পূজা ও উৎসব হোক ভয়হীন - অজয় দাশগুপ্ত

পূজা ও উৎসব হোক ভয়হীন - অজয় দাশগুপ্ত

কিছুদিন বাদেই শুরু হতে যাচ্ছে দুর্গাপূজা। তারই প্রস্তুতিতে চলছে মণ্ডপে মণ্ডপে প্রতিমায় রং-তুলির আঁচড়। ফাইল ছবি 


বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে কখনো নিজেকে সাম্প্রদায়িক ভাবতে পারিনি। মাঝে মাঝে বঞ্চনা বা সমাজ বাস্তবতায় হিন্দু হবার কারণে যে সব দুর্ভোগ হয় তা পীড়িত করে বৈকি। তখন রাগ হয়।


পূজা ও উৎসব হোক ভয়হীন


অজয় দাশগুপ্ত, Published : 07 Oct 2023, 12:24 PM, Updated : 07 Oct 2023, 12:24 PM


শারদ উৎসব সমাগত প্রায়। এদিকে নির্বাচনের বাতাসও বইতে শুরু করেছে। চলছে নানা কথা নানান বিষয়। প্রতিবারের মতো এবারও সংখ্যালঘু সমস্যার কথাই শুরু হয়েছে বেশি করে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে, এখনো আমাদের দেশ ও সমাজ থেকে সংখ্যালঘু নিয়ে রাজনীতির বিষয়টি বাদ যায়নি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে সবাই সমান হবে এমন একটা শপথ নিয়েই দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আমরা ধারণা করেছিলাম আর কখনো সাম্প্রদায়িকতা মাথা তুলতে পারবে না। আর কোনোদিন আমাদের মতো হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান বা অন্য কোনো মত ও পথের মানুষকে কটু কথা শুনতে হবে না। মাশুল গুণতে হবে না সংখ্যালঘু বলে। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। আমি আশাবাদী মানুষ। কাজেই কেবল হতাশার কথা আমি বলব না। মনে রাখব আওয়ামী লীগ আমলেই এদেশে সংখ্যালঘু নামে পরিচিত মানুষজন ভালো ভালো পদে উচ্চস্তরে যেতে পেরেছে। তাদের গুণ, কর্ম বা দেশপ্রেম স্বীকৃত হয়েছে। সব কথা বাদ দিলে কেবল লিটন দাসের কথা বললেই মনে হয় বোঝানো সহজ হবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমে প্রতিভা বা মেধার ঘাটতি নেই, বরং বেশি প্রতিভা আর বহুল মেধার চাপে মাঝে মাঝে দিশা হারাই আমরা। সেই ক্রিকেট দলের অন্যতম একজন লিটন, মাঝে অধিনায়কত্বও করেছেন। কই তাকে মানতে তো কারও সমস্যা হয়নি।


ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা পর্যালোচনা আছে। আমি বাংলাদেশের মানুষ হিসেবে কখনো নিজেকে সাম্প্রদায়িক ভাবতে পারিনি। মাঝে মাঝে বঞ্চনা বা সমাজ বাস্তবতায় হিন্দু হবার কারণে যে সব দুর্ভোগ হয় তা পীড়িত করে বৈকি। তখন রাগ হয়। প্রতিক্রিয়াও বেরিয়ে পড়ে। পরমুহূর্তে আমি হিসেব কষি। আমার যা কিছু অর্জন বা প্রাপ্তি তা তো আমার দেশ আমার স্বদেশের মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া। যদি বলি অস্ট্রেলিয়ায় প্রাপ্ত পুরস্কার বা পদকের কথা? না সেখানেও কিন্তু স্বদেশ। আমি দেশের মানুষের ভালোবাসা বা সমর্থন না পেলে, সেখানে আমার লেখা ছাপা না হলে, কথা বলতে না পারলে এরা আমায় চিনত না। যার মানে একটাই. আমাদের শেকড়, আমাদের নাড়ির টান বাংলাদেশ। এতকিছুর পরও আমাদের সমস্যা দূরীভূত হয়নি।


শিশুকাল থেকে দেশান্তরী হবার একটা প্রবণতা দেখেছি আমরা। সেটি যে থেমে গেছে তা নয়। বরং চলছে। এর যৌক্তিক ও আবেগীয় কারণগুলো সবার জানা। কিন্তু সে তো কোনো সমাধান নয়। সমাধান যে নয়, আমাদের চাইতে ঢের খারাপ থাকা পাকিস্তানের হিন্দু বা খ্রিস্টানদের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তারা পালালেও সবাই যেতে পারেনি। অসহ্য কষ্ট আর অবর্ণনীয় দুঃখ ভোগ করেও তারা পাকিস্তানি। উপমহাদেশের দেশভাগ এক অজানা বেদনার কাহিনী, যা সেই থেকে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। সেই ধারাবাহিকতার অবসান ঘটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা যায়নি।


বলছিলাম এখনকার কথা। এখন সমাজে পোশাক থেকে আচরণে প্রায়ই বিদ্বেষ আর হিংসার হাতছানি দেখা যায়। বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের বড় ভরসা সরকার বা রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তাদের কথা বললেও আগেকার সরকারগুলোর আমলে সেভাবে তাদের কথা কেউ শোনেনি। বিএনপি-জামায়াত আমলে একবার শারদীয় দুর্গাপূজা না হবার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছিল দেশে। তারপরও বোধোদয় হয়নি। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় শারদীয় উৎসব আসার আগমনী বার্তা মূলত আর শরৎকালের আবহ বা ঢাকের বাজনা নয়। তারচেয়ে যখন আমরা মূর্তি ভাঙ্গার ফুর্তি দেখি তখনই বুঝি পূজা সমাগত।


এতকিছুর পরও মানুষ আশা ছাড়েনি। আশা ছাড়েনি বলেই দিনে দিনে পূজার সংখ্যা বেড়েছে। এতটাই বেড়েছে যে সরকারকে অনুরোধ জানাতে হচ্ছে যাতে তারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেন। তাদের এই সাবধানতাকে আমি স্বীকার করেই বলতে চাই যদি সমাজ আর দেশ চায়, যদি সমাজ থেকে সাম্প্রদায়িকতা নির্মূল করা যায় তাহলে পুলিশ প্রহরারই কোনো দরকার পড়বে না। আমি পূর্ব পাকিস্তান আমল দেখা মানুষ। এক-দুজন আনসার সদস্য বা লাঠি হাতে সিকিউরিটি গার্ড ব্যতীত তখন কোনো নিরাপত্তাই ছিল না। কিন্তু সাড়ম্বরে পূজা উদযাপন চলত। স্বাধীনতার পর পরিকল্পিতভাবে আওয়ামী লীগকে দুর্বল করার চক্রান্তে শুরু হয়েছিল প্রতিমা ভাঙচুর।


সংখ্যালঘুদের বড় আশ্রয় তাদের ভোটাধিকার। যা দিয়ে তারা তাদের সুখ-দুঃখ, মত-অভিমত প্রকাশ করতে পারে। আগামী নির্বাচনের আগে তাদের সে অধিকারবোধ নিয়ে কথা উঠছে। এটা সবাই জানেন সংখ্যালঘু নামে পরিচিতদের ভোট যাবে প্রগতিশীলদের বাক্সে। যারা তাদের মান-সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করবে তারা তাদেরই নির্বাচিত করবে। এখন কথা হচ্ছে যারা চেতনার কথা বলেন বা ধারণ করেন তারা কি আসলেই আন্তরিক? শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা সেসব ইচ্ছে পূরণে এগিয়ে আসে না। বাংলাদেশে এটাই সমস্যা। কারণ সে হিসেব আলাদা আর কঠিন। মূল কথা সমাজের বদলে যাওয়া বাস্তবতা আর প্রবণতা মাথায় রেখে যারা নেতা হয়. তারা মনে করে আমি কেন তোমাদের জন্য ঝুঁকি নিতে যাব? যে কোনো নাগরিকের যে সমান অধিকার বা তার অধিকার নিশ্চিত করা যে ঝুঁকি নেয়া নয়—এটা এখন মানানো বা বোঝানো কঠিন।


সবচাইতে বড় বিষয় বোধকরি দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ। সংখ্যালঘুদের ব্যাপারে এই সন্দেহ একটা রোগের মতো। তারা দেশকে ভালোবাসলেও বাঁকা চাউনির শিকার হতে হয়। জানি এর পেছনেও ঘটনা আছে। দেশত্যাগ, দেশ থেকে টাকা পাচার সম্পত্তি পাচার এমন সন্দেহকে ঘনীভূত করে। কিন্তু অর্থ পাচার বা সম্পত্তি পাচার সবার বেলায় সত্য। আজকাল অবশ্য সবাই জানেন কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষ এই অপারাধের সাথে জড়িত নয়। এটা এখন সর্বজনীন সমস্যা।


সংখ্যালঘুদের কথা উঠল এই কারণে সামনে শারদীয় দুর্গা পূজা আর নির্বাচন। এই দুই উৎসব এগিয়ে এলেই তাদের আতঙ্ক বাড়ে। অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। বারবার আক্রান্ত হওয়া ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাবে—এটাই স্বাভাবিক। আর এটাও সত্য একসময় যে তারুণ্য ছিল ভরসা তারাই এখন গলার কাঁটা। ভাবতে অবাক লাগে তলে তলে এমন এক তারুণ্য তৈরি হয়ে গেছে, যারা জাতীয় সঙ্গীত গায় না। যারা পতাকা মানে না। যারা মাটি ভালোবাসে না। মাথা নত করে না। যারা বাঙালিকে বাঙালিত্ব দিয়ে বিচারও করে না। এদের হাতে কী আসলেই নিরাপদ আমরা?


রাজনীতির কঠিন খেলা বোঝা দায়। এটুকু বুঝি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যতদিন আছেন ততদিন অন্তত নিরাপত্তা আছে, থাকবে। থাকবে আশাবাদ। সবার আগে যে বাঙালি আর তার দেশ এটা প্রতিষ্ঠিত হলেই কিন্তু সমস্যার ভার লাঘব হতে পারে। আজকের বাংলাদেশ বহু বিষয়ে উঁচুতে। বিশ্বে নানা কারণে তার পরিধি বেড়েছে। বেড়েছে পরিচয়। এমন স্বদেশের জন্য সবাই গর্বিত হবে এটাই স্বাভাবিক। যেসব অর্জন আমাদের বড় করছে তার পেছনে সবার ত্যাগ, মেধা আর পরিশ্রম থাকে। সে বিবেচনায় দেশটির জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত সংখ্যালঘু নামে পরিচিতেরাও কম কিছু করেনি। সময় দ্রুত বয়ে যায়। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ আর স্মার্ট বাংলাদেশের মূলসূত্র হোক আমাদের সকলের ঐক্য। যে সমাজে কেউ কাউকে সংখ্যালঘু বিবেচনা করবে না সেটাই তো আসল আধুনিক সমাজ। তেমন একটা রাষ্ট্রের জন্য আর কতকাল সবুর করতে হবে আমাদের?


সূত্র: বিডিনিউজ২৪

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ