পুরো ইন্টারনেটে এরকম তথ্যে ভরে আছে। আমি গুগল সার্চ করে দেখেছি এরকম লেখায় ভরপুর। সবগুলিই বাংলাদেশী সাইট। মূলধারার মিডিয়াতে কলাম লিখেও এরকম দাবী করা হয়েছে। ইনকিলাব, সংগ্রাম, আমার দেশ পত্রিকা অন্যতম। অথচ বখতিয়ার খিলজি নদীয়ার খুব সামান্য অংশই দখল করতে পেরেছিলেন। লক্ষণসেনের বংশধররা বখতিয়ার খিলজির মৃত্যুর আরো একশ বছর পর্যন্ত বাংলা শাসন করেছিলেন। বখতিয়ার ১২০৩-১২০৪ সালে নদীয়া ও নবদ্বীপের কিছু অংশ জয় করেন। এদিকে ১২৮৯ সাল পর্যন্ত মধু সেন নামের একজন সেন বংশীয় রাজার কথা জানা যায় যিনি বঙ্গ শাসন করেছেন। তাহলে এতদিনে তো বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হয়ে যাবার কথা! বখতিয়ার খিলজিকে বঙ্গ বিজয়ী বলা ইতিহাসের একটি মিথ ছাড়া আর কিছু নয়।
ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে বৌদ্ধ ও নিন্মবর্ণের হিন্দুদের নিপীড়নের ইতিহাস গোপন করার চেষ্টা হিন্দুত্ববাদীরা করলেও তা মুছে যাবে না। কিন্তু তুর্কি আফগানদের কাছে বৌদ্ধও যা ব্রাহ্মণরাও তা। উদন্তপুরী বৌদ্ধবিহার যে বখতিয়ার খিলজি আক্রমন করে বৌদ্ধ বিক্ষুদের কচুকাটা করেছিলেন সে বিষয়ে ভারতীয় হিন্দু বামপন্থীরাও স্বীকার না করে পারেন না। বখতিয়ার ন্যাড়া মাথার ভিক্ষুদের ব্রাহ্মণ মনে করেছিলেণ। বস্তুত বখতিয়ার ভারতবর্ষ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতেন না। কেবল এরা পৌত্তলিক এটাই জানতেন। সেকালের মুসলিমদের কাছে ভারত ঐশ্বর্যের এক কল্পপূরী বলে আকর্ষণ করলেও এখানকার মানুষদেরকে তীব্র ঘৃণা করেই হামলা চালাতো কারণ এরা সবাই পৌত্তলিক মূর্তি পুজারী। ফলে বখতিয়ারের আক্রমনে সেনদের হাতে নিপীড়িত বৌদ্ধরা যারা বাংলা ভাষার আদিরূপ চর্যাপদ লিখতেন তারা সবাই পালিয়েছিলেন। এদের কেউ বগুড়ায়, কেউ নেপালে স্থান্তরিত হয়েছিলেন। সেনদের অত্যাচারেও বৌদ্ধরা পালিয়েছে মুসলমানদের ভয়েও পালিয়েছে। উদন্তপুরি ও নালন্দা সম্পর্কে প্রাচীন প্রামাণ্য সূত্রের মধ্যে শাক্য শ্রীভদ্রের তথ্য মতে তুর্কিদের ভয়ে বৌদ্ধ বিহার দুটি থেকে ভিক্ষুরা সবাই পালিয়েছিলো।
এটা তো খুবই স্বাভাবিক বিষয় ছিলো। মধ্যযুগীয় একজন যোদ্ধা ভিনজাতি একটি দেশের সমস্ত কৃষ্টিকালচারকে ঘৃণা করবে। তাদের সমস্ত কিছুকে অসভ্য মনে করবে সেটাই ছিলো রীতি। আজকের যুগেও আমাদের মধ্যে যে পরিমাণ জাতীয়তাবাদী ঘৃণা বিরাজ করে মধ্যযুগের বখতিয়ার খিলজির মত একজন সাম্রাজ্যবাদীর কাছে এর বেশি কি আশা করতে পারি? এমন কি বৌদ্ধ সম্রাট অশোকও বহু হিন্দুকে হত্যা করেছিলেন বুদ্ধকে অবজ্ঞা করার অভিযোগে! ব্রাহ্মণরা কি বৌদ্ধদের উপর হামলা করেনি? বিহার ধ্বংস ব্রাহ্মণ্যবাদীরাও অগুণতি করেছে। তবে সেই সব ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কেউ আজকে হিরো বলে না। তাদের নাম নিশানাও আজ নেই। কিন্তু বখতিয়ার খিলজিকে মুসলমানরা জিইয়ে রেখেছে। বাঙালি এক কবি তাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। আল্লা সেপাই তিনি, তার ভয়ে কাফের পালিয়েছিলো...। বাংলাদেশে বখতিয়ার খিলজি দিবস পালিত হয়। এটা জনপ্রিয়তা পেলে বাংলাদেশের বামপন্থীরাও পালন করা শুরু করবে।...
যা হোক, বাংলা ভাষার কথা উঠেছিলো। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করেছে হিন্দু মুসলমান উভয়েই। আবার বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলো উভয় সম্পদায়ই। বাংলার মুসলমান সুলতানী আমলে বাংলা ভাষায় কাব্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এটা অকাট্য সত্য। এইসব সুলতানদের কারোর ভাষাই বাংলা ছিলো না। এদিকে চর্যাপদ ছিলো মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় সংগীত। এটাই বাংলার আদিরূপ। কাজেই বাংলা ভাষাকে মুসলমানদের ভাষা বললে (ইন্টারনেটে কিছু লেখা দেখেছি যেখানে বলা হয়েছে ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র সেন বাংলা ভাষাকে ‘বাঙালি মুসলমানের ভাষা’ বলে তার বইতে উল্লেখ করেছেন। এরকম কিছু রমেশচন্দ্র লিখেছিলেন কিনা তা ক্রসচেক করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু এরকম একপেশে কথা কি কোন ঐতিহাসিক লিখতে পারেন?) সেটা মস্তবড় ভুল হবে।
চর্যাপদের পরবর্তী দুশো বছরের মধ্যে কোন বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এর কারণ হিসেবেও ঐতিহাসিকদের মিশ্র মত। ঐতিহাসিকরা এই সময়কালে মুসলিমদের আগমনে বৌদ্ধদের দেশত্যাগ, অত্যাচার অরাজকতাকে দায়ী করেছেন। চর্যাপদের পর বাংলা সাহিত্য বা বাংলা ভাষার আদি রূপ কেমন ছিল তার সবচেয়ে প্রামাণ্য দলিল হচ্ছে ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’। ঐতিহাসিকদের সাম্প্রদায়িক অবস্থানের যে কথা আগে বলেছিলাম তার একটি নিদর্শন হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চেয়ে পুরোনো হিসেবে ইউসুফ জুলেখা কাব্যকে দেখানো। কারণ ইউসুফ জুলেখা একজন মুসলমান কবির লেখা। কিন্তু এই দাবী যে সঠিক নয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনই যে চর্যাপদের পর সবচেয়ে পুরোনো আদি বাংলা রূপ তাতে এখন আর কেউ দ্বিমত নয়। ভাষাবিদরা ইউসুফ জুলেখার ভাষা রীতি পরীক্ষা করে দেখেছেন এটি বহু পরের শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পরিবর্তিত রূপ ছিল।
বাংলায় সুলতানী আমলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত ঘটেছিল কারণ বাংলার মুসলিম সুলতানদের এই সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আর পৃষ্ঠপোষকতা। এই আমলে প্রচুর কাব্য কাহিনী রচিত হয় রাজদরবারের অনুকূলে। এ সময় কৃত্তিবাস, মুকুন্দরাম, আলাওল, কাশীরাম দাস, ভারতচন্দ্র প্রমুখ কবিদের রচনায় বাংলা ভাষা এক উচ্চ আসনে স্থান লাভ করে। সুলতানী বা মোগল আমলে দরবারী ভাষা ছিল ফারসী। এ কারণে বাংলা ভাষাতে এই সময়কালে আরবী ফারসী ভাষা অনুপ্রবেশ ঘটে। মনে রাখতে হবে সে যুগের সুলতানদের ব্যক্তিগত ভাল লাগা থেকে কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা না হওয়াতে সমস্ত দরবারী কাজ চলত বিদেশী ভাষাতেই।
মুসলমান সুলতানরা বাংলা সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করলেও লেখকদের নাম দেখে বুঝতে পারি বাঙালি হিন্দু মুসলমান কবিরাই বাংলা ভাষাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবু একপাক্ষিক ইতিহাসের কোন বিরাম নেই। মুসলিম সাম্প্রদায়িক মানসিকতার লোকজনের, সহজ করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বলি, দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রাম বা দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় যেসব লোকজন লেখালেখি করে তাদের ইতিহাসে বখতিয়ার খিলজিদের সব পাপ ধুয়েমুছে বাংলাদেশকে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাত থেকে রক্ষাকারী ও বাংলা ভাষার সুরক্ষার কারিগর হিসেবে দেখাতে দেখি। তাদের লেখার রেফারেন্স হিসেবে খালি কমরেডদের লেখা ইতিহাসই কেন দেথতে পাই?
লিখেছেন: সুষুপ্ত পাঠক Susupto Pathok
0 মন্তব্যসমূহ