পূর্বে বলেছিলাম যে, ভারতবর্ষে ১২ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন মঠ-মন্দির ও ছোট ছোট রাজকোষাগারে এত সোনা জমা হয়েছিল যে রাজারা আর মুদ্রা করার মত আলাদা সোনা পেত না। এ ছাড়া বর্হিবাণিজ্য বন্ধ থাকায় সোনাও আমদানী হয়নি। এখন প্রশ্ন ১২ শতকের পর ১৩ শতকে এসে বিদেশি মুসলমান শাসকরা এত সোনা পাইল কই?
ভারতবর্ষের বহিরাগত মুসলিম শাসকদের জানার জন্য ভাল উপায় হচ্ছে সেকালে বহিরাগত ঐ মুসলিম ইতিহাস লেখকদের বই পড়া। যেমন সৈয়দ গোলাম হোসেন, জিয়াউদ্দিন বারাণী, মোহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা ইত্যাদি ইত্যাদি।
এঁরা কোনো কথা চেপে রাখেনি। ভারতে বিধর্মীদের কোতল করতে হবে --নগর -গ্রাম -মন্দিরগুলো লুট করতে হবে কিন্তু হিন্দু রাজার মেয়েটা অপরূপ সুন্দরী -- তাকে হারেমে নিয়ে যাওয়ার জন্য কি করতে হবে, মন্দিরের মূর্তিটা কিভাবে লাথি দিয়ে ফেলতে হবে কিন্তু স্বর্ণমূর্তি হলে নিয়ে যেতে হবে --এ সব খোলাখুলি বলেছেন।এ সব তাঁরা আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে বলেছেন।
যেমন -বারাণী লিখেছেন, " প্রত্যেক বৎসরই সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির দুই তিনটি করিয়া পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করিত "( তারিখ- ই -ফিরুজশাহী ; পৃ. ২১৪)।
কিন্তু আপনি যদি এ কালের মুসলিম ঐতিহাসিকদের বই পড়েন --দেখবেন ঐ সব কোনো কথা নাই। মনে হবে এরা এত ভাল! কি সুন্দর রাজ্য শাসন করেছেন --কত শৃঙ্খলা! কি চমৎকার! আপনি সেকালের মূলকথাই জানতে পারবেন না।
এইবার সোনা লুটের কথা বলি।
বারাণীর কথামত সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি তার সেনাপতি ও সৈন্যদল সহ হিন্দু রাজ্য মেবার আক্রমণ করিয়া ( হিজরী সন ৭১১) কি লুট করিলেন শুনুন:
- ১. সোনা: ৯৬ হাজার মণ। মানে কম করে ৪ হাজার টন।
- (এখন গোটা ভারতে সোনা রিজার্ভ মাত্র ৭-৮ শত টন। আমেরিকার রিজার্ভ আট হাজার টন।)
- ২. মুণিমুক্তা হীরক ভর্তি: অসংখ্য সিন্দুক
- ৩. ঘোড়া: ২০ হাজার
- ৪. হাতি: ৬১২ টি
বারাণী লিখেছেন, ঐ সময়ে আলাউদ্দিন খিলজির বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক নায়েব দেবগিরি আক্রমণ করিয়া কি লুট করিলেন, শুনুন:
- সোনা রূপা মণিমুক্তা হীরা: ১৭ টি হাতি বোঝাই বস্তা।
এবার লদ্দর দেবের তেলেঙ্গা আক্রমণ করিয়া আলাউদ্দি খিলজির ঐ মালিক নায়েব কি লাভ করিলেন শুনুন:
- ১. হাতি: ১ শত
- ২. ঘোড়া: ৭ হাজার
- ৩. সোনা রূপা মণিমাণিক্য: বহু
এই সব সোনা রূপা তখন সুলতানের লোকেরা মানে আমীর সেনাপতিরা লুটের অভিযানে গিয়া "প্রত্যেকে বিশ ত্রিশ মণ এমনকি অনেকে পঞ্চাশ মণ সোনা লাভ" করিতেন। (বারাণী, ২০১২, পৃ. ২০১)
এবার মোহাম্মদ কাশিম ফিরিশতা (জ.১৫৭০) নামে আর এক মুসলিম লেখকের "ভারতের মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস" (১৫৯৬ ) নামক গ্রন্থ থেকে সোনা লুটের কথা বলি।
এই লেখক পূর্বরচিত নানা গ্রন্থ ঘাটিয়া ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা করেন।
এই লেখক কাস্পিয়ান সাগর এলাকার লোক। নানা ঘাটের পানি খাইয়া গজনী আসেন।
ফিরিশতা লিখেছেন -- গজনীর অধিপতি সুলতান মাহমুদ 1008 খৃষ্টাব্দে ভারতের নগরকোট আক্রমণ করেন।এবং 'ভীমদূর্গ' থেকে কি লুট করেন শুনুন:
- ১. সোনা: ৭ লক্ষ দিনার
- ২. সোনা+রূপার থালা: ৭ শত মণ
- ৩. খাঁটি সোনার পিণ্ড: ২ শত মণ
- ৪. রূপার বাট: ২ হাজার মণ
- ৬. মণিমুক্তা হীরক: ২০ মণ ( গ্রন্থ ঐ,পৃ.৬৪ )
ফিরিশতার মতে সুলতান মাহমুদ ১০১৭ খৃষ্টাব্দে ভারতের মথুরা নগরী আক্রমণ করেন যা দিল্লীর অধীন। কি লুট করলেন শুনুন:
- ১. স্বর্ণ মুদ্রা + রৌপমুদ্রা: ২০ কোটি
- ২. হাতি: ৩৫০টি
- ৪. বন্দি: ৫৩০০০ জন মানুষ
- ৪.মণিমুক্তা: অসংখ্য মানে বহু
মাহমুদ ১০২৪ খৃষ্টাব্দে সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেন। কি লুট করেন শুনুন:
- ১. সোনার শিকল: ১টা : ওজন: ২০০ মণ।
- ২. মণিমুক্তা হিরা: অসংখ্য
- ৩. "এই মন্দিরে যে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও রত্ন সুলতান মাহমুদ পেয়েছিলেন জগতে কোনো রাজার ভাণ্ডারে এত ছিল না"। (গ্রন্থ -ঐ ; পৃ ৭৮)
আমরাও জানি সোমনাথ মন্দির জগতের রত্নভাণ্ডার ছিল।
এই ভাবে বিদেশি মুসলমানরা ভারতবর্ষের লক্ষ লক্ষ মঠ-মন্দির লুট করিয়া স্বর্ণের হিমালয় গড়িয়াছিলেন।
আমি কেবল ২% লুটের পরিসংখ্যান দিলাম।
ভারতে বিদেশি মুসলিম শাসনের অবসানে সেই লুট করা এত সোনা গেল কই?
এবার বলি -সুলতান মাহমুদ সমস্ত সোনা লুট করিয়া সঙ্গে লইয়া ভারত ত্যাগ করিয়া চলিয়া যান। তাঁর রাজ্য খোরাসান বোখারা গজনী সেই স্বর্ণের ভাগ পায়। আর আমীর ওমরাওরা যে সোনা পান, তা ভারতের বাইরে নিজের এলাকায় নিয়ে যান। এইভাবে ভারতবর্ষের সোনা পাচার হইয়া যায়। সুলতান মাহমুদের মত নাদির শাহও ভারত লুট করে অপরিমেয় স্বর্ণ ভারতের বাইরে নিয়ে যান তথা পাচার করেন।
এবার আলাউদ্দিন খলজি এত স্বর্ণ কি করেন --তা বারাণীর লেখা হইতে বলি --
"সুলতান মাহমুদের সমগ্র রাজত্বকাল ব্যাপিয়া যে সকল গণ্যমান্য লোক, বিশেষজ্ঞ, জ্ঞানী, গুণী, সম্ভ্রান্ত বংশীয় ব্যক্তি ও দূর্ঘটনায় পতিত অভাবগ্রস্তরা খোরাসান, ইরাক, মাওরায়ান্নিহার খোওয়ারজম্, সিসস্তান, রায়, মিশর, দামেস্ক প্রভৃতি স্থান হইতে তাঁহার দরবারে সাহায্য ও ধনসম্পদের লাভের আশায় উপস্থিত হইয়াছেন, তাহারা সকলেই যথেষ্ট পরিমাণ তাহা লাভ করিয়াছেন। তাঁহার রাজত্বের শেষের দিকে মোগলদের বহ গণ্যমাণ্য আমীর, লাখী ও হাজারী সর্দার, সম্মানিত মহিলা এবং সম্ভ্রান্ত বংশীয় লোক সুলতানের দরবারে ধনপ্রাপ্তি ও চাকুরীলাভের আশায় উপস্থিত হইয়াছেন। তাহাদের অনেকেই সুলতানের খেদমতে অবস্থান করিয়াছেন; আবার অনেকেই লাখ-লাখ তঙ্কা, বহু স্বর্ণ রৌপ্যের পাত্র, রত্নমাণিক্য, জরির পোষাক ও বহুমূল্য ঘোড়ালাভ করিয়া ফিরিয়া গিয়াছেন।"( পৃ. ৩৬৩)।
মানে ভারতের বাইরে চলে গিয়েছেন আর এই ভাবে ভারতের সোনা পাচার হইয়া যায়।
আপনারা যদি এই সব বিদেশি মুসলমান সুলতানদের সেনাপতি আমীর ওমরাও উজির কাজী নায়েব প্রভৃতি উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের সকলের নাম ধাম মানে জন্মভূমির খোঁজ নেন, দেখবেন উহারা ঐ ইরান ইরাক সিরিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে থেকে আগত। সেকালে তাঁরা সোনাদানা-টাকা পয়সা সব তাঁদের দেশে পাঠাইত। আর যাওয়ার সময় মণ মণ সোনা লইয়া যাইত। এই ভাবে ভারতের সোনারূপা পাচার হইয়া যাইত। কয়েক শ' বছর ধরে এই পাচার প্রক্রিয়া চলে। উচ্চ পদস্থ লোকদের সেকালে ট্যাকস্ লাগত না। ভারতের এই লুটকৃত স্বণের্র ইতিহাস এখনো পরিপাটিভাবে লেখা হয়নি। বহু সহস্র মন্দিরের লুটকৃত সোনার পরিমান জানলে তার মূল্য ৪৫ ট্রিলিয়ন অপেক্ষা বেশি বই কম হবে না।
একটা কথা বলা দরকার-- রাজদবারবারের কেবল উজির নাজির আর উচ্চ পদস্থ লোকদের হাতেই থলে ভরা সোনা রূপা থাকত।
এমনকি বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ (১৭০০ খৃ.) -র জামাই সুজাউদদৌলা দরবারে সেই সুদুর মধ্যপ্রাচ্য থেকে চাকরির আশায় এসেছিলেন আলীবর্দী খাঁ ও তার ভাই হাজী আহমদ। চাকরি পেয়েছিলেন ১০০ টাকা বেতনে। এর থেকে প্রমাণ হয় --সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে লোকও জানতো --ভারতবর্ষ ছিল সোনারূপা মণিমাণিক্যে দেশ।
খ্রিষ্টীয় ১২০০-১৭০০ পর্যন্ত বহু আমীর ওমর উজির বড় বড় হুজুর ভারতে থাকেননি। ভারতে এসেছেন আর পরে চলে গিয়েছেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন বহু ধনসম্পদ। এ ছাড়া ব্যবসায়ী বণিকরা তো আছেই।
এইভাবে দেখা যায়, ভারতে বিদেশি মুসলিম শাসনের শেষদিকে তথা বৃটিশ আমলে স্বর্ণমুদ্রা করার মত আর সোনা নেই। বৃটিশরা রৌপমুদ্রাই চালু করে। সখের হিসাবে কিছু স্বর্ণমুদ্রা চালু করে বড় মানুষদের কিছু উপঢৌকন দেওয়ার জন্য।
একটা ঘটনার কথা বলি। আমার গ্রামে (রংপুর) ১৯৮৬ সালে একটা হিন্দু জোতদার পরিবারের বাড়ির মাটির নিচে ৬ কলসি রৌপমুদ্রা পাওয়া যায়। (এতে মোট ৬৩০০ রৌপমুদ্রা ছিল।) অথচ একটাও স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়নি। ৮-১০টি রূপার মুদ্রা আমার হস্তগত হয়, -- আমি দেখি; --মুদ্রাগুলিতে নেড়ে মাথা রাজা ও রানীর ছবি।
খৃষ্টীয় ১২০০-১৬০০ পর্যন্ত বিদেশি মুসলিম শাসকরা ভারতবর্ষের হাজার হাজার মন্দির লুট করে যে সোনা হস্তগত করে তার ৮০% - ৯০% সোনাই ভারতের বাইরে পাচার হইয়া যায়। এ কালে কিছু নবাব সলিমুল্লাহর মত কিছু বিদেশি মুসলমান দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু এ আর কত।
আপনারা যদি ইতিহাস পড়েন, দেখতে পাবেন সুলতান নবাবদের দরবারে শত শত আমীর ওমরাও রা --তারা ভারতে নেই। তারা কই? -- তারা চলে গিয়েছেন। এইজন্য গোটা উত্তর ও পশ্চিম ভারত হিন্দুতে ঠাসা। আর বাংলাদেশে ঐ সব মুসলমান খুব একটা আসেনি। মীর কাসিমের পতনের পরপর অনেকে বা বেশিরভাগ অন্যত্র চলে যান।
তবে ভারতে মুসলিম শাসনের মধ্য পরেই তামার মুদ্রা চালু হতে দেখা যায়। এজন্য মোগলের শেষ তথা নবাব আমলে ভারতের সবর্ত্র টাকশাল চালু হয়। আর সিরাজের সময়েই ইংরেজরা সোনা রূপা আমদানী করে যার একমাত্র ক্রেতা জগৎশেঠ মহতাপ চাঁদ।
এই স্বর্ণময় ভারতবর্ষে বিদেশি মুসলিম শাসকরা যেভাবে ফুর্তি করে দিন পার করেছেন -তাও বারাণী বলেছেন। আমি আর সে সব বললাম না। সমস্ত রাজ্যের কর বাবদ পাঠানো টাকা সুলতানরা ফুর্তি করেই শেষ করেন।
গবেষক দেখান, মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলা থেকে বার্ষিক ৯৪ লক্ষ টাকা দিল্লীকে ট্যাকস দেন। কিন্তু তিনি রাজস্ব উঠান ১০৯ লক্ষ টাকা। (Fifth report: আব্দুল করিম; মুগল রাজস্ব ব্যবস্থা) তাহলে বাকী ১৫ লক্ষ টাকা? ধরেন ওটা মুর্শিদ কুলির পকেটে যায়।
বাংলার টাকা দিল্লী খায় আর দিল্লীর টাকা কে খায়? এর উত্তর আগে আমি দিয়েছি। আর সে আমলে প্রজারা চির দুঃখীই থেকেছে। এ দুঃখ কেমন তা জানার জন্য পড়ুন মুসলিম শাসন আমলে রচিত কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর লেখা কবিতা "ফুল্লরার বারমাস্যা দুঃখ" -এ।
সূত্র: লিংক
0 মন্তব্যসমূহ