ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার মন্দির ভাঙচুর

ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার মন্দির ভাঙচুর
ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার মন্দির ভাঙচুর


অভিযোগ উঠেছে, ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের পর ‘দখলদার’ ওয়াহেদ মন্দিরটি ভেঙেছেন।


হবিগঞ্জ প্রতিনিধি, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, Published : 29 Aug 2024, 07:03 PM, Updated : 29 Aug 2024, 08:14 PM


ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার শেষচিহ্ন হিসেবে টিকে থাকা জীর্ণ মন্দিরটিও রাতের আঁধারে ভেঙে ফেলা হয়েছে।

হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার ২ নম্বর উত্তর-পশ্চিম ইউনিয়নের বিদ্যাভূষণ পাড়া গ্রামে ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি অনেক দিন ধরেই দখল করে আছেন ওয়াহেদ মিয়া নামে রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত এক ব্যক্তি।

অভিযোগ ওঠেছে, ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের পর সর্বত্র যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে, তখনই আগে থেকে দখল করে রাখা জীর্ণ মন্দিরটি ভেঙে ফেলার সুযোগ নেন ওয়াহেদ ও তার পরিবারের সদস্যরা।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) প্রভাংশু সোম মহানকে বিষয়টি অবহিত করা হলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, 

“এ বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ওয়াহেদ বছর দুয়েক আগেও আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ছিলেন। তবে তার বড় ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা সবসময়ই আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আছেন। ফলে সরকার পরিবর্তন হলেও বানিয়াচংয়ের বিদ্যাভূষণ পাড়ায় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি একটু কমেনি বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।

বাইসাইকেলে বিশ্ব ভ্রমণের জন্য খ্যাত রামনাথ বিশ্বাস ছিলেন অকৃতদার। বিদ্যাভূষণ পাড়ায় তার ভাইয়ের পরিবারের সদস্যরা বাস করতেন। তিনি নিজেও এখানে থিতু হবেন বলে চলে এসেছিলেন গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে। পরে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর রামনাথ বিশ্বাস ও তার পরিবারের সদস্যরা ভারতে চলে গেলে তাদের জন্মভিটা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি খতিয়ানে চলে যায়।

সে হিসাবে এ সম্পত্তির মালিক হয় বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাসের বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছেন স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়াহেদ মিয়া ও তার পরিবার। এরপর থেকে পুরোনো বাড়িটির অনেক অংশ একটু একটু করে ভেঙে ফেলেছেন দখলদার ওয়াহেদ। বাড়িসংলগ্ন পারিবারিক মন্দিরটি ভাঙবার সাহস করেননি এতকাল, যা এবার করলেন এবং এর ফলে এখানে যে একদা একটি প্রাচীন একটি বাড়ি ছিল তার চিহ্নও মুছে গেল।



হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ায় রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার জীর্ণ মন্দিরটি ভাঙচুরের পর বুধবারেও ভাঙা ইট স্তূপ করে রাখা ছিল।
হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার বিদ্যাভূষণ পাড়ায় রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার জীর্ণ মন্দিরটি ভাঙচুরের পর বুধবারেও ভাঙা ইট স্তূপ করে রাখা ছিল।



বুধবার রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটায় গিয়ে প্রাচীন বাড়িটির শেষাংশটুকু সদ্য ভাঙার নিদর্শন দেখা গেল। ওয়াহেদ মিয়ার বসতবাড়ির সঙ্গে ঘিরে ফেলা মন্দিরটির সামনে তখনও পড়েছিল ভেঙে ফেলা প্রাচীন ইট।

যদিও ওয়াহেদের দাবি, তিনি ভাঙেননি, পুরাতন ও জরাজীর্ণ হওয়ায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে বাড়িটির একাংশ ভেঙে পড়েছে।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষে তার কাছে এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে ওয়াহেদ বলেন,

“ভবনটি ভেঙে পড়ার তাৎক্ষনিকভাবে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. জিতু মিয়াকে অবহিত করা হয়েছে।”

ইউপি সদস্য জিুত মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, 

“আমরা পূর্বে দেখেছি ভবনটির একাংশে ফাটল ছিল। তবে বৃষ্টিতে ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় ছিল না। এখন কিভাবে ভেঙেছে জানি না। ওয়াহেদ আমাকে অবগত করেছেন যে বৃষ্টিতে এমন হয়েছে।”

বিদ্যাভূষণ পাড়ার বাসিন্দা আবু ছালেক বলেন, 

“রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িটি আমরা পূর্ব থেকেই দেখে আসছি। আমাদের ধারণা, বাড়ির একাংশ ওয়াহেদ মিয়া গোপনে ভেঙে ফেলেছেন। এর আগে তার দখলে থাকা বাড়িটি সম্পর্কে সাংবাদিকরা খোঁজখবর নিতে আসলে তিনি ও তার লোকজন তাদেরকে মারধর করেন। এ নিয়ে মামলা-মোকদ্দমাও হয়েছে।”

একই গ্রামের নুরুল আমিন বলেন, 

“সম্ভবত গত ৫ অগাস্ট রাতে ওয়াহেদ মিয়া ভাঙচুরের কাজটা করেছেন। নিজে ও তার ভাইবেরাদর প্রভাবশালী হওয়ায় আশপাশের হিন্দু-মুসলিম কেউই বাধা দেয়নি।”

ওই গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা আমির মিয়া বলেন, 

“তিনি দীর্ঘদিন ধরে বাড়িটি দখলে নিয়ে রেখেছেন। শুনেছি, এখন রামনাথের ভিটাবাড়ি বিক্রির পাঁয়তারা করছেন তিনি। তাই সবকিছু ভেঙে সাফ করতেছেন।”

ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য্যের আঁকা রামনাথ বিশ্বাসের এ ছবিটি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত।
ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য্যের আঁকা রামনাথ বিশ্বাসের এ ছবিটি আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে সংগৃহীত।



এর আগে ২০২১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাসের বাড়িতে গিয়ে অবৈধ দখলদার ওয়াহেদ ও তার লোকজনের হামলার শিকার হন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট এডিটর রাজীব নূরসহ চার সাংবাদিক। আহত সাংবাদিক রাজীব নূর, বানিয়াচং প্রেসক্লাব সভাপতি মোশাহিদ মিয়া, হবিগঞ্জ সমাচারের স্টাফ রিপোর্টার তৌহিদ মিয়া ও দেশসেবার বানিয়াচং প্রতিনিধি আলমগীর রেজা বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল তখন।

এ ঘটনায় সাংবাদিক তৌহিদ মিয়া বাদী হয়ে দখলদার আব্দুল ওয়াহেদ, তার ছেলে ওয়ায়েছ, ওয়ালিদ ও ওয়াসিফের বিরুদ্ধে বানিয়াচং থানায় মামলা করেন। মামলা ওয়াহেদ ও তার এক ছেলে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। বর্তমানে আসামিরা জামিনে রয়েছেন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,

 “রামনাথ বিশ্বাস আমাদের আবেগের বিষয়। একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে ওনার বাড়িটি দখলে নেয়ার পাঁয়তারা করছে। দখল পাকাপোক্ত করার জন্য বাড়িটির অবশিষ্টাংশও ভেঙে ফেলা হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই, দ্রুত বাড়িটি উদ্ধার করে রামনাথ বিশ্বাসের নামে একটি জাদুঘর এবং ভ্রমণবিষয়ক বইয়ের পাঠাগার তৈরির।”

ভূ-পর্যটক রামনাথ বিশ্বাস ১৯৩১ থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত চারটি মহাদেশ ভ্রমণের কারণে খ্যাতি পান। পরে তিনি তৃতীয়বারের মতো ভ্রমণে বেরিয়ে ১৯৪০ সালে দেশে ফেরেন। এতে তিনি ভ্রমণ করেন প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার বর্গমাইল। দেশভাগের আগে তিনি মূলত কলকাতায় থাকলেও নিয়মিত বানিয়াচংয়ে আসতেন। পরে তার ভাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতে চলে গেলে আর এখানে আসা হয়নি রামনাথের।

তাই রামনাথের জন্মভিটা অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে সরকারি খতিয়ানে চলে যায়। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে রামনাথ বিশ্বাসের বসতভিটার কিছু অংশ উদ্ধার করা হলেও ওয়াহেদ আবার তা দখল করে নেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ