অনেকেই একটা প্রশ্ন করেন—এই উপমহাদেশের বা বিশেষ করে বাঙালি মুসলমানদের আনন্দ-উৎসব, সংস্কৃতি, গান, কবিতা, শিল্প এসবের প্রতি এতো অনীহা কেন? কেন এত ফোবিয়া?
এর পিছনে একটা বড় কারণ হলো পরিচয়ের সংকট। আমরা মুসলমান, আবার আমরা বাঙালিও। কিন্তু এই দুই পরিচয় একসাথে মেনে নিতে আমাদের অনেকেরই কষ্ট হয়। যেন কেউ একজন আমাদের বোঝাতে চায়—বাঙালি হওয়া মানে মুসলমান হওয়া যাবে না, বা মুসলমান হলে বাঙালি হওয়া চলে না।
আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন কৃষক । মাঠে ফসল ফলানো, ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে উৎসব করা, গ্রামীণ গান, মেলা এই সবই ছিল তাদের জীবনের অংশ। পহেলা বৈশাখ, চৈত্র সংক্রান্তি, নবান্ন—এসব ছিল হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবার উৎসব। তখন ধর্ম একটা বিশ্বাস ছিল, সংস্কৃতি ছিল জীবনের রঙ।
কিন্তু ধীরে ধীরে কিছু মানুষ আমাদের বোঝাতে শুরু করলো—এইসব উৎসব নাকি “হারাম”, “বিধর্মীদের অনুসরণ”।
আমরা ভুলে গেলাম, আনন্দ করা গুনাহ না, বরং অন্ধভাবে ভাবা গুনাহ। বিশেষ করে যখন কেউ নিজে কিছু না বুঝে শুধু “হারাম-হালাল” এর ফেসবুক তালিকা বানিয়ে বসে থাকে, তখন বুঝতে হয় মগজটা নিজে থেকে ছুটিতে গেছে।
বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে আমাদের মাথায় গেঁথে দেওয়া হয়েছিল, মুসলমান মানেই আরবদের মতো হতে হবে—ওদের মতো পোশাক, ওদের মতো ভাষা, ওদের মতো আচরণ।
কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা আরব না। আরবদের মরুভূমিতে হাঁটার মতো লম্বা জোব্বা পরে ঢাকার গরমে হাঁটলে হাসপাতালে যেতে হবে । আমাদের খাবার, চলাফেরা, ইতিহাস সব আলাদা। ফলে আরব সংস্কৃতি ঠিকঠাক মানাতে পারি না, আবার নিজের সংস্কৃতিও ত্যাগ করে বসি। তখন শুরু হয় সাংস্কৃতিক শূন্যতা।
এই সংকট থেকেই আসে রাগ, ফ্রাস্ট্রেশন। কেউ যদি নিজের আনন্দ ভুলে যায়, সে কখনোই অন্যের আনন্দ মেনে নিতে পারে না। তাই কেউ যদি পহেলা বৈশাখে রঙিন জামা পরে, ঢাকের বাজনায় নাচে, গান গায় তখনই অনেকে তা সহ্য করতে পারে না। মনে হয়, যেন কেউ তাদের সেই 'ভাঙা পরিচয়' এর উপর আঘাত করছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার, যারা দিনরাত ইসলাম রক্ষার জন্য সোশাল মিডিয়ায় পোস্ট করে, তাদের অনেকের জীবনেই ইসলাম থাকে না—না আচরণে, না ব্যবহারিক জীবনে। শুধু কপালের দাগ, মুখে দাড়ি, ফেসবুকে কোরআনের আয়াত।
ধর্ম মানে তো শুধুই বিশ্বাস, আর সংস্কৃতি মানে জীবনযাপন। কিন্তু কিছু মানুষ ধর্মকে বানিয়েছে একটা “কমপ্লিট প্যাকেজ”—যেটাতে তোমার কী খেতে হবে, কী পরতে হবে, কী বলতে হবে, এমনকি কী নিয়ে হাসতেও পারবে না—সব আগেই ঠিক করে দেওয়া।
আজ যারা বৈশাখে ঘুরতে যাওয়া বা মেলা করাকে “হারাম” বলেন, তারা আসলে নিজেরা খুব গভীরে এক ধরনের দ্বিধায় ভোগেন। তারা জানেন না তারা আসলে কারা—আরব? না বাঙালি? অবশ্যই আমরা বাঙালি। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ মুসলিমরা বাঙালি হয়েও নিজেকে বাঙালি বলতে চায়না বাঙালির সংস্কৃতির উপর বিদ্বেষ দেখায়।
আর এই দ্বিধা থেকেই আসে অন্যদের বাধা দেওয়া, বুলিং করা। নিজেরা যেহেতু সংকটে আছে, তাই তারা চায় না অন্য কেউ সুখে থাকুক। কেউ স্বাধীনভাবে ভাবুক, সেটা তারা সহ্য করতে পারে না।
এই সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে—"আমি কে?" আমি কি শুধু ধর্মে মুসলমান? নাকি আমি বাঙালি যার একটা ইতিহাস, সংস্কৃতি, গান, আনন্দ আছে?...
জীবনে যদি একটু পান্তা-ইলিশ খাওয়ার মাঝেও “হিন্দুত্ব” দেখে ফেলি, তাহলে আসল সমস্যা খাবারে না, সমস্যা মাথার ভেতরে। এই মানুষগুলা বই পড়লে “নাস্তিকতা” দেখে, প্রেম করলে “ধর্ম নষ্ট” দেখে।
পূজার প্যান্ডেলে গেলেই কুফরি দেখে, ভালো গান শুনলেই বলে “শরীয়ত বিরোধী”, কেউ একটু হিন্দু বন্ধুর বিয়েতে গেলেই বলে “ঈমান গেছে”,ছেলে-মেয়ে একসাথে কথা বললে বলে “জাহান্নামের টিকিট কনফার্ম”। মেয়েরা বাহিরে চাকরি করলেই তারা নাকি পতিতা।
অথচ ওরা নিজেরাই দিনে হাদিস, রাতে ফেসবুকে অর্ধ-নগ্ন স্ট্যাটাস দেয়। তাদের কাছে সবকিছুতেই কুফরি, কিন্তু নিজেদের ভণ্ডামিতে কোনো সমস্যা নাই।
সংস্কৃতি মানে ওদের কাছে ধর্মবিদ্বেষ , এদের ধারণা সবাই এদের ধর্মের বিরুদ্ধে সারাদিন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে। আসল কথা হলো—বিশ্ববিদ্যালয়, বই, উৎসব, এমনকি খাবারেও যারা ষড়যন্ত্র দেখে,
তাদের আসল ভয় মানুষকে মানুষ ভাবতে শেখা।
সূত্র: ফেসবুক পোস্ট
0 Comments