তরুণ সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান আজাদ |
ধর্মানুভূতির অর্থনীতি, উপমহাদেশের অপরাজনীতি ও বাংলাদেশী ধার্মিকদের কর্তব্য - আখতারুজ্জামান আজাদ
জাতি হিশেবে আমরা বরাবরই যারপরনাই কৌতূহলী, অসম্ভব অত্যুৎসাহীও। এ দেশের কোথাও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি হলে কাজকর্ম ফেলে অসংখ্য লোক দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে তা দেখতে থাকে, পথিমধ্যে ছিনতাইকারী ধরা পড়লে জামার হাতা গোটাতে-গোটাতে লোকজন সেখানে তীরের বেগে ছুটে যায় নিজেও দু-এক ঘা মেরে দীর্ঘদিনের প্রহারতৃষ্ণা পূরণ করতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ সেরেফ ভাত খাওয়ার ভিডিও প্রকাশ করলে এ দেশের মানুষ ঘণ্টাব্যাপী তা দেখতে থাকে এই আশায়— অন্তত শেষ মিনিটে এসে খাদক অদ্ভুত কিছু করে বসবে। কার মাসিক উপার্জন কত, কার কন্যা রাতের আঁধারে কার পুত্রের হাত ধরে এলাকা ছেড়ে পলায়নপূর্বক গোপনে বিয়ে করেছে, বিয়ের দীর্ঘদিন পরও বাচ্চা-না-নেওয়া বা বাচ্চা-না-হওয়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে 'সমস্যা' কার— এমন একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে যেখানে বাঙালির অত্যুৎসাহের অন্ত নেই; সেখানে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের মতো চমকপ্রদ চাঞ্চল্যকর ব্যাপারে বাঙালির যে আকাশচুম্বী আগ্রহ থাকবে— এ নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ধর্মানুভূতি-জনিত ঘটনায় উত্তুঙ্গ উত্তেজনা আছে, সাঁইসাঁই শিহরণ আছে, আছে 'যখন-তখন যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে' প্রজাতির টানটান টনিক। এই প্রজাতির ঘটনায় বাদ-জুমা সমাবেশের বজ্রকঠিন ব্যাপার আছে, জ্বালাময়ী স্লোগান তোলার সুনীল সুবিধা আছে, মুহুর্মুহু মিছিলের সুখকর সুযোগ আছে, সম্পূর্ণ বিনা বাধায় অপছন্দের ব্যক্তিবর্গের বাড়িঘর-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-উপাসনালয়ে অগ্নিসংযোগ করার লেলিহান লাইসেন্স আছে, আছে 'যাচ্ছেতাই করে ফেলার পরও বিচার হবে না' শীর্ষক দায়মুক্তি অধ্যাদেশ। এতসবের সন্নিবেশ আছে যেখানে, সেখানে বাঙালি পিলপিল পায়ে পইপই করে হাজির হবে না— এ অসম্ভব।
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কথিত ঘটনায় এই যে 'তৌহিদি জনতা' মুহূর্তের মধ্যে হাজির হয়ে যায়, এরা একেকজন একেক উদ্দেশ্যে আসে। কেউ আসে ভিন্ন ধর্মের অপছন্দের ব্যক্তিবর্গকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করতে, কেউ বা আসে 'বিধর্মীদের' বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট চালিয়ে নিজের ভাগ্যপরিবর্তন করতে, কারো-কারো উদ্দেশ্য থাকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদেরকে ধর্ষণ। ঘটনায় ধর্মের প্রলেপ থাকলে সরকার নিষ্ক্রিয়তা প্রদর্শন করবে, প্রশাসন নীরবতা পালন করবে, বিচারবিভাগ জগদ্দল পাথরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে— এমন ব্লাংক চেক পাওয়ার কারণেই স্থানীয় সন্ত্রাসীরা দিনের পর দিন অপেক্ষায় থাকে এলাকার ধর্মানুভূতিবৃক্ষে কখন একটা ফল ধরবে, সেই ফল টুপ করে পেড়ে কখন খপ করে খেয়ে ফেলা যাবে। তৌহিদি জনতার বেশ ধরে থাকা সবার উদ্দেশ্যই যে লুটপাট-অগ্নিসংযোগ-ধর্ষণ, তা নয়; এসব সমাবেশে কেউ-কেউ আসে সেরেফ 'উৎসুক দর্শক' হিশেবে, কেউ আসে এ রকম সমীকরণ নিয়ে— 'এই সমাবেশে অংশগ্রহণের উছিলায় রোজহাশরে পরম পরওয়ারদিগার হয়তো সকল গুনাহ্খাতা মাফ করে হাতে জান্নাতের টিকেট ধরিয়ে দেবেন।' এদের অধিকাংশই ব্যক্তিজীবনে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করে না এবং হরেক কিসিমের অনিয়ম, দুর্নীতি ও পাপাচার-অজাচারে নিমজ্জিত। বিধর্মীদের বাড়িতে অন্তত একটা ঢিল ছুড়তে পারলেও জাহান্নামের আগুন থেকে সেই পবিত্র ঢিলের উছিলায় রেহাই পাওয়া যেতে পারে— বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীর মনেই এ ধরনের চিন্তা কাজ করে।
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কথিত ঘটনায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালানোর পেছনে কাজ করে দুটো জিনিশ— অর্থনীতি ও রাজনীতি। লুটপাটের অর্থনীতির ব্যাখ্যা এই নিবন্ধে ইতোমধ্যেই দেওয়া হয়ে গেছে। আরো 'অর্থনীতি' জড়িয়ে আছে এই ধর্মানুভূতির সাথে। গোটা একটা সংখ্যালঘু-পাড়ায় একবার হামলা করতে পারলে সেই পাড়ার সংখ্যালঘুরা পরবর্তী কয়েক দশকের জন্য সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের পদাবনত হয়ে থাকে, রাজনীতি বা ব্যবসাবাণিজ্যে সংখ্যাগুরুদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়ার সাহস পায় না, ফলে সংখ্যাগুরুরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়। নিয়মিত হামলা চালাতে পারলে সংখ্যালঘুরা আত্মরক্ষার খাতিরে পূর্বপুরুষদের হাজার বছরের আদিনিবাস ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়ে ভিনদেশে পাড়ি জমায়, দেশ ছাড়ার আগে তাদের কেউ-কেউ নামমাত্র দামে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে যেতে বাধ্য হয়, কেউ বা বিক্রি না করেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সেরেফ জান নিয়ে পালিয়ে যায়; আর এই পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখল করে নেয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা, যাদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সে দলের স্থানীয় নেতারা সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের সুবিধাভোগী। অর্থাৎ ধর্মানুভূতিতে আঘাতের মামলায় আপাতদৃষ্টিতে 'তৌহিদি জনতার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ' থাকলেও বাস্তবতা উলটো। এইসব সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। সাধারণ মানুষের আবেগকে পুঁজি করে যারা এ ধরনের হামলার ছক কষে; তারা ঐ সাধারণদের মতো নির্বোধ না, লাঠি না ভেঙে সাপ মারার মাধ্যমে তারা অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক পরিমাণ লাভবান হয়, আর হামলার পর নির্বোধ সাধারণরা বাড়ি ফেরে 'এই উছিলায় আখেরাতে পানাহ্ পাব' ভাবতে-ভাবতে।
ধর্মানুভূতিতে আঘাতের গুজব রটিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি গভীরভাবে কাজ করে। সরকারগঠনের জন্য সংখ্যালঘুদের ভোট বেশ গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিশেবে কাজ করে এই উপমহাদেশে। কোনো এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘবদ্ধ হামলা হলে এর ফল হয় বহুমুখী। এই হামলা নিয়ে রাজনীতিও হয় নানামুখী। হামলার পর ভীতসন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুদেরকে প্রভাবিত করা যায় সহজেই। একদল এদেরকে বলতে পারে— আমরা ক্ষমতায় এলে তোমাদেরকে নিরাপদ রাখব, অতএব তোমরা আমাদেরকে ভোট দাও; আরেক দল বলতে পারে— আমাদের বিদায় হলে অন্য সরকারের আমলে তোমাদের অবস্থা আরো করুণ হবে, অতএব পরবর্তী নির্বাচনেও তোমরা আমাদেরকেই ভোট দিতে বাধ্য। দিনের শেষে— কোনো সরকারের আমলেই সংখ্যালঘুরা ভালো থাকে না, সংখ্যালঘু-নির্যাতনে কেউই কারো চেয়ে কম যায় না, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পত্তিদখল ও নারীসম্ভোগে কোনো দলেরই সবিশেষ অনীহা নেই। উল্লিখিত দুই বস্তু উপমহাদেশে সর্বদলীয় হালাল খাদ্য। কংগ্রেস-বিজেপি আওয়ামি লিগ-বিএনপি নির্বিশেষে সব সরকারের আমলেই ভারত-বাংলাদেশের সংখ্যালঘুপাড়া থেকে ভেসে আসে সেই চেনা আর্তনাদ— 'বাবারা, তোমরা একজন-একজন করে আসো; আমার মেয়েটা খুব ছোট।'
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার পেছনে কেবল জাতীয় রাজনীতিই কাজ করে না, ক্ষেত্রবিশেষে কাজ করে আন্তর্জাতিক রাজনীতিও। একটি দেশের কোনো এলাকায় সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হলে এর 'সুফল' প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক দলগুলোও ভোগ করে। প্রতিবেশী দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হলে রাজনৈতিক দলগুলো নিজ দেশের জনগণকে বলতে পারে— 'পার্শ্ববর্তী দেশে আমাদের সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন হচ্ছে, আমাদেরকে ভোট দিয়ে বিজয়ী করলে আমরা ঐ দেশের সরকারকে চাপ দিয়ে নির্যাতন বন্ধ করাব।' বিভিন্ন দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলো আপাতদৃষ্টিতে পরস্পরবিরোধী মতাদর্শ প্রদর্শন করলেও ভেতরে-ভেতরে তারা পরস্পরের স্বার্থ বাস্তবায়নেই কাজ করে। এক দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হলে অন্য দেশের উগ্র সাম্প্রদায়িক দলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই একটা সুবিধা পেয়ে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের কোনো দেশে সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু-নির্যাতন হঠাৎ করেই বেড়ে যায়। এই বেড়ে যাওয়ার পেছনে সূক্ষ্ম সুগভীর রাজনীতি থাকে, যা শাদা চোখে দেখা বা বোঝা মুশকিল। বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দাসংস্থা বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও, ক্ষেত্রবিশেষে, দাঙ্গা বাধানোর সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করে বলে জনশ্রুতি আছে। ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশ শাসনই করেছিল 'ডিভাইড অ্যান্ড রুল' নীতি অবলম্বনে, অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ইচ্ছেকৃতভাবে বিবাদ সৃষ্টি করে রেখে; যাতে উপমহাদেশবাসী পরস্পরের বিরুদ্ধে হানাহানি করেই ক্লান্ত হয়ে যায় এবং শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের শক্তি আর না পায়। অর্থাৎ পৃথিবীর কোথাও সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হলে ধরে নিতে হবে— এর জাল কেবল সংশ্লিষ্ট দেশের ভেতরেই সীমিত নয়, এই জাল বরং বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত; কলকাঠি নাড়া হচ্ছে এমন এক স্থান থেকে, যে স্থান গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া কেউই চেনে না, যে ষড়যন্ত্রের নকশা উন্মোচিত হবে না মহাপ্রলয়ের আগমুহূর্তেও। সাম্প্রদায়িক হামলার সাথে বিশ্বরাজনীতি এভাবেই অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
২০২২ সালের মার্চে মুনশিগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানশিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল— ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে তিনি ইসলামবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন। তদন্তে দেখা গিয়েছিল ভিন্ন ব্যাপার। কিছু ছাত্র ক্লাসে এলোপাতাড়ি প্রশ্ন করে হৃদয় মণ্ডলকে সুপরিকল্পিতভাবে বাধ্য করেছিল এমন কিছু বাক্য উচ্চারণ করতে, যাতে রঙ-বেরঙের প্রলেপ মাখিয়ে বলা যায় তিনি ইসলাম অবমাননা করেছেন। ছাত্রদের দুরভিসন্ধি সফল হয়েছিল, দুরভিসন্ধির ফলস্বরূপ হৃদয়কে কারাভোগ করতে হয়েছে, হয়েছিল তার চাকরি চলে যাওয়ার উপক্রমও। তদন্ত কমিটি সঠিক সময়ে সঠিক তথ্য প্রকাশ করায় হৃদয় কারাগার থেকে বেরোতে পেরেছিলেন, স্বপদে ফিরে যেতে পেরেছিলেন, সর্বোপরি প্রাণ বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই ঘটনায় একটা মারাত্মক ব্যাপার লক্ষণীয়— ধর্মানুভূতিতে আঘাতের নাটক মঞ্চস্থকরণের নেতৃত্ব দিতে এখন আর শাদা ধবধবে দাড়িওয়ালা জোব্বাধারী কোনো বৃদ্ধ মওলানাকে লাগছে না, লাগছে না মসজিদ-মাদ্রাসার মাইক থেকে যুদ্ধের ঘোষণা কিংবা জুমা-পরবর্তী মিছিলও। এখন তোরো-চৌদ্দ বছরের স্কুলছাত্ররাই তাদের পিতৃতুল্য শিক্ষককে নিখুঁতভাবে ফাঁসিয়ে দিতে সক্ষম। অর্থাৎ 'ধর্মানুভূতিতে আঘাত' নামক অস্ত্রটি চালানো এতই সহজ যে, শৈশব-না-পেরোনো বাচ্চাদেরকে দিয়েও এই অস্ত্র দিব্বি চালিয়ে নেওয়া যায়। যা হোক, হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ঐ ছাত্রদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন ঐ স্কুলেরই সেই বিজ্ঞানশিক্ষরা, হৃদয় মণ্ডলের কারণে যাদের কোচিংবাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। অর্থাৎ মুনশিগঞ্জের হৃদয় মণ্ডল ইশুতে ধর্ম ছিল অজুহাত মাত্র, এখানে কাজ করেছে অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
ভারতীয় জনতা পার্টির নেত্রী নূপুর শর্মা সম্প্রতি ইসলাম অবমাননা করেছেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে। নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের এক হিন্দু ছাত্র ফেসবুকে নূপুর শর্মার পক্ষে কথা বলায় কলেজটির অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করে কিছু মুসলমান ছাত্র (ঘটনাকাল জুন ২০২২)। নালিশের পরপরই রটে যায়— অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস ঐ হিন্দু ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ঘটনাস্থলে জেলাপ্রশাসক ও পুলিশ সুপার উপস্থিত হওয়ার পরও 'ক্ষুব্ধ তৌহিদি জনতা' স্বপন কুমারকে জুতার মালা পরিয়ে কলেজ থেকে বের করে দিয়েছে। এখানে লক্ষণীয় হলো জেলাপ্রশাসক ও পুলিশ সুপারের উপস্থিতি। জেলাপ্রশাসক একটি জেলার নির্বাহী প্রধান, তার হুকুম ছাড়া বা তার অগোচরে জেলায় গাছের একটা পাতাও ঝরে না। পুলিশ সুপারও জেলায় অনেকটা নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এই দুই পরাক্রমশালীর উপস্থিতিও 'তৌহিদি জনতা'কে নিবৃত্ত করতে পারেনি, দুই মহাশক্তিধর মিলেও উন্মত্ত অসুরদেরকে মোকাবেলা করতে পারেননি, নিশ্চয়ই এ ব্যাপারে তারা সরকারের সবুজসংকেত পাননি। অর্থাৎ ধর্মানুভূতিতে আঘাত-জনিত অস্ত্রটি এখন এতটাই শক্তিশালী যে, এই অস্ত্রের খেলা এখন জেলাপ্রশাসক আর পুলিশ সুপারকেও চেয়ে-চেয়ে দেখতে হয়। যা হোক, আলোচ্য অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানোয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন এই কলেজেরই আরেক শিক্ষক, যিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের ইউনিয়নপর্যায়ের একটি ইউনিটের সভাপতিও। সেই শিক্ষক দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই অধ্যক্ষকে অপসারণ করে নিজেই অধ্যক্ষ হতে। দীর্ঘ চেষ্টায়ও বাগে না পেয়ে অধ্যক্ষকে তিনি ধর্মের কার্ডে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন, জুতার মালা পরিয়ে মানসিকভাবে চিরতরে পঙ্গু করে দিয়েছেন, অধ্যক্ষ লজ্জায় দেশত্যাগ করলে তিনিই বসতে পারবেন অধ্যক্ষের চেয়ারে। অর্থাৎ স্বপন কুমার ইশুতেও ধর্ম ছিল দাবার গুটি মাত্র, এই জুতার মালার পেছনে কাজ করেছে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। ধর্ম-রাজনীতি-অর্থনীতি— এই তিনই মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে নড়াইলের স্বপন কুমারকে পরানো জুতার মালায়।
নওগাঁর দাউল বারবাকপুর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমোদিনী পালের ঘটনাও অনেকটা স্বপন কুমারের মতো (ঘটনাকাল এপ্রিল ২০২২)। সেখানেও কাজ করেছিল শিক্ষকরাজনীতি, তথা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। আমোদিনী পালের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তিনি ছাত্রীদেরকে হিজাব পরতে বাধা দিয়েছেন। অভিযোগ, স্বভাবতই, বানোয়াট ছিল। ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক ধরণীকান্ত বর্মণ অবসরগ্রহণের দ্বারপ্রান্তে ছিলেন। তার অবসরের পর, প্রধান শিক্ষক হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে ছিলেন আমোদিনী। কিন্তু ধরণীকান্ত চাইছিলেন না আমোদিনী প্রধান শিক্ষক হন, অন্য কেউ প্রধান শিক্ষক হোক— এই ছিল তার চাওয়া। স্কুলে যে উন্নয়নকার্যক্রম চলছিল, আমোদিনী প্রধান শিক্ষক হলে ধরণী কোনো কমিশন পাবেন না— এই আশঙ্কা থেকেই ধরণী অন্য কাউকে প্রধান শিক্ষক বানাতে চেয়েছিলেন। আমোদিনীকে কোনোভাবেই দমাতে না পেরে ধরণী একপর্যায়ে ধর্মের কার্ড খেলেছেন, সাময়িকভাবে বিজয়ী হয়েছেন, শেষতক আমোদিনীরই দায়েরকৃত মামলায় কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো— ধর্মানুভূতিতে আঘাতের আলোচ্য ঘটনার শিকারও একজন হিন্দু; যিনি আঘাতের নাটক সাজিয়েছেন, তিনিও একজন হিন্দু। অর্থাৎ বাংলাদেশে ধর্মানুভূতি অস্ত্রটি এখন এতটাই চমকপ্রদ, অব্যর্থ ও বিচিত্র হয়ে উঠেছে যে; এখন অমুসলমানরাও অমুসলমানদেরকে ঘায়েল করার জন্য ইসলাম অবমাননার নাটক মঞ্চস্থ করে চলছে!
২০১৩ সালের ৫ মে কথিত আট দফা দাবি নিয়ে চট্টগ্রাম-ভিত্তিক ধর্মীয় সংগঠন হেফাজতে ইসলাম মতিঝিলে যে সহিংস তাণ্ডব চালিয়েছিল, এর পেছনে ধর্ম ছিল সেরেফ অজুহাত। ঐ তাণ্ডবের পেছনে রাজনীতি ছাড়া কিছুই ছিল না। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অপরাধে জামায়াত-নেতা আবদুল কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে ঐ বছর যে গণজাগরণ হয়েছিল, তা প্রতিহত করতেই জামায়াত-বিএনপির ক্রীড়নক হিশেবে হেফাজত সেদিন মতিঝিলে এসেছিল। মাদ্রাসার অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেদেরকে হেফাজত-নেতারা এটা বলে এনেছিলেন যে, মতিঝিলে বড় একটা মাহফিল আছে, বড় হুজুর (প্রয়াত আহমদ শফি) সেখানে বয়ান করবেন। সেদিনকার সহিংসতায় হেফাজতিদের আক্রমণে একাধিক পুলিশসদস্য যেমন নিহত হয়েছিলেন, পুলিশের পালটা-আক্রমণে হেফাজতেরও কিছু কর্মী কিংবা কিছু মাদ্রাসাছাত্র সেদিন নিহত হয়েছিলেন। নিহত কর্মীরা মৃত্যুকালে নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছিলেন যে; তারা ধর্মযুদ্ধে নিহত হয়েছেন, ইসলামের জন্য শহিদ হয়েছেন, পরপারে বেহেশতে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা হলো— সেদিনকার সংঘাত মোটেই ধর্মীয় ছিল না, ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদেরকে বাঁচাতেই জামায়াত-বিএনপির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ছিল হেফাজতে ইসলামের সেদিনকার লক্ষ্য। সেই সংঘাতে কিংবা পরবর্তী কোনো সংঘাতে কোনো ধর্মীয় নেতা বা কোনো নেতার সন্তান জীবন দেননি; জীবন দিয়েছেন মাদ্রাসার সাধারণ ছাত্ররা, যাদের জীবনের মূল্য ধর্মীয় নেতাদের কাছে হিমাঙ্কেরও নিচে। সাধারণ ছাত্রদেরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে ধর্মীয় নেতাদের কেউ-কেউ ঘটনাস্থল থেকে গোপনে সটকে পড়েন, সরকারের সাথে গোপনে সমঝোতা করে মোটা অঙ্কের টাকা পান, দেশ অস্থিতিশীল করার পুরস্কার হিশেবে বিরোধীদলের কাছ থেকেও পান অগুনতি অর্থ। বেঘোরে জীবন দেওয়ার আগে মাদ্রাসার হতভাগা ছেলেগুলো জেনেও যেতে পারে না— ওরা কতিপয় ধর্মব্যবসায়ীর সেরেফ 'মাছের আধার' হিশেবে কাজ করেছে।
বাংলাদেশের জন্মের সুবর্ণ জয়ন্তী ও শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সরকার প্রতিবেশী দেশগুলোর প্রধানদেরকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ২০২১ সালের মার্চে। সেইমতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন নরেন্দ্র দামোদর মোদিও। এমন না যে, ঐ আয়োজনে ব্যক্তি মোদি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। তিনি আমন্ত্রণ পান ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিশেবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি না হয়ে অন্য কেউ হলে সেই ব্যক্তিই আমন্ত্রণ পেতেন। অত্যুৎসাহী হেফাজতে ইসলাম মোদির আগমন প্রতিহত করার ঘোষণা দিলো। হেফাজত ২০২১-এর মার্চের শেষটাজুড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় তাণ্ডব চালাল, একের পর এক সাংস্কৃতিক স্থাপনা ও সরকারি দপ্তরগুলো ছারখার করে ফেলল, আক্রমণ চালাতে লাগল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর। বিভিন্ন বাহিনীর গুলিতে সেই ঘটনায় হেফাজতের উনিশজন নিহত হলো। এর জেরে শত-শত মামলা হলো, হেফাজত ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, সংগঠনটির নেতারা এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে সকাল-বিকাল ধর্না দিচ্ছেন সাধারণ ক্ষমা পাওয়ার জন্য।
এমনও না যে, মোদি বাংলাদেশে আগে কখনও আসেননি। তিনি এ দেশে আগেও এসেছিলেন এবং তখন তার আগমনের ব্যাপারে কেউ টুঁ শব্দটিও করেনি। হেফাজত নরেন্দ্র মোদির এবারকার আগমন নিয়ে দেশে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যাতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সুবর্ণ জয়ন্তী পালিত হতে না পারে। এই সংগঠনটির অধিকাংশ নেতাই বাংলাদেশের জন্ম এখনও মেনে নিতে পারেননি, তাই মোদিকে অজুহাত হিশেবে দেখিয়ে তারা দেশকে তখন অস্থিতিশীল করেছেন। হেফাজত কাগজে-কলমে অরাজনৈতিক হলেও নরেন্দ্র মোদিকে ঠেকানোর আন্দোলন শতভাগ রাজনৈতিক ছিল, এই আন্দোলনে আন্তর্জাতিক রাজনীতি ছিল, নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক লেনদেনও ছিল। কিন্তু যে উনিশটা মানুষের জীবন ঝরে গেছে, তারা জেনে যেতে পারেননি, কখনও জানবেনও না— তাদের জীবন ধর্মযুদ্ধে যায়নি; গিয়েছে উপমহাদেশের অপরাজনীতিতে, গিয়েছে বাংলাদেশের লোভী ধর্মব্যবসায়ীদের পাতা ফাঁদে, যে ব্যবসায়ীদের কেউ-কেউ উনিশটা লাশের ওপর পা রেখে ঘটনার অব্যবহিত পরেই 'শহিদুল ভাইয়ের ওয়াইফ'-কে নিজ স্ত্রী সাজিয়ে আমোদ করতে রিসোর্টে গিয়েছেন আর ধরা খেয়ে প্রকৃত স্ত্রীকে বলেছেন— 'মাঝখান দিয়ে তুমি কিছু মনে কোরো না।'
উত্তম বড়ুয়া নামক একজন বৌদ্ধ তরুণ ইসলাম অবমাননা করেছে— এমন গুজব ছড়িয়ে ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের রামুতে বারোটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ও এই সম্প্রদায়ের চৌত্রিশটি বসতি ধ্বংস করে ফেলা হয়; পরেরদিন অগ্নিসংযোগ করা হয় উখিয়া ও টেকনাফের আরো সাতটি বৌদ্ধবিহার ও হিন্দু মন্দিরে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর তাণ্ডব চালানো হয় রসরাজ দাস নামক এক হিন্দু ইসলাম অবমাননা করেছে— এই অভিযোগে। এই রসরাজ দাস পেশায় একজন মৎস্যজীবী, সোজা বাংলায় জাইল্লা। ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে একজন জাইল্লার পক্ষে ইসলাম অবমাননা বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রীতিমতো অসম্ভব হলেও সেই ঘটনার জের ধরে নাসিরনগরের 'বিক্ষুব্ধ তৌহিদি জনতা' টানা কয়েকদিন ধরে হিন্দুদের ওপর তাণ্ডব চালিয়েছিল। টিটু রায় নামক কেউ একজন ফেসবুকে ইসলাম অবমাননা করেছে মর্মে গুজব রটিয়ে ২০১৭ সালের নভেম্বরে রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রামে যে সাম্প্রদায়িক হামলা সংঘটিত হয়েছিল, আসল ঘটনা হলো সেই টিটু রায় নিরক্ষর, ফেসবুক ব্যবহারের কোনো যোগ্যতাই তার ছিল না। গত দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় ইকবাল হোসেন নামক এক মুসলমান তরুণ রাতের আঁধারে পূজামণ্ডপে মূর্তির কোলে কোরান রেখে এসে যেভাবে কুমিল্লাকে অস্থিতিশীল করে ফেলেছিল; কক্সবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, রংপুরেও ঐ একই ঘটনা ঘটেছিল। অর্থাৎ কোনো-না-কোনো মুসলমান উত্তম-রসরাজ-টিটুদের নামে ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ইসলামবিরোধী বক্তব্য দিয়েছিল। প্রথমোক্ত তিন ঘটনার প্রতিটিতেই ক্ষমতাসীন আওয়ামি লিগের স্থানীয় নেতাদের কাউকে-কাউকে দেখা গেছে হামলায় নেতৃত্ব দিতে অথবা হামলাকারীদেরকে উৎসাহ দিতে, বিএনপি-জামায়াত-হেফাজতের নেতারাও উল্লিখিত ঘটনাগুলোয় আওয়ামি লিগের নেতাদেরকে উপযুক্ত 'সঙ্গ' দিয়েছেন। সংখ্যালঘু-নির্যাতনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা দলমত নির্বিশেষে এক ও ঐক্যবদ্ধ। অর্থাৎ বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলার এমন কোনো ঘটনা নেই; যার সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি বা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের সম্পৃক্ততা নেই।
সারমর্ম—
এত বড় নিবন্ধের পেছনে উদ্দেশ্য কী? চারিদিকে এত সরস ইশু থাকা সত্ত্বেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা খরচ করে কেন লেখা হলো এই বিরস রচনা? উদ্দেশ্য সামান্য। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের গুজব এলাকায় যখনই ছড়িয়ে পড়বে; একজন সাধারণ নাগরিককে অবশ্যই নিজের বুদ্ধি, বিবেক ও আত্মসংযমকে কাজে লাগাতে হবে। কেউ ধর্ম অবমাননা করেছে শুনলেই গড্ডলিকাপ্রবাহে গা ভাসানো যাবে না, এ সংক্রান্ত সমাবেশ-মিছিলে 'উৎসুক জনতা' হিশেবেও উপস্থিত হওয়া যাবে না, অংশগ্রহণ করা যাবে না অন্যের বাড়িঘর আক্রমণের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে— লুটতরাজে। মসজিদ-মাদ্রাসার মাইক থেকে ঘোষণা আসুক, জুমার বয়ানে ইমাম সাহেব আহ্বান জানাক, উসকানি দিক ক্ষমতাসীন বা বিরোধীদলের কোনো প্রিয় নেতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন নামী-বেনামী অ্যাকাউন্ট থেকে আসুক যবনবিরোধী যুদ্ধের ডাক— ধর্মানুভূতিতে আঘাতের ইশুতে কোনো পরিস্থিতিতেই মাঠে নামা যাবে না।
ধর্মপ্রাণ প্রত্যেক ব্যক্তিকে বুঝতে হবে— ধর্মানুভূতিতে আঘাত-জনিত বিতণ্ডায় হয় স্থানীয়, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িত; নয় কারো কোনো অর্থনৈতিক স্বার্থ বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা সম্পৃক্ত। কোনো সাধারণ মানুষই পুরো একটি সম্প্রদায়ের বাড়িঘর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার মতো বৃহৎ ঘটনা সংগঠিত বা সংঘটিত করতে পারে না। এর পেছনে জড়িয়ে থাকে বড় কোনো শক্তিশালী চক্র— যে চক্রের নির্দিষ্ট কোনো ধর্ম নেই, নৈতিকতা নেই, নেই মানবিক মূল্যবোধ; অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থই যাদের কাছে শেষ কথা। আরো লক্ষ করা গেছে— সাম্প্রদায়িক হামলায় অংশ নেওয়া অধিকাংশ লোকই বহিরাগত, স্থানীয়রা তাদেরকে চেনেই না; হামলা বাস্তবায়ন শেষে তারা দ্রুত পালিয়ে যায়, বেঘোরে ধরা পড়ে অত্যুৎসাহী স্থানীয়রা, যারা না বুঝেই ঘটনাস্থলে গিয়ে রুহানি জোশের বশে ভাংচুরে সামান্য অংশ নিয়েছিল। অর্থাৎ একেকটা সাম্প্রদায়িক হামলার পেছনে দীর্ঘদিনের ছক থাকে, নীলনকশা থাকে, থাকে টাকাপয়সার ঝনঝনানি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংখ্যালঘু কেউ সংখ্যাগুরুর ধর্মানুভূতিতে আঘাত করেছে— এমনটি শুনলেই পত্রপাঠ ধরে নিতে হবে এর পেছনে জড়িত আছে সদ্যখোলা একটি ফেইক অ্যাকাউন্ট, যে অ্যাকাউন্টটি চালাচ্ছে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়েরই কোনো নাটের গুরু। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইসলাম অবমাননার যত ঘটনা অদ্যাবধি ঘটেছে, শেষতক দেখা গেছে কোনো-না-কোনো মুসলমানই অমুসলমান নামে ফেইক অ্যাকাউন্ট খুলে গোপনে এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। ধর্মানুভূতিতে আঘাতের কথিত ঘটনায় সভা-সমাবেশে অংশ নিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ঐ চক্রকেই সহায়তা করা হয়। এসব সমাবেশে অংশগ্রহণের আগে উপলব্ধি করতে হবে— অংশগ্রহণকারীদেরকে এই স্বার্থান্বেষী চক্রটি সেরেফ ব্যবহার করছে। উল্লিখিত ধর্মব্যবসায়ীদের ডাকে সাড়া দিয়ে জীবন উৎসর্গ করে 'শহিদ' হয়ে বেহেশতে যাওয়া যাবে কিংবা 'বিধর্মীদেরকে' পিটিয়ে নেকি অর্জন করা যাবে, এমনটি ভাবার সুযোগ নেই। মনে রাখতে হবে— এ জাতীয় সংঘাতে জীবন দিলে নিহতের ঠাঁই হয় গোরস্তানে, উসকানিদাতার ঠাঁই হয় রয়েল রিসোর্টের পাঁচশো এক নাম্বার কক্ষে।
পুনশ্চ—
১৯৯২ সালে উত্তর প্রদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের হাতে বাবরি মসজিদ বিধ্বস্ত হওয়ার পর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বেধে যায়, পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশেও হিন্দুদের ওপর চলে একতরফা তাণ্ডব। এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। গোটা ভারতবর্ষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ক্ষত-বিক্ষত হলেও বাবরি মসজিদ ইশুতে পশ্চিমবঙ্গে কোনো দাঙ্গাফ্যাসাদ হয়নি। কেন হয়নি— জাভেদ আখতার নামক এক সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন— 'আমি পুলিশকে বলে দিয়েছি দাঙ্গা দেখলেই দলমত নির্বিশেষে গুলিবর্ষণ করতে।' দাঙ্গাবাজদের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বইয়ে দেওয়ার জন্য জ্যোতি বসুর এই এক হুঁশিয়ারিই যথেষ্ট ছিল। আপনার রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয় না কেন— এর উত্তরে জ্যোতি বসু ছোট্ট আরেকটা কথা বলেছিলেন, যে উক্তিটি পৃথিবীজুড়ে প্রযোজ্য— 'প্রশাসন চায় না, আমাদের রাজ্যে তাই দাঙ্গা হয় না।' এর প্রেক্ষিতে বলাই বাহুল্য— বাংলাদেশের কোনো সরকারই চায়নি দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা না হোক, বরং ইচ্ছে করেই জিইয়ে রেখেছে সাম্প্রদায়িকতার বীজ, সাম্প্রদায়িক হামলা কখনও-কখনও পাচ্ছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও। তাই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে-হচ্ছে-হবে। সাধারণ ধার্মিকরা যেন এই সুগভীর কূটচালে অংশ নিয়ে নিজেরা লাশে পরিণত না হয়, অন্যদেরকে লাশে পরিণত হতে ভূমিকা পালন না করে— সেই বার্তা দেওয়ার জন্যই এই নীরস নিবন্ধের অবতারণা।
১৭ জুলাই ২০২২
https://www.facebook.com/azadinlaw/posts/pfbid02vYotFuaQh7sij7G5bZDsx5TnXbnKovtGEdDxGYoqhS6gs5FNWbsDEaamvpvUaccdl
0 মন্তব্যসমূহ