শিক্ষকের গলায় জুতার মালা ও জুতার মাহাত্ম্য - চিররঞ্জন সরকার

শিক্ষকের গলায় জুতার মালা ও জুতার মাহাত্ম্য- চিররঞ্জন সরকার
গ্রাফিক্স: ইত্তেফাক


শিক্ষকের গলায় জুতার মালা ও জুতার মাহাত্ম্য

চিররঞ্জন সরকার

প্রকাশ : ২৮ জুন ২০২২, ০৩:২০

https://www.ittefaq.com.bd/603678



নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। ২৭ বছরের শিক্ষকতা জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এসে তিনি পেয়েছেন জুতার মালা! অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালা পরিয়ে দিচ্ছে তারই ছাত্র, দুই পাশে দাঁড়িয়ে দুই জন পুলিশ সদস্য। ছবিতে তাদের নির্বিকার চেহারা দেখে মনে হয়েছে, জুতা পরানোর কাজেই যেন পাহারা দিচ্ছে!


শিক্ষককে প্রহার ও জুতার মালা পরানোর কারণটা কী? কারণ তিনি ধর্ম অবমাননা করেছেন। ধর্ম অবমাননা কীভাবে করেছেন? গত ১৮ জুন একদল উত্তেজিত ছাত্র সেই কলেজের একজন হিন্দু ছাত্র ভারতের নূপুর শর্মার পক্ষে পোস্ট দিয়ে ইসলামধর্মের অবমাননা করেছে বলে অভিযোগ জানায়। স্বপন কুমার বিশ্বাস বুদ্ধিমানের মতোই সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফোন করেন। এই ফোন করাই নাকি তার অপরাধ। এই ফোন করাটাই ধর্মের অবমাননা। পুলিশে ফোন দিয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস নাকি ঐ অভিযুক্ত ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন। সম্ভবত পুলিশও সেটা মনে করে, এ কারণে স্বপন কুমারকে তারা জুতার মালা পরানো থেকে রক্ষা করেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনেই শিক্ষক স্বপন কুমারের সম্মান ‘হত্যা’ করে তার ‘ছাত্ররা’! ‘হত্যা’ বলাই সংগত, কারণ শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর সামনে একজন শিক্ষককে বিনা দোষে মারধর ও জুতার মালা পরানো কি তাকে মানসিকভাবে হত্যা করা নয়? তার স্ত্রী-সন্তানদের ‘হত্যা’ করা নয়?


ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে শিক্ষক স্বপন কুমারের গলায় জুতার মালা পরানোর সময় আশপাশে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও তারা এখন দাবি করছে, এমন কোনো ঘটনা তাদের চোখে পড়েনি। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও ঐ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি তারা। শিক্ষক হেনস্তা বা কলেজে সহিংসতার ঘটনায় কোনো মামলাও হয়নি। অন্যদিকে, হেনস্তার শিকার শিক্ষককে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত হেনস্তার বর্ণনা দিয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বলেছেন, ‘পুলিশ আমাকে কলেজের কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল। এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল।’


তবে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়া ছাত্রের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার পর তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরানো এ দেশে কোনো নতুন ঘটনা নয়। মাত্র কয়েক মাস আগেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের একটি স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলকে হেনস্তা করা হয়। কারাগারেও যেতে হয়। তারও আগে নারায়ণগঞ্জের স্কুলশিক্ষক শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করানো হয়। কারাগারে নেওয়া হয়। এমন ঘটনা আরো অনেক আছে। ছাত্রদের দিয়ে শিক্ষককে অপমান, ধর্ম অবমাননার অভিযোগ, কান ধরে ওঠবস, জুতার মালা পরানো—সবই এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অনিবার্য পুরস্কারে পরিণত হয়েছে। এ নিয়ে কথা বলে, ক্ষোভ-রাগ প্রকাশ করে, বিলাপ করে কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না। আমরা বরং স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় যে জুতার মালা পরানো হয়েছে, সেই জুতা নিয়ে কিছু সাধারণ আলোচনা সেরে নিতে পারি।


প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, মানুষের জীবনে জুতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পা ছাড়া মানুষ দেখা যায়, কিন্তু জুতা ছাড়া মানুষ বর্তমানে একেবারেই বিরল। কে, কবে, কোথায় প্রথম জুতা ব্যবহার করেছে, তা নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার। তবে এ কথা ঠিক, মানুষের জুতা ব্যবহারের বয়স সভ্যতার বয়সের কাছাকাছি। বর্তমান যুগে কিছু কিছু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠী (আদিবাসী) এবং অতিশয় দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ছাড়া সবাই জুতা ব্যবহার করে। আধুনিক মানুষের জীবনে জুতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। যে জাতি যত উন্নত, সে জাতি তত বেশি এবং আকর্ষণীয় জুতা ব্যবহার করে। সেদিক থেকে বিবেচনা করে দেখলে জুতা কোনো জাতির আয়-উন্নতি-সমৃদ্ধিরও পরিমাপক।


ভারতবর্ষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সম্ভবত প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুতা ‘আবিষ্কার’ করেন। ‘জুতা আবিষ্কার’ নামক কবিতায় এ বিষয়ে বিশদ বিবরণ খুঁজে পাওয়া যায়। তারও আগে অবশ্য ‘পাদুকা’ ব্যবহারের নজির রয়েছে। তবে সেগুলো ঠিক জুতা নয়। রামায়ণে বর্ণিত কাহিনি অনুযায়ী রামচন্দ্র যখন পিতার অঙ্গীকার রক্ষায় বনবাসে যান, তখন সদাশয় দাদাভক্ত অনুজ ভরতচন্দ্র রামের অনুপস্থিতিতে একজোড়া পাদুকা বা খড়ম সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করেন। ভরতের কাছে ঐ পাদুকাই ছিল রামের প্রতীক। পাদুকা তথা জুতাকে মহিমান্বিত করার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে প্রাক-আধুনিক যুগে খড়ম বা পাদুকা (প্রাক-জুতা) রাজ্য শাসনে পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে পরবর্তীকালে জুতা নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটেছে। কথিত আছে, পলাশির যুদ্ধে পরাজিত বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে পলায়ন করেছিলেন; কিন্তু পায়ের বিশেষ জুতার কারণেই তিনি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েন এবং নির্মমভাবে নিহত হন।


আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে জুতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন টিকে ছিল। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জমিদার পরিবারের বাইরের লোকদের জুতা পায়ে বেড়ানো নিষিদ্ধ ছিল বহুকাল। আমাদের বাপ-দাদারা জুতাকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন। তারা জুতা পায়ে দিতেন খুব কমই; হাতেই জুতা শোভা পেত বেশি। উত্সবে-অনুষ্ঠানেই কেবল জুতা পায়ে দেওয়া হতো। তা-ও আবার নির্দিষ্ট বাড়ি বা উত্সবস্হলের কাছাকাছি গিয়ে তা পায়ে পরা হতো। তার আগে তা অত্যন্ত আদর ও যত্নের সঙ্গে হাতে বহন করার রীতি ছিল।


সমাজে ভোগবিলাসিতার চরম উৎকর্ষ বোঝাতেও জুতার সংখ্যা পরিমাপ করার রীতি সৃষ্টি হয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগে ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক মার্কোসের স্ত্রী ইমেলদা মার্কোসের হাজার হাজার জোড়া জুতা গোটা পৃথিবীতে খবরের শিরোনাম হয়েছিল। ইমেলদার জুতার সংখ্যা দিয়েই তখন মার্কোসের অন্যায়-অপরাধ, ভোগদখলের মাত্রা চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। মোট কথা, মানুষের জীবনে জুতার ভূমিকা অপরিসীম। বাঙালি ‘অস্ত্র’ হিসেবে জুতা ব্যবহার করছে যুগ যুগ আগে থেকে। গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরদের জুতা তো চিরকাল নিরীহ ও উদ্ধত লোকদের পিঠে দণ্ড হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। পরিবারের অনেক রাগী অভিভাবক অশিষ্টদের শায়েস্তা করতে জুতা ব্যবহার করতেন। যুগে যুগে বেহায়া, বেয়াদব, এমনকি অপরাধীদের পর্যন্ত জুতিয়েই শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করা হতো। আধুনিক যুগে পুরুষের চাইতে মেয়েরাই জুতাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ‘অ্যাসিড নিক্ষেপ’ যুগের আগে অনাকাঙ্ক্ষিত ও বাহুল্য প্রণয়প্রত্যাশীকে তাড়াতে মেয়েদের জুতাই ছিল প্রধান ভরসা। অবশ্য এর জন্য জুতাপেটার প্রয়োজন হতো না, দেখালেই কাজ হতো। এক্ষেত্রে জুতা ছিল ‘রেড সিগন্যাল’। কোনো মেয়ের পিছে কেউ যদি বেশি ঘুরঘুর করত এবং বিষয়টিতে যদি ঐ মেয়ের আপত্তি থাকত, তাহলে একদিন সাহস করে জুতা দেখালেই ঝামেলা চুকে যেত। প্রেমপ্রত্যাশী ঐ জুতা দেখেই বুঝে যেত ওদিকে আর এগোনো যাবে না। যা হয়েছে তা যথেষ্ট হয়েছে, এবার ফুলস্টপ। জুতা সে ক্ষেত্রে ট্রাফিকের রেড সিগন্যালের মতো কাজ করত।


স্থান-কাল-পাত্রভেদে জুতার ভূমিকাও বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। পশ্চিমা মেয়েরা কোনো পরিস্থিতেই নাকি জুতা খুলতে চায় না। অথচ আমাদের দেশের মেয়েরা জুতা খুলতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। স্বল্পদৈর্ঘ্য মেয়েদের কাছে জুতা নিজেদের উচ্চতা বাড়ানোর হাতিয়ার। এখনো কেউ জুতা ছাড়া, অর্থাত্ খালি পায়ে যদি হাঁটাহাঁটি করে, তাহলে আমরা তাকে ‘আতরাফ’ হিসেবে চিহ্নিত করি। তাকে আমরা মোটেই ভালো চোখে দেখি না। অথচ আমাদের দেশে কোনো ইবাদত বা উপাসনাই জুতা পরে করা যায় না। নামাজ, পূজা, মন্দির, মসজিদ সবখানে জুতা নিষিদ্ধ। কবর, শহিদ মিনার ও স্মৃতিসৌধেও জুতা নিষিদ্ধ।


জুতার অনেক মাহাত্ম্য থাকা সত্ত্বেও কী এক অজ্ঞাত কারণে জুতা দেখানো, জুতাপেটা, জুতার মালা পরানো ও জুতাচোরকে সমাজে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়। ক্ষমতাবানেরা যুগ যুগ ধরে দুর্বলের বিরুদ্ধে জুতা ব্যবহার করেছেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার ইসু্যতে যদি শিক্ষকের বিরুদ্ধে জুতা ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়, তাহলে সেটা সীমাহীন নৈরাজ্যেরই বহিঃপ্রকাশ।


যা হোক, জুতা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভলো। এতে কল্যাণের চাইতে অকল্যাণেরই আশঙ্কা থাকে। আমরা চাই জুতা প্রত্যেকের পায়ে শোভা পাক। পায়ের জুতা হাতে উঠে আসুক, তা মোটেও কাম্য নয়।


লেখক: রম্যরচয়িতা

ইত্তেফাক/এসজেড


ইত্তেফাক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ