের প্রতিমা পাওয়া যায়৷ ১৯৪০ সালের দিকে এই খননকাজের নেতৃত্ব দেন সংস্কৃত পণ্ডিত ও ASI এর ডিরেক্টর জেনারেল মধু সরুপ ভাট৷ তিনি এই খননকাজের উপর "Excavation at Harappa" নামে একটি বইও লিখেন।

এরপরও যারা প্রতিমা পূজার শাস্ত্রীয়, দার্শনিক, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রামাণিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে ধরে নিতে হবে তারা নিজেরাই বিভ্রান্ত। প্রতিমা পূজা নিয়ে অহেতুক বিতর্ক তৈরী করা তাদের হঠকারিতা ও অনৈতিকতার অংশ মাত্র। 



কলমে: অনিক কুমার সাহা 

© Swastika-স্বস্তিকা 

সত্য ও সুন্দরের পথে স্বাগতম।।


# ফেবুপোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ