'মনুসংহিতা' সনাতন ধর্মের প্রধান স্মৃতিশাস্ত্র। জ্ঞানস্বল্পতার কারণ বশত আমাদের মাঝে এ ধারণা গড়ে উঠেছে যেহেতু তা সনাতন ধর্মশাস্ত্র নিশ্চয়ই তা ভারতকেন্দ্রিক হবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন ও গৌরবময়।
মনুসংহিতার কেবল ভারতেই নয় বরং বিশ্বের অধিকাংশ সভ্য দেশগুলোতেই বিস্তর প্রভাব ছিল। প্রাচীনকালে দূরদূরান্ত পর্যন্ত মনুসংহিতার প্রসার হয়েছিল। বহু দেশের ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা মনুসংহিতা দ্বারা প্রভাবিত ছিল। উক্ত তথ্যসমূহ আমেরিকা, ইংল্যান্ড, জার্মানি দ্বারা প্রকাশিত 'এনসাইক্লোপিডিয়া', 'দ্য কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া' এবং শ্রী কেওয়াল মোটওয়ানী দ্বারা লিখিত 'মনু ধর্মশাস্ত্র : এ সোশ্যালজিকাল এন্ড হিস্টরিকাল স্টাডি' নামক বইগুলোকে বিস্তরে আলোচনা করা হয়েছে। এই লেখকগণ দেখিয়েছেন যে মনুসংহিতার প্রভাব কোনো না কোনো ভাবে চীন, জাপান, মিয়ানমার, ফিলিপাইন, মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, জাবাল, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, বালী, শ্রীলঙ্কা, ব্রিটেন, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, রাশিয়া, সাইবেরিয়া, তুর্কিস্তান, স্লোভাকিয়া, রোম, য়ূনান, বেবিলোনিয়া, তুরস্ক, ইরান, মিশর, সুমেরীয়, আমেরিকা তথা আমেরিকান দীপপুঞ্জ সমেত দেশগুলোতে পাওয়া যায়। এমন কি দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশের সংবিধান মনুসংহিতার ভিত্তিতে লিখিত এবং তাদের লেখকদের সম্মানসূচক ভাবে 'মনু' উপাধি দেয়া হয়।
🔸 চীনে প্রাপ্ত পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ - মনুসংহিতার মৌলিক স্বরুপ ও কাল সম্বন্ধিত তথ্য জানতে চাইনিজ ভাষার পান্ডুলিপি এক গুরুত্বপূর্ণ পুরাতাত্ত্বিক প্রমাণ।
১৯৩২ সালে জাপান কর্তৃক বোমা হামলায় চীনের 'ঐতিহাসিক দেয়াল' এর কিছু অংশ যখন ভেঙে যায়, তার মধ্য থেকে লোহা নির্মিত এক ট্রাঙ্কের সন্ধান মিলে যা চাইনিজ গ্রন্থের পান্ডুলিপিতে পূর্ণ ছিল। স্যার অগাস্টাস ফ্রিটস জর্জ (Augustus fritz Geogre) তা খুজে পান এবং লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখেন। সেই পান্ডুলিপিগুলো প্রোঃ এন্থনী গ্রেম (Prof. Anthony Graeme) চাইনিজ ভাষাবিদদের সাহায্যে পড়া হয় এবং তা হতে এ তথ্য বেরিয়ে আসে যে চীনের রাজা চিন-ইজ-ওয়াং (Chin-ize-wang) তার শাসনকালে তার সেনাদের সকল প্রাচীন গ্রন্থ নষ্ট করে দেয়ার আদেশ দেন, যাতে চীনের সভ্যতার সকল প্রাচীন নিদর্শন বিলুপ্ত হয়। তখন কোনো এক বিদ্যাপ্রেমী ব্যক্তি কিছু পুস্তক লোহার ট্রাঙ্কে ভরে চীনের প্রসিদ্ধ দেয়াল তৈরির সময় সেখানে লুকিয়ে রাখেন। ভাগ্যক্রমে সেই ট্রাঙ্ক বোমা বিস্ফোরণে বেড়িয়ে আসে। সেই পান্ডুলিপিতে লেখা ছিল-
" মনুর ধর্মশাস্ত্র ভারতে সর্বাধিক মান্য যা বৈদিক সংস্কৃতে লিখিত ও দশ সহস্রাধিক বছরের পুরনো। "
[ Ref: i]
🔸 ''দ্য ক্যাম্ব্রিজ হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়া' বইয়ে ইংরেজ ইতিহাসবিদেরা লিখেছেন যে ইংরেজরা যখন ভারতে আসে সেইসময় ভারত সহ দক্ষিণ তথা দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, জাবা, বালীদ্বিপ (ইন্দোনেশিয়া), শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও রাশিয়ার কিছু অংশে সংবিধান হিসেবে মনুসংহিতার সর্বাধিক মান্য ছিল। সেসকল দেশের সংবিধানকর্তা গৌরবের সাথে 'মনু' উপাধি ধারণ করতো। সেখানের প্রাচীন পান্ডুলিপিগুলোতেও মনুসংহিতার শ্লোক উদ্ধৃত রয়েছে। মিয়ানমারের সংবিধানের নামই 'ধম্মথট্' ও 'মানবসার'। একইভাবে কম্বোডিয়ার সংবিধানের নাম ছিল 'মানবনীতিসার' বা 'মনুসার'। কম্বোডিয়ার প্রাচীন ইতিহাসে লিখিত রয়েছে যে তারা সকলে মনুর বংশধর।
🔸 সংস্কৃত সাহিত্যের বিখ্যাত ইতিহাসবিদ পাশ্চাত্য লেখক এ.বি. কীথ তার 'এ হিস্ট্রি অফ সংস্কৃত লিটারেচার' বইয়ে মনুসংহিতার প্রভাব ব্যক্ত করতে লিখেছেন-
"The influence of the text us attested by its acceptance in Burma, siam(Thailand) and Java as authoritative and production of works based on it." [Ref :ii]
অর্থাৎ- "বার্মা, থাইল্যান্ড, জাবার মতো দেশসমূহের সংবিধানের প্রামাণিক ও আধিকারিক মূল গ্রন্থ হিসেবে মনুসংহিতার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।"
"The smriti of Manu not to guide the life of any single community, but to be a general guide for all the classes of the state." [Ref : iii]
অর্থাৎ- "মনু রচিত স্মৃতিশাস্ত্র (মনুসংহিতা) শুধু নির্দিষ্ট কোনো সম্প্রদায়ের জন্য জীবনপথ প্রদর্শক নয়, বরং সেটা বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের জন্য দিকনির্দেশক।"
🔸 বিখ্যার জার্মাল দার্শনিক ফ্রীডরিচ নীৎসে 'Beyond Nihilism Nietzsche, Without Marks' এ মনুসংহিতা ও বাইবেলের তুলনায় মনুসংহিতাকে বাইবেলের হতে উত্তম শাস্ত্র মেনেছেন তথা বাইবেল ছেড়ে মনুসংহিতা পড়ার আহবান জানিয়েছেন। নীৎসে বলেছেন-
"How wretched is the new testament compared to manu. How faul it small!"
(P- 41)
[Ref- iv]
"Close the bible and open the cod of manu."
(The will to power, Vol.1,Book 2, P- 126)
[Ref- v]
অর্থাৎ- "মনুসংহিতা বাইবেল থেকে বহুগুণে উত্তম গ্রন্থ। বাইবেল থেকে তো অশ্লীলতা ও পরনিন্দার দুর্গন্ধ নির্গত হয়। বাইবেল বন্ধ করে রেখে দাও আর মনুসংহিতা পড়া শুরু করো।"
🔸 ভারতরত্ন শ্রী পী.বী. কাণে যিনি একজন ধর্মশাস্ত্রের প্রামাণিক গবেষক ও ইতিহাসবিদ, তিনি তার 'ধর্মশাস্ত্র কা ইতিহাস' নামক বৃহৎ গ্রন্থে এমনই তথ্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি লিখেছেন-
"মনুসংহিতার প্রভাব ভারতের বাহিরেও বিস্তৃত ছিল। চম্পা (দক্ষিণ ভিয়েতনাম) হতে প্রাপ্ত এক শিলালিপিতে মনুসংহিতার বহু শ্লোক পাওয়া যায়। ভিয়েতনামের যে 'ধম্মথট্' রয়েছে, তা মনুসংহিতার ভিত্তিতে রচিত। বালীদ্বীপে (ইন্দোনেশিয়া) আইনের ভিত্তিও ছিল মনুসংহিতা।"
[Ref- vi]
🔸 এশিয়ার ইতিহাসে প্যারিস ইউনিভার্সিটি থেকে ডি.লিট. উপাধিপ্রাপ্ত ও বহু পুরস্কার দ্বারা সম্মানিত ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ডাঃ সত্যকেতু বিদ্যালংকার তার 'দক্ষিণ-পূর্ব ও দক্ষিণী এশিয়া মে ভারতীয় সংস্কৃতি' বইয়ে উক্ত বিষয় সম্বন্ধে মূল্যবান তথ্য দিয়েছেন-
(ক) "ফিলিপাইনের অধিবাসীরা মনু ও লাওৎসের স্মৃতিকে তাদের আচার সংহিতার ভিত্তি মানেন।"
[Ref- vii]
(খ) "দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রাপ্ত পান্ডুলিপি, রাজকীয় শিলালিপিগুলো দ্বারা জানা যায় যে সেখানকার আইন মূলত মনু, নারদ তথা ভার্গব ঋষির স্মৃতি বা ধর্মশাস্ত্রের ভিত্তিতে তৈরি। এক পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী রাজা ইন্দ্রবর্মদেব মনুমার্গ (মনু দ্বারা প্রতিপাদিত পথ) অনুসরণকারী ছিলেন।"
[Ref- viii]
(গ) "দক্ষিণ ভিয়েতনাম সমাজ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ভিত্তিক ছিলো।...... রাজা বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা স্থাপনের আদর্শকে সর্বদা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন। ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দের রাজা ইন্দ্রবর্মা (প্রথম) এর পান্ডুলিপিতে তার রাজধানী সম্বন্ধে লেখা হয়েছে...সেখানে বর্ণাশ্রম উত্তমরুপে সুব্যবস্থিত ছিল।"
[Ref- ix]
(ঘ) "কম্বোডিয়ার অধিবাসীগণ কাছে মনুসংহিতা বহু আগে থেকেই পরিচিত। রাজা উদয়বীর বর্মার 'সদোক কাকভ্রেম' থেকে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিতে 'মানব নীতিসার' এর উল্লেখ রয়েছে,যা মানব সম্প্রদায়ের নীতিশিক্ষা বিষয়ক গ্রন্থ ছিল। যশোবর্মার 'প্রসত কোমন' থেকে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপিতে মনুসংহিতার এক শ্লোকেরও উল্লেখ রয়েছে, যা বর্তমানে মনুসংহিতার ২য় অধ্যায়ের ১৩৬ নং শ্লোক হিসেবে পরিচিত। "
[Ref- x]
(ঙ) "৬৬৮ খ্রিস্টাব্দে জয়নবর্মা (পঞ্চম) ককম্বোডিয়ার রাজা হন.....এই রাজা সম্বন্ধে এক পান্ডুলিপিতে লেখা হয়েছে যে- তিনি বর্ণ ও আশ্রমকে দৃঢ়ভাবে স্থাপিত করে ভগবানকে তুষ্ট করেন।"
[Ref- xi]
(চ) বালীদ্বীপ (ইন্দোনেশিয়া) এর সমাজে আজও বর্ণ ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে। সেখানে আজও বৈদিক বর্ণব্যবস্থার প্রভাবে ব্রাহ্মণদের 'দ্বিজাতি' তথা শূদ্রদের 'একজাতি' নাম প্রচলিত রয়েছে। এই নাম মনু ১০/৪ নং শ্লোকে দিয়েছেন। সেখানে শূদ্রদের সাথে কোনো ভেদাভেদ বা অস্পৃশ্যতা মতো ব্যবহার করা হয় না। এটাই মনুর বর্ণব্যবস্থার বাস্তবিক রুপ ছিল।
[Ref- xii]
[ আরো জানতে পড়ুন-
"বিশুদ্ধ মনুসংহিতা-ডাঃ সুরেন্দ্র কুমার
ও " মনু ধর্মশাস্ত্র- এ সোশ্যাল এন্ড হিস্টরিকাল স্টাডি" ]
তথ্যসূত্রঃ
- (i) MANU DHARMA SASTRA : A sociological and historical study (p - 232-233)
- ii) The History of Sanskrit Literature (p- 445)
- iii) The History of Sanskrit Literature (p- 404)
- iv) Beyond Nihilism Nietzsche, Without marks (p - 41)
- v) The will to power, Vol 1, Book 2, (P - 126)
- vi) धर्मशास्त्र का इतिहास (Vol 1, P- 47)
- vii) दक्षिणी-पूर्वी और एशिया में भारतीय संस्कृति (p- 47)
- viii) ঐ (p- 254)
- ix) ঐ (p- 257)
- x) ঐ (p- 198)
- xi) ঐ (p- 149)
- xii) ঐ (p- 19, 114)
ছবি সহ তথ্যসূত্রঃ https://docs.google.com/document/d/1jKgxPgCq8vFoSYNR4S90Bu3Hcv6Coq-7/edit?usp=drivesdk&ouid=104174012361186469312&rtpof=true&sd=true
🖋️ আবির কুন্ডু
(চট্টগ্রাম শাখা)
বাংলাদেশ অগ্নিবীর
সত্য প্রকাশে নির্ভীক সৈনিক
0 মন্তব্যসমূহ