বাঙালি ও মুসলমানের পার্থক্য - ইমাম হোসাইন

বাঙালি ও মুসলমানের পার্থক্য - ইমাম হোসাইন
 

বাঙালি ও মুসলমানের দ্বৈরথ সেই আদিকাল থেকে, অর্থাৎ ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের শুরুর সময় থেকেই। 


উল্লেখ্য যে— ভারতে যখন মুসলমানরা আসেন, তারা ধর্মপ্রচারের জন্য আসেন নি। এসেছেন ভারতকে শাসন করার জন্য। এক বর্ণনায় পাওয়া যায় ভারতে সর্বপ্রথম মুসলমানদের দেখা যায় ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে। আরেক বর্ণনায় বলা হয়েছে ৭১২ খ্রিস্টাব্দে। যতদূর ইতিহাসে পাওয়া যায়, তখন ভারতে লোকায়ত ধর্ম ও সংস্কৃতিই ছিল প্রধান। এটা ততদিন চলেছিল, যতদিন উচ্চবর্ণ হিন্দুদের নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নিম্নবর্ণ হিন্দুরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নি। ভারতে যত মুসলমান এসেছেন, তারা তাদের অনুসারী সাথে নিয়ে আসেন নি। এখানের লোকজনই তাদের অনুসারী হয়েছে। তারা এখানে থেকেছেন, বিয়ে করেছেন, বাচ্চা জন্ম দিয়েছেন।


তারউপর ধর্মান্তরিত হিন্দু তো ছিলই। ঠিক তখনই সমস্যাটা দেখা দেয়— মুসলিম বনাম বাঙালি। 


আমাদের শরীরে সিংহলের ভেড্ডা, মঙ্গোলীয়, ইন্দো-আর্য, তুর্কি, আরব, পারস্য আরও নানা দেশের মানুষের রক্ত বইছে।


এই ভারতের মাটিতে বাঙালিরা জন্মের পর থেকে পেয়ে এসেছে এক সংস্কৃতি, কিন্তু তারা ইসলাম গ্রহণ করার পর দেখল আরেক সংস্কৃতি। তারা সারাজীবন পালন করেছে অসংখ্য ফ্যাস্টিবল, আনন্দ করেছে, গান গেয়েছে, খেয়েছে, নেচেছে। কিন্তু মুসলিম হবার পর তাদের আনন্দের সীমানা সংকোচিত হতে শুরু করে, অর্থাৎ নিরানন্দ হয়ে যায়। মুসলিম শাসকরা তখন অতটা ধর্মপ্রাণ ছিলেন না, এবং অতটা ধর্মীয় জ্ঞান রাখতেন না। তারা শাসন করতে চেয়েছেন, তাদের দরকার জনবল এবং ক্ষমতা। তারা নব মুসলিমদের দিলেন ইদ, আনন্দ হিসেবে দুই ইদ। কিন্তু ইদ বাঙালির কাছে নিরানন্দই ঠেকেছে। গান, বাজনা, নাচানাচি, নারীপুরুষ মিলন নেই, মদ নেই। এখানে একটা চমৎকার বিষয় হচ্ছে, ইদও মুসলমানদের জন্য শুরু থেকে ছিল না। নবী মুহাম্মদ যখন মদিনায় যান, দেখতে পান, সেখানের মানুষ বছরে দুটো উৎসব পালন করে, একটি নওরোজ আরেকটা মিহিরজান। সেগুলো সেখানের বাসিন্দাদের গোত্র ও ধর্মীয় উৎসবে পরিচিত ছিল। ওই দুটি উৎসবের আদলে মুসলমানদের জন্য ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব পালনের রীতি প্রবর্তন হয়।


বাংলাদেশে ইদ আসে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা হাজি শরিয়ত উল্লাহের সময়ে। কিন্তু ততটা হাকডাক নেই ইদের। আজ থেকে দেড়শো বছর আগেও ইদ নিয়ে মুসলমানদের এত আগ্রহ ছিল না। কারণ তারা তখনও বাঙালি ছিলেন, তাদের জীবানাচরণে লোকায়ত সংস্কৃতির মিল ছিল প্রবল। ১৬৬০ সালে ঢাকায় মোঘলরা এসে ইদ উদযাপন করেন, এর আগে ইদের নামগন্ধও ছিলও না ঢাকায়। কবি জসিমউদদীন তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, বাংলাদেশে ইদের চেয়ে পৌষ সংক্রান্তিই বিখ্যাত ছিল, সেটাই চর্চা করত মুসলমান। মোঘলরা ঢাকায় এসে ইদ চালু করেন, যার স্মারক এখনো আছে, ধানমন্ডি ইদগাহ। ১৮৮৫ সালে ঐতিহাসিক জেমস ওয়াইজের লেখায় উল্লেখ পাওয়া যায়— এ অঞ্চলের মানুষ ইদ কী, কীভাবে নামাজ পড়তে হয় তাই জানতো না। তখন ঢাকা কেন্দ্রিক ছিল সব আয়োজন। অন্যান্য জেলার বা ঢাকা জেলার গ্রামের মানুষও ইদ চিনত না। বর্তমানে ইদ এমন ব্যাপক হারে বেড়েছে ১৯৪৭-এর পর পাকিস্তান গড়ার পরে।


তো স্পষ্টত এই— বাঙালি তখন ইদ চিনত না, চিনলেও আনন্দ নেই, ফুর্তি নেই। কাজেই তারা বাঙালি সংস্কৃতিই আঁকড়ে ধরেছিল৷ ফ্যাস্টিবল ও হ্যাপিনেস, রোমান্স হিসেবে। শাসকরাও মুসলিমদের মুসলিম থেকেও পুরোনো সামাজিক সংস্কৃতির চর্চা, লোকায়ত ফ্যাস্টিবলে বাধা প্রধান করেন নি। বলেন নি, এগুলো হারাম। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখবেন, মুসলিম শাসকদের সময়েই মুসলিমরা পৌষ সংক্রান্তি, পহেলা বৈশাখ বা এন্তার লোকায়ত ফ্যাস্টিবল দেদারসে পালন করেছেন। মুসলিম শাসকরাই বঙ্গপঞ্জিকা অনুসারে পহেলা বৈশাখকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেন। এর কারণ কৃষিনির্ভর জনতার হিসাব-নিকাশের দিনক্ষণ জানা-বুঝা। যার প্রমাণ এখনো রয়েছে, হালখাতা। 


কিন্তু সমস্যা বাঁধল এর পরে, মুসলিমরা ধীরে ধীরে ধর্মের দীক্ষা নিয়েছে, তাদের সেই দীক্ষা ঘোর অভিমানে মাথা চেড়ে বসল, বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। তারা সমস্ত গান, বাজনা, নাচ, আনন্দ, উল্লাস, নারী-পুরুষের মিলনমেলা সব কিছুরই বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেন। জানালেন এগুলো মুসলমানি কালচার নয়। কোনো মুসলমান এগুলো করতে পারবে না। এবং আশ্চর্যের বিষয় এই— তারা মনে করতেন, তারা এ-দেশি নয়, ইরান-তুরান থেকে, আরব থেকে আগত। অথচ তারা সম্পূর্ণ এদেশেরই মানুষ ছিলেন, এদেশের বাতাস, এদেশের জল-কাদার মানুষই ছিলেন। তারা নিজেদের অবাঙালি বলে সুখ পেতেন, গর্ববোধ করতেন। তারা বাংলা ভাষাটাও ঘৃণা করতেন, কথা বলতেন উর্দু বা আরবি ভাষায়। আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন বইয়ে এ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। কবি আব্দুল হাকিম তো মুসলমানদের এমন দ্বিচারিতা দেখে বলেছেন— “বঙ্গে জন্মে যে-জন হিংসে বঙ্গ বাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।” কত অভিমান করে কবি বলেছেন, নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি তার টান কত মধুর, তা অনুমেয়। আবার বলেছেন, এরা বাংলাদেশে জন্মে বিদেশের ভাষায় কথা বলে, বাংলাভাষাকে ঘৃণা করে যদি, তো বিদেশে যায় না কেন? আহমদ ছফা বলেছেন— তখন মুসলমানরা দ্বিধায় ছিলেন, তারা বাঙালি নাকি মুসলমান এই নিয়ে। তারা বাংলা ছেড়ে উর্দু না বললে, মনে হয় পুরোপুরি মুসলিম হবেন না। পাঠক খেয়াল করুন, এখান থেকেই বাঙালি ও মুসলমানের পার্থক্য, বা সংঘাত শুরু; যা আজও অবিরাম চলছে। 


মুসলমানরা বাঙালি কি না, এই প্রশ্নের অবসান ঘটে এভাবে, আহমদ ছফা বলেন, বোধকরি যারা বাঙালি ও একইসাথে মুসলমান তারা বাঙালি মুসলমান। অর্থাৎ মুসলমান ও বাঙালি আলাদা হলো না। মুসলমান না হলো পরিপূর্ণ মুসলমান, আর বাঙালি না হলো পরিপূর্ণ বাঙালি। গাধা ও ঘোড়ার কম্বিনেশনে খচ্ছর টাইপ কিছু একটা হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে বাঙালি মুসলমান বলতে যা বুঝায়, দেখা যায়— তা আর কিছু নয়। যেসব মুসলিমরা নিজেদের এ-দেশীয় ভাবতেন না, তাদের ভাবনারও যৌক্তিক কারণ আছে। তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মুসলিমরা দেশ ও সীমান্ত অনুযায়ী বাঁধা নয়; তাদের নির্দিষ্ট দেশ নেই। কিন্তু বাঙালি মুসলমান বলে কথা, বাংলা নয় ইরান-তুরানই তার দেশ। ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি তাঁর রচিত— বুখারীর ভাষ্যগ্রন্থ ফাতহুল বারিতে, ইমানের ৭৭টা শাখা উল্লেখ করেন। যেটা প্রতিটি মুসলমানের জন্যই অনস্বীকার্য। উক্ত শাখাগুলির ব্যক্তি বিশেষ সম্পৃক্ত শাখার ১৫-টির মধ্যে ১১ ও ১২ নম্বর শাখায় বলা হয়েছে— “দিন ও ইমান নিয়ে টিকে থাকার জন্য দেশ ত্যাগ করা, ইমানের শাখা। এবং দিন ও ইমান বাঁচানোর জন্য কাফের রাষ্ট্র ত্যাগ করে ইসলামি রাষ্ট্রে চলে যাওয়া ইমানের শাখা৷” অর্থাৎ প্রমাণ হয়, কেউ যদি পরিপূর্ণ মুসলিম হন, আল্লাহর প্রতি আত্মসমর্পণ করেন তবে তার নির্দিষ্ট দেশ ও দেশপ্রেম, দেশের সংস্কৃতি প্রেম থাকা অনুচিত। কেননা কখন না জানি রাষ্ট্র ত্যাগ করা লাগে। তৎকালীন সময় যারা ইরান-তুরানের মানুষ হিসেবে গর্ববোধ করতেন, তাদের কাছে হয়ত এমন তথ্য ছিল— সেখানে ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে৷ তাই তারা বাংলা, বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করতেন। আহমদ ছফারা হাজার বার ‘বাঙালি মুসলমান’ বললেও মুসলমান কিন্তু ধরে নিয়েছে তারা মুসলিম, বাঙালি নয়। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ— জুলাই। জুলাইয়ে আমাদের শিবিরের ভাইয়েরা, ‘তুমি কে আমি কে/ বাঙালি বাঙালি’ স্লোগানের বদলে বলেছেন, বাংলাদেশি বাংলাদেশি। অর্থাৎ তারা বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া মুসলমান, কিন্তু বাঙালি নন। এছাড়াও তারা বলেছেন, আমি প্রথমে মুসলমান, তারপর বাংলাদেশি। কিন্তু তারা একবারও বলেন নি, আমি মুসলমান পরে বাংলাদেশি, এর পরে বাঙালি। অর্থাৎ ‘বাঙালি’-বলে যে জাত আছে, এই জাতের পরিচয় তারা দিতে চান না। তারা মুসলিম, তাদের পরিচয় মুসলমান। আমার জানা নেই, সৌদি আরবের মানুষ কি এভাবে তাদের জাতি-গোষ্ঠীর পরিচয় চেঁপে রাখে, অর্থাৎ তারা আগে মুসলিম পরে সৌদিয়ান কিন্তু আরাবিয়ান নয়?


এখানে বুঝার বিষয় হচ্ছে সৌদিয়ান মানেই সৌদি জাতি নয়, নাগরিক পরিচয়। সৌদিয়ানের আগেও তাদের পরিচয় আছে, যেমন রাসূলের যুগেও ছিল, বনু কুরাইজা, বনু কুনুইকা, বনু ইসরায়েল, বনু কুরাইশ ইত্যাদি জাতি বা গোষ্ঠী। তেমনি বাংলাদেশি বলতে বাঙালি নয়, নাগরিক পরিচয়। জাতিগত পরিচয় অসংখ্য রয়েছে আমাদের, গারো, মারমা, চাকমা, খাসিয়া ইত্যাদি। তার মধ্যে আমরা যারা বাঙালি, আমাদের শরীরে বাঙালির রক্ত, তারা গাদ্দারি করছি স্বজাতির সাথে। ধর্মীয় পরিচয়ই মুছে ফেলেছে আমাদের জাতিগত পরিচয়। কিন্তু অবাক লাগে ধর্মীয় পরিচয়টা আবার নিজ দেশকে অস্বীকার করে অন্য দেশের প্রতি মোসাহেবি করে যখন। মুসলমানদের দেখবেন— বাংলাদেশের পতাকার চেয়ে সৌদির পতাকা, আইএস, তালেবানের পতাকায় দরদ বেশি। গতছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যখন ভারতের পতাকা পায়ে মাড়ায়, এরপর উলটা ভারত বাংলাদেশের পতাকা মাড়ালে এখানকার মুসলমান বলেছেন, 


‘বাংলাদেশের পতাকার সাথে যা ইচ্ছা করুক ভারত, আমাদের পতাকা কলেমার’।


তবে আর যাইহোক, বাংলাদেশি মুসলমান বাঙালি পরিচয়ের যে বিরোধিতা করেন, তা ধর্মসম্মত। এক্ষেত্রে তারা অন্য মুসলমানপ্রধান দেশের চেয়ে বেশি ধার্মিক। তারা যেগুলোর বিরোধিতা করেন, ব্যক্তিজীবনে তা চর্চা করেন কি না, সেটা আলাদা প্রশ্ন, তবে বাঙালি বিরোধিতায় তারা এক পায়ে খাঁড়া৷ মুসলমানদের ধর্মীয় নীতি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ হারাম। কোনো মুসলিম মডারেট যদি এখানে সমঝোতা করতে চায়, তাহলে সে ভণ্ড— না মুসলিম আর না বাঙালি। কারণ পহেলা বৈশাখ মুসলমানদের নয়, বাঙালির উৎসব। আমাদের সলিমুল্লাহ খান, ফরহাদ মজহাররা অমুক, তমুক দেশের উদাহরণ দিয়ে বলেন, দেশীয় সংস্কৃতির সাথে ধর্মের বিরোধ নেই। অথচ একথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। অমুক তমুক দেশ তো ইসলাম নয়। কাজেই কোনো দেশের উদাহরণ দিয়ে হারামকে হালাল করা গোনাহের কাজ। তারা নিজেদের পিঠ বাঁচাতে এরকমটা বলে থাকেন। 


বাঙালি মুসলমান বাক্যটি এতকাল থেকে ভুল হিসেবে ব্যাবহার হয়ে আসছে। বাঙালি ও মুসলমান এক হতে পারে না, যেমন পারে না তেল ও জল। বলতে হবে, মুসলমান। পরে প্রশ্ন আসলে দেশের নাম, বলা যাবে বাংলাদেশি মুসলমান। যেমন ভারতীয় মুসলমান। কিন্তু ভারতের পাঞ্জাবি মুসলমান নয়, নয় মালায়ালি মুসলমান। 

.

বাঙালিকে পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা; শুভ নববর্ষ। নতুন বছরের সব সূর্যোদয় প্রত্যেক বাঙালির জীবনে নিয়ে আসুক প্রত্যাশা, সব সূর্যাস্ত বয়ে আনুক অনাবিল শান্তি। 

.

— ইমাম হোসাইন 

১৪. ৪, ২৫ খ্রি.


সূত্র: ফেসবুকপোস্ট

Post a Comment

0 Comments