আমাদের পড়ানো হয়েছে শেরশাহ জি টি রোড (গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক Road) বানিয়েছিল। এটা যে কতো বড় মিথ্যে আসুন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তা জানার চেষ্টা করি -----
🚩 প্রথমেই আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের ভারত এবং ভারতীয় সভ্যতা কখনোই চৌদ্দশো (1400 বছর) বছরের পুরানো সভ্যতা নয় --- আমাদের সভ্যতা হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা।
🚩 বর্তমানের জিটি রোড যা প্রাচীন কালে উত্তরাপথ নামে পরিচিত ছিল তা কে নির্মাণ করেছিল সেকথা সঠিক ভাবে বলা সম্ভব নয়। বেদে দশ রাজার যুদ্ধের ঘটনা, রামায়ণ এবং মহাভারত থেকে এই পথের অস্তিত্বের কথা স্পষ্ট ভাবে জানা যায়।
🚩 যাইহোক রামায়ণ মহাভারতের কথা বললে অনেকেরই হয়তো এ্যালার্জি হতে পারে, তাই আমি সেদিকে যেতে চাইছি না। তবে সর্বমান্য ঐতিহাসিক তথ্যের উপর যদি দৃষ্টি দেওয়া যায় তাহলে দেখা যায় যে প্রাচীন কাল থেকেই তৎকালীন ভারতের সাথে পশ্চিমে মেসোপটেমিয়া, গ্রীস প্রভৃতি পশ্চিমা দেশের স্থলপথে বানিজ্য চলতো এবং পূর্বে বঙ্গদেশ হয়ে ব্রহ্মদেশ (বার্মা/মায়ানমার) পর্যন্ত স্থলপথ এবং জলপথে বানিজ্য চলতো। স্থলপথে পণ্যসামগ্রী নিয়ে যাওয়া হতো ঘোড়ায় টানা রথ, গরুর গাড়ি বা অন্যান্য বাহনের মাধ্যমে। ভারতের পশ্চিম সীমান্ত থেকে পূর্ব সীমানা পর্যন্ত সংযোগকারী উপযুক্ত রাস্তা না থাকলে এই বাণিজ্য যে সম্ভব হতো না তা অতি মূর্খও বুঝতে পারবে।
✍️✍️এবার, বেশি দূর নয় খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ/পঞ্চম শতক থেকে শুরু করা যাক -- বর্তমানে যাকে জি টি রোড বলা হয় সেই রোডের অস্তিত্ব প্রাচীন ভারতের তথা বিশ্বের প্রথম ব্যাকরণ রচয়িতা পনিনীর রচনায়ও পাওয়া যায় - "উত্তরাপথ" নামে, এছাড়াও পাণিনীর রচনায় অন্য একটি পথের নাম জানা যায় "দক্ষিণা পথ", এই রাজপথ দুটো প্রধানত দেশবিদেশের সাথে বানিজ্য এবং সেনা চলাচলের জন্য ব্যবহৃত হতো ।
এরপর খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মগধরাজ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের সময় মেগাস্থিনিসের রচনায় এই পথের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় । উল্লেখ্য মগধরাজ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের শাসনকালে মেগাস্থিনিস তৎকালীন ভারতের উত্তর-পশ্চিমের প্রবেশদ্বার দিয়ে গান্ধার হয়ে এই উত্তরাপথ ধরে পাটলিপুত্রে (বর্তমান বিহারের পাটনার আশপাশের এলাকা) আসে এবং চন্দ্রগুপ্তের রাজভবনে প্রায় পনেরো বছর অবস্থান করেন।
মেগাস্থিনিসের বিবরণ :----
মেগাস্থিনিস তার লিখিত পুস্তক ইন্ডিকাতে সুদীর্ঘ এই পথের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এই পথের ব্যাপারে মেগাস্থিনিসের রচিত গ্রন্থ ইন্ডিকা থেকে নেওয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে লিখিত পুস্তক "Intercourse between India and the Western World", (H. G. Rawlingson, Cambridge University Press 1916 ) তে মেগাস্থিনিসের দ্বারা উত্তরাপথের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় । ইন্ডিকাতে উল্লেখ রয়েছে -- মেগাস্থিনিস ভারতে প্রবেশ করার পর সর্বপ্রথম যে বিষয়টি তাকে সর্বাধিক আশ্চর্য করেছে তা হচ্ছে এই উত্তরাপথ। সুদূর আফগানিস্তান থেকে পাটলিপুত্র (বর্তমান পাটনা এলাকা) পর্যন্ত এই পথের বর্ণনা তিনি করেছেন এবং পাটলিপুত্রের পর থেকে পূর্ব দিকে অর্থাৎ বঙ্গদেশে তিনি যাননি,তাই পূর্বে বঙ্গদেশ পর্যন্ত বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে তিনি উল্লেখ করেছেন যে পাটলিপুত্র থেকে গঙ্গার অভিমুখ বরাবর এই পথ পূর্ব দিকে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে। মেগাস্থিনিস এই পথকে আটটি চরণে বিভক্ত করেন -
- পুষ্কলাবতী বা আফগানিস্তানের গান্ধার থেকে তক্ষশীলা;
- তক্ষশীলা থেকে সিন্ধু হয়ে ঝিলম নদী অর্থাৎ যে পর্যন্ত আলেকজান্ডার এসেছিল ;
- ঝিলম থেকে ব্যাস নদী হয়ে সাতলেজ নদী;
- সাতলেজ থেকে যমুনা নদী ;
- যমুনা থেকে হস্তিনাপুর হয়ে গঙ্গা ;
- গঙ্গা থেকে দভাই ( Rhodopha) নামক উন্নত গ্রাম ;
- দভাই থেকে কনৌজ ( বর্তমান কানপুর এলাকা) ;
- কনৌজ থেকে গঙ্গা যমুনা সঙ্গম (প্রয়াগরাজ/এলাহাবাদ) হয়ে পাটলীপুত্র/পাটনা এলাকা যা মগধের রাজধানী ছিল।
উল্লেখ্য, মেগাস্থিনিস পাটলীপুত্র থেকে পূর্বে বঙ্গদেশের দিকে আর যাননি তাই তার লেখায় পূর্বদিকের অংশের বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে তিনি পাটলিপুত্র থেকে গঙ্গার অভিমুখে এই পথ যে বঙ্গদেশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে তা তিনি উল্লেখ করেছেন।
মেগাস্থিনিস তার ইন্ডিকা গ্রন্থে আরও উল্লেখ করেছেন যে এই পথ সম্পূর্ণ কংক্রিটের তৈরি ছিল এবং এই পথ দেখাশোনা এবং সংরক্ষণের জন্য সরকারি বেতনে নির্দিষ্ট আয়োগ বা কমিটি নিযুক্ত ছিল। মেগাস্থিনিস উত্তরাপথের যে রূপরেখা বর্ণনা করেছে তার সাথে বর্তমান জিটি রোডের ম্যাপ একদম মিলে যায়। পরবর্তী কালে সম্রাট অশোক এই পথের দুই ধারে গাছ লাগায়, পানীয় জলের ব্যবস্থা করে এবং প্রচুর যাত্রী বিশ্রামাগার তৈরী করে।
কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘ 74 বছর ধরে আমাদের পড়ানো হয়েছে ঐ পথ নাকি শেরশাহ বানিয়েছিল! এই শেরশাহ ৫/৬ বৎসর রাজত্ব করেছে এবং অধিকাংশ সময় যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থেকেছে। এই শেরশাহ নাকি ২৫০০ কিলোমিটারেরও বেশি লম্বা কংক্রিটের রাস্তা বানিয়েছিল এবং রাস্তার দুই ধারে নাকি সরাইখানা, স্থায়ী জলের ব্যবস্থা আরও কতকিছু করেছে!!! আধুনিক যুগে এতো উন্নত টেকনোলজির সাহায্য নিয়েও এত কম সময়ে পাহাড়/জঙ্গল কেটে এতো লম্বা সড়ক বানানো সম্ভব নয়।
কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে পাঁচজন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী বামপন্থী রোমিলা থাপার এবং ইরফান হাবিবের মতো ইতিহাসবিদদের লেখা গল্প কথাকে ইতিহাসের মর্যাদা দিয়ে সেই সব ভুল তথ্য আমাদের পড়ানো হয়ে চলেছে আর আমরাও বিনা বিচারে তা বিশ্বাস করে নিচ্ছি ।
তথ্যসূত্র:---
1. Narayan Singh kolota. "India as directed by Megasthenes"; Concept Publishing Company.
2. Caravanserias as along The G. T. Road in Pakistan,, UNESCO'
3. A. Senopole, (1998). Arch Bridges. ISBN - 7789058090126.
4. धनपति पाण्डेय (1998), प्राचीन भारत का राजनैतिक और सांस्कृतिक इतिहास [ मोतीलाल वनारसीदास पब्लिशर्स; पृष्ठ -112. ] ISBN 9788120823808.
✍️ S. I. Saraswati.
ম্যাপ : প্রাচীন উত্তরাপথ ( বর্তমানের গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড).
0 মন্তব্যসমূহ