বাংলা নববর্ষ vs. হিন্দু নববর্ষ
অক্ষরম্ , ১৪ই এপ্রিল ২০২৫
প্রথমেই সকলকে জানাই চৈত্র সংক্রান্তির আন্তরিক শুভেচ্ছা।
আজকের প্রসঙ্গ হলো বাংলা নববর্ষ বনাম হিন্দু নববর্ষ। হিন্দু নববর্ষ আসলে কী? হিন্দু নববর্ষ বলতে মূলত ‘বৈদিক নববর্ষ’কে বোঝানো হয়। যা প্রতিবছর চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে সেই বৈদিক যুগ হতেই পালিত হয়ে আসছে। কারণ, সনাতনী তথা বৈদিক পরম্পরা অনুসারে বছরের প্রথম মাস শুরু হয় চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথি হতে এবং শেষ হয় ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণা অমাবস্যা দিয়ে। যা এবছর ৩০মার্চ, ২০২৫ইংরেজি তারিখে পালিত হয়েছিলো। এটি মূলত চান্দ্র-সৌর বর্ষ।
৫৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের চৈত্র মাসের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে এই আর্যাবর্তের মহান চক্রবর্তী সম্রাট বিক্রমাদিত্যের রাজ্যাভিষেকও হয়েছিলো, তাই সম্রাট দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখার উদ্দেশ্যে সেদিন থেকেই ‘বিক্রম সংবৎ’ নামে একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রবর্তন করেন এবং তদনুসারে বর্তমানে ২০৮২ বিক্রম সংবৎ চলছে।
এখন আপনাদের মাথায় আসতে পারে যে, তাহলে পয়লা বৈশাখে কেনো আমরা নববর্ষ পালন করি এবং এটাকে বাংলা নববর্ষই বা কেনো বলি! এর জন্যে আপনাদের একটু গভীরে যেতে হবে।
বাংলা নববর্ষ তথা পয়লা বৈশাখের প্রবর্তন করেন বঙ্গাধিপতি মহারাজ শশাঙ্ক। ৫৯৩খ্রিস্টাব্দের ১৫এপ্রিল তারিখে এই গৌড়বঙ্গে রাজ্যাভিষেক হয়েছিলো বঙ্গাধিপতি মহারাজ শশাঙ্কের, আর বৈদিক বর্ষ হিসেবে সেদিন ছিলো ‘পয়লা বৈশাখ’। তাই রাজ্যাভিষেকের এই দিনকে স্মরণীয় করার জন্যে তিনি সেদিন থেকেই পয়লা বৈশাখকেই বছরের প্রথম দিন ধরে বাংলা অঞ্চলের জন্যে নতুন একটি বর্ষ তথা পঞ্জিকার প্রবর্তন করেছিলেন, যা ‘বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন’ নামে পরিচিত। আর সে হিসাবে আগত বছরটি হবে ১৪৩২বঙ্গাব্দ।
আবার বিজ্ঞানসম্মতভাবেও সূর্য যেইদিন Eliptic এ ৩ ডিগ্রী ২০ মিনিট অক্ষাংশে বিশাখা বা Librae নামক নক্ষত্রের সাথে এক সরলরেখায় অবস্থান নেবে তখন থেকে পহেলা বৈশাখ শুরু হবে আর এই অবস্থানের সূচনা হবে আগামীকাল সূর্যোদয়ের সময় অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকভাবেই বৈশাখ মাসের শুরু তথা পয়লা বৈশাখ বা পহেলা বৈশাখ হল আগামীকাল (১৫ এপ্রিল), আজ (১৪ এপ্রিল) নয়। তাহলে বাংলাদেশে কেন তা আজকে (১৪ এপ্রিল) পালন করা হচ্ছে?
এখন আসি যারা বেশ কয়েকবছর ধরে এই পয়লা বৈশাখকে হিন্দুদের উৎসব, হিন্দুয়ানী বা হিন্দুদের নববর্ষ বলে প্রচার করছে তাদের নিয়ে। তারা তাদের এই প্রচারের ভিত্তি হিসেবে চৈত্র সংক্রান্তিতে সনাতনী হিন্দুদের দ্বারা পালিত বিভিন্ন পূজা (যেমনঃ চড়কপূজা, নীলপূজা, শিবের গাঁজন ও ক্ষেত্রপালের পূজা প্রভৃতি) ও হিন্দু ব্যবসায়ীদের হালখাতাকে তুলে ধরে। তো তাদের উদ্দেশ্যে বলে রাখি যে, বাংলা সনের এই বারোটা মাস কিন্তু শুধু বাংলার জন্যে নয় বরং সমগ্র বিশ্বের জন্যেই বৈদিক ঋষিরা প্রবর্তন করেছিলো; আর এই বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছিলো মহাকাশের ২৭টি নক্ষত্রের নামের সাথে মিলিয়ে, যেমনঃ বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জৈষ্ঠ্য, পূর্ব ও উত্তরাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, উত্তর ও পূর্বভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে অগ্রহায়ণ, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, পূর্ব ও উত্তরফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন ও চিত্রা থেকে চৈত্র প্রভৃতি। আবার এই নক্ষত্রগুলোর নাম এসেছে পবিত্র অথর্ববেদের নক্ষত্রসূক্ত হতে আর নক্ষত্রগুলোতে চন্দ্রের অবস্থানের ভিত্তিতেই তিথি নির্ধারিত হয়, যা সনাতনীদের বিভিন্ন পূজা-পার্বণ তথা সনাতনী বা বৈদিক পরম্পরার অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর সংক্রান্তিতে বিভিন্ন পুজো তথা যাগ-যজ্ঞের প্রচলন সনাতনীদের মধ্যে সেই বৈদিককাল থেকেই প্রচলিত। তাই আপনারা দেখবেন যে, আজকের দিনে এই ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে [যেমনঃ বাংলা অঞ্চলে চড়কপূজা, নীলপূজা, শিবের গাঁজন ও ক্ষেত্রপালের পূজা প্রভৃতি; দক্ষিণ ভারতে পুতাণ্ডি, পোঙ্গল ও বিশু এবং আসামে বিহু আর পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের (আদিবাসীরা বেশিরভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষ) বৈসুখ, বিজু ও সাংগ্রাই একত্রে বৈসাবি প্রভৃতি] উৎসবের আয়োজন করা হয়।
আর রইলো বাকি পয়লা বৈশাখের হিন্দু উৎসব হওয়ার প্রসঙ্গ। তাহলে বলতে হয় যে, পয়লা বৈশাখ নিয়ে বাংলা নববর্ষ তথা বঙ্গাব্দ শুধুমাত্র তার নিজের রাজ্য তথা বাংলা অঞ্চলের মানুষের জন্যেই বঙ্গাধিপতি মহারাজ শশাঙ্ক প্রবর্তন করেছিলেন; যিনি ছিলেন এই গৌড়বঙ্গের প্রথম স্বাধীন ও সার্বভৌম রাজা, যার রাজ্যের বিস্তার ছিলো বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা-ভুবনেশ্বরসহ সুবিশাল অঞ্চলে এবং রাজধানী ছিলো কর্ণসুবর্ণ; যা বর্তমান বাংলাদেশেরই একটি অংশ। মহাসামন্তরাজ শশাঙ্কই প্রথম পয়লা বৈশাখ নিয়ে বাংলা নববর্ষের বর্ষপঞ্জিকা তৈরী করেছিলেন ও এই বাংলার সকল মানুষের জন্যে তা প্রবর্তন করেছিলেন আর তখন থেকেই ১৫এপ্রিলে (অধিবর্ষে ১৪এপ্রিল) পয়লা বৈশাখ পালিত হয়। আর যখন থেকে এই বঙ্গাব্দের শুরু হয়েছে তখন কোনো মোঘল বাদশাহর ছায়াও এই উপমহাদেশে পড়েনি, তাই দয়া করে কেউ আর বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে আকবরের নাম নিতে যাবেন না এবং এ প্রসঙ্গে আমাদের বিস্তারিত আর্টিকেলও বহুপূর্বেই পেজে আপলোড করা রয়েছে।
আরে! তাহলে বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে আকবরের নাম কোত্থেকে এলো? চলুন তবে এটারও মীমাংসা করে নিই।
এই ভারতীয় উপমহাদেশে মোঘল শাসন শুরু হলে মোঘলরা তাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোন বিবেচনায় হিজরী ক্যালেন্ডার অনুসারে দেশ চালাতে শুরু করে। কিন্তু তারা এতে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হলেন। কেননা হিজরী ক্যালেন্ডারের সাথে ঋতু, ফসল ফলন কিছুই মেলেনা যার কারনে কর সংগ্রহ প্রায় অসম্ভব হয়ে পরে। এমতাবস্থায় মোঘল সম্রাট আকবর পুনরায় ভারতীয় বৈদিক বর্ষপঞ্জিকা চালু করেন যাকে ফসল উৎপাদনের সময় নির্দেশ করতে পারার গুনের কারনে ‘ফসলি সন’ বলা হত; সম্রাট আকবরের এই কাজের মাধ্যমে ভারতীয় তথা বৈদিক বর্ষপঞ্জির গুরুত্বও বোঝা যায়। আর যেহেতু ভারতীয় বৈদিক বর্ষপঞ্জির সাথে বাংলা বর্ষপঞ্জিরও মিল রয়েছে তাই হয়তো অনেকেই বাংলা সনের প্রবর্তক হিসেবে আকবরের নাম নিয়ে থাকে। তবে বলে রাখা ভালো যে, আকবর কখনোই সমগ্র বাংলা অঞ্চলে একত্রে আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়নি। বাংলা অঞ্চলে সে সময়ে বেশিরভাগ অঞ্চল স্বাধীনভাবেই মহারাজা প্রতাপাদিত্য, বারো ভুঁইয়া ও আফগানিরা শাসন করছিলো।
তারপর ১৯৭১এ পাকিস্তান ভাগের পর এই ক্যালেন্ডারটিতে ভারতবিরোধী স্রোতের কারনে কিছু পরিবর্তন আনার চিন্তা করা হয়।
১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ'র নেতৃত্বে গঠিত কমিটি একে সম্পূর্ণ ইংরেজী ক্যালেন্ডারের অনুকরণে সাজানোর প্রস্তাব দেন এবং ফলস্বরূপ এর স্বকীয়তা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তাদের প্রস্তাবনাগুলো ছিল এরূপ-
- ১. বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিনে হবে।
- ২.চৈত্র থেকে আশ্বিন পরবর্তী সাতমাস ৩০ দিনে হবে।
- ৩.প্রতি অধিবর্ষে (Leap year) ফাল্গুন মাসের সাথে এক দিন যুক্ত হবে।
পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে রাষ্ট্রপতি এরশাদ পয়লা বৈশাখ যাতে 'হিন্দু ক্যালেন্ডার' এর সাথে না মেলে সেজন্য পয়লা বৈশাখকে রাষ্ট্রীয়ভাবেই একদিন আগে ১৪ই এপ্রিল নির্দিষ্ট করে দেন। সেজন্যই বাংলাদেশের হিন্দুদের দুবার এই পয়লা বৈশাখ পালন করতে হয়। একবার বাংলাদেশী হিসেবে ১৪ তারিখ যা প্রকৃতপক্ষে অন্যায়ভাবেই প্রযোজ্য করা হয়েছে আর একবার ১৫ই এপ্রিল যা ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিকভাবেই ধ্রুব সত্য। অবশ্য কয়টা জাতিই বা নববর্ষ দুদিন পালনের এই দূর্লভ সুযোগ পায়!
তাই পরিশেষে বলতে চাই যে, বাংলা নববর্ষ বা বঙ্গাব্দ বা পয়লা বৈশাখ হলো বাংলার মানুষ তথা পুরো উপমহাদেশের উৎসব; শুধুমাত্র কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয়। তবে কোনো সম্প্রদায় এই দিনকে বিশেষভাবে পালন করতেই পারে, এটা একান্তই তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছে।
সর্বোপরি, সকলকে জানাই চৈত্র সংক্রান্তির শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন🏵️🌼
অক্ষরম্ - Aksharam
বিদ্যয়া বিন্দতেঽমৃতম্
- সংগৃহীত লিংক
0 Comments