পয়লা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতীক সম্পর্কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ - পিনাক রঞ্জন সরকার

বর্তমান সময়ে পয়লা বৈশাখ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে সাধারণ মানুষের মনোভাব দেখে নিচের কথাগুলো বলার প্রয়োজন বোধ করছি। আশা করি মানুষের মনের বেশ কিছু প্রশ্ন ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উত্তর ও সমাধান দিতে পারবো।


প্রথমেই আসি মঙ্গল শোভাযাত্রার ভাষ্কর্য/স্ট্রাকচার ও মুখোশ গুলোর প্রসঙ্গে। সাধারণ দেখা যায় লক্ষ্মীপেঁচা, রাজা-রানি, কাঠ/মাটির খেলনা ঘোড়া, হাতি, টেপাপুতুল, বাঘ, দোয়েল, সাদা কবুতর, গরু/ষাঁড় এগুলোর মোটিফের উপর মুখোশ ও ভাষ্কর্য তৈরি করা হয়। কিন্তু কেন? এগুলোই কেন? একটি একটি করে বলি-


লক্ষ্মী পেঁচা: গ্রামবাংলায় হেমন্তকালে যখন ধান পাকে তখন সেই পাকা ধানের গন্ধে পেঁচা আসে। পেঁচার আসল উদ্দেশ্য কিন্তু ধান না বরং ঐ ধান খেতে যে ইঁদুর হয় সেই ইঁদুর খাওয়া। অতএব এই পেঁচা কিন্তু কৃষকের উপকার করে। তাই একে লক্ষ্মি পেঁচা বলা হয়। এটা বলছি না যে এই প্রাণীটি আমাদের মঙ্গল করছে বা মঙ্গল বয়ে আনছে। কিন্তু এটা মানতেই হবে যে মাঠের পর মাঠ পাকা শস্য দেখে কৃষকের মনে যে আনন্দ বয়ে যায় অবস্যই তার প্রতীক এই প্রাণীটি। উল্লেখ্য, এই পেঁচা কিন্তু এটা দেখে না যে কৃষক কোন ধর্মের। অর্থাৎ, এটি অসাম্প্রদায়িকতারো প্রতীক। এটা বাংলার গ্রামের একটি স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা। তাই আমাদের লোকজ শিল্পে ও সাহিত্যে এর দেখা মেলে। বাংলা ভাষার অন্যতম সাহিত্যিক কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায়ও এই পাখিটির উল্লেখ পাওয়া যায়। এমন ঘটনা এখন দেখা যায় কিনা জানা নাই। কিছু কূপমন্ডুকদের কাছে এই বিষয়গুলো হয়তো অবিশ্বাস্য, হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু বাংলার সাথে, কৃষকের সাথে এমন সম্পৃক্ততার জন্যই লক্ষ্মি পেঁচার মটিফ ব্যবহার করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়। এখানে যে পেঁচার মুখোশ দেখা যায় তা মূলত কাঠের তৈরি খেলনা পেঁচার মটিফ থেকে নেয়া। এছাড়াও টিয়া, ময়না, বক এসবের মোটিফের উপরও স্ট্রাকচার তৈরি করা হয়, কাগজের তৈরি নান্দনিক ‘তুহিন পাখি' বানানো হয়।


রাজা-রানি: মানুষের ধারণা এই রাজা-রানীর মুখোশ হয়তো এদেশের ইংরেজ আমলের অত্যাচারি জমিদার অথবা জ্বীন-পরীর চেহারা। কিন্তু এটা ভুল। এই মুখোশের চরিত্রগুলো নেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তাসের দেশ, ঠাকুরমার ঝুলির যে রাজা-রানীর চরিত্র সেখান থেকে।


টেপাপুতুল: বাংলার নরম কাদামাটি দিয়ে তৈরি খুব সহজ কৌশলে শুধু আঙুল দিয়ে টিপে তৈরি করা পুতুল। একসময় গ্রামবাংলার শিশুদের খেলার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ ছিল এটি। এই পুতুল নিয়েই তাদের কত কল্পনা, কত আয়োজন- পুতুলের বিয়ে দেওয়া, সংসার করানো, কত কি! আমাদের পুরো শৈশব জড়িয়ে থাকতো এই পুতুলের সাথে। অথচ কত নোংরা ভাবনাই না এখন জন্ম নিচ্ছে মানুষের মনে মঙ্গল শোভাযাত্রায় এই টেপাপুতুলের ভাষ্কর্যের দিকে তাকিয়ে!!


কাঠের বা মাটির তৈরি হাতি ঘোড়াও একই ভাবে একসময় যেমন আমাদের খেলার সামগ্রী ছিল পাশাপাশি এই সামান্য খেলনাগুলোই বিশ্ববাসীর কাছে বাংলার পরিচয় তুলে ধরে। কতো ছোট, সামান্য, সরল কিছু জিনিস অথচ কি গুরুদায়িত্ব!


বাঘ, দোয়েল পাখি: এগুলো যে বাংলাদেশের জাতীয় পশু ও পাখি এবং জাতীয়তাবাদের প্রতীক এটা উল্লেখ করার প্রয়োজন ছিল না কিন্তু কিছু মাথামোটা আছে যারা এর অপব্যাখ্যা দেয়, তাই বললাম। শোভাযাত্রায় ব্যবহার করা বাঘের মুখোশ গাজির পটে আঁকা বাঘ এবং কাঠের তৈরি বাঘের খেলনা পুতুলের মটিফ থেকে নেয়া।


সাদা পায়রা: বিশ্বব্যাপী শান্তির প্রতীক। তাই শোভাযাত্রাতেও এটি ব্যবহার করা হয়।


গরু, ষাঁড়: কৃষি কাজের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত দুটি প্রাণী। যন্ত্রনির্ভর কৃষিকাজ শুরুর পূর্বে কেবল বাংলার কৃষকেরাই এদের গুরুত্ব ও মায়া কতটা তা বুঝবেন। চাইলে শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পটা পড়তে পারেন। একসময় গ্রাম্য মেলা বা হাটে বিক্রি হওয়া মাটির তৈরি খেলনা ষাঁড়ের মোটিফের আদলে এসব তৈরি করা হয়।


তাছাড়া, শুরুর দিকে স্বৈরাচারী সরকার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিদ্রুপ করা ও এদের ভয়ংকর রূপ জনগণের কাছে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে কিছু ব্যঙ্গাত্মক স্ট্রাকচার তৈরি করা হয়েছিল।

এছাড়াও বাংলার ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথা, শীতল পাটি, জামদানি শাড়ি, পটচিত্র, টেরাকোটা, শখের হাঁড়ি, সরা, ইত্যাদির নকশার মোটিফ নিয়ে দেয়াল চিত্র ও অন্যান্য কাজ করা হয়। এগুলো বাঙালি জাতির নাম পরিচয় বহন করলেও অনেকে আছেন যারা তাদের পরিচয় লুকাতে চায়। তাই অনেক সময় এইসব দেয়ালচিত্র পোড়া মোবিল দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করে।

সবই নাহয় ঠিক আছে, প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুখোশ, ভাষ্কর্য এগুলো নিয়ে মিছিল কেন করা লাগবে? কারণটা খুব সহজ, বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে আমাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরা এবং এই সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য তৈরি করা। ভাষা ও জাতিগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয় তা জাতীয় জীবনে সুফল বয়ে আনতে পারে। তাই এই শোভাযাত্রাকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বলা হচ্ছে। এই শোভাযাত্রার শুরুও হয়েছিল কিন্তু ৮০'র দশকে স্বৈরাচারী সরকার এর বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য প্রদর্শন করতে গিয়ে। স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করছিলো। ঐ সময় এর বিপরীতে সব ধর্মের মানুষের কাছেই বাঙালি সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় এই শোভাযাত্রার মাধ্যমে যাতে সকলে আবার একত্রিত হতে পারে। আগে থেকেই সবার ইচ্ছা ছিল এর নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা রাখা হবে। কিন্তু ঐ সময় যখন সরকার ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতি করছিলো তখন তারা এর ভুল ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারতো। তাই ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানের পর সম্ভবত ৯৬ সাল থেকে এই শোভাযাত্রা তার মূল নামে আয়োজন করা হচ্ছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, আজও এই বিষয়টা নিয়ে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে যা কেউ আশা করে নাই। তাছাড়া এমন শোভাযাত্রা কিন্তু শুধু আমাদের দেশেই নয়, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চীনসহ অনেক দেশেই এই ধরনের শোভাযাত্রা হয়ে থাকে যেখানে তারা তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরে।


আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে এই শোভাযাত্রা হাজার বছরের সংস্কৃতি কিনা। না, এই শোভাযাত্রা হাজার বছরের সংস্কৃতি না। এটা একটা ভুল তথ্য। এই শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সাল থেকে। তবে আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে শোভাযাত্রা শহুরে যান্ত্রিক জীবনের চাপে হারাতে বসা বাঙালি জাতির হাজার বছরের সাংস্কৃতিক নিদর্শনগুলো বিশ্বের সামনে তুলে ধরছে, সেটাকে যদি হাজার বছরের সংস্কৃতি বলাও হয় তাহলে কি খুব ভুল বলা হয়??


অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে এই বিশাল আয়োজন করতে গিয়ে কি পরিমাণ সরকারি/জনগণের টাকার ধ্বংস করা হয়। এর উত্তর শুনে তারা একটু হতাশ হতে পারেন কারণ এই শোভাযাত্রা করার জন্য আজ পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে ১টি টাকাও নেওয়া হয় নাই। এমন কি কোনো কোম্পানি থেকেও কোনো রকম স্পন্সর নেওয়া হয় না। এই সম্পূর্ণ শোভাযাত্রাটিই পেইন্টিং, মুখোশ, সরা, কাগজের পাখি ও অন্যান্য কারুপণ্য বিক্রির টাকা দিয়েই করা হয়। এতে করে সাধারণ মানুষের এই আয়োজনের উপর যেমন একধরনের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয় তেমনি শিল্পের প্রসারও ঘটে। এবং নাগরিক জীবনের সাথে লোক ঐতিহ্যের মেলবন্ধন তৈরি হয়।এছাড়া যদি কেউ স্বেচ্ছায় অনুদান দিতে চায় তবে সেটা গ্রহণ করা হয়।


এখন আসল প্রশ্ন হচ্ছে এটা কোনো ধর্মীয় সংস্কৃতি/উৎসব কিনা। উপরের লেখাটুকু ভালোভাবে পড়ে থাকলে এটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা না যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এর সাথে কোনো ধর্মের কোনো রকম সম্পর্ক নাই এবং এখানে কারোর কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করা হয় না। আরো ভালো করে খেয়াল করলে দেখবেন যে কাঠামো গুলো নিয়ে এই শোভাযাত্রা করা হয় সেগুলো কোনো প্রাণীর প্রতিরূপও নয় বরং কিছু লোকজ পুতুলের বড় আকৃতির প্রতিরূপ মাত্র। তাই এটি একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান/আয়োজন যেখানে সকল ধর্মের, সকল জাতের, সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। পুরো আয়োজনটি করা হয় বাঙালি জাতির ধর্মনিরপেক্ষ কিছু সাংস্কৃতিক নিদর্শন তুলে ধরার মাধ্যমে যাতে সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ বাড়ে, দেশ ও সমাজের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়, দেশীয় সংস্কৃতিক উপাদান সম্পর্কে সচেতনতা ও মমত্ববোধ তৈরি হয় এবং সেসব উপাদানের সাথে মানুষ নিজেকে; নিজের ছেলেবেলাকে একাত্ব করতে পারে। এতে করে সেই সব মানুষের বদ্ধ মনে টোকা দেওয়ার চেষ্টা করা হয় যারা জাতীয় স্বার্থ চিন্তা না করে দ্রব্যমূল্য বাড়ায়, দূর্নীতি করে, সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, নিজেকে বড় ভেবে অন্যের উপর অত্যাচার করে।


তবুও যদি কেউ নিজের মনগড়া তথ্য ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এই সুন্দর আয়োজনটিকে কলুষিত করার চেষ্টা করে তাহলে তাদের বলতে চাই– পরিবারের বাচ্চাদের তো ঠিকই সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, বারবি ইত্যাদি পুতুল কিনে দেন, বাসায় টেলিভিশন দেখেন, গান শুনেন, সোস্যাল মিডিয়াও দেখেন, তাহলে নিজের দেশীয় কৃষ্টির প্রতি এমন তাচ্ছিল্য, অবহেলা কেন? সর্বোপরি কেউ ঘাড় ধরে জোর করে কারো ধর্মীয় নির্দেশের বাইরে গিয়ে পয়লা বৈশাখ পালন করতে বা শোভাযাত্রায় আসতে বাধ্য করছে না। ভালো মনে হলে করবেন, নাহলে নাই। তবে নিজের মনের সংকীর্ণতার থেকে আরেকজনকে বাধা দেওয়ার অধিকার আপনার নাই। এই উৎসব কেবল ফেসবুকে কটুক্তি করে থামাতে পারবেন না। কারণ দিনশেষে আপনিও ‘বাঙালি’।


সূত্র: ফেসবুক পোস্ট

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ